শুক্রবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১

রবীন্দ্রনাথের গদ্যকবিতা

আবু আফজাল সালেহ
  ০৩ মে ২০২৪, ০০:০০
রবীন্দ্রনাথের গদ্যকবিতা

'গীতাঞ্জলি' অনুবাদের সময় রবীন্দ্রনাথের গদ্যকবিতার প্রতি ইচ্ছা বা আগ্রহ জন্মায়। লিপিকা'য় তিনি গদ্যকবিতার পরীক্ষা করেন। এর অনেক পরে 'পুনশ্চ' কাব্যে খন্ডিত-বাক্যের মাধ্যমে গদ্যকবিতা লেখেন। প্রথমে গদ্যের মতো করে শব্দের ব্যতিক্রম স্থাপনে কবিতা লেখেন। বলা যায়, তার গদ্যকবিতার উৎস গদ্য থেকেই। তিনি ভেবেছিলেন, গদ্যকেই তিনি কবিতা বা পদ্য করে তুলবেন, যাতে থাকবে পদ্য ছন্দের মতো একটি ঝংকার।

বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ পদ্য-ছন্দকে ভেঙে পদ্য বা গদ্যকবিতার সৃষ্টি করতে চাননি! তার গদ্যই রূপান্তরিত হয়েছে গদ্যকবিতায় বা পদ্যে। তার পদ্যের ভাষা সাধু ও চলিত ভাষার মিশ্রণে নির্মাণ। বলা যায়, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার এ ধারা ধরে রেখেছিলেন। এটা তার গদ্যরীতির প্রধান একটি বৈশিষ্ট্য। রবীন্দ্রনাথের গদ্যকবিতার প্রয়োগ বা শুরু 'মানসী' কাব্যে। এ-কাব্যের 'নিষ্ফলা কামনা' কবিতায়। কিন্তু স্পষ্ট হয়েছে 'বলাকা' আর 'পলাতকা'য়। ছন্দমুক্তির আসল সাফল্য এসেছে 'পুনশ্চ' কাব্য থেকে। ইউরোপীয় বস্নাংক-ভার্স অনুসরণ ও কিছুটা পরিবর্তন করে (এর ফলে মাইকেলীয় অমিতাক্ষর বলতেন বুদ্ধদেব বসু) প্রবাহমান ছন্দ (অমিত্রাক্ষর) শুরু হয়েছিল মাইকেল মধুসূদন দত্তের হাত ধরে। তাতেও কবির ছন্দের মুক্তি হলো না। রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে এসেছে প্রকৃত 'মুক্তক ছন্দ'। অমিত্রাক্ষর অক্ষরবৃত্তের নিয়মে নির্মিত হলেও রবীন্দ্রনাথের মুক্তক ছন্দের প্রয়োগ এলো তিনটি ছন্দেই- স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত আর অক্ষরবৃত্ত। প্রাশ্চাত্যের ফ্রি-ভার্স অবলম্বন করে এ ছন্দ। তবে পুরোপুরি অনুসরণ তিনি করেননি। এতেও রবীন্দ্রনাথের মন ভরলো না। গদ্যকবিতার সূচনা রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই। গদ্যকবিতাতেই এলো কবির মুক্তি- ছন্দমুক্তি। কবি স্বাধীন হলেন। ইচ্ছেমতো পর্ব ও লাইন নির্মিত করতে পারছেন।

১৯৩১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঞযব ঈযরষফ নামে দীর্ঘ-কবিতা লেখেন। এটা গদ্যকবিতার প্রথম সার্থক প্রয়াস। পরে এটি বিচিত্রা'র ভাদ্র-১৩৩৮ সংখ্যায় বাংলায় অনূদিত করে প্রকাশ করা হয়। পরে এটি 'পুনশ্চ' কাব্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

রাত কত হল?

উত্তর মেলে না।

কেন-না অন্ধ কাল যুগযুগান্তরের গোলকধাঁধায় ঘোরে, পথ অজানা

পথের শেষ কোথায় খেয়াল নেই।

পাহাড়তলিতে অন্ধকার মৃত রাক্ষসের চক্ষুকোটরের মতো

স্তূপে স্তূপে মেঘ আকাশের বুক চেপে ধরেছে;

পুঞ্জ পুঞ্জ কালিমা গুহায় গর্তে সংলগ্ন

মনে হয় নিশীথরাত্রের ছিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ;

দিগন্তে একটা আগ্নেয় উগ্রতা

ক্ষণে ক্ষণে জ্বলে আর নেভে-

ও কি কোনো অজানা দুষ্ট গ্রহের চোখ রাঙানি

ও কি কোনো অনাদি ক্ষুধার লেলিহান লাল জিহ্বা।

(শিশুতীর্থ)

খন্ড-বাক্য দিয়ে এটাই প্রথম গদ্যকবিতা। এর আগে ছিল গদ্যরূপে। বলা যায়, এ 'শিশুতীর্থ' কবিতার মাধ্যমেই বাংলায় সত্যিকারের গদ্যকবিতার জন্ম নিল। দেখা যায়, রবীন্দ্রনাথ গদ্যের বিশেষ ভাষারীতি পদ্যে কখনো ত্যাগ করেননি। বলা যায়, গদ্যকে অনুসরণ করেই নির্মাণ করেছেন গদ্যকবিতা। তবে, ভেঙে-চুরে নতুন করে সৃষ্টি করতে চেয়েছেন ছন্দ-ঝংকার, সাজাতে চেয়েছেন ভিন্ন রূপে। রবীন্দ্রনাথের একটি গদ্যাংশ তুলে ধরছি :

'মেঘে মেঘে লাগল ঠেলাঠেলি, সূর্যাস্ত আকাশের সোনার পাঁচিল ডিঙিয়ে ব্যস্ত বেগে বেরিয়ে পড়ল, মেঘের ভিড়, যেন ইন্দ্রলোকের আগুনলাগা হাতিশালা থেকে ঐরাবতের কালো বাচ্চাগুলো ছুটছে গাঁ গাঁ শব্দ আছড়িয়ে। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের গায়ে গায়ে দগদগ করছে লাল আলো, যেন ছিটকে পড়া রক্ত। বিদু্যৎ লাফ মারছে মেঘের থেকে মেঘে, চালাচ্ছে তার ঝকঝকে খাঁড়া, বজ্রশব্দে গর্জে উঠছে দিগন্ত ডাক-ছাড়া জন্তুর মতো।' এ-অংশটুকু গদ্য না বললে পদ্য বললেও কেউ বাধা দেবে? ভালো কবিতা বললেও বেশি বলা হবে না! খন্ডিত বাক্য সাজিয়ে এটিকে কী সুন্দর গদ্যকবিতা বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে!-

'মেঘে মেঘে লাগল ঠেলাঠেলি,

সূর্যাস্ত আকাশের সোনার পাঁচিল ডিঙিয়ে

ব্যস্ত বেগে বেরিয়ে পড়ল, মেঘের ভিড়-

যেন ইন্দ্রলোকের আগুনলাগা

হাতিশালা থেকে ঐরাবতের কালো বাচ্চাগুলো

ছুটছে গাঁ গাঁ শব্দ আছড়িয়ে।

ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের গায়ে গায়ে দগদগ করছে লাল আলো,

যেন ছিটকে পড়া রক্ত।

বিদু্যৎ লাফ মারছে মেঘের থেকে মেঘে,

চালাচ্ছে তার ঝকঝকে খাঁড়া,

বজ্রশব্দে গর্জে উঠছে দিগন্ত ডাক-ছাড়া জন্তুর মতো।'

রবীন্দ্রনাথের গদ্যের ভাষা অনেক উন্নত; পদ্যের কাছাকাছি, কবিতার সমান। কিছু কিছু অংশ তো ভালো কবিতার স্তবক হিসেবেই বিবেচনা করা যায়! তার গদ্যের এ ছন্দময়তা, এ ঝংকার পাঠকের কাছে স্থায়িত্ব দিচ্ছে। বিপ্রতীপ ক্রম, ক্রিয়াপদহীন বাক্যগুচ্ছ, পদগুচ্ছ- তিনটির যোগফল রবীন্দ্রনাথের গদ্য। এখানে নতুন এক স্পন্দন তৈরি হয়েছে- যা তার আগে দেখা যায়নি। এসব বৈশিষ্ট্য নিয়ে রবীন্দ্রনাথ সাজাতে থাকলেন গদ্যের লাইন- যাতে নতুন এক ঝংকার তুলল। রবীন্দ্রনাথ ১৯১৬ সাল থেকে গদ্যে শতভাগ সাধুভাষা আর ব্যবহার করলেন না। রবীন্দ্রনাথের গদ্যের একটি বিশেষ ভঙ্গি আছে। তার গদ্যের অনেক স্থানে মনে হয় কবিতার চরণ পড়ছি। রবীন্দ্রগদ্যে বাড়তে লাগল ক্রিয়াহীন বাক্যের সংখ্যা। গদ্যের এ-গুণ তাকে অন্য মর্যাদায় আসীন করেছে। গদ্যে 'ঘরেবাইরে' এ বিশেষরীতি শুরু। তারপর 'শেষের কবিতা' আর 'দুই বোন' হয়ে পর্যায়ক্রমে 'যোগাযোগ'-এ এসে ষোলোকলা পূর্ণ হলো। 'যোগাযোগ' উপন্যাসের কিছু লাইন তুলে ধরছি, তাহলে পাঠক আমার উপস্থাপনার পক্ষে সায় দেবেন। এগুলোকে পংক্তি বললেও ভুল হবে না।

(১) সূর্য উঠেছে উত্তরায়ণে

(২) এমন সময় বাবা গেল মারা

(৩) গায়ে জড়িয়ে নিলেন লাল বেনারসী শাড়ি

(৪) বাই নাচের ব্যবস্থা হবে বজরা নদীর ওপর

(৫) আগুন নিবল, কাঠও বাকি রইল না, সবই হল ছাঁই

রবীন্দ্রনাথের অনেক গদ্য প্রায় পদ্যের কাছাকাছি। গদ্যের বড় লাইন ভেঙে পংক্তি বিভক্ত করলেই সুন্দর ও কাব্যশৈলীর গদ্যকবিতা পাওয়া সম্ভব। ছোটগল্পের অনেক জায়গায় এ-লক্ষণ দেখা যায়। উপন্যাস বা অন্য গদ্যের অনেক জায়গায় গদ্যকবিতার ফ্লেভার পাওয়া যায়। আর এ-গুণের জন্যই রবীন্দ্রনাথের গদ্য (বিশেষ করে গল্প) পাঠকের কাছে অনেক জনপ্রিয় এবং হৃদয়ে স্থায়ী দাগ রেখে দেয়। রবীন্দ্রনাথ

ছন্দোমুক্তির ব্যাপারে শিশিরকুমার দাশ যথার্থই বলেন, 'পদ্যে যার শুরু,

গদ্যে তার শেষ'।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে