শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

সাঈদ আহমদের নাট্য নিরীক্ষা

শাহমান মৈশান
  ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
সাঈদ আহমদের নাট্য নিরীক্ষা

সাঈদ আহমদের বহুমুখী চর্চার মধ্যে নাটক লেখার ক্ষেত্রটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কীভাবে সাঈদ একজন নাট্যকার হয়ে উঠলেন এর উত্তর তালাশ করতে গিয়ে 'সাঈদ আহমদ রচনাবলি'র সম্পাদক উপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক হাসনাত আবদুল হাই ৪টি বর্গ পাঠকের পাতে তুলে দিয়েছেন। প্রথম বর্গে তিনি ইঙ্গিত করেছেন সাঈদের পারিবারিক মালিকানায় লায়ন থিয়েটারের প্রসঙ্গ। এটি ১৮৯৮ সালে ডায়মন্ড থিয়েটারের হিন্দু মালিকের কাছ থেকে তাদের পরিবার ক্রয় করেছিল। এর সূত্রে বাল্যবয়স থেকেই তার নাটক দেখার সূচনা হয়। যদিও হাসনাত উলেস্নখ করেছেন যে, 'ভবিষ্যতে নাট্যকার হবেন এমন অভিলাষ তার তখনো মনে দেখা দেয়নি।'১ দ্বিতীয় বর্গের আলোচনায় হাসনাত দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে অনেকখানি নিশ্চয়তার স্বরে বলছেন, 'ক্লাসিকাল নয়, 'অ্যাংরি ইয়াংম্যান'দের লেখা নাটক দেখে ও পড়ে তার নাট্যভাবনা গড়ে ওঠে'।২ ক্রুদ্ধ ইংরেজ যুবকদের ভাবনার সাথে সাঈদের পরিচয় ঘটে বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে প্রথম যৌবনে যখন তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য লন্ডনে যান। তখনকার সমকালীন নাটকে এস্টাবলিশমেন্টের বিরোধিতার সাথে 'বিশেষত তরুণ প্রজন্মের হতাশাজনিত' প্রতিবাদের সাথে সাঈদের ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটেছিল বলে হাসনাত তথ্য দিয়েছেন। হাসনাত তৃতীয় বর্গে সাঈদের নাট্যকার হয়ে ওঠার প্রেরণাসূত্র হিসেবে করাচির অভিনেতাদের প্রসঙ্গ উলেস্নখ করেছেন- 'পঞ্চাশের শেষ দিকে দেশে ফিরে সরকারি চাকরি ব্যাপারে দেশে করাচি শহরে থাকার সময় তিনি কিছু শখের অভিনেতার সঙ্গে পরিচিত হন এবং তাদের পরীক্ষামূলক নাটক দেখেন'।৪ উত্তরকালে সাঈদের নাটকের নিরীক্ষাধর্মিতার সাথে এই তথ্যকে নিশ্চিতভাবেই সমীকরণ করা যায়। চতুর্থ বর্গে আমরা দেখছি, পাশ্চাত্যের অ্যাবসার্ডবাদী নাটকের আঙ্গিক ও বিষয় সাঈদের নাটকে যে সংশ্লেষিত হয়েছে হাসনাত খুব সরাসরি সেই প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। এর সপক্ষে হাসনাত 'ড্রামা সার্কল'র অন্যতম উদ্যোগী ও নির্দেশক বজলুল করিমের বক্তব্যেরও দোহাই দিয়েছেন। হাসনাত নিজের সিদ্ধান্তমূলক বক্তব্যে বলেছেন, 'নাটক সম্বন্ধে তার চোখ খুলে যায় স্যামুয়েল বেকেটের 'ওয়েটিং ফর গোদো' ধরনের অ্যাবসার্ড নাটক পড়ে। এর অব্যবহিত পরই তিনি পরিচিত হন আরেক অ্যাবসার্ড নাট্যকার ইউজিন আয়োনেস্কোর নাটকের সঙ্গে। শুধু পড়েই তাদের বিদঘুটে, অদ্ভুত ধরনের নাটক তাকে দারুণ প্রভাবান্বিত করে। এসব নাটকের অস্বাভাবিক কাহিনী, পটের অভাব অথবা উচ্ছৃঙ্খল গঠন, সংলাপের সংক্ষিপ্ততা ছিল [সাঈদকে] আকর্ষণ করার বাইরের দিক। এদের ভেতরে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন আধুনিক ব্যক্তিমানসের অস্থিরতা, ক্ষ্যাপামি, বেপরোয়া মানসিকতা, কৌতুক ও হাস্যবোধ এবং সর্বোপরি বুদ্ধির উজ্জ্বল ঝলক।' 'বাংলাদেশের নাগরিক থিয়েটার অনেকান্ত অবলোকন' নামের বইয়ে সংস্কৃতি-ভাবুক ড. বিপস্নব বালা 'নাগরিক বাংলা থিয়েটারে' দেশজরীতি কীভাবে শিকড় গেড়েছে সেই প্রশ্নের উত্তর তালাশ করেছেন হরেক রকমের দৃষ্টান্তে। এ ক্ষেত্রে সাঈদ আহমদ সম্পর্কে সিদ্ধান্তমূলক পদ্ধতিতে বিপস্নব বালার ক্ষিপ্রগতি-মন্তব্য হলো, 'সাঈদ আহমদের 'কালবেলা', 'মাইলপোস্ট' নাটকে লোকরীতির সঙ্গে আধুনিক নাট্যপদ্ধতি অন্বিত।' যদিও লোকরীতি কী ও আধুনিক নাট্যপদ্ধতি কী এবং কীভাবেই বা সাঈদ স্বরচিত নাটকে এই দুইয়ের অন্বয় ঘটিয়েছেন সেটি তিনি ব্যাখ্যা করেননি। থিয়েটার বিষয়ে ইন্টারডিসিপিস্ননারি পদ্ধতিতে সমালোচনামূলক গবেষণায় পন্ডিত অধ্যাপক সৈয়দ জামিল আহমেদ সমকালীন বাংলাদেশের থিয়েটারে বাচনের নকশা কীভাবে আঁকা হয়েছে এর তত্ত্বতালাশে তিনভাগে বিভক্ত একটি অনুপুঙ্খ পর্যালোচনা হাজির করেছেন, 'ডিজাইনস অফ লিভিং ইন দি কনটেমপোরারি থিয়েটার অব বাংলাদেশ' প্রবন্ধে। এই প্রবন্ধের দ্বিতীয় ভাগের নাম আর্টিকুলেশনস অফ সাবল্টার্ন রেজিসটেন্স, বাংলায় বলা যায়, 'নিম্নবর্গের প্রতিরোধের রূপায়ণ'। ওই অংশে জামিল আহমেদ বদরুদ্দীন ওমরের বাংলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমস্যা বইয়ের একাংশের আলোচনার সারমর্ম হিসেবে তুলে ধরে বলেন, ১৯৪০'র দশক ও ১৯৫০'র দশকের প্রথম দিকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটি অংশ [পাকিস্তান] রাষ্ট্রের সামন্তবাদী ও ধর্মীয় ভাবাদর্শ প্রতিরোধে সচেষ্ট হয়ে ওঠেছিল। এর মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিপরীত ভাবাদর্শ, যার মূলে গণতান্ত্রিক ও সেকু্যলার মূল্যবোধ [কাজ করে], এমনকি শ্রেণী-সচেতনতার সাথেও [ওই বিপরীত ভাবাদর্শের] সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। পর্যায়ক্রমে, ১৯৪৮ থেকে ১৯৫০-এর মধ্যে বেশকিছু কৃষক আন্দোলন, যেমন- ভেভাগা, নানকার, টঙ্ক ও নাচোলে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল। কিন্তু সেই সময় এগুলোর কোনোটিই পারফরম্যান্সের 'কাল্পনিক' প্রতিবেশে কোনো খোরাক জোগাতে পারেনি।৭ এরকম একটি সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে প্রায় ১৫ বছর পর, জামিল আহমেদ উলেস্নখ করছেন যে, ১৯৬৫ সালে বাস্তব ও থিয়েটার, উভয়ক্ষেত্রই যখন শ্রেণী শোষণের বিরুদ্ধে যেকোনো প্রতিরোধের রূপায়ণ থেকে বিচ্ছিন্নতায় ভুগছে, ঠিক সেই সময় সাঈদ আহমদের 'মাইলপোস্ট' নাটকটি বাংলা একাডেমিতে মঞ্চস্থ হয়। জামিল আহমেদের ইংরেজি বক্তব্যটি অনুবাদ করলে অর্থ দাঁড়ায় যে, 'সাঈদ মার্কসবাদী বয়ান পরিহার করে, বাঁচনের এমন এক নকশাকে তার নাটকের ভেতরে বুনেছেন যা বেকেটিয় ধমনী থকে আসা এক অ্যাবসার্ড ভিশন বা রূপকল্প।'৮ বাংলা একাডেমি থেকে ১৯৭৯ সালে ইংরেজিতে প্রকাশিত সাঈদের 'দ্য মাইলপোস্ট' ও এর প্রযোজনীয় উপাত্ত পাঠ করে জামিল আহমেদ বিচার করছেন জনগণ যদি তাদের জীবন উৎসর্গের জন্য প্রস্তুত থাকে তবুও স্যালভেশন বা পরিত্রাণ অসম্ভব কিনা এই সংশয়ে ভোগে নাটকটি। তাই সাঈদ আহমদের এই নাট্যভাষ্যকে জামিল আহমেদ 'মেটাকমেন্টারি' বা 'মহাভাষ্য' আখ্যা দিয়ে বলেছেন যে, এই নাটকটি ১৯৬৯-এর গণঅভু্যত্থানের পটভূমিতে একান্তই এক ভুল প্রতিরূপায়ণ।৯ কারণ পাকিস্তানের জন্মের পর বৃহত্তম গণজাগরণের ওই সময়টাতেই রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর গুলিতে ছয়জন জীবনোৎসর্গ করেছিল এবং প্রায় সর্বস্তরের কৃষক-লেখক-শিল্পী-ছাত্র-শ্রমিক এমনকি সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে নিম্ন ও মধ্য বেতনভোগী কর্মচারীরাও তৎকালীন বিরোধী দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে সামিল হয়ে আইয়ুব শাহীর পতন ঘটিয়েছিল। ফলে, নাটক ও সমকালীন বাস্তবতার রসায়নের প্রেক্ষাপটে যুক্তি ও তথ্যের নিরিখে জামিল আহমেদের মূল্যায়ন হলো, সাঈদের 'মাইলপোস্ট' নাটকে দেখা যায় জনগণ জীবনোৎসর্গের জন্য প্রস্তুত থাকলেও পরিত্রাণ অসম্ভব- এই মেটাকমেন্টারি সেই সময়ের অর্থাৎ ১৯৬৯'র গণঅভু্যত্থানের বাস্তবতা ও এর ফলাফলের নিরিখে সত্য নয়, বরং জীবনের বিনিময়ে রাজনৈতিক পরিত্রাণ আসে। বিপস্নব বালার ভাবনাসূত্র থেকে পাওয়া দুটো ধারণা 'লোকরীতি' এবং 'আধুনিক নাট্যপদ্ধতি'- এর মধ্যে যদি দ্বিতীয় ধারণাটিকে আপাতত সামনে নিয়ে আসি, তাহলে জামিল আহমেদের বিশ্লেষণী সমালোচনা থেকে পাওয়া একটি ধারণার সাথে সম্পর্কিত করা সম্ভব। 'মাইলপোস্ট' সম্পর্কে জামিল এ-ও বলেছেন যে, এ নাটকে বেকেটিয় ধমনী থেকে আগত অ্যাবসার্ড ভিশন প্রবাহিত হয়েছে। তাহলে বিপস্নব যে 'আধুনিক নাট্যপদ্ধতির' কথা বিমূর্তভাবে বলেছেন, সেটাই জামিলের পর্যালোচনায় সুনির্দিষ্টভাবে অ্যাবসার্ড ভিশন রূপে মূর্তমান হচ্ছে। সৈয়দ জামিল আহমেদ ও বিপস্নব বালার সমালোচনার সূত্রে আমরা এগিয়ে জিজ্ঞাসু হতে পারি এই উত্তরের লক্ষ্যে যে, তাহলে সাঈদ আহমদের ড্রামাটার্জি বা নাট্যতত্ত্ব কী?- এই প্রশ্নরেখা ধরেই প্রমাণসাপেক্ষে আমরা প্রস্তাব করতে পারি পাশ্চাত্যের আভাঁগার্দ অ্যাবসার্ড ধারাটি বাংলা নাটকে শালুকসংশ্লেষণের রূপকার হলেন সাঈদ আহমদ। এবার, জামিল আহমেদের প্রতিপাদন থেকে আলোকিত হয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করব যে, ১৯৬৯-এর গণঅভু্যত্থানের পটভূমিতে সাঈদের 'মাইলপোস্ট' নাটক যদি একটি ভুলরূপায়ণ (মিসরে প্রিজেন্টেশন) হয়ে থাকে, তাহলে নাটক কি শুধু এর রচনার পরিপ্রেক্ষিতে নিজের কালেরই রূপায়ণ? নাকি পাশাপাশি একটি নাটক কালাতীতেরও রূপকল্প হতে পারে! আমরা জানি যে, থিয়েটার কালের মাত্রা ও স্থানের নির্দিষ্টতায় গঠিত এক শিল্প। সেক্ষেত্রে নাটক (সেটি যখন ১৯৬৫ সালে মঞ্চস্থ হয়, এটি আবার ২০১৫ সালেও মঞ্চস্থ হতে পারে) থিয়েটারেরই একটি সবিশেষ উপাদান হিসেবে, এমনকি পাঠযোগ্য সাহিত্যরূপেও গতকালের জন্য যা ছিল আপাতত, আজ ও আগামীকালের জন্য তা হতে পারে চিরায়ত। সৃষ্টির একটি বড় লক্ষণই হলো সময়ের নিরিখে এর নিহিত প্যারাডক্স। কারণ, শিল্প একই সঙ্গে আজকের এবং আজকের নয়। আজকের নয় বলেই এটি ভাবীকালের। জামিল আহমেদের প্রতিপাদনের হিসেবে, সাঈদ আহমদের 'মাইলপোস্ট' যদি ১৯৬৯-এর গণঅভু্যত্থানের প্রেক্ষাপটে ভুলরূপায়ণ হয়ে থাকে, তাহলে এই প্রশ্নও তো আমরা তুলতে পারি যে, নাটকটি মঞ্চায়নের আজ প্রায় অর্ধশতাব্দী পর দৈশিক ও বৈশ্বিক বিভিন্ন ঘটনাবলি, বিশেষত সশস্ত্র পুঁজিবাদের দামামা, প্রতিরোধের 'জেহাদি' ব্যাকরণ ও ইহুদি জাত্যাভিমানের সাথে আলিঙ্গনাবদ্ধ 'ক্রুসেডের' মলস্নযুদ্ধে থাকা এই পৃথিবীতে আত্মাহুতির ফলে পরিত্রাণ কি ঘটেছে কিংবা পরিত্রাণের পূর্বাভাস কি আদৌ শুনতে পাওয়া যায়? তবুও মানুষের বাঁচনের মর্মার্থ কী? পরিত্রাণ অসম্ভব, যখন এই সংশয়ে সবাই বিরাজ করে, তখনো মানুষ কেনো বাঁচে?- এই সমুদয় প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বলবার থাকে, ১৯৬৯ সালের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সাঈদ আহমদের নাটকটি ভুলরূপায়ণ হলেও, এর চিরায়ত প্রাসঙ্গিকতা আজকের দিনেও হারাবার কোনো অবকাশ থাকে না। কারণ, সাঈদের সেই নাটকটি কি কেবল 'পরিত্রাণের' ধারণার নিরিখেই অর্থবহ, নাকি এর আরো অর্থ খুঁজে নেয়া যায়? এমন কি পরিত্রাণ বিষয়ক সংশয়ের অ্যাবসার্ডবাদী উপস্থাপনার অন্য আরো অর্থ কি নির্মাণ করা যায় না? এ জন্যই সাঈদের নাটকে সংশ্লেষিত অ্যাবসার্ড রূপকল্পজনিত ভাবনার আদ্যোপান্ত জোরালোভাবেই তদন্তযোগ্য বিষয় হয়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে সাঈদ আহমদ সম্পর্কে জামিল আহমেদের বিশ্লেষণে প্রাপ্ত প্রথম অংশটিকে তুলনামূলকভাবে সাঈদের নাট্যতত্ত্বের অনুসন্ধানে অধিকতর প্রয়োজনীয় অনুচিন্তন বলে গ্রহণ করে আমরা ব্যবচ্ছেদ করব বেকেটিয় ধমনী কী ও এর থেকে প্রাপ্ত অ্যাবসার্ড ভিশনইবা কী। পাশাপাশি, সাঈদের নাটকে অ্যাবসার্ড ভিশন কীভাবে সংশ্লেষিত হয়েছে যার দরুণ নাট্যকার হিসেবে সাঈদের উদ্ভাবনশক্তি, আপাততের গন্ডি পেরিয়ে চিরায়তের দাবি মেটাতে লক্ষণযুক্ত কিনা সেটি তদন্ত করার পরেই কেবল নাট্যকার সাঈদ আহমদ সম্পর্কে বিচার-বিবেচনা সংবলিত একটি পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনা হাজির করা সম্ভবপর হতে পারে। এবং এই পর্যালোচনায় আমরা এ-ও নিরীক্ষা করার সুযোগ নেব যে, সময়ের গন্ডি পেরিয়ে চিরায়তের ভাবনা নিয়ে উড়ালের কথাও অ্যাবসার্ড ভিশন বলে কিনা। অতএব, সাঈদ সম্পর্কে বিদ্যমান মূল্যায়নের ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত সমালোচকদের বিরোধপূর্ণ ভাবনা আলোকপাত না করলে সাঈদ বিষয়ক বাহাস তার সামগ্রিকতা নিয়ে শাখা-প্রশাখা মেলতে পারবে না। ইতোমধ্যে প্রস্তাবিত সমালোচনা ও বিশ্লেষণের সূত্রে সাঈদের দ্বিতীয় নাটক 'মাইলপোস্ট' আলামতেই প্রথমে আমরা ময়নাতদন্ত চালাব। এ প্রয়োজনে আবারও 'সাঈদ আহমদ রচনাবলি'র সম্পাদক উপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক হাসনাত আবদুল হাইয়ের আলোচনা ধরে এগুনো যাক। হাসনাত অবগত করছেন, 'সাঈদ আহমদের দ্বিতীয় নাটক 'মাইলপোস্টে'র রচনাকাল ১৯৬২-১৯৬৪। নাটকে দুর্ভিক্ষের সময়ে কয়েকটি চরিত্রের সংলাপের এবং নূ্যনতম ঘটনার ভিত্তিতে দুর্ভিক্ষের করুণ চিত্র আঁকা হয়েছে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দার্শনিক মাত্রা যেখানে দুর্ভিক্ষকে দেখানো হয়েছে মানুষের আত্মার পতন হিসেবে। নাটকে সিদ্ধান্তহীনতার মানবিক অসহায়তা ফুটে উঠেছে।'১০ এই প্রসঙ্গে নাটকটির ভূমিকায় লেখা নাট্যকারের একটি মন্তব্যকে উপরোক্ত বক্তব্যের সমর্থনে হাসনাত উদ্ধৃতিও দিচ্ছেন, 'দুর্ভিক্ষ যে শুধু নিরন্নের হাহাকার নয়, মানবাত্মার সঙ্কটের তীব্র আর্তনাদও- এই তথ্য প্রকাশের তাগিদে 'মাইলপোস্ট' লেখা হয়।'১১ বক্তব্য কী, এর চেয়ে, বক্তব্যটি কীভাবে প্রকাশ পেয়েছে এই অনুসন্ধানের তাগিদ থেকে আমরা দেখব হাসনাত ও আতাউর রহমানের সিদ্ধান্ত থেকে প্রস্থান করে অন্য সিদ্ধান্ত হাজির করছেন জামিল আহমেদ। কারণ হাসনাতকে বলতে দেখছি, 'এটি অ্যাবসার্ড নাটক নয় যদিও সংলাপে কখনো কখনো তার আভাস পাওয়া যায়। একে বলা যায় আধুনিক মনস্তাত্ত্বিক নাটক।'১২ সম্পাদকের বক্তব্যেও প্রতি সমর্থন নাটকটির অনুবাদক আতাউর রহমানের বক্তব্যেও প্রতিধ্বনিত হয়- 'সাঈদ আহমদের নাটকের বিষয়বস্তু আন্তর্জাতিক বা বিশ্বজনীন কিছু নয়। তার নাটক বাংলাদেশের নিত্যসহচর তুফান, বন্যা ইত্যাদি সমস্যাকে নিয়েই। তবে তার উপস্থাপনা পদ্ধতি এবং বিষয়বস্তু থেকে নিয়ে নাটকীয় চরিত্রসমূহের ট্রিটমেন্ট ইত্যাদি সব ট্রাডিশনাল অর্থে প্রাচ্যের বা বাংলাদেশের নয়।'১৩ আতাউরের বক্তব্যের মধ্যেও নিহিত স্ববিরোধ সহজেই পাঠকের কাছে প্রতীয়মান হয়। একবার তিনি বলছেন সাঈদের নাটকের বিষয় 'বাংলাদেশের নিত্যসহচর সমস্যা', আবার একই বাক্যে বলছেন, এগুলো প্রচলিত অর্থে 'বাংলাদেশের নয়'। এর অর্থ হলো, সাঈদ আহমদের নাটকের বিষয়বস্তু ও উপস্থাপনারীতি তাদের বিশ্লেষণ থেকে সম্পূর্ণরূপে আহরণ করা যাচ্ছে না। তাহলে এই পর্যায়ে, সাঈদের নিজের বক্তব্যকেই আমার প্রস্তাব বিশ্লেষণের সপক্ষে দালিলিক সূত্র হিসেবে গ্রহণ করতে চাইবো। পাশাপাশি, এ-ও ভুলছি না যে, মিশেল ফুকোর 'হোয়াট ইজ অ্যান অথর' এবং রোলাঁ বার্থের 'দ্য ডেথ অফ দ্য অথর' থেকে সেই ভাবনাগুচ্ছ, যার মাধ্যমে আমরা অনুধাবন করতে পারি যে, [পাশ্চাত্যের] প্রচলিত চিন্তায় একজন রচয়িতাকে প্রাথমিক সূচনাকারী ও উদ্দেশ্যাবলীর পরিকল্পক হিসেবে সকল জ্ঞানের উৎস মনে করার বিষয়টি পরিহার্য। কারণ রচয়িতার এজেন্সি/চালিকাশক্তি কোনো নিজে নিজেই সন্নিহিত, উদ্দেশ্যমূলক ও নির্ণায়ক মনুষ্যকর্তা নয়, বরং মনুষ্য সত্তা হলো অনৈক্যবদ্ধ এক আপনসত্তা, যে আবার বিচিত্র মনোযৌন শর্তের উৎপাদমাত্র এবং সেই সত্তা এমনকি অজ্ঞান জবরদস্তির অনিয়ন্ত্রিত কার্যকলাপের কাছেও সমর্পিত।১৪ রোলাঁ বার্থকে প্রতিধ্বনিত করেও আওয়াজ তোলা যেতে পারে যে, লেখালেখি সর্বদা সামাজিক ও ভাবাদর্শিক মূল্যবোধগুলো দিয়ে ঠাসা থাকে, তাই ভাষা কখনোই নিষ্পাপ নয়।১৫ এই তর্কের সূত্রে তাই সাঈদের নাটকের নিবিড় পাঠে কেবল সাঈদকেই দোহাই মানছি না, ঠিক বর্তমান প্রসঙ্গের নিষ্পত্তির প্রয়োজনে বিশেষভাবে জামিল আহমেদ ও ক্ষেত্রবিশেষে বিপস্নব বালার দোহাই মেনে, এমনকি প্রয়োজনবোধে তাদের সাথে ইতোমধ্যে এ বিষয়ে সূচিত বিতর্ক অব্যাহত রাখার মাধ্যমে প্রস্তাব পর্যালোচনা করব। প্রথমেই নিরিখ করবো সাঈদের জবান কী অর্থ উৎপাদন করে? বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত 'এয়োনেস্কোর দুটি নাটক' শীর্ষক বইয়ের মুখবন্ধে সাঈদ আহমদ উলেস্নখ করেন- "অল্প সময়ের জন্য এয়োনেস্কোর সান্নিধ্য লাভের সুযোগ আমার হয়েছিল। ১৯৭৬ সালে ওয়াশিংটন ডিসির জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি তখন নাটকের ওপর ক্লাস নিচ্ছি- এ সময় তিনিও নাটকের ওপর বক্তৃতা দেবার জন্য আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে এসেছিলেন। দু'জনের দেখা হলে কফি খেতে খেতে একসময় জিজ্ঞাসা করেছিলাম, 'আর কিছু লিখছেন নাকি?' তিনি হেসে জবাব দিলেন, 'হ্যাঁ, কিছুদিনের মধ্যেই দেখতে পাবেন। তবে নাটকের শেষ পর্যন্ত বোধ হয় দু'জন দর্শকই উপস্থিত থাকবেন- আমি এবং আমার স্ত্রী।' আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল 'অ্যাবসার্ড'।' সাঈদ আহমদ মুখবন্ধটিতে আরো বলেন, 'এ ধরনের নাট্যকারদের কাজ- 'বাস্তব'-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। বাচনভঙ্গির সক্রিয়তা, চিন্তাধারার জটিলতা এবং জীবনবোধের অসংলগ্নতা দর্শককে আর এক দ্রাঘিমায় নিয়ে যায়।'

সাঈদ আহমদ নিজে যখন নাটক ও নাট্যকার সম্পর্কে আলোচনার অবতারণা করেছেন তখন লক্ষ্য করা যায় তিনি ‘নিরীক্ষা’কে তার সমালোচনা পদ্ধতির প্রধান মাপকাঠিতে পরিণত করেছেন। সে কারণেই মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ বা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর নাটকের মূল্যায়নে নিরীক্ষার মাধ্যমে সৃজিত নব্যতর শৈলীকে সাঈদ সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দিয়েছেন। ফলে, আমরা যখন এ কালে সাঈদের নাটক কিংবা নাট্যকার হিসেবে তার ড্রামাটার্জি বা নাট্যতত্তে¡র আলোচনায় অবতীর্ণ হবো তখন আমাদের ভুলে গেলে চলবে না এই ‘নিরীক্ষা’র প্রশ্নটি। ২০০৫ সালে ইংরেজি ‘দৈনিক নিউ এজ’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘মিটিং ইউজিন আয়োনেস্কো এট জর্জটাউন ড্রামা ফ্যাকাল্টি’ নামের লেখায় সাঈদ ড. মারফি নামে তার এক বন্ধুর মন্তব্যের উল্লেখ করেন। সাঈদের উপস্থিতিতে ড. মারফি আয়োনেস্কোকে বলেন, অ্যাবসার্ড আঙ্গিকের আধুনিক নাটকের রচনায় সে [সাঈদ] বাংলার মেটাফর নিয়ে কাজ করে। তাহলে একে কেবল বিপ্লব বালা কথিত ‘লোকরীতি’ বলাটাও সুবিবেচনা প্রসূত নয়।

১৯৯৩ সালের ২০ এপ্রিল সাপ্তাহিক কাগজে মুদ্রিত ‘এই শতকের নাটক’ নামের প্রবন্ধে সাঈদ যেমন ওয়ালীউল্লাহর প্রসঙ্গে বলছেন, ‘আধুনিক শিল্প চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি সম্পূর্ণ নতুন কায়দায় এই ধরনের নিরীক্ষাধর্মী নাটক লিখতে শুরু করলেন।’১৮ ওয়ালীউল্লাহর নাটক রচনার বংশপরম্পরায় নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করে সাঈদ নিজের নাটকের মূল্যায়ন করেছেন ওই ‘নিরীক্ষা’র প্রেক্ষিতেই- ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ যেমন বাংলা নাটকে সর্বপ্রথম অস্তিত্ববাদী চেতনা সংযোজন করেন আমিও তেমনি অ্যাবসার্ড বা অধিবাস্তব চেতনা আমার নাটকের মাধ্যমে সংযোজন করি। এই নাটকগুলো হচ্ছে- ‘কালবেলা’, ‘মাইলপোস্ট’ এবং ‘তৃষ্ণায়’। আমার নাটকে নায়ক কোনো মানুষ নয়, নায়ক হচ্ছে প্রকৃতি। ‘কালবেলা’ নাটক সাইক্লোনের ওপর লেখা, ‘মাইলপোস্ট’ দুর্ভিক্ষের ওপর লেখা এবং ‘তৃষ্ণায়’ নাটকটি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লেখা। এখানে প্রতীক অর্থে নেয়া হয়েছে শিয়াল এবং কুমিরের গল্প ও চরিত্র। শিয়াল কুমিরের সব বাচ্চা একে একে খেয়ে ফেলে, সেই পুরনো লোককাহিনীর ওপর ভিত্তি করে নাটকটি রচিত হলেও মূলত পাকিস্তান সামরিক শাসনের পটভ‚মিতে আমার এই নাটক রচিত ছিল।’

‘নিরীক্ষার’ মাধ্যমে ওই অ্যাবসার্ড ‘দ্রাঘিমায়’ নিজের নাটক স্থাপন করতে সতত ইচ্ছুক নাট্যকার সাঈদ আহমদ যখন বলছেন অ্যাবসার্ড ধারার নাট্যকারদের কাজ ‘বাস্তব’-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ’, তখন আমাদের এ বিষয়ে মনোনিবেশ করার প্রয়োজন আছে। এ জন্য, ১৯৬১ সালে আমেরিকা থেকে প্রথম প্রকাশিত মার্টিন এসলিনের ‘দ্য থিয়েটার অব দি অ্যাবসার্ড’ নামের বিখ্যাত বইয়ের শরণ নেব। এসলিন বলেছেন, ‘মানব দশার অ্যাবসার্ডিটির মধ্যে অধিবিদ্যাগত তীব্র মনঃকষ্টের বোধই হলো সাধারণভাবে বেকেট, অ্যাডামভ, আয়োনেস্কো, জেনে ও অন্যান্য লেখকদের নাটকের বিষয়’২০। এসলিন অস্তিত্ববাদী থিয়েটারের সাথে অ্যাবসার্ড থিয়েটারের ফারাক খুঁজতে খোলাশা করে বলছেন, ‘অ্যাবসার্ড থিয়েটার মানবদশার অর্থহীনতার অর্থ ব্যক্ত করতেই সচেষ্ট হয়’, পাশাপাশি এটি ‘যুক্তিবাদী পন্থা ও যুক্তিশৃঙ্খলভিত্তিক চিন্তার ধারাকেও খোলাখুলিভাবেই বর্জন করে।’ ( অংশ বিশেষ)

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে