এথেন্সের প্রেক্ষাপটে নাট্যকার মনোজ মিত্রের লেখা নাটক 'দেব কণ্ঠ'। নাটকের একটি দৃশ্যে চরিত্র হিসেবে সক্রেটিস দেখছেন ঘরের বাইরে আশ্রয়হীন এক বৃদ্ধা কেশেই চলেছেন। অপরদিকে, ঘরের মাঝে অবিশ্বাস্য সুন্দর পেইন্টিং করে চলেছেন এক সুদর্শন যুবক। বৃদ্ধা ও যুবকের সম্পর্ক মাতা-পুত্রের। বাইরে মাকে ফেলে রাখার কারণ কাশির শব্দে সন্তানের মনোযোগ বিঘ্নিত হওয়া থেকে পরিত্রাণ। অথচ সক্রেটিস পেইন্টিংগুলো দেখতে এবং যুবকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এক সময় নিশ্চিত হয়, পেইন্টিংয়ের প্রত্যেকটির উৎস মূলে যুবকটির মায়ের সঙ্গে কাটানো শৈশব। সেই স্বর্ণালি শৈশব, বর্ণালি কৈশবের স্মৃতিই আজ যুবকের যৌবনে আঁকা নয়ানিভিরাম নান্দনিক পেইন্টিং। পরিণত সৃজনতো এক অর্থে শৈশবের স্মৃতির রোমন্থন। অনেকটা সেভাবেই ভূপেন হাজারিকার ভূপালি সুর তাল লয়ে বেড়ে ওঠা অসমিয়া কন্যা ড. রীতা চৌধুরী। তার শৈশবে পিতা বিয়োজা নন্দ চৌধুরীর সঙ্গে ঘুরে ঘুরে দেখেছে আসামে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং নিতে। হাফলং এ সেই সময়ের এস এস বি সোশ্যাল সিকিউরিটি বু্যরোর ট্রেনিং দেখা, উদ্বাস্তু মানুষের দিকহীন দিশাহীন হাহাকারের আর্তনাদে বাতাসকে ভারী হতে দেখা, চিকিৎসায় আহতদের সারিয়ে তোলা, ময়মিয় গানের সুরে শোকার্তদের সঙ্গে সমব্যাথী হওয়া, নাটক প্রদর্শনের মধ্যে দিয়ে যুদ্ধের ভয়াবহতা ফুটিয়ে তোলা এসবই একান্তে অনুভবে আবেগে বাস্তবতার নিরিখে পর্যবেক্ষণ করেছেন সেদিনেই সেই ছোট মেয়ে রীতা চৌধুরী। আজ আর সেই ছোট মেয়েটি ছোট নেই। গোহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পলিটিক্যাল সায়েন্স নিয়ে স্নাতোকোত্তর শেষ করে উচ্চতর পেশায় যুক্ত হয়ে লেখনীতে সম্পন্ন করেছেন তার সৃজনশীল জীবন। শৈশবের সেই স্মৃতিতে যুদ্ধ কি, উদ্বাস্তু মানুষ আশ্রয়ের আশায় কোথায় যায়, যুদ্ধ কেন বাঁধে, যুদ্ধ কারা বাঁধায়, যুদ্ধে মানবতা কীভাবে বিপন্ন হয় এরকম অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর খোঁজার এবং অন্বেষণ শেষে সংশয় এবং সমাধানের গ্রন্থ 'নেভার ল্যান্ড জিরো আওয়ার'।
দ্যা রিডার্স ফ্যাক্টরি প্রকাশনায় ড. রীতা চৌধুরী রচিত গ্রন্থটির প্রকাশনা হবে আগামীকাল ২০ এপ্রিল শনিবার ঢাকায় ছায়ানটের নিজস্ব অডিটোরিয়ামে বিকাল ০৫.৩০-এ কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের সভাপতিত্বে। বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল আলম বীর প্রতীক যিনি ওই যুদ্ধকালীন সময়ে এক লড়াকু সৈনিক এবং প্রকাশিত গ্রন্থের বিশেষ চরিত্র, তিনিও থাকবেন; আরো অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির সমান্তরাল উপস্থিতও। পাশাপাশি বইয়ের চুম্বকাংশ পঠিত হবে গুণী পাঠকের উচ্চরণে।
উচ্চরণ কিংবা উপস্থিতি প্রশ্নে নোম্যানস ল্যান্ড কিংবা মাই হোমল্যান্ড এই বিশ্ব ভূখন্ডে অসংখ্য। কিন্তু নেভার ল্যান্ড এবং জিরো আওয়ার এই দ্বৈত নামে গ্রন্থের নামকরণ কেন এই কৌতূহলী প্রশ্ন ওঠাইতো পাঠক মহলে স্বাভাবিক। ড. রীতা চৌধুরীর কথনে এই প্রসঙ্গ স্পষ্ট। তার রচিত 'নেভার ল্যান্ড জিরো আওয়ার' গ্রন্থটি তার স্বপ্নের ট্রিলজি রচনার প্রথম পর্ব। প্রথম পর্ব যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া বাঙালির উদ্বাস্তু জীবন এবং পাল্টা লড়াই তৈরি মনোভাব পর্ব। দ্বিতীয় পর্বে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন নয় মাসের সময়কাল। তৃতীয় পর্বে স্বাধীন উত্তর বাংলাদেশের পথচলা। এই তিন পর্বের চলতি পথের রচনা শুধু বাংলাদেশ, বাঙালি, অসমীয়, ভারত এই গন্ডিতে আটকানো না বরং একটা যুদ্ধ যে একটা বিশ্ব রাজনীতির বলয়ে নিরুপিত, একটি স্বাধীনতাকামী দেশের মানুষের লড়াই সংগ্রামে যে শত্রম্ন মিত্র ঘরে কিংবা বাইরে, সম্প্রীতির মাঝে বিদ্বেষ নিয়ে আসাটা যে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিপুল অর্থ লগ্নির ফসল এসবেরই তথ্য সত্য ইতিহাস কল্পনার সংমিশ্রণে ড. রীতা চৌধুরীর রচনা নেভার ল্যান্ড জিরো আওয়ার। জিরো আওয়ার মানে যে যুদ্ধ শুরুর ঘণ্টা ধ্বনি সেতো যুদ্ধমত্ত এই ধরিত্রীবাসীর সবার জানা কিন্তু নেভার ল্যান্ড শব্দে জিজ্ঞাসা-জিঘাংসা-নিরুপায়তা-স্বপ্ন দেখা-স্বপ্ন ভঙ্গের যন্ত্রণা; যেসব ডিঙিয়ে এক নব প্রভাতের মতো, নব শিশুর মতো একটা স্বপ্নের ভূখন্ডের দেখা শোনা, যেখানে আছে বাঁচার স্বাধীনতা, হাত বাড়ালেই সহযোগিতা, সমবেত চলতি পথের গর্বিত শোভাযাত্রা।
শোভা যাত্রার স্বপ্ন চারিণী ড. রীতা চৌধুরীর রচনায় উদ্বাস্তুনামা আছে, এগারো সেক্টরের পরিকল্পিত লড়াই আছে, সর্বসাধারণের ভূমিকা আছে আর আছে লেখনীতে লেখিকার কাব্য সত্তা যে কারণে গ্রন্থের নাম নেভার ল্যান্ড জিরো আওয়ার। নেভার ল্যান্ড জিরো আওয়ার লেখিকা ড. রীতা চৌধুরীর সর্বশেষ রচনা। কিন্তু এই পরিণত রচনার মাইলফলক ছোঁয়ার মুহূর্তে তাকে ফেলে আসতে হয়েছে রচনার অজস্র পথ। অনুপ্রবেশ বিষয়ে অবিরত যাত্রা, দেশ প্রেম বিষয়ে তীর্থভূমি, পথভ্রষ্ট যুবকদের ঘরে ফেরার আলোকে মহাজীবন আঁধারশীলা, প্রতিভাবান যুবক-যুবতীদের পথরুদ্ধকারীদের চিনিয়ে দিতে পাপিয়া তারার সাধু, মধ্য বয়সি নারীর অস্তিত্বহীনতার সংকট নিয়ে রাগ মালকোস, উগ্রবাদকে নিরুৎসাহিত করতে জলপদ্ম, পরিত্যক্ত শিশুদের নিয়ে রাজীব ঈশ্বর, যুদ্ধবাজদের মুখোশ উন্মোচন করতে জাহ্নবী এবং মায়বৃত্ত'র মতো অসংখ্য রচনা তাকে পাইয়ে দিয়েছে অসমীয় সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার। রচনামালায় তার যে অসংখ্য উপন্যাস সেখানে বেশিরভাগটাই বিষয়ভিত্তিক। সেখানে সেভাবে নিজেকে উপস্থিত রাখা কঠিন। কিন্তু কবিতায় সেটা সম্ভব। জীবনের বাঁকে বাঁকে ঘাটে ঘাটে জীবন যেভাবে বদলে বদলে যায় একটু একটু করে সেটা নিয়েই ড. রীতা চৌধুরীর কাব্য গ্রন্থ প্রত্যাশার স্বপ্ন, সুদূর নক্ষত্র, অলাপ প্রহরর অলাপ আন্ধারর, বগা মাটির তুলসী প্রভৃতি। ড. রীতা চৌধুরী কাব্য গ্রন্থের মাঝে রেখে দিয়েছেন তার নিজস্ব জীবনের ছায়া। অপরদিকে, তার ট্রিলজির প্রথম প্রকাশে বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বের প্রতি তার নিজস্ব আবেগের সিগনেচার। যে কারণে তিনি তার গ্রন্থ নেভার ল্যান্ড জিরো আওয়ার উৎসর্গ করেছেন শেখ রাসেল এবং যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত সমস্ত বিশ্বের শিশুদের। আর আগামীকাল ছায়ানটে গোধূলি বেলায় নেভার ল্যান্ড জিরো আওয়ার প্রকাশের মুহূর্তক্ষণে, ড. রীতা চৌধুরীর সজল চোখ খুঁজে ফিরবে আবেগ ভরা হৃদয় নিয়ে, যদি তার ট্রেইনার পিতা যাকে সবাই আদর করে বলত বি এন গুরু তার ট্রেনিংপ্রাপ্ত কোনো বীর মুক্তিযোদ্ধার দেখা মেলে। কারণ শৈশবের স্মৃতিই তো পরিণত রচনা- নেভার ল্যান্ড জিরো আওয়ার। এ পুনঃপুনঃ ফিরে আসে আবার দেখাও মেলে।