শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

সিজোফ্রেনিয়া

আজহার মাহমুদ
  ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
সিজোফ্রেনিয়া

ফারজানার সঙ্গে অপূর্বের পরিচয় বিসিএসের কোচিং করতে গিয়ে। ফারজানা অনার্স শেষ করেছে মহসীন কলেজ থেকে আর অপূর্ব চট্টগ্রাম কলেজ। চট্টগ্রাম কলেজ আর মহসীন কলেজ পাশাপাশি হলেও তাদের বিসিএসের কোচিংয়ে এসেই প্রথম পরিচিত হলো। দুজনেই একই কলেজ থেকে এইচএসসি পাসও করেছে। প্রায় ৮ বছর তারা দুজন পাশাপাশি কলেজে পড়াশোনা করলেও কেউ কারও চোখে পড়ল না।

এমনটা হতেই পারে। আবার তাদের কখনো দেখা না হতেও পারতো। তাদের দেখা হওয়ার কথা ছিল বলেই একই কোচিংয়ে একই বিষয়ে দুজন ভর্তি হলো। অপূর্ব আর ফারজানা নিয়মিত কোচিংয়ে আসে এবং বিসিএসের জন্য বেশ ভালোভাবে প্রিপারেশন নিতে থাকে। মাত্র তিন মাস তাদের হাতে সময়। পড়াশোনার জন্য অপূর্ব আর ফারজানা দুজনই সবার সঙ্গে মিশে যেতে পারে। এটা তাদের একটা ভালো গুণ বলা যায়। এভাবে এ সময় ফারজানা আর অপূর্বের ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায়। এখন তারা একে অপরকে সহযোগিতা করে বেশ ভালোভাবেই চালিয়ে নিচ্ছে পড়াশোনা।

পড়াশোনার পাশাপাশি তাদের আড্ডা, ঘুরাফেরা সবই হয়। তাদের আরও কিছু বন্ধু থাকে। তবে অপূর্ব আর ফারজানা মাঝে মাঝে দুজন আলাদা ঘুরাফেরা করে। এভাবেই এক সময় ফারজানা অপূর্বকে ভালোবেসে ফেলে। অপূর্বও ফারজানাকে পছন্দ করে। তবে আপাতত তাদের ধ্যান জ্ঞান সবই হচ্ছে বিসিএস।

এরই মধ্যে তারা বিসিএসের প্রিলি ও লিখিত পরীক্ষা দিয়েছে। এরপর দুজনই বেশ আত্মবিশ্বাসী- তারা ভালো করবে। প্রচুর পড়াশোনাও করেছে তারা। তাই তারা কোনো ধরনের সময় ক্ষেপণ না করে লিখিত পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা আরও গুরুত্ব দিয়ে করছে। তবে এরই মধ্যে ফারজানা আর নিজের ভেতরের ভালোবাসা প্রকাশ না করে থাকতে পারল না। একদিন প্রপোজ করে বসল অপূর্বকে। অপূর্ব ফারজানার সেই প্রপোজ ফিরিয়ে না দিলেও গ্রহণও করেনি।

অপূর্ব ফারজানাকে বলে, দেখ আমাদের সম্পর্কটা ভিন্নমাত্রায় যাক সেটা আমিও চাই। আমিও তোমাকে পছন্দ করি। কিন্তু আমার পক্ষে এখন তোমার সঙ্গে সম্পর্কে যাওয়া সম্ভব না। আমার মূল লক্ষ্য হচ্ছে বিসিএস। ভাইবা দেওয়ার পর রেজাল্ট বের হলে তারপর আমি এসব প্রেম-ভালোবাসা করতে পারব। আপাতত এসব করে আমার স্বপ্নকে শেষ করতে পারি না। তুমিও ভালো স্টুডেন্ট। সুতারং, এসব চিন্তা আপাতত বাদ দিয়ে ভাইবা পরীক্ষায় মনোযোগ দাও।

এসব কথা শুনে ফরজানা একটু কষ্ট পায়। ফারজানা আর অপূর্বের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে না। সেদিনেই ফারজানা অপূর্বকে সব ধরনের যোগাযোগ মাধ্যম থেকে বস্নক করে দেয়। ফারজানা আর অপূর্ব দুজনই লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। দুজনই ভাইবা দেবে এখন।

ভাইবা দেওয়ার জন্য ঢাকায় বেশ কয়েকদিন আগেই চলে এসেছে ফারজানা। অপূর্বের কি খবর জানে না। আজ সকালে ভাইবা পরীক্ষা। ফারজানা ভাবছে ভাইবা সেন্টারে অপূর্বের সঙ্গে দেখা হলে সে কি করবে! এসব ভাবতে ভাবতে ফারজানা ভাইবা দিতে গেল। সেখানে গিয়ে অপূর্বকে দেখতে পেল না। নিজের ভাইবাটা দিয়ে চলে এলো।

ভাইবা দেওয়ার দেড় মাস পার হলো। আজ রেজাল্ট দেবে। সবাই ফারজানাকে উইশ করছে। ফারজানা প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে। ফারজানাকে নানাজন ফোন দিচ্ছে। কিন্তু এমন খুশির দিনেও ফারজানার মন অন্য কোথাও। লিস্টে কোথাও অপূর্বের নাম দেখেনি ফারজানা। ফারজানা ভাববে অপূর্ব কি তাহলে ভাইবাতে ফেল করল!

কিন্তু অপূর্বতো এতটা খারাপ করার মতো না। তবে ফারজানার সেদিনের কথাগুলো মনে পড়লে অপূর্বের প্রতি রাগও হয়। ফারজানার এবার একটু অহংবোধও চলে এলো। তাই এসব চিন্তা বাদ দিয়ে আনন্দ উপভোগ করছে। ফারজানা সবার উইশ পেতে পেতে ক্লান্ত। ফেসবুকে নোটিফিকেশন আসতে আসতে অবস্থা খারাপ। পুরো নিউজফিডে শুধু তার ছবি। তার বন্ধুবান্ধব সবাই পোস্ট দিচ্ছে। এতকিছুর মাঝেও একটা পোস্ট দেখে ফারজানার চোখ আটকে গেল। সে যে কোচিংয়ে পড়েছে সেখানাকার এক শিক্ষক এই পোস্ট দিয়েছেন। পোস্টের সঙ্গে অপূর্বের হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা একটি ছবি। পোস্টে লেখা আছে, 'অপূর্ব আজ তুমিও তোমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারতে। কিন্তু নিয়তি তোমাকে হাসপাতালের বেডে এনে রাখল।'

ফারজানা সেই পোস্টাটা পড়ছে আর চোখের জল ফেলছে। রাত তখন ১টার বেশি হবে। তখনই ফরজানা হাসপাতালের উদ্দেশে ছুটলো। ফারজানার বাবা-মা কিছু জিজ্ঞেস করলেও ফারজানা কিছু না বলেই হাসপাতালে পৌঁছাল। গিয়ে দেখল অপূর্ব শুয়ে আছে।

অপূর্বের বাবা-মা ফারজানাকে চিনতে পারলেও অপূর্ব চিনতে পারছে না। মূলত ভাইবার আগের দিন রাতেই অপূর্ব হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যায়। এরপর থেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। তার স্মৃতিশক্তি হারিয়ে গেছে। এই রোগের নাম সিজোফ্রেনিয়া। এ রোগের কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত নয় বিজ্ঞান। নিরাময় পদ্ধতিও জানা নেই ডাক্তারদের। কোনোরকম সেবা করে যতদিন রোগীকে ভালো রাখা যায়।

এসব কথা শুনে ফারজানার অপূর্বেও প্রতি বেশ মায়া হলো। ফারজানা অপূর্বকে এখনো মন থেকে সরাতে পারেনি। ফারজানা সিদ্ধান্ত নিল এই অপূর্বকেই বিয়ে করবে সে। যে ভালোবাসা অপূর্ব ফিরিয়ে দিয়েছিল সেই ভালোবাসা দিয়েই অপূর্বকে সুস্থ করে তুলবে ফারজানা।

তবে ফারজানার এই ভালোবাসা মেনে নেয় না তার পরিবার। তারা ফারজানার বিয়ে অন্য কোথাও দিতে চেয়েছিলেন। ফারজানাও মানসিকভাবে চাপে পড়ে যান। বাব-মায়ের কথাবার্তায় ফারজানা আবার সিদ্ধান্ত পাল্টে বিয়ের জন্য রাজি হয়। নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে ফারজানা অবশ্য হেরে যায়। অপূর্বের অদ্ভুত এক মায়ায় পড়ে যায় ফারজানা। ঘর থেকে পালিয়ে অপূর্বকে নিয়ে দূরে চলে যায়। বিসিএসের ক্যাডার হওয়ার পরেও ফারজানা সেখানে জয়েন করে না। পরিচিত পরিবেশ থেকে অনেকটা দূরে সংসার শুরু করে দেয় ফারজানা।

অপূর্ব এখন বাচ্চাদের মতো হয়ে গেছে। প্রায় সবকিছুই ভুলে গেছে। ফারজানাকে ছাড়া আর কাউকেই চেনে না। ফারজানা বাসায় একরুমে কিছু বাচ্চা পড়ায়। একদিন এক ছাত্রের মা বলল আপু আপনি তো বিসিএস ক্যাডার। এটা ছাড়লেন কেন? ফারজানা এড়িয়ে গেল। রাতে ফারজানার কোলে মাথা রেখে অপূর্ব বলে, আচ্ছা একটা মহিলা তোমাকে বিসিএস ক্যাডার বলল। আচ্ছা বিসিএস মানে কি? ফারজানা চোখের জল লুকিয়ে শুধু অপূর্বকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে