শুক্রবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১

সরদার ফজলুল করিমের আমি মানুষ

এস ডি সুব্রত
  ০৩ মে ২০২৪, ০০:০০
সরদার ফজলুল করিমের আমি মানুষ

'কিন্তু আমার প্রাণের মানুষ নজরুলের কান্ডারি হুঁশিয়ার'-এর অমর উচ্চারণটিকে আমি আমার মনের গভীরে ধারণ করে রাখার চেষ্টা করি। সে নজরুলের জন্য নয়। আমার জীবনের জন্য (পৃ.১১)। এক অনন্য বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারী সরদার ফজলুল করিম একজন মানবতাবাদী দার্শনিক। তার দর্শনের প্রধান উৎস 'মানুষ'। জীবনে যা কিছু ভেবেছেন, যা কিছু করেছেন তার সবই মানুষের জন্য। মানুষের রহস্যাবৃত জগতে তিনি মানুষকেই তালাশ করেছেন বিচিত্র উপায়ে। তাই মানুষের ভালো-মন্দ সব কিছুই তাকে ভাবিয়েছে। ইট-পাথরের গাঁথুনির চেয়ে হৃদয়কেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। সরদার ফজলুল করিমের বই আমি মানুষ ২০০৯ সালে কথা প্রকাশ থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। বইটির ভূমিকায় লেখক বলেছেন- 'আমি কি মানুষ? যখন এ প্রশ্নের আমি কোন জবাব দিতে পারছিলাম না, সেই লা-জবাবের কারণে, নিজেই হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিলাম, তখন আমার এক স্নেহাস্পদ কয়েকটি শিরোনামের মুদ্রণ আমার চোখের সামনে রেখে জিজ্ঞেস করলেন, এই শিরোনামগুলোকে আপনি কি স্বীকার করেন না? আমি শিরোনাম কয়টির দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় স্নেহাস্পদকে বলেছিলাম : তুমি আমাকে জীবন ফিরিয়ে দিলে। তোমাকে এ জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি আমার জীবন দিয়ে।' বইটিতে মোট ২০টি প্রবন্ধ নিবন্ধ রয়েছে। এগুলো হলো- আমি মানুষ, হঁ্যা, মানুষ, মানুষের জন্য/আড়াই হাজার বছর বয়সি এক বৃদ্ধের উক্তি/সহজ সরল সত্য কথা/সত্য কথার একটি কথামালা/ '৭১-এর আলামত। নাই কাজ, তো খৈ ভাজ/আমাদের দেয়াল ক্যালেন্ডারের সংস্কৃতি/ব্যাংকের টেবিলে রবীন্দ্রনাথ/এই তো জীবন, যতদিন ততদিন/সুন্দরের সংগ্রাম/একটি দিনের পদ্য/ মানুষের উপায় কী বল/আমেরিকা বনাম মুসলিম বিশ্ব/তবুও মৃতু্যরই মরণ ঘটবে/বিচারপতিও অসুস্থ হয়ে পড়েন! ৬৪ সত্যি সেলুকাস!/পেন্টাগন, সিআইএ; কি বস্তু? ৭১ কোনো মহৎশিল্পীরই মৃতু্য নেই/ত্রিশ হাজার বছর পরে।

আলোচ্য বইটির প্রবন্ধগুলো ২০০১-২০০৪ এবং ২০০৮ সালে লিখিত। এর মধ্যে ২০০৩ সালে লিখিত হয়েছে ৭টি, ২০০৪ সালে ১০টি এবং ২০০১, ২০০২ ও ২০০৮ সালে ১টি করে রচনা লিখিত হয়েছে।

\হএ বইতে তিনি বেশ অসাধারণ কথার অবতারণা করেছেন। মানুষ হিসেবে মানুষের পরিচয় কেমন। মূল্যবোধ ও চেতনার যে পরিশীলিত ব্যবহার- তাই মানুষকে মানুষ করে তোলে। 'আমি মানুষ' বইটিতে মানুষ হিসেবে নিজস্ব দার্শনিক চিন্তার কথা প্রকাশ করেছেন সরদার ফজলুল করিম। বাস্তবজীবনের ক্ষেত্র থেকে নিজের উপলব্ধি লিপিবদ্ধ করেছেন বইটিতে। জীবনকে সহজ ও সাবলীল ভাষায় সুন্দর করে বিশ্লেষণ করেছেন লেখক। তার নিজ জীবনের মতোই আরেক জীবনের কথা নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন সরদার ফজলুল করিম তার আমি মানুষ বইয়ে। মানুষই পাপ-পুণ্যের উৎসস্থল। মানুষই অপরাধী, মানুষই বিচারক, মানুষই পুণ্যবান আবার মানুষই পাপী। মানুষই দাতা আবার মানুষই ডাকাত। মানুষের জন্যই স্বর্গ আবার মানুষের জন্যই নরক। এভাবে বহু কথার অবতারণা করা যায়। তবে সার-নির্যাসে এটুকু বলা যায় যে, ধরণীর সবকিছুই মানুষের জন্য মানুষ করেছে। মানুষই সৃষ্টি করে মানুষই ধ্বংস করে। সত্যিই 'মানুষই সবকিছুর মাপকাঠি'। মানুষই তার ভালোমন্দের জন্য দায়ী।

মানুষেই আস্থা রাখে মানুষ। মানুষেই আস্থা হারায় মানুষ। তাই তো গীত হয়, '...আস্থা হারানো এই মন নিয়ে আমি আজ/তোমাদের কাছে এসে দু'হাত পেতেছি।' 'মানুষ, মানুষের জন্যে জীবন জীবনের জন্যে...।' মানুষই আবার মানুষের হাতে মারণাস্ত্র তুলে দেয় মানুষকে মারার জন্য। মানুষই আবার বানরের হাতে লাঠি তুলে দেয় মানুষকে আঘাতের জন্য। মানুষই এগিয়ে যায় মানুষের জন্য। মানুষের বিপদে মানুষই পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে আসে।

সরদার ফজলুল করিম তার ৮৯ বছরের জীবনে পড়িয়েছেন ও লিখেছেন। ভাষান্তর করেছেন। শক্ত কঠিন অন্যের রচনাকে মোলায়েম করে মাতৃভাষায় ভাষান্তর করেছেন। দূর গ্রিক দার্শনিকদের রচনাকে নিজভূমে সহজলভ্য ও প্রিয় করে তুলেছেন দক্ষ হাতে।

সরদার ফজলুল করিম তার কাজ সম্পন্ন করে গেছেন। আমরা কী করেছি তার জন্যে?

সরদার ফজলুল করিমের কতটুকু মূল্যায়ন করতে পেরেছি। তার অসংখ্য রচনা থেকে ক্ষুদ্র পরিসরের 'আমি মানুষ' বইটি নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনার প্রয়াস থেকেই আমার এ লেখা। মানুষ কী? মানবকুলে জন্ম নিলেই কী মানুষ হওয়া যায়? 'আমি মানুষ' বইটি উৎসর্গ করেছেন 'মানুষ'কে।

বাংলাদেশ ও ভারতে মানুষকে কষ্ট দেওয়ার বুদ্ধিজীবী প্রদত্ত নাম 'সাম্প্রদায়িকতা'। কারা এসব কুকর্মে জড়িত থাকে রাষ্ট্র সব জানে। কিন্তু রাষ্ট্র চুপ থাকে আর তখন একদল আরেক দলকে দোষারোপ করে। তখন শুরু করে 'দোষারোপের রাজনীতি'। পৃথিবী এখন বড় ব্যস্ত। কে কাঁদে কার জন্যে? এসব ঘটনা যখন মুষড়ে ওঠে তখন সরদার ফজলুল করিম বুকে ব্যথা অনুভব করেন নিজের ভেতর।

'...মানুষ মানুষকে পণ্য করে/মানুষ মানুষকে জীবিকা করে...।' মানুষকে কেন্দ্র করেই পৃথিবীর সব শিল্প-কারখানা, বিধাতার স্বর্গ-নরক, রাষ্ট্রের কয়েদখানা, সুগন্ধি কারখানা, শরাব কারখানা। ধর্মশালায় প্রত্যেকে মানব-মানবীর স্বতন্ত্র পরিচয়- কেউ মুসলিম, কেউ ইহুদি, কেউ খ্রিষ্টান, কেউ হিন্দু, কেউ শিখ, কেউ জৈন। আবার কেউ যদি এসব নিয়ে মাথা না ঘামায়, সবাই মিলে তাকে ডাকে 'নাস্তিক'।

বইটির নাম কেন যে তিনি 'আমি মানুষ' রেখেছেন তার একটি ফিরিস্তি দিয়েছেন। একদিন বাজার করতে গিয়ে দোকানি একটি মেয়ের প্রশ্নের মুখোমুখি হলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন, 'আমি মানুষ'। পরক্ষণেই দোকানির কণ্ঠে শুনতে পান '...উনি মানুষ' (পৃষ্ঠা-১২)। বইটিতে তার প্রিয়জনদের লেখালেখি এবং তাদের চিন্তাধারা এবং তার প্রতি তাদের আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশও রয়েছে। ৮৯ বছর বেঁচেও তার মধ্যে আফসোসের শেষ ছিল না। তারাশঙ্করের নিতাইচরণের কণ্ঠে বলেছেন, 'জীবন ছোট ক্যানে?' মায়া মানুষের সহজাত। প্রাচীন গ্রিক দর্শন ও দার্শনিকদের প্রতি তার প্রবল আগ্রহ ছিল। আড়াই হাজার বয়সি বুড়ো সক্রেটিস, পেস্নটো, এরিস্টটলের সঙ্গেই ছিল তার আলাপচারিতা, জ্ঞান-কারবার ও দহরম-মহরম। অন্তিম মুহূর্তেও উতলে উঠেছে এরিস্টটলের প্রতি তার ভালোবাসা। এরিস্টটলের 'পলিটিক্স'র গায়ের ধুলো আমার গায়ের জামা দিয়েই মুছলাম। পরিষ্কার করলাম। ...আমি এর এক অন্ধ ভক্ত। আমি জানি এর যে কোনো পাতাটিই স্বর্ণ কেন, হীরক খন্ড' (পৃষ্ঠা-১৭)। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জ্ঞান সাধনা করা মানুষ সরদার ফজলুল করিম নিজেকে 'বই-এর বলদ' (পৃষ্ঠা-২২) বলে পরিচয় দিতেন। বইয়ের সঙ্গেই তার হৃদ্যতা, বইয়ের সঙ্গেই তার সারা জীবনের কথোপকথন। বই কী? এ সম্পর্কে তিনি বলেন, 'বই অবশ্যই লিখিত এবং মুদ্রিত, মানুষের এক মহৎ আবিষ্কার। ...যে বই পাঠ করা হয় না, সে বই, বই নয়। একটা হালকা বস্তু বটে। কেবল তাই নয়, যে বই পঠিত হয়, কিন্তু তার বিষয়বস্তু আলোচিত হয় না, তার বক্তব্য অনুসৃত হয় না, সে বইও বই নয়। বস্তু মাত্র' (পৃষ্ঠা- ২২)।

বিজ্ঞান একই সঙ্গে আশীর্বাদ ও অভিশাপ। বিজ্ঞানের অভিশাপ পর্যালোচনা করে তার নিজের ভেতর হাহাকার জেগে উঠেছে। তিনি বলেছেন, 'রোবট বানান, ক্ষতি নেই। কিন্তু আগে মানুষ বানান' (পৃষ্ঠা-২২)। মানুষ বিশ্বকে সৃষ্টি করেনি, কিন্তু বিশ্বকে ধ্বংসের ক্ষমতা রাখে। তাই বিজ্ঞান নিয়ে তার দুঃশ্চিন্তার শেষ নেই। বাংলাদেশের রাজনীতির ভয়ানক একটি ব্যাধির সরকারি নাম হচ্ছে 'হরতাল'। যে তালে হরহামেশা জানমালের ক্ষতি হয় আদতে তা-ই হরতাল। জীবনে বেতালের সৃষ্টি করে বলে বাংলাদেশের হরতাল নিয়ে তিনি স্মৃতিচারণ করেছেন। তার দুঃখ হচ্ছে হরতালের দিনে তিনি বাসায় বন্দি থাকেন। ফলে মানুষের সাক্ষাৎ না পেলে তার আর নিজেকে দেখা হয় না।

বাংলায় গ্রিকদর্শন মানেই সরদার ফজলুল করিমের অনুবাদের আশ্রয় গ্রহণ। এত প্রাণবন্ত অনুবাদ- জ্ঞান তালাশকারীদের মনে বিস্ময়ের উদ্রেক সৃষ্টি করে। তার বিপুল অনুবাদের মধ্যে 'পেস্নটোর সংলাপ' প্রথম অনুবাদ করেছিলেন জেলখানায় বসে।

তার অনুবাদে মুগ্ধ হয়ে প্রফেসর মুজাফফর (ন্যাপ) বিস্মিত হয়েছিলেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, 'মুজাফফর নিজে 'পেস্নটোর সংলাপ' আজিজ সুপার মার্কেট থেকে কিনে বেশ মনোযোগ দিয়ে পাঠ করেছে। ওর কেবল প্রশ্ন ছিল : সত্যিই কি এই রকম একটা মানুষ ছিল? (পৃষ্ঠা-৩১)। প্রকৃতির প্রতি ছিল তার নিখাদ প্রেম। প্রকৃতি বিনাশী কার্যক্রম তাকে ব্যথিত করে। সমুদ্রপ্রেমিক মানুষটি বলেন, 'কক্সবাজারের সমুদ্রের পূর্ব কিংবা পশ্চিমের দিগন্তে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের ছবি আমার মনকে উদ্দীপিত করে' (পৃষ্ঠা-৩৫)। মানুষের দানবিক আচরণের কিছু নমুনা তিনি দিয়েছেন। সেটি আমেরিকার দ্বারা ইরাকে হামলা হোক কিংবা অন্যদের দ্বারা আমেরিকায় হামলা হোক। এসব তার মনোকষ্ট বৃদ্ধি করেছে। টুইন টাওয়ার ধ্বংস সম্পর্কে লিখেছেন, 'এই হচ্ছে, আজকের, এই মুহূর্তের পৃথিবী। এটা কি মানুষের পৃথিবী?' (পৃষ্ঠা-৪২)। সরদার ফজলুল করিমের মূল্যবান এই বইটি সাহিত্য, দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ-মনোবিদ্যাসহ জ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে স্পর্শ করেছে দারুণভাবে।

লেখকের প্রকৃতি প্রেমের পরিচয় পাওয়া যায় বইটিতে। বইটিই 'মানুষ'কে নিয়ে লিখিত হয়েছে। তবে মানুষের তৈরি রাষ্ট্র প্রকৃতির বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ করে তারও বর্ণনা রয়েছে। সভ্যতা বিনাশকারী মানুষের ওপর ক্ষোভের উদ্গীরণ করেছেন লেখক। প্রাকৃতিক জলাধার ভরাট করে ইট-পাথরের গাঁথুনি তাকে ব্যথিত করেছে। এদেশে অহরহ নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ, আত্মহত্যা, নিপীড়ন আর অবিচারের ঘটনায় তার মনের ক্ষোভের কথাও জানা যায়। ব্যক্তি, ব্যক্তিত্ব, মর্মযন্ত্রণা, স্বপ্ন আর দুঃস্বপ্নের বয়ানও এ বইতে রয়েছে। মানুষ হিসেবে বাঁচার, মানুষের সংগ্রামের ইতিহাসও এ গ্রন্থে পাওয়া যায়। মার্কসবাদ সম্পর্কে বলতে গিয়ে লেখক বইয়ের সবশেষ প্রবন্ধ 'ত্রিশ হাজার বছর পরে' বলেছেন, মার্কসবাদের পক্ষে-বিপক্ষে দ্বন্দ্ব বর্তমানে যেরূপ দেশে দেশে ব্যপ্ত ও বিস্তারিত, ইতিহাসে এমনটি আর কখনো হয়নি। সেদিক থেকে বর্তমানের বিশ্বব্যাপী এই তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব মার্কসবাদের সফলতারই পরিচায়ক। দুর্বলতার নয়। 'সরদারকে যারা ভালোবাসতেন তিনি তাদের কোনো আবদারকে না বলতে পারতেন না। 'কোনো মহৎশিল্পীর মৃতু্য নেই' প্রবন্ধে তিনি নিজেই বলছেন, 'কিন্তু একটা কথা আমি স্বীকার করি, যারা আমাকে ভালোবাসেন তাদের কোনো দাবিকে না বলার আমার শক্তি নেই।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে