সমরেশ বসুর গঙ্গা

প্রকাশ | ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০

এস ডি সুব্রত
গঙ্গা সমরেশ বসুর লেখা জলজীবনের বাস্তব চিত্রসংবলিত একটি ধ্রম্নপদি বাংলা উপন্যাস। ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত নদীকেন্দ্রিক এই উপন্যাসের মূল উপজীব্য বিষয় দক্ষিণবঙ্গ, বিশেষত অবিভক্ত চব্বিশ পরগনা জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের জীবনসংগ্রামের কাহিনি। এই উপন্যাসখানি লেখক তথা বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা বলে বিবেচিত হয়। দেশ পত্রিকার বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ২৪টি বাংলা উপন্যাসের তালিকাতেও স্থান পায় উপন্যাস গঙ্গা। আমাদের সাহিত্যে নদী জীবনকেন্দ্রিক যেসব উপন্যাস প্রাধান্য পেয়েছে তার মধ্যে অদ্বৈত মলস্নবর্মণের 'তিতাস একটি নদীর নাম', মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পদ্মানদীর মাঝি', সমরেশ বসুর 'গঙ্গা', বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইছামতি এবং হুমায়ুন কবীরের 'নদী ও নারী'। অবশ্য ইছামতি নদীপারের জীবনকেন্দ্রিক একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনালেখ্য। এখানে তৎকালীন সময়ের নদী আর নদীপারের জীবন একাকার। যতটা সামাজিক ততটা রাজনৈতিক। নদীকেন্দ্রিক উপন্যাসগুলোর মধ্যে বহুল পঠিত ও প্রচারিত উপন্যাস হলো পদ্মানদীর মাঝি। পঠিতের চাইতে বেশি প্রচারিত হলো তিতাস একটি নদীর নাম। এখানে তিতাসই মুখ্য। প্রধান চরিত্রও বটে। এরপর আসে গঙ্গা উপন্যাসের নাম। অথচ বোদ্ধা পাঠক মহলে সবচেয়ে বেশি প্রশংসিত গঙ্গা। ১৯৫৭ সালে জন্মভূমি পত্রিকার শারদ সংখ্যায় গঙ্গা উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলে সমরেশ বসু এটিকে উৎসর্গ করেন বরেণ্য কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দেশ্যে। পরে দীর্ঘকাল অমুদ্রিত থাকার পর ১৯৭৪ সালে লেখকের অনুমতিক্রমে মৌসুমী প্রকাশনী বিস্তারিত গ্রন্থপরিচয় ও গবেষণা-সমীক্ষণসহ গঙ্গা উপন্যাসের একটি সমৃদ্ধ সংস্করণ প্রকাশ করে। বর্তমানে এই সংস্করণটিই পৃথক গ্রন্থাকারে বাজারে প্রাপ্ত হয়। গঙ্গা উপন্যাস সম্পর্কে বলতে গিয়ে লেখক সমরেশ বসু বলেন, 'বাপ-ছেলে মারামারি করছে, বউ-সোয়ামি ছাড়াছাড়ি করছে। এই না মাছমারার জীবন! এক কোটালে বাঁচে, আর এক কোটালে মরে। মাছের প্রাণের চেয়েও তার আয়ু টলোমলো।' বাঙালির শিল্প-সাহিত্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য, নগর-জনপদ গড়ে উঠতে নদী একটা বড় ভূমিকা রেখেছে সব সময়। সংগতভাবেই কবি ও লেখকদের ?কলমে কোনো না কোনোভাবে এসেছে নদীর কথা, জীবনের গল্প। অধ্যাপক হীরেন চট্টোপাধ্যায়ের এ উপন্যাস সম্পর্কে অভিমত খানিকটা এ রকম। তিনি বলেছেন, জলের সঙ্গে মানুষের এই সংগ্রাম, এই মধুর প্রতিদ্বন্দ্বিতার চিত্র পাই না আমরা অন্য কোনো নদীকেন্দ্রিক উপন্যাসে, অন্তত এমনি করে। তিতাসকে অবলম্বন করেও মানুষ হিসেবে হয়তো বেঁচে ওঠা যায় অন্তত তার প্রমাণ, কিন্তু সেই কল্পবীজ এ উপন্যাসে শাখায়িত হতে পারেনি। হোসেন মিয়া ময়নামতীর দ্বীপে পদ্মার প্রতিস্পর্ধী এক জনবসতি গড়ে তুলতে চেয়েছে, কিন্তু তার সে প্রয়াসও রহস্যময় থেকে গেছে। কিন্তু গঙ্গার বুকে মালো পরিবারের মাছমারা ছেলে সমুদ্রের স্বপ্ন এমনভাবে লালন করেছে মনের মধ্যে, প্রতিহত করা যায়নি তাকে। গঙ্গাকে এভাবে পেরিয়ে যেতে পারে বলেই গঙ্গা এই জাতীয় উপন্যাসগুলোর মধ্যে স্বতন্ত্র। সমরেশ বসু জনজীবনের শিল্পী হিসেবে কতটা সার্থক। যদিও গঙ্গা উপন্যাস রচনার আগেই সমরেশ বসু আমাদের কাছে জনজীবনের কথাকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। যেমন উত্তরবঙ্গ, নয়নপুরের মাটি এবং পরের দু'বছরে প্রকাশিত বি টি রোডের ধারে ও শ্রীমতী কাফে এই খেতাবের জন্য যথেষ্ট ছিল। দেশ, সমকাল, মাটির মানুষের সজীব ও উষ্ণ ছোঁয়ায় অনেক বেশি প্রাণবন্ত ছিল এই চারটি উপন্যাস। প্রমথ সেনগুপ্ত 'অমৃতসন্ধানীর সংক্ষিপ্ত জীবনালেখ্য' শিরোনামে এক স্মৃতিকথায় বলেছিলেন, 'গঙ্গা, সাম্প্রতিক বাংলা উপন্যাসমালার মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় রচনা।' জনপ্রিয়তার কারণ হতে পারে, এত কাছে থেকে দেখা নদী-জীবনের রূঢ় বাস্তবতার নিখুঁত রূপময়তা। আর সমরেশ বসু বলেই হয়তো তা এত করে সম্ভব হয়েছে। কারণ জীবনের কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে তার মেলামেশা অনেক দিনের। 'আদাব' গল্পে আমরা যার চিহ্ন দেখেছি অনেক আগেই।' তিনি কতটা সাধারণ জীবনের কাছাকাছি ছিলেন তা স্পষ্ট করা যেতে পারে শঙ্করলাল ভট্টাচার্যের লেখনি দিয়ে। তিনি বলেছেন, 'সমরেশ বসুর জীবন নিয়ে আর বেশি কী বলার আছে? মাত্র বাইশ বছর বয়সে 'আদাব' গল্প লিখে তুলকালাম কান্ড বাধিয়ে দিয়েছিলেন। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা নিয়ে এত অসাধারণ একটা গল্প একজন বস্তিবাসী, আধা-শ্রমিক মানুষের হাত দিয়ে কী করে বেরোলো কে জানে! দুই সম্প্রদায় সম্পর্কেই কী নির্মোহ, কিন্তু সহানুভূতিতে দ্রব মনোভাব।' সমরেশ বসু যা লিখেছেন তা কাছে থেকেই লিখেছেন। ছায়া দেখে নয়, কায়া দেখে। গঙ্গার পটভূমি রচনার পেছনেও তাই রয়েছে আরেক পটভূমি। আতাপুরে থাকার সময়ে মালোপাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে লেখক মাছ ধরতে যেতেন। কখনো বর্ষার পুরো মৌসুম ধীবর বন্ধুদের সঙ্গে মাছ ধরেছেন গঙ্গায়। তিনি দেখেছেন তাদের হাসি-কান্না, ক্ষোভ, অভিমান, টানাপোড়েন, ধার-দেনা, সুদ আর তা পরিশোধের নির্মম বাস্তবতা। তিনি দেখেছেন জাল, জল ও জেলে জীবনের গৃহস্থালি। আর আমরা পেয়েছি গঙ্গা। সমরেশ বসু গঙ্গা উপন্যাসের ভূমিকায় স্বীকার করেছেন জেলেপাড়ার সেসব বন্ধুর ঋণ। তিনি যাদের কথা উলেস্নখ করেছেন তাদের কয়েকজনের নাম হলো, 'আতাপুরের মালোপাড়ার কার্তিক দাস, পরেশ দাস এবং হালিশহরের নিমাই অধিকারী ও তার পিতা এবং জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা। এদের সঙ্গে অনেক দিন ও রাত্রি আমার কেটেছে গঙ্গার বুকে। এদের সাহায্য ছাড়া 'গঙ্গা' রচনা সম্ভব ছিল না।' লেখকের এই সরল স্বীকার আর ঋণ আমাদের শ্রদ্ধা জাগায় লেখকের প্রতি। সমরেশ বসুর গঙ্গার ক্ষেত্র প্রস্তুতির অনেকটাই উন্মোচন করেছেন হালিশহরের রামপ্রসাদ লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক নিমাই চাঁদ অধিকারী। তিনি সমরেশ বসু : স্মরণ সমীক্ষণ গ্রন্থের একটি প্রবন্ধে এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছেন। প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল, 'সমরেশ দার গঙ্গা ও আমরা'। এখানে তিনি আলোচনা করেছেন, লেখক কীভাবে গঙ্গা-মাল্য নির্মাণের মণিমুক্তা সংগ্রহ করেছেন। কীভাবে হাজারো প্রশ্নবাণে চার-পাঁচ বছর ধরে জর্জরিত করেছেন তাদের। সমরেশ বসু একটা সত্য উদ্ঘাটন করেছেন বটে, যা স্পষ্ট হয় নিমাই চাঁদের কথায়, 'মাছধরাদের একটা নিজস্ব ভাষা আছে, আমি তা খেয়াল করিনি। পেশার সঙ্গে ভাষার এত মিল সমরেশদার প্রশ্ন করার আগে পর্যন্ত সত্যি কথা বলতে কী, বুঝিনি। 'গঙ্গা' বইয়ে সেই সব শব্দের কিছু প্রতিফলন হয়েছে।' হয়তো সেই কারণেই, পদ্মানদীর মাঝি ও গঙ্গার পটভূমি এক হলেও চরিত্র-চিত্রণ, ভাষা, কথোপকথন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, মোটকথা সবকিছু উপস্থাপনার গুণে উপন্যাস দু'টির অবস্থান হয়ে দাঁড়িয়েছে যোজন যোজন দূরে। গঙ্গা উপন্যাসের সার্থকতা এখানেই। সমরেশ বসু রূঢ় বাস্তবতার নিখুঁত কারিগর। তার শ্রেষ্ঠ গল্পগুলো মূলত সমাজের নিচের মানুষদের নিয়ে রচিত। এই ধারার গল্পগুলোর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলো, 'বিষের ঝাড়', 'পার', 'রং', 'ছেঁড়া তমসুক', 'পসারিণী'সহ আরও অনেক। এই ধারায় গঙ্গা হলো একটি মহীরূহ। গঙ্গা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে যে বিষয়গুলো সবার আগে আসে, তা হলো এর পটভূমি, চরিত্রগুলোর স্বাভাবিক বিচরণ, ঘটনার উপস্থাপন আর বাস্তবতার উপযোগিতায় ভাষার প্রয়োগ। গঙ্গার পটভূমি একটাই, জল-জাল-জেলে। গঙ্গা উপন্যাসের চরিত্রগুলো সামনে অতটা উজ্জ্বল হয়ে ধরা দেয়নি। পদ্মানদীর মাঝিতে যতটা উজ্জ্বল হয়ে আছে কুবের, মালা, সিতলবাবু কিংবা কপিলা। এদিক থেকে বলা চলে সমরেশ বসুর মূল বিষয় চরিত্র চিত্রণ নয়, মূল বিষয় জেলেজীবন। জেলেজীবনের সংগ্রাম চিত্রণ করতে যা যা প্রয়োজন, তা করেছেন। চরিত্রের ক্ষেত্রেও তাই। এখানে মোটা দাগে যারা রয়েছে : সাইদার নিবারণ, নিবারণের ছোট ভাই পাঁচু ও ছেলে বিলাস, বশীর, সয়ারাম, পাচী (ছায়া), রসিক, দুলাল, অপরদিকে অমর্তের বউ, দামিনী, হিমি, হিমির সখী আতর, মহাজন ব্রজেন ঠাকুর প্রমুখ। আপাতদৃষ্টিতে এই উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা হলো বিলাস ও হিমি। কিন্তু সব চরিত্র যার ছায়া অবলম্বনে, তিনি হলো নিবারণ। সেদিক থেকে নিবারণ হলো কেন্দ্রীয় চরিত্র। নিবারণের সব বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় তার ছেলে বিলাসের মধ্যে। নিবারণকে আমরা হারিয়েছি উপন্যাসের প্রথম ভাগেই। ন্যায় ও সত্যের পক্ষে থেকে করেছে জীবন সংগ্রাম। অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেনি কখনো। এখানে নিবারণের প্রতিপক্ষ মহাজন, তার রক্তচক্ষু, কখনো নিঠুর গঙ্গা, সমুদ্র ও তার মীন। গঙ্গা উপন্যাসের মূল বাস্তবতা হলো গঙ্গা বা সমুদ্রের জেলে মানেই ঋণী, ঋণের প্রতিনিধি। ঋণের বোঝায় নিমজ্জিত হতে হতেই তা শোধের চেষ্টা করতে হয় মরণপণ। ঘরে দেনা বাইরে দেনা। তাদের রাগ করতে নেই, অভিমান করতে নেই। জেলেজীবনের বড় বাস্তবতা টিকে থাকা। তারা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে জানে না, পারে না। 'সে যদি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকে, জানবে সেটা ন্যায্য। সে কখনো নিজেকে ফাঁকি দেয় না। এই উপন্যাসের অন্তর্বাস্তবতা যা আছে, তা হলো, জেলে-মনের নয়, জেলেজীবনের। জেলেজীবনের বীভৎস এক সৌন্দর্যের নাম অভাব। ধারদেনায় তাদের অস্তিত্বও নিজের অজান্তে বন্ধকি হয়ে যায় মহাজনের কাছে। মীনের জীবন জলে, আর জেলের জীবনও জলে মানে মীনে। আর এই জীবন বাঁধা থাকে এক অদৃশ্য সুতায় মানে মহাজনের হাতে। সে ইচ্ছা করলে টান দেয়, আবার ইচ্ছা করলে ঢিল দেয়। জেলেপাড়ায় অভাব আছে মহামারি হয়। অথচ কত শান্ত ও নীরব। মরণ দেবতা হানা দেয় ঘরে ঘরে। তার ভয়ংকর সংহার মূর্তি সবকিছু ভেঙে ফেলতে চায়। ভাঙতে চায় জেলেজীবনের গেরস্থালি। \হনদীকেন্দ্রিক বাসিন্দাদের নিয়ে যতগুলো উপন্যাস রচিত হয়েছে তাতে গঙ্গার আসন সবার ওপরে। এর গুরুত্ব যতটা না কাহিনিতে তার অধিক পটভূমিতে। কাহিনি হয়তো অতটা জমাট বাঁধতে পারেনি। তবে এর আখ্যান যাদের জীবন নিয়ে নির্মিত, তা ফাঁকফোকরহীন। এত নিখুঁত, নিটোল আর জলের সঙ্গে মানুষের এমন গভীর সংগ্রাম অন্য কোনো নদীকেন্দ্রিক উপন্যাসে দেখা যায় না। আর্থ-সামাজিক কাহিনি এবং প্রচুর উপকথা-মিথের ব্যবহার গঙ্গা উপন্যাসকে বিশিষ্টতা দান করেছে। সম্পর্কের বিভিন্ন জটিলতা ঔপন্যাসিক সমরেশ বসু বেশ দক্ষতার সঙ্গে উপস্থাপনা করেছেন। পাঁচুর সঙ্গে বিলাসের সম্পর্ক, দুলাল-আতরবালা সম্পর্ক, অমৃতর বউয়ের সঙ্গে বিলাসের সম্পর্ক প্রভৃতি সম্পর্কগুলো আশ্চর্য রকম পরিমিত ও বাস্তব জীবনের নিখুঁত চিত্রের এক অসামান্য প্রকাশ।