আন্তর্জাতিক বুকার প্রাইজ শর্ট লিস্টের ৬ লেখক
প্রকাশ | ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
আহমদ মতিউর রহমান
আন্তর্জাতিক বুকার প্রাইজ ২০২৪ এর শর্ট লিস্ট ঘোষণা করা হয়েছে সম্প্রতি। গত দু'বছর ভারতের গীতাঞ্জলি শ্রী ও শ্রীলংকার শেহান করুণাতিলকা পান এ পুরস্কার। অনেকেই আশা করেছিলেন এ অঞ্চলের কোনো দেশ হয়তো ওঠে আসবে এবার। কিন্তু তা হয়নি। লংলিস্টেও জাপান, ভারত, শ্রীলংকা, পাকিস্তান ও নেপাল কোনো দেশেরই কেউ ছিলেন না। আর লংলিস্ট থেকে ৬টি বইকে বেছে নেওয়া হয়েছে সেরা হিসেবে। সোশ্যাল মিডিয়া পেজে ৯ এপ্রিল বুকার প্রাইজ ২০২৪ এর শর্ট লিস্টের তালিকার কথা ঘোষণা করা হয়। সেখানে বুকার প্রাইজ কমিটির তরফে লেখা হয়, 'আমরা আনন্দের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বুকার প্রাইজ ২০২৪ এর শর্ট লিস্ট ঘোষণা করছি।' কারা শেষ হাসি হাসবেন বলা মুশকিল। মূল লেখক ও অনুবাদক দু'জনেই পাবেন এ পুরস্কার।
নোবেল পুরস্কারের পর বিশ্বের মর্যাদাবান পুরস্কার হিসেবে স্বীকৃত বুকার পুরস্কার। অক্টোবরে নোবেলের পরপরই দেওয়া হয় এ পুরস্কার। বুকারের পাশাপাশি আরেকটি পুরস্কার হচ্ছে বুকার ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ ফর ফিকশন। তিনটি ধাপে এ পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। তারই একটি ধাপ শর্ট লিস্ট ঘোষণা। আন্তর্জাতিক বুকার প্রাইজের শর্ট লিস্টে ১৩টি বইয়ের লং লিস্ট থেকে কোন কোন বই বাদ পড়ল এবং কোন কোন বই ও লেখকরা জায়গা করে নিলেন এই তালিকায় সেটা নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ। জল্পনা কল্পনা শুরু হয়ে গেছে কে পেতে পারেন এবারের ইন্টারন্যাশনাল বুকার প্রাইজ।
আন্তর্জাতিক বুকার প্রাইজ হচ্ছে এমন একটি বার্ষিক প্রাইজ, যা ইংরেজিতে অনূদিত সেরা ফিকশনের জন্য দেওয়া হয়। আর সেই বইটিকে ইংল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ড থেকে প্রকাশিত হতে হয়। আরও একটু স্পষ্ট করে বললে বলতে হয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লেখকদের ইংরেজিতে অনূদিত ও যুক্তরাজ্য বা আয়ারল্যান্ড থেকে প্রকাশিত বইগুলো এই পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হয়। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সাহিত্য যাতে গোটা বিশ্বের মানুষ পড়তে পারেন তাই এই পদক্ষেপ। পুরস্কারের আর্থিক মূল্য ৫০ হাজার পাউন্ড, যা লেখক ও অনুবাদক উভয়ের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দেওয়া হয়। এ ছাড়াও সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত প্রতিটি বইয়ের জন্য পাঁচ হাজার পাউন্ড পুরস্কার রয়েছে : লেখকের জন্য আড়াই হাজার এবং অনুবাদকের জন্য আড়াই হাজার পাউন্ড। বিজয়ী লেখক ও অনুবাদক পাবেন মোট ৫৫ হাজার পাউন্ড পুরস্কার। এটা দু'জনে ভাগ করে নেবেন। আগামী ২১ মে ইন্টারন্যাশনাল বুকার পুরস্কারের চূড়ান্ত বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হবে। এই পুরস্কারের মাধ্যমে অনুবাদকদের কাজকেও সম্মান জানানো হয়।
ইন্টারন্যাশনাল বুকার পুরস্কারের দীর্ঘ তালিকা প্রকাশিত হয় প্রথম ধাপে। ১৩ জন লেখকের লেখা বই ছিল এ তালিকায়। এবারের দীর্ঘ তালিকায় স্থান পায় ১২টি দেশের ১৩ জন লেখক-লেখিকার বই। ইতালির দু'জন। ইউক্রেন, আর্জেটিনা, ব্রাজিল থেকে শুরু করে পেরু পর্যন্ত। এশিয়ার মাত্র একটি দেশ দক্ষিণ কোরিয়া ছিল তালিকায়। ভাগ্যক্রমে তিনি আছেন শর্ট লিস্টেও। ছিলেন আলবেনিয়ার খ্যাতিমান লেখক ইসমাইল কাদারে। ২০০৫ সালে দেওয়া প্রথম ইন্টারন্যাশনাল বুকার পুরস্কারটিও পেয়েছিলেন তিনি। বলতে গেলে বুকার পুরস্কারে ফিরে আসেন ইসমাইল কাদারে। তবে শর্ট লিস্ট থেকে ছিটকে গেছেন তিনি। রেকর্ড গড়া আর হলো না।
\হ২০০৫ সাল থেকে দেওয়া হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল বুকার প্রাইজ। আর মূল বুকার পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। নোবেল পুরস্কারের পর বুকার পুরস্কার বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাবান সাহিত্য পুরস্কার এ কথা আগেই বলেছি। এ বছরের পুরস্কারের পরিসংখ্যানটি এ রকম। এ বছর ১৪৯টি বই জমা পড়ে। ২০১৬ সালে নতুন ফরম্যাটে এই পুরস্কার চালুর পর এটি বইয়ের সবচেয়ে বড় সংখ্যা। ৩২টি ভাষার বই এ বছর স্থান পায়, গত বছর ছিল ২৭টি ভাষার বই। বই ও ভাষার সংখ্যা বাড়ছে।
এ বছর লংলিস্টে ছিল ইউক্রেনের লেখক আন্দ্রে কুরকভের বই 'দ্য সিলভার বোন', ভেনিজুয়েলার রডরিগো বস্নাংকো ক্যালডেরনের বই 'সিমপাটিয়া', আর্জেন্টিনার সেলভা আলমাদার বই 'নট এ রিভার', পেরুর গ্যাব্রিয়েলা উইনারের বই 'আনডিসকভার্ড', পোল্যান্ডের উরসুলা হোনেকের বই 'হোয়াইট নাইটস', দক্ষিণ কোরিয়ার হোয়াং সক ইয়ংয়ের বই 'ম্যাটার ২-১০' নেদারল্যান্ডসের জেন্টে পোশতুমাসের বই 'হোয়াট আইডর্ যাদার নট থিংক অ্যাবাউট', ব্রাজিলের ইটামার ভিয়েরা জুনিয়রের বই 'ক্রুকড পস্নাউ', ইতালির ডোমেনিকো স্টারননের বই 'দ্য হাউজ অন ভায়া জেমিতো, ইতালির আরেকজন ভেরোনিকা রাইমোর বই 'লস্ট অন মি', আলবেনিয়ার ইসমাইল কাদারের বই 'এ ডিক্টেটর কলস', জার্মানির জেনি এরপেনবেকের বই 'কাইরোস' ও সুইডেনের ইয়া জেনবার্গের বই 'দ্য ডিটেইলস'।
কোন ছয়টি বই এবার বুকার প্রাইজের জন্য নির্বাচিত হয়েছে এবার সেটা দেখা যাক। ওপরের ১৩ বইয়ের মধ্যে টিকে গেছে আর্জেন্টিনার সেলভা আলমাদার বই 'নট এ রিভার', দক্ষিণ কোরিয়ার হোয়াং সক ইয়ংয়ের বই 'ম্যাটার ২-১০', নেদারল্যান্ডসের জেন্টে পোশতুমাসের বই 'হোয়াট আইডর্ যাদার নট থিংক অ্যাবাউট', ব্রাজিলের ইটামার ভিয়েরা জুনিয়রের বই 'ক্রুকড পস্নাউ', জার্মানির জেনি এরপেনবেকের বই 'কাইরোস' এবং সুইডেনের ইয়া জেনবার্গের বই ' দ্য ডিটেইলস'।
'নট এ রিভার' উপন্যাসটি লিখেছেন আর্জেন্টিনার সেলভা আলমাদা। স্পেনিশ ভাষার বই থেকে অনুবাদ করেছেন অ্যানি ম্যাকডারমট। আর্জেন্টিনাকে আমরা চিনি ফুটবল চ্যাম্পিয়ন দেশ বা ম্যারাডোনা ও মেসির দেশ হিসেবে। সাহিত্যেও দেশটির অবস্থানের কথা ওঠে এল এই বইয়ের মাধ্যমে। সেলভা পুরস্কারটি পেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আর আর্জেন্টিনাসহ দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে স্পেনিশ ভাষা চালু আছে। ফলে সাহিত্য লেখা হয় সেই ভাষাতেই। এই উপন্যাসে আলমাদার আকর্ষণ লিখন শৈলী 'গ্রামীণ আর্জেন্টিনার একক দৃষ্টিভঙ্গি'-তে প্রয়োগ করা হয়েছে। উপন্যাসে তিনজন পুরুষের একটি মাছ ধরার কাহিনি বিধৃত। উপন্যাসটি এর গভীরতা এবং ব্যতিক্রমী গদ্যের জন্য প্রশংসিত হয়েছে।
ম্যাটার ২-১০ দক্ষিণ কোরিয়ার হোয়াং সোক-ইয়ং লেখা উপন্যাস। শর্ট লিস্টে কোয়াং এশিয়ার একমাত্র প্রতিনিধি। বইটি কোরিয়ান ভাষা থেকে অনুবাদ করেছেন সোরা কিম-রাসেল ও ইয়ংজে জোসেফাইন বে। এই প্রজন্মের মহাকাব্যধর্মী উপন্যাসটিতে আমেরিকা থেকে আসা একটি রেলওয়ে কর্মীর পরিবারের কাহিনি। এটি দক্ষিণ কোরিয়ার অন্যতম বিখ্যাত উপন্যাস হিসেবে চিহ্নিত। লেখক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে কোরিয়ার ইতিহাস তুলে এনছেন। জাপানী দখলদারিত্বে কথা আছে এতে। বইটি জিতে নিতে পারে বুকার ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ।
'কায়রোস' জার্মানীর জেনি এরপেনবেক লেখা উপন্যাস। মাইকেল হফম্যান জার্মান থেকে অনুবাদ করেছেন। এই আলোকিত উপন্যাসটি ১৯৮০-এর দশকে পূর্ব বার্লিনে একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রেমের সম্পর্কের বিষয় নিয়ে। যেখানে সম্পর্কের অবসান ঘটানো হয়েছে। লেখিকা নিজেই এই অশান্ত স্থান-কালের একটি সু-প্রতিষ্ঠিত ক্রনিকলার। এখানে তার নিজের ভাষায় কথা বলেছেন।
সুইডেনের ইয়া গেনবার্গের 'দি ডিটেইলস' উপন্যাস আছে তালিকায়। বইটি অনুবাদ করেছেন কিরা জোসেফসন, সুইডেন থেকে। মজাদার এবং প্রাণবন্ত এই উপন্যাসের কাহিনি। জ্বরে আক্রান্ত এক মহিলার শয্যাশায়ী অবস্থার চিত্র আছে এতে। অস্বাভাবিক কাহিনিকে আক্ষরিক অর্থে জ্বরের স্বপ্ন বলা হয়েছে। হ্যাঁ, প্রচন্ড জ্বর নিয়ে বিছানায় পড়ে থাকা এক মহিলার দ্বারা বর্ণিত কাহিনি দুঃসাহসী এবং শ্রেণীবদ্ধ করা কঠিন। ব্রাজিলের লেখক ইটামার ভিয়েরা জুনিয়রের লেখা উপন্যাস 'ক্রুকড পস্নাউ'। পর্তুগীজ ভাষা থেকে অনুবাদ করেছেন জনি লরেঞ্জ। ব্রাজিলে পর্তুগীজ ভাষা চালু, সেখানকার সাহিত্য লেখা হয় সে ভাষাতেই। ব্রাজিলের কুইলোম্বোসের দুই বোনের কাহিনি এটি। সংকটের মধ্যে থাকা একটি পরিবারের কাহিনি সূক্ষ্ণতার সঙ্গে বর্ণিত হয়েছে এখানে। 'হোয়াট আইডর্ যাদার নট থিংক এবাউট' ওলন্দাজ লেখক জেন্টে পোস্টহুমার লেখা উপন্যাস। ডাচ ভাষা থেকে অনুবাদ করেছেন সারাহ টিমার হার্ভে। লেখিকার এটি দ্বিতীয় উপন্যাস। এখানে এক জোড়া যমজ সন্তানের কাহিনি বর্ণিত। যাদের মধ্যে একজন আত্মহত্যা করে। সমালোচকরা এই অ্যাবসার্ড কাহিনির সমালোচনা করার পাশাপাশি প্রশংসাও করেছেন। জেনি, জেন্টে, ইটামার বা গেনবার্গ যে কেউ জিতে নিতে পারেন এ পুরস্কার। তবে তা জানা যাবে ২১ মে। সে সময় পর্যন্ত থাকছে জল্পনা কল্পনা।