বাংলা সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ
প্রকাশ | ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
শোষণ নিপীড়ন যুগ যুগ ধরে চলমান একটি প্রক্রিয়া। তবে কালের আবর্তে পরিবেশ পরিস্থিতিতে এটার মাত্রা কমবেশি হয়ে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কাজটি মোটেও সহজ কোনো কাজ নয়। তবে সেটা যত কঠিনই হোক অসম্ভব নয়। লেখক, সাহিত্যিক, দার্শনিক, মুক্তচিন্তাবিদরা হাত গুটিয়ে বসে থাকেন না। তাদের কলমি শক্তি শোষণ নিপীড়নকে যুগ যুগ ধরে চ্যালেঞ্জ করে আসছে। অস্তিত্ববাদ ঠিক তেমনই একটি ধারা যেটি ছিল মুক্তচিন্তাবিদদের একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন। বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন শুধু যে পাশ্চাত্যে হয়েছে তা নয়, আমাদের এখানেও হয়েছে। কাজী আব্দুল ওদুদ আমাদের এখানে বুদ্ধিমুক্তি আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য দারুণ একটি স্স্নোগান তিনি লিখেছিলেন, জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।' কলমি আন্দোলনকে চাঙা রাখতে একটি মোটিভেশন চরণ প্রয়োজন হয়। ফরাসি বিপস্নবের নেপথ্যে জ্যাক রুশোর বিখ্যাত সেই চরণ 'মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন, কিন্তু সর্বত্র সে পরাধীন' ( গধহ রং নড়ৎহ ভৎবব নঁঃ বাবৎুযিবৎব যব/ংযব রং রহ পযধরহ) দারুণ ভূমিকা রেখেছিল। মার্টিন লুথার কিং মুক্তিকামী মানুষের উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, 'আমার একটি স্বপ্ন আছে (ও যধাব ধ ফৎবধস)। তার এই স্স্নোগান দারুণ সাড়া ফেলেছিল। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের মূল পয়েন্ট ছিল, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।' বুদ্ধিবৃত্তিক সব আন্দোলনের নেপথ্যেই কালজয়ী স্স্নোগান ভূমিকা রেখেছে। অস্তিত্ববাদও ছিল এমন একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন। অনেকে হয়তো ভাবেন যে, অস্তিত্ববাদ শুধু একটি দার্শনিক তত্ত্বমাত্র। কিন্তু সেই ধারণা সঠিক নয়। এটি একটি দার্শনিক মতবাদ হলেও এটি ছিল একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন এবং এটি একটি কালজয়ী সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করেছে। অস্তিত্ববাদ সহজ কোনো তত্ত্ব নয়, এটা বুঝার জন্য মুনশিয়ানা প্রয়োজন। অস্তিত্ববাদী আন্দোলনের পেছনেও একটি কালজয়ী স্স্নোগান ছিল। আর সেটা হলো 'অস্তিত্ব সত্তাসারের পূর্বগামী'। অস্তিত্ব এবং সত্তাসার- এ দু'টি টার্ম বোঝা প্রয়োজন। এটাতে আলোচনায় যাওয়ার আগে একটু ফিরে তাকাই। অস্তিত্ববাদের যাত্রা শুরু হয় জার্মান দার্শনিক সোরেন কিয়ের্র্কগাদের হাতে। পরবর্তীতে হাইডেগার, জ্যা পল সার্তে, নিটশের হাত ধরে সেটা একটি বহুমাত্রিক আন্দোলনে রূপ নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মানুষের জীবন এক ভয়াবহ বিপর্যয়ে পরিণত হয়। অতিমাত্রায় অস্তিত্বের সংকটে পড়ে যায় মানুষের জীবন। চরম শূন্যতা ভর করতে থাকে মানবসত্তায়। বিশ্বযুদ্ধের দামামায় সব যখন লন্ডভন্ড অবস্থা তখন অস্তিত্ববাদ আশার সঞ্চার করেছিল মানব মনে। কেননা অস্তিত্ববাদ মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতাকে ঘোষণা করেছিল। রুশ লেখক ভল্টয়ভস্কি, চেক লেখক ফ্রান্স কাফকা ও সিমেন বোভেয়ার অস্তিত্ববাদকে এগিয়ে নিয়ে যান। জ্যা পল সার্তে তার বিং এন্ড নাথিংনেস গ্রন্থে স্পষ্টভাবে বললেন, মানুষ অপূর্ণ, আর মানুষ তার পূর্ণতার জন্য ছুটে চলে। আর এই পূর্ণতা প্রাপ্তির জন্য মানুষের স্বাধীনতা অপরিহার্য। অস্তিত্ববাদীরা ব্যক্তি স্বাধীনতার জয়গান গেয়েছেন। তারা মনে করেন, উপদেশ কোনো উপকারে আসে না। উপদেশের খপ্পরে পড়ে ব্যক্তি স্বকীয়তা ও অস্তিত্ব হারায়। তারা মনে করেন অস্তিত্ব থেকে চিন্তা ও স্বাধীনতার জন্ম। আধুনিক দর্শনের জনক ডেকার্ট বললেন, 'আমি চিন্তা করি, তাই আমি আছি।' ডেকার্টের মতই সিগমন্ড ফ্রয়েড ঝঃৎবধস ড়ভ পড়হংপরড়ঁংহবংং-এর কথা বললেন। মানুষ তার অবচেতন সত্তায় ইচ্ছার প্রস্ফুরণ ঘটাতে চায়। ইচ্ছার স্বাধীনতা, স্বাধীন চিন্তাশক্তি ও দায়িত্ববোধ অস্তিত্ববাদের প্রাণ। অস্তিত্ববাদীরা মনে করেন, মানুষের পরিণতি পূর্বনির্ধারিত নয়। অপূর্ণ মানুষ তার স্বাধীন কর্ম দিয়ে নিজেকে পূর্ণ করে। প্রতিটি মানুষ একটি স্বতন্ত্র সত্তা, তার সমস্যা স্বতন্ত্র, সমাধান স্বতন্ত্র। তার নিজেকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। চিন্তা ও কর্মে মানুষ যেহেতু স্বাধীন, তাই সে দায়বোধসম্পন্ন মানবিক। মানবতাবাদ আর অস্তিত্ববাদ মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ মাত্র। তবে অস্তিত্ববাদের যাত্রা শুধু পশ্চিমা সীমানায় আটকে থাকেনি। এর ডালপালা বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হতে থাকে। বাংলা সাহিত্যেও এর ব্যাপক প্রভাব আমরা লক্ষ্য করি। বাংলা সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ এক নতুন মাত্রা ধারণ করেছে। কেননা বাঙালিরা সীমাহীন শোষণ- নির্যাতনের শিকার ছিল। তাই তাদের নিকট অস্তিত্ববাদের আগমন নিশ্চয়ই আবেদনময়ী। বাংলা ভাষার ধ্রম্নপদী লেখকদের লেখনিতে অস্তিত্ববাদ ব্যাপকভাবে স্থান পেয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী রচিত বাংলা সাহিত্য, কাব্য, নাটক ও উপন্যাসে অস্তিত্ববাদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। আমি আগেই বলেছি যে, অস্তিত্ববাদ কোনো গাইডলাইন বা নির্দেশনা নয়, এটি একটি কলমি ও বৌদ্ধিক আন্দোলন। যে আন্দোলন কোনো রাজপথে ঘটে না, যে আন্দোলনে কোনো রক্তপাত হয় না। এটি একটি নীরব সাইকোলজিক্যাল আন্দোলন যেটি মানব মনের লুকিয়ে থাকা সত্তাকে জাগ্রত করে। মানব মনের অবচেতন (ংঁনপড়হংপরড়ঁং) স্তরে এটি বিকশিত হয়। এটি ব্যক্তি স্বাধীনতাকে সবার ওপরে স্থান দেয়। এটি শোষণের বিরুদ্ধে ব্যক্তি মনের শৈল্পিক প্রতিবাদ। যে প্রতিবাদ চিন্তার জগতকে সমৃদ্ধ করে। যে প্রতিবাদ শোষকগোষ্ঠীর ঘুম হারাম করে দেয়। যে প্রতিবাদ শাসক চিত্তকে অস্থির করে তুলে। কাজী নজরুলের বেশির ভাগ লেখনি শোষণের বিরুদ্ধে কলমি আন্দোলন হিসেবে বিশ্বস্বীকৃতি পেয়েছে। নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার কথাই বলা যাক। এর চেয়ে বড় কলমি প্রতিবাদ বিশ্বসাহিত্যে ঘটেনি। যে কবিতার প্রতিটি চরণে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের জয়গান করা হয়েছে। কবি তার স্বীয় মনের প্রতিবাদকে সার্বজনীন রূপ দিতে পেরেছেন। কবির মনের প্রতিবাদকে গণমনের প্রতিবাদে রূপান্তর ঘটিয়েছেন। কবিতার প্রতিটি শব্দই যেন এক একটি প্রতিবাদী বোমা। বিদ্রোহী কবিতায় কবি ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ব্যক্তি মনের মুক্তির কথা কাব্যিক ছন্দে ফুটিয়ে তুলেছেন। এই কবিতায় ব্যক্তি স্বাধীনতার গল্প এতটাই প্রকট যে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠির রাতের ঘুম হারাম হয়েছিল। অস্তিত্ববাদের বড় প্রভাব দেখা যায় নজরুলের আনন্দময়ীর আগমনে কবিতায়। যে কবিতার কয়েকটি চরণে প্রবল ব্যক্তি স্বাধীনতা ঘোষিত হয়েছে। 'আর কত কাল থাকবি বেটি, মাটির ঢিবির মূর্তি আড়াল/স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাড়াল/দেব শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি/ ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কবে সর্বনাশী।' এই চরণগুলো ব্যক্তির অবচেতন মনে ঘুমিয়ে থাকা স্বাধীনতাকে জাগিয়ে তুলেছে এবং ঘোষণা করেছে ব্যক্তির অস্তিত্ব আগে। তার স্বাধীনতা আগে তারপর অন্য কিছু। অস্তিত্ববাদ মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গড়ে ওঠা একটি দার্শনিক তত্ত্ব ও বৌদ্ধিক আন্দোলন। কিন্তু এর অনেক পূর্বেই ব্যক্তি স্বাধীনতার জয়গান গেয়েছেন কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। 'স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে/কে বাঁচিতে চায়?/ দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায়?' মাকর্সবাদী ধারায় বিশ্বাসী কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য যখন লিখেন, 'এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়/জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার/তবু মাথা নোয়াবার নয়।' এমন চরণে ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রবলভাবে ঘোষিত হয়েছে। কলেস্নাল, কালি ও কলম, প্রগতি, পরিচয় প্রভৃতি পত্রিকাকে কেন্দ্র করে একদল লেখক (যারা সাহিত্য দুনিয়ায় পঞ্চপান্ডব হিসাবে পরিচিত ছিলেন) যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ভয়াবহ অস্তিত্ব সংকটের ছবি তারা কাব্য শরীরে লেপন করার তাগিদ অনুভব করেছেন। তবে এসব লেখকেরা যে ধরনের অস্তিত্ববাদ বিশ্বাস করতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন সেটার ব্যতিক্রম। তিনি মূলত জ্যাঁপল সার্তের অস্তিত্ববাদকে অনুসরণ করে বাংলা সাহিত্যে সেটাকে নান্দনিক অস্তিত্ববাদ হিসেবে রূপ দেন। অস্তিত্ববাদীরা মনে করেন মানুষ শোষণের শিকার হয়ে এক ধরনের শূন্যতা ও ভীতি অনুভব করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই শূন্যতাবোধকে ব্যাপকভাবে গুরুত্ব দিলেন। তিনি মনে করেন মত প্রকাশের মধ্যে রয়েছে এক নির্মল আনন্দ। এটাকে তিনি অলৌকিক আনন্দ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি লিখেন, 'অলৌকিক আনন্দের ভার/বিধাতা যাহারে দেয়/তার বক্ষে বেদনা অপার।' নন্দনতাত্বিক অস্তিত্ববাদী হিসেবে তিনি বলেন, মানুষের আত্মবিকাশের সুযোগ ও সম্ভাবনা আছে। ব্যক্তিত্বের বিকাশে শিল্প বিকশিত হয়। মানুষ অপরিহার্যরূপে স্বাধীন। বাহ্যিক জীবনে যত বাধাই থাক, মনস্তাত্বিক দিক থেকে অন্তত মানুষ স্বাধীন। তিনি লিখেন, 'কোথাও আমার হারিয়ে যেতে নাই মানা।' তিনি আরও লিখেন, 'মন মোর মেঘের সঙ্গী/উড়ে চলে দিগদিগন্তের পানে।' মানুষের মনে যখন শূন্যতা বাসা বাধে তখন সে অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। তাই তো তিনি তরুণদের এগিয়ে এসে শূন্য মনের মানুষদের নিস্তার দিতে আহ্বান জানিয়েছেন। 'ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা/ওরে সবুজ ওরে অবুঝ/ আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।' রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেঁচে থাকা আর অস্তিত্বশীল হওয়াকে এক করে দেখেননি। যারা আত্ম অতিক্রমের চেষ্টা করে না তারা প্রতীকি অর্থে বেঁচে থাকলেও অস্তিত্বশীল নয়। তিনি মানুষের অসীম সম্ভাবনার কথা বলেছেন যে সম্ভাবনার কথা অস্তিত্ববাদী দার্শনিক জ্যাঁপল সার্তে বলেছিলেন। 'গধহ ভরৎংঃ ড়ভ ধষষ বীরংঃং, বহপড়ঁহঃবৎং যরসংবষভ, ংঁৎমবং ঁঢ় রহ :যব ড়িৎষফ.' জ্যাঁপল সার্তের মতই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, অপূর্ণ মানুষ নিজেকে পূর্ণতার (সারসত্তা) দিকে নিতে চায়। এই শক্তি বিধাতা মানুষকে দিয়েছেন। তিনি এই শক্তি বা ক্ষমতাকে আলো হিসেবে অভিহিত করেছেন। 'আলো আমার, আলো ও গো, আলোয় ভুবন ভরা।' বিশ্বকবি মনে করেন, মানুষ নিজেকে শ্রেষ্ঠ সত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য অনন্তকাল ধরে চেষ্টা চালিয়ে থাকে। তিনি লিখেন, 'তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদ্ঘাটন সূর্যের মতন।' অস্তিত্ববাদের মূল কথা হলো অস্তিত্ব সত্তাসারের পূর্বগামী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, মানুষের জন্মগত অবস্থান তার সারসত্তা বা প্রকৃত পূর্ণতার তুলনায় অনেক অপূর্ণ। মানুষ তার সৃজনশক্তি দিয়ে নিজেকে বিকশিত করতে পারে। তিনি বলেন, মানুষ অসীম সম্ভাবনাময় সত্তা। মানুষের মাঝে ঐশ্বর্য থাকে। তবে সবাই ঐশ্বর্যের খবর রাখে না। তাই আত্ম অতিক্রম করতে পারে না। বাংলা সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ যে কতটা প্রকট তা সৈয়দ ওয়ালিউলস্নার 'কাঁদো নদী কাঁদো' উপন্যাসের দিকে তাকালে বুঝা যায়। ওয়ালিউলস্নাহ সাত্রীয় অস্তিত্ববাদ অনুসরণ করেছেন। তার মতে মানুষের নিয়তি ঈশ্বর বা সমাজ কর্তৃক পূর্বনির্ধারিত নয়। মানুষ স্বাধীন এবং দায়িত্ববোধ সম্পন্ন। তিনি আরেফ আলীর চরিত্রটিকে অস্তিত্ববাদের আদলে দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। মুখোশধারী সমাজের বাসিন্দা ও পরান্নভোগী হওয়া সত্ত্বেও স্বাধীন ইচ্ছার পথেই পা বাড়িয়েছেন। নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকেছেন। 'লালসালু'র মজিদের চরিত্র যেন অস্তিত্ববাদের এক মূর্ত দৃষ্টান্ত। জীবনের দ্বন্দ্ব-সংঘাত, প্রেম-ভালোবাসার মাঝেও নিজের স্বাধীন সত্তা টিকিয়ে রাখার নামই অস্তিত্ব। প্যাসক্যাল তাই তো বলেই দিলেন, মানুষ দুনিয়া জয়ের পরিবর্তে নিজেকেই জয় করে। চরিত্রায়নের জাদুকর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিভিন্ন সৃষ্টিকর্মে অস্তিত্ববাদ লক্ষ্য করা যায়। পদ্মার কুবের হাজার সমস্যার মাঝেও নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে মরিয়া। তার সৃষ্ট ভিখু চরিত্রটি প্রবলভাবে সংগ্রামশীল ও অস্তিত্ববাদী। মূর্ত এই জগতে টিকে থাকা, চেতন অচেতন সব বস্তুর সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সংযুক্ত থাকা, সংবদ্ধ থাকার নামই অস্তিত্ব। তিনি তার প্রাগৈতিহাসিক গল্পে এই চরিত্রটিকে এমনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যেন তা অস্তিত্ববাদকেই প্রতিফলিত করে। জীবনে টিকে থাকতে হলে সংগ্রাম অনিবার্য। আর এই সংগ্রাম মানুষ করে ইচ্ছাশক্তির দ্বারা তাড়িত হয়ে। অস্তিত্ববাদী দার্শনিক কামুর 'দ্যা পেস্নগ' আর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পুতুল নাচের ইতিকথা'র মাঝে দারুণ মিল রয়েছে। দুটোই অস্তিত্ববাদকে প্রতিনিধিত্ব করে। ১৯৪৭ সালে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে চরম অস্তিত্বের সংকট চলাকালে কামু তার 'দ্যা পেস্নগ' রচনা করেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কামুকে অনুকরণ করেছেন তার 'পুতুল নাচের ইতিকথা'য়। এটি জীবনের এক গভীর উপলব্ধির আভাস দেয়। পুতুল নাচের ইতিকথার প্রধান চরিত্রগুলো ব্যক্তি সত্তার এক মূর্ত প্রতীক, এক অপরূপ ‘ওডিসি’।
কামু তার ‘দ্যা প্লেগে’ বিশ্বযুদ্ধের পরে ছড়িয়ে পড়া ভয়ংকর প্লেগ মহামারিতে মানুষের নিদারুণ অসহায়ত্বের চিত্র অংকন করেছেন। ঠিক একইভাবে ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’য় লেখক আকাশের দেবতার অলক্ষ্য হাতে মানুষের অসহায় মৃত্যুর ছবি এঁকেছেন। এছাড়াও অস্তিত্ববাদী ফ্রান্স কাফকা ও হেনরিক ইবসেনের ব্যাপক প্রভাব বাংলা সাহিত্য ও নাটকে লক্ষ্য করা যায়। ইবসেন তার ডলস হাউসে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে জীবনের সর্বশক্তি হিসেবে অংকিত করেছেন। তার মতে স্বাধীনতাবিহীন জীবন অর্থহীন। বাংলা সাহিত্যের বড় মাপের প্রায় সব লেখকই কম বেশি অস্তিত্ববাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। বিভ‚তিভ‚ষণের ‘পথের পাঁচালী’র কয়েকটি চরণ লক্ষ্য করলেই বুঝা যায় তিনি অস্তিত্ববাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। ‘মনির চিন্তা চিন্তামনি, নাই অন্য আশা/নিষ্কর্মা লোকের চিন্তা তাস আর পাশা/ধনীর চিন্তা ধন আর নিরানব্বই এর ধাক্কা/যোগীর চিন্তা জগন্নাথ, ফকিরের চিন্তা মক্কা।’ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, জীবনান্দ দাশ, বিষ্ণু দে, সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র অস্তিত্ববাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। ব্যক্তি মনের শাশ্বত প্রেম সুধীন্দ্রনাথের অর্কেষ্টায় চিত্রিত হয়েছে। এরূপ প্রেমের জন্য প্রয়োজন প্রবল ইচ্ছাশক্তি, স্বাধীন সত্তা। তিনি লিখেন, ‘একটি কথার দ্বিধা থর থর চড়ে/ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী/একটি নিমেষ দাঁড়ালো সরণীজুড়ে/ থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি।’ বদ্ধুদেব বসু মনে করতেন ব্যক্তি মনের স্বাধীনতাকে কখনই শৃঙ্খল করা যায় না। স্বাধীনতা ও নিত্যতার যেন কোনো শেষ নেই। তিনি লিখেন,‘আমরা দু’জন দেখি বসে বসে/আকাশ কত না নীল/ছোট পাখি আরও ছোট হয়ে যায়/আকাশের মুখে তিল।’
বিষ্ণু দে মনে করতেন ব্যক্তিসত্তা আগে। ব্যক্তি তার ইচ্ছার দ্বারা পরিচালিত হয়। ব্যক্তি কারও হাতের ক্রিড়নক নয়। তিনি লিখেন, ‘সভ্যতার আর একটি বড় প্রত্যয় হচ্ছে ব্যক্তিত্ববোধ। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করতেন, জীবন প্রবাহ শুধুই বালুচর নয়, বালুচর ভেদ করে উৎসারিত হয় মধুরের নির্ঝর। মানুষের মধ্যেই জীবনীশক্তির শ্রেষ্ঠ প্রকাশ।’ তিনি আরও লিখেন, ‘এ ভুবনে ডুবল যে চাঁদ/সে ভুবনে উঠিল কি তা/হেথায় সাঁঝে ঝরল যে ফুল/হেথায় প্রাতে ফুটল কি তা।’ জীবনানন্দ দাশ তো বলেই দিলেন, ‘শরীর রয়েছে, তবু মরে গেছে আমাদের মন/হেমন্ত আসেনি মাঠে; হলুদ পাতায় ভরে হৃদয়ের বন।’ তিনি মনে করেন মানুষ স্বপ্ন নিয়ে বাঁচে। আর এই স্বপ্ন তার স্বাধীন সত্তার এক অনন্য প্রকাশ। তিনি লিখেন, ‘মরণের হাত ধরে স্বপ্ন ছাড়া কে বাঁচিতে পারে?’ মানুষের মাঝে যখন শূন্যতা এসে ভর করে তখন সে মরতে চায়। ‘ফাল্গুনের রাতের আঁধারে যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ/মরিবার হলো তার সাধ।’
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অস্তিত্ববাদ চাঙ্গা হয়ে উঠলে মার্কসবাদের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। মাকর্সবাদ সামগ্রিক মানবতাবাদের কথা বলল আর অস্তিত্ববাদ নিরঙ্কুশ ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা বলল। অনেকে অস্তিত্ববাদকে মনস্তাত্বিক একটি ফ্যাক্টর হিসেবে দেখেন। আসলে অস্তিত্ববাদ এক চলমান নৌকার মতো, কোথায় ভিড়বে কেউ জানে না, তবে যতক্ষণ চলে ততক্ষণ থেকে যায় এর বাস্তবতা। মানুষ তার প্রতিটি কাজের জন্য দায়ী। যেহেতু সে স্বাধীন, তাই সব সিদ্ধান্ত তাকেই নিতে হবে। অসুস্থ মায়ের সেবা করবে নাকি দেশের সেবার জন্য বেড়িয়ে পরবে এটা নিতান্তই তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। এ যেন সেই প্রোটাগোরাসের কথারই প্রতিফলন, ‘গধহ রং ঃযব সবধংঁৎব ড়ভ ধষষ ঃযরহমং.’ মানুষ সবকিছু পরিমাপের মাপকাঠি। মার্টিন হাইডেগার বলেন, মানুষ হলো ‘ডেসেইন’। এই ডেসেইন অস্তিত্বকে সম্ভব করে তোলে। মানুষের দু’টি সত্তা। একটি সামগ্রিক, অন্যটি ব্যক্তিক। সামগ্রিক সত্তাকে বলা হয় সারসত্তা। জীবনের নানা পর্বের ঘাত-প্রতিঘাত, অসম্ভাব্যতা, আর অস্তিত্ব রক্ষার এক ক্লান্তিহীন পদচারণার নামই অস্তিত্ববাদ। ইচ্ছা, চিন্তা, স্বাধীনতা সবই আপেক্ষিক। আর এই আপেক্ষিকতা থেকে জন্ম নিয়েছে অস্তিত্ববাদ। নৈর্ব্যত্তিক সত্য বলে কিছু নেই। প্রতিটি মানুষের জীবন এক ভয়াবহ যুদ্ধের গল্প।
মানুষ হয়ে কেউ জন্ম নেয় না, তাকে মানুষ হয়ে উঠতে হয়। তাই অস্তিত্ব মানুষের পরিচয়।