শোধ

প্রকাশ | ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০

সাবরিনা হোসেন মিষ্টি
ঘড়িতে বাজছে রাত এগারটা দশ! আরও বিশ মিনিট বাকি! প্রতীক্ষার প্রহরের উত্তেজনা কাটাতে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে বসে আছে সোনিয়া! তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে নিজেকে মাপছে! চলিস্নশ পেরিয়েছে কিন্তু মুখের চামড়ায় এখনো বয়সের ছাপ জেঁকে বসেনি! যদিও শরীরটা বেশ মুটিয়ে গেছে তবুও আধুনিক কাটের পোশাকের আড়ালে সেটি বেশি চোখে পরে না! সাদা হয়ে যাওয়া চুলগুলো বিউটি সেলুনের মুনশিয়ানার বদৌলতে দারুণ একটা শেড দিচ্ছে! চোখ ধাঁধানো না হলেও মন বাঁধানো সুন্দরী সোনিয়া, তারপরও কেন যেন বুকের মধ্যে কি নেই কি নেই এমন একটা হাহাকার সবসময় পীড়া দেয়। বহুজাতিক কোম্পানির দামি আই মেকাপও চোখের বিষণ্নতার চিরস্থায়ী ক্ষত ঢাকতে পারে না! এই বয়সে এত উত্তেজনা সহ্য হবে না বলে প্রেসারের ওষুধটা সময়ের আগেই খেয়ে নিয়েছে! এখনো খানিকটা সময় বাকি আছে! আয়নার দিকে তাকিয়ে পুরানো স্মৃতি মনে পড়ে যায়! এই ঢাউস ড্রেসিং টেবিলটা বিয়ের সময়কার! স্বামী তানভীরের সঙ্গে সম্বন্ধ করেই বিয়ে হয়! হবু স্বামী শিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করতে চায় শুনে ভেবেছিল, বিয়ের পর এমবিএ শেষ করে দারুণ একটা চাকরিতে ঢুকে নিজে একটা ক্যারিয়ার করতে পারবে কিন্তু ভুল ভেঙে যায় বিয়ের পাঁচ মাসের মধ্যেই! আসলে, সোশ্যাল সট্যাটাস নামক ভড়ং বজায় রাখার জন্যই এমবিএ পডুয়া মেয়ে বিয়ে করা! চাকরি করা নিষিদ্ধ! খরচ করার জন্য স্বামী তাকে অঢেল টাকা দিয়েছে কিন্তু নিজের মেধা খরচের কোনো সুযোগ রাখেনি! মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবারের মেয়ে উচ্চবিত্ত পরিবারের বউ হয়ে প্রথম প্রথম আহ্লাদে আটখানা হলেও ধীরে ধীরে কেমন যেন হতাশা গ্রাস করে! তানভীরের জগতেও কেন যেন সে অনুপ্রবেশ করতে পারেনি! নিয়মরক্ষার দৈহিক মিলনের সম্ভোগ সুখের সময়টুকু অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরক্ষণেই তানভীরের নিরলিপ্ত ঔদাসীন্য শেলের মতো বুকে বিধেঁছে! অথচ তানভীর সব সামাজিক অনুষ্ঠানে উচ্ছ্বসিত সুঠাম পুরুষালী সৌন্দর্যে ভরপুর এক টগবগে লেডী কিলার! যে কোনো আলোচনা সভায় অন্য কোনো নারীর সাদামাটা কথাও অক্ষুণ্ন্ন মনোযোগে শোনে তানভীর অথচ সোনিয়া কোনো বিষয়ে মতামত দিতে গেলে এমন তাচ্ছিল্যের চোখে তাকায় যে বিব্রত সোনিয়া থেমে যায় মাঝপথেই! এই নিরুত্তাপ বিরক্তির পেছনে সমস্যা কোথায় তা আজও খুঁজে পায়নি সে! প্রথম যেদিন তানভীরের মূল্যবান সফেদ শার্টের কলারে গাড় লিপস্টিকের দাগ দেখলো সোনিয়া সেদিন সে প্রাণপণে মনকে বুঝালো ভুল দেখছে সে! দু'জনের মধ্যে এতটাই শীতল দূরত্ব যে, ঝগড়া কখনো হয়নি! পরে ধীরে ধীরে জানতে পারল বসুন্ধরাতে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট নিয়ে আরেকটা সংসার করে তানভীর! সেটা ছাড়াও এদিক সেদিক অনেক নারীর সঙ্গে সম্পর্ক মেইনটেইন করে সে! এছাড়াও প্রতি মাসে নেদারল্যান্ডস বা থাইল্যান্ডে বিজনেস টু্যরের নামে প্রমোদ ভ্রমণ তো রয়েছেই! সুন্দরী শিক্ষিত সোনিয়া কেবল তথাকথিত সামাজিক অবস্থানের 'ওয়াইফ' লেখা সাইনবোর্ড- যা শুধু দুয়ারেই লটকানো! সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দুই পুত্রের মা হওয়ার পাশাপাশি সোনিয়া মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়া দু'ই শিখে গেছে! তাছাড়া, আকণ্ঠ বিলাসিতার স্বেচ্ছায় বন্দিত্ব থেকে বেড়িয়ে আসাও বড় কঠিন! আয়েসের আবেশ অতি সহজেই অভ্যস্ততা তৈরি করে! প্রথম প্রথম সোনিয়ার পাগল পাগল লাগতো! সম্পর্কের প্রতি অভিমান আর নিজ নারী সত্ত্বার প্রতি অপমান বয়ে চলা দুঃসহ মনে হতো! কেন এই অকারণ অবজ্ঞা? কেন এই নির্বিকার নিরাসক্তি ...? পাগলের মতো স্বামীর অন্তর জয় করার সবরকম চেষ্টা করত সে! এখন অবশ্য সেই পাগলামিটা নেই! আঠার বছর এভাবে কাটিয়ে দিয়েছে! কিন্তু একটা নতুন পাগলামি কয়েকদিন ধরে মনের সঙ্গে সঙ্গে শরীরেও বাসা বেঁধেছে! তার নাম সালমান!!! সালমান গুলশান আড়ংয়ে কাজ করে! বয়সে অন্তত বিশ বছরের ছোট! মেয়েরা শৈশবে যে ধরনের চেহারার যুবকের স্বপ্ন দেখে বড় হয়, অবিকল সেরকম চেহারা! করপোরেট রুলভ ভদ্র ব্যবহার! পর্দার ডিজাইন দেখানোর সময় বলিষ্ঠ হাতের ফরসা আঙুল যখন হাত ছুঁয়ে গেল তখন কি এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল- যতটা না দেহ জুড়ে তার চেয়ে ঢের বেশি হৃদয় জুড়ে! নৈতিকতা, সামাজিক সংস্কার, দৈহিক সুচিতা এসবের অস্থিত্ব তো কেবল মগজে; শরীর বা হৃদয়ে এগুলো নিছক শব্দ মাত্র! পরদিন আবার পর্দার সঙ্গে মানানসই চাদর খোঁজার বাহানায় আড়ং! আজ চোখের কাজল আরেকটু গাড়- নীল মাশকারার প্রলেপে স্বপ্নীল চোখ! গিয়ে দেখে সালমান নেই, তার নাকি ডে অফ!! কি কষ্ট... কি কষ্ট...! হাজারো যন্ত্রণায় যে সোনিয়া যন্ত্র হয়ে গিয়েছিল আজ সালমানকে এক পলক দেখতে না পারার কারণে সেই সোনিয়া ছটফটিয়ে মরতে লাগল! পরদিন আবার আড়ং- এবার দেখা! অতঃপর, হুয়াটসঅ্যাপে ভিডিও কল- গাড়ি দিয়ে এদিক সেদিক ঘোরা! অনাস্বাদিত প্রেম পূর্ণিমা রজনীর উত্তাল সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ফুলে ফেঁপে উঠতে লাগল! সৈকতে এক পাটি হারিয়ে যাওয়া স্যানডেলের মতো ঢিলে হয়ে যাওয়া সংসারটাও বুঝি প্রবল ঢেউয়ে হারিয়ে গেল! আজ রাতে সে সালমানের জন্যই অপেক্ষা করছে! তানভীর বিজনেস টু্যরে ইউরোপ, বড় ছেলেটি কানাডায় পড়াশোনা করে! ছোট ছেলে কলেজ থেকে স্কাউটিং এ! রান্নার বাবুর্চিকে ছুটি দেওয়া হয়েছে! মতির মা বুড়া মানুষ- দশটা নাগাদই গুল গালে দিয়ে শুয়ে পড়ে! আজ রাতটা তার আর সালমানের! তারা দুজন অন্তরঙ্গ হবে ভেবেই বারবার কেঁপে উঠছে সোনিয়া! যতটা না প্রেম থেকে তার চেয়ে ঢের বেশি জেদ, হতাশা আর শোধ নেওয়ার সপৃহায়!! আর মাত্র পনেরো মিনিট পর !!! অভিজাত কলিং বেলে সিম্ফনির সুর বেজে উঠল! সে কি পনের মিনিট আগেই এসে পড়েছে!! হালকা বেগুনী পাতলা নাইটির উপর স্যাটিনের গাউনটা চড়িয়ে চুলে পারফিউম স্প্রে করে দুরুদুরু বক্ষে দরজা খুলেই স্থবির হয়ে গেল সোনিয়া! ছোট ছেলে তৌফিক এসেছে! "আম্মু আজ আমাদের প্রোগ্রাম বাতিল, ইনস্টাক্টর সিঁক!!' সোনিয়ার কানে কোনো কথা ঢোকে না! আজন্মলালিত সংস্কার যেন উচ্ছ্বসিত তরুণের রূপ নিয়ে তার সামনে উপস্থিত! ছি! ছি! একী সর্বনাশা খেলায় মেতে উঠেছিল সে! শোধ নিতে গিয়ে ভুলেই গিয়েছিল শুদ্ধ থাকাটা অন্যের জন্য নয়- নিজের জন্য!! আজ ভুল করলে আমৃতু্য নিজেকে ক্ষমা করতে পারত না!" আম্মু, অৎব ুড়ঁ ভববষরহম নধফ?' সম্বিৎ ফিরে পেয়ে হতবাক পুত্রের চোখের সামনে থেকে দৌডে নিজের বেডরুমে আসে! পাগলের মতো সাইলেন্ট করে রাখা আইফোনটা খোঁজে! এক্ষুনি সালমানকে আসতে নিষেধ করতে হবে! এক্ষুনি!!! হাতে সময় আছে মাত্র পাঁচ মিনিট !!!