বহুমাত্রিক রবীন্দ্রনাথ ও বাঙালি চেতনা
প্রকাশ | ০৩ মে ২০২৪, ০০:০০
তারাপদ আচার্য্য
বহুমাত্রিক রবীন্দ্রনাথ। তিনি কবি ঔপন্যাসিক গল্পকার সঙ্গীতজ্ঞ চিত্রশিল্পী সমাজসেবক মানবতাবাদী ও শিক্ষানুরাগী। তিনি যতটা কবি তার চেয়েও বড় বেশি পন্ডিত ও দার্শনিক। শিক্ষিত বাঙালির ভাব-মানসই তিনি কেবল নির্মাণ করেননি, তাদের সত্যিকার অর্থে বাঙালি করেছেন। শুদ্ধ ও পরিশীলিত বাংলায় কথা বলতে শিক্ষিয়েছেন। বাংলা গদ্যরীতিতে তিনি অসামান্য পরিবর্তন এনেছেন এবং অবদান রেখেছেন। তিনি বহু নতুন বাংলা শব্দ নির্মাণ করেছেন। রবীন্দ্রপরবর্তী অনেক লেখকই রবীন্দ্রনাথের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। সামগ্রিক অর্থে তার ভাষাকে অনুসরণ করে বাংলা সাহিত্য এগিয়ে চলেছে। অবশ্য অনেক লেখকই নিজস্ব ভাষারীতি তৈরিতে সক্ষম ও সফল হয়েছেন। তারপরেও আমাদের জাতীয় জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব অনেক গভীরে। বিশেষ করে তার গান ও কবিতা বাঙালির নিত্যদিনের চর্চার বিষয়। তিনি তিন দেশে জাতীয় সঙ্গীত রচনা করেছেন (বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলংকা)। জীবনকে গভীরভাবে উপলব্ধি করার জন্য তার লেখা আমাদের অনুপ্রাণিত করে, সামনে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি জোগায়।
উচ্চশিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ছিল ভিন্নতর। সেই লক্ষ্যে ১৯২১ সালে তিনি 'বিশ্বভারতী' প্রতিষ্ঠা করেন। কলকাতা থেকে দূরে বোলপুরের সেই পরিবেশ ছিল নাগরিক জীবন থেকে ভিন্ন কিন্তু আঞ্চলিকতা মুক্ত। এজন্য ক্রমান্বয়ে দেশ-বিদেশ থেকে প্রচুর ছাত্রছাত্রী ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতে আসেন। বিশ্বভারতীর স্বনামধন্য ছাত্রদের মধ্যে বিশেষভাবে উলেস্নখযোগ্য নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, অস্কারবিজয়ী চিত্র-পরিচালক সত্যজিৎ রায়, ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রমুখ। বিভিন্ন ভাষা ও বিচিত্র জাতি এবং নানা বিষয় অধ্যয়ন এবং জ্ঞান জগতের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য সেখানে স্থাপিত হয়েছে চীনা ভবন, হিন্দি ভবন, কৃষি অর্থনৈতিক গবেষণা কেন্দ্র, পলস্নী শিক্ষা ভবন প্রভৃতি। বিদেশি একাধিক পন্ডিত ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে সেখানে দীর্ঘ দিন শিক্ষকতা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক 'বিশ্বভারতী'র মহৎ আদর্শ প্রচারিত হওয়ার পর দেশ-বিদেশের পন্ডিত ও নানা শ্রেণির লোক শান্তিনিকেতনে উপস্থিত হতে থাকেন। ফ্রান্স, জার্মান, চীন থেকে অসংখ্য গ্রন্থ, পত্রিকা আসে; বিশ্বভারতী গ্রন্থাগার পূর্ণ হয়। বিচিত্র প্রায়োগিক কাজের মধ্য দিয়ে শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়ে ওঠে।
রবীন্দ্রনাথের দর্শন হচ্ছে 'পৃথিবীতে কে কাহার'। তিনি জীবনকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখলেও পোস্টমাস্টার গল্পে এই অতিবাস্তব সত্য ফুটে উঠেছে। অন্যরকম রবীন্দ্রনাথকে দেখতে পাই তার গানে। 'জাগরণে যায় বিভাবরী- আঁখি হতে ঘুম নিল হরি মরি মরি, যার লাগি ফিরি একা একা- আঁখি পিপাসিত নাহি দেখা। তারি বাঁশি ওগো তারি বাঁশি, তারি বাঁশি বাজে হিয়া ভরি মরি মরি। ছায়া দোলে তারি ছায়া দোলে, ছায়া দোলে দিবানিশি ধরি মরি মরি।' কিংবা 'হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে তবু পাইনি আমি।' আবার কবিতায় যখন তিনি উচ্চারণ করেন- 'এ ধরার বুকে তুলিয়া নিনাদ/ করিতে চাহিনা বাদ প্রতিবাদ/ যার যা আছে তার থাক তাই/ কারো অধিকারে যেতে নাহি চাই/ শান্তিতে যদি থাকিবার পাই/ একটি নিভৃত কোণ।' রবীন্দ্রনাথের গান কবিতা গল্প থেকে এমন বহু উদাহরণ দেওয়া যায়। মানুষকে উপেক্ষা করে তিনি কোনো সাহিত্য রচনা করেননি। তার বৈচিত্র্যময় রচনার প্রধান কেন্দ্রই হলো মানুষকে নিয়ে। তিনি মানবিকতাকে সব সময় প্রাধান্য দিয়েছেন। মানব মনের গহীনে প্রবেশ করেছেন। জয়গান গেয়েছেন জীবন দেবতার। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ তার অঢেল রচনার মাধ্যমে মানুষের পাশাপাশি বাংলা ভাষা বাংলা সাহিত্য বাংলাকে আন্তর্জাতিকপর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছেন। মূলত তিনি সাহিত্যচর্চা করেননি, করেছেন মনে-প্রাণে সাহিত্য সাধনা। সাধারণ মানুষকে করেছেন লেখার প্রধান বিষয়। তাই তো তার বলিষ্ঠ উচ্চারণ- 'মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক আমি তোমাদেরই লোক।'
রবীন্দ্রনাথের কালজয়ী সৃষ্টি 'গীতাঞ্জলি'। গীতাঞ্জলি প্রকাশের শতবর্ষ পালিত হয়েছে। এই কাব্যের জন্য তিনি ১৯১৩ সালে বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার 'নোবেল' পান। গীতাঞ্জলি মূলত গীতি-কবিতা সংকলন। এই গ্রন্থে মোট ১৫৭টি গীতি কবিতা রয়েছে। কবিতাগুলো ব্রাহ্ম-ভাবাপন্ন ভক্তিমূলক রচনা। যার মধ্যে ঈশ্বর-বন্দনা, মানব-বন্দনাও রয়েছে। এর বেশিরভাগ কবিতাতেই রবীন্দ্রনাথ নিজে সুরারোপ করেছেন। ১৯০৮ থেকে ১৯০৯ সালে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এই কবিতাগুলো প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯১০ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।
বাংলা সাহিত্যে এই প্রথম বাঙালি কোনো কবি নোবেল পুরস্কার পান। এই পুরস্কার অর্জনের মাধ্যমে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্বদরবারে পৌঁছে দিয়ে পৃথিবীর মানুষের কাছে তুলে ধরেন। ফলে বাংলা ভাষা এবং বাঙালি জাতিকে নতুন করে চিনেছে জেনেছে বিশ্ব। এর ফলে বাঙালির মর্যাদা ও সম্মান বিশ্ব আসরে বৃদ্ধি পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে বাঙালি হয়েছে মহিমান্বিত।
দু'জন বাঙালি মহান পুরুষ বাঙালিকে বিশ্বদরবারে উচ্চাসনে নিয়ে গিয়েছেন। একজন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অন্যজন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই দু'জনই বাঙালি জাতির অহংকার, বাঙালির কাছে নমস্য। কয়েক বছর আগে বিবিসির জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচিত হয়েছেন বঙ্গবন্ধু। বাঙলা ভাষা বাঙলা সাহিত্য আর রবীন্দ্রনাথ একই সূত্রেগাঁথা। যতদিন বাংলা বাঙালি বাংলা ভাষা থাকবে ততদিন রবীন্দ্রনাথও থাকবেন। তার অমর সৃষ্টির মাধ্যমে উপকৃত হবে বাঙালি। বাঙালি চেতনায় সুর ঝংকৃত হতে থাকবে।