'সাধ মিটেছে? সাধ কি মিটবার?' -মাথার ভিতর গানের কলির মতো গুনগুন করে এ দুই চরণ। সেই কবে সে পড়েছিল বইটা। হয়তো কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়াকালে। আজ এতো বছর পরও যেন সেই দৃশ্যকল্প মানস চোখে ভাসে। বন বিভাগের কিছুটা বন্যতা মাখা চেহারার কর্মকর্তা। কী নাম ছিল তার? -মনে নেই। মনে নেই বইটার নামও। লেখক যেন কে? বুদ্ধদেব বসু না গুহ? না অন্য কেউ? তবে ভারতীয় লেখক এটা ঠিক মনে আছে। স্থান মণিপুর বা নাগাল্যান্ডের জঙ্গল। ইম্ফল, কোহিমা নামগুলো তো বেশ মনে আছে। এসব অঞ্চলের জঙ্গলের কোনো শুকনো ডোবা না কুয়ার ভেতরে রাশিকৃত শুকনো পাতার শয্যায় উত্তপ্ত ও আবেশিত প্রথম মিলন শেষে নায়িকা শুধিয়েছিল, সাধ মিটেছে?...আহ্! গল্পটা চুপচাপ শুনল অমিয়, যেমন শোনে সবসময়। কোনো প্রতিক্রিয়া শুনতে না চেয়ে আলটপকা প্রশ্ন করে রুচিতা, আচ্ছা অমিয়, আমাদের সমাজ কতটা ভন্ডামিবান্ধব তা ভেবে দেখেছ কখনো? যেমন? যেমন! তুমি পাল্টা প্রশ্ন করছ, যেমন! তার মানে তুমি ভাবনি। তুমি এ সমাজ নিয়ে ভাব না? ভাবি। আমার মতো করে ভাবি। তুমি কিভাবে ভাবছ, এর কোনো ভন্ডামি নিয়ে এখন চিন্তা করছ, তা বুঝতে প্রশ্ন করেছি। দেখ, এই সমাজে 'সত্যনিষ্ঠা' শব্দটা এখন পুরো অচল। তুমি যদি সত্যকে আঁকড়ে ধরে এখানে কিছু করতে চাও, তা যদি কারও কোনো ক্ষতি নাও করে, তবু তুমি তা করতে পারবে না। সমাজ তোমাকে তার সংস্কারের বাইরে কিছু করতে দেবে না। হোক সে সংস্কার বাসি-পচা, ব্যক্তিজীবনের পক্ষে অহিতকর, এমনকি অপমানকর। অমিয় চুপ থাকে। ইয়ারফোন কানে একটু ভালো করে গুঁজে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে। সে জানে যে এখন পনেরো-বিশ মিনিট একাই বলে চলবে রুচিতা। অমিয় এ সময় হুঁ-হাঁ না করলেও চলবে। নেটওয়ার্ক ভালো থাকলে একটানা অনেকক্ষণ বলে একটু থামবে রুচিতা। তারপর উপসংহার টানার ভূমিকায় বলবে, যে কারণে এতক্ষণ বক্তৃতা করে তোমার কান টনটনিয়ে দিলাম তা এই যে...। এই বাচাল মেয়েটাকে অমিয় ভালোবাসে। এতটাই বাসে যে বদলির চিঠি হাতে পেয়ে 'নাইক্ষ্যংছড়ি' শব্দটার দিকে সে কতক্ষণ যে চেয়েছিল নির্বোধ-শূন্য চোখে! তারপর দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে কখন যে দুচোখ উপচে গড়িয়ে পড়েছিল অশ্রু! চিঠিটা হাতে টলমল পায়ে সে বেরিয়ে গিয়েছিল অফিসের বাইরে। তারপর বদলি ঠেকানোর নানা ফিকিরে দুসপ্তাহ পার করে এই দুই দিন হলো নাইক্ষ্যংছড়ির মতো শান্ত-সুন্দর- জনবিরল-দুর্গম স্থানে এসেছে সে। অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় রুচিতার সঙ্গে এমন স্থানে ভ্রমণের ইচ্ছেয় কদিন আগেও আনচান করত মন। রুচিতা, রুচিতা বড়ই ভালোবাসে বেড়াতে। রুচিতাকে নিয়ে এমন পাহাড়-জঙ্গলে রাত কাটানোর, দিনে হাত ধরে ঘুরবার রোমাঞ্চকর ইচ্ছেগুলোকে কতকাল ধরে যে বাক্সবন্দি করে রাখতে হচ্ছে! অমিয়! বলো সোনা, আমি শুনছি। আমি ওই গল্পটা নিয়ে এই দুদিন হয় ভাবছি। কেন? মনে হচ্ছে এখান থেকে আমি গল্পটাকে আমার মতো করে সাজাই। বেশ তো। সাজাও। কিন্তু এ দুদিনে তোমার মাথায় এই গল্পটা কেন এতো ভর করেছে? আমি পাহাড়ে এসেছি বলে? এবং আমি আর তোমার গল্পের নায়ক একই ডিপার্টমেন্টে চাকরি করি বলে? হয়তো। সোনা, তুমি ভালো করেই জান যে এ পৃথিবীতে এমন কোনো নারী নেই... হয়েছে, হয়েছে। আমি কখনোই অমন ভাবছি না যে তুমি বনে-জঙ্গলে শুকনো পাতার শয্যায়...। তাছাড়া ইম্ফল-কোহিমার জঙ্গলের মতো ঘন জঙ্গল কি আর তোমরা এদেশে রেখেছ? আফটার অল, বন খেকো প্রজাতি... এই এই, ডিপার্টমেন্ট নিয়ে মন্দ কথা বলো না পিস্নজ। এমনিতেই মনে হচ্ছে চাকরি-বাকরির গুষ্ঠি কিলিয়ে তোমার কাছে ছুটে যাই... ওই মনে হওয়া পর্যন্তই। বেশ জান যে চাকরিটা করা ছাড়া অন্য কিছু করার উপায় আপাতত তোমার নেই। বৌ-বাচ্চার ভরণ-পোষণের দায় যার কাঁধে তার রোমান্টিসিজমের সীমা আছে। তুমি ফের নিষ্ঠুরের মতো... আমি তো নিষ্ঠুরই। এবার এই নিষ্ঠুররচিত গল্পাংশটুকু দয়া করে মন দিয়ে শোন। বেশ, বলো। নায়ক-নায়িকা উভয়ে ঘরে ফেরে। ঘর বলতে নায়ক থেকে যায় তার কর্মস্থলে, নায়িকা ফেরে সভ্য শহরে। অবশ্য সেই দিনেই নয়। আরও কটা দিন নায়িকা ছিল সেই জঙ্গলের রেস্ট হাউসে। ইচ্ছে করে আর দেখা করেনি নায়কের সঙ্গে। তবে যদি ফের দেখা হয়, এই আশা ও আশঙ্কার দোলায় দুলতে দুলতে পুরোপুরি দোদুল্যমান কটা দিন-রাত মাতালের মতো পার করে সে ফিরেছিল তার শহরে, তার ঘরে। ঘরে ফিরে কয়েকটা দিন কাটে এক অদ্ভুত অবসাদভরে। কেন এমন ঘটল? কেন এক প্রায় অপরিচিত মানুষকে এতো অল্প কটা দিনের পরিচয়ে সে...? দেহ-মন কেন হঠাৎ অমন বুভুক্ষু-তৃষিতের মতন...? ইস্ট্রোজেন-প্রজেস্টরেনের খেলা? কেবলই তাই? আর তার? শুধু দুর্দম টেস্টস্টেরনের অদম্য প্রবাহই কি তাকে টেনে এনেছিল ইস্ট্রোজেনের মোহনায়? জানা নেই, জানা হয়নি। কার্যকারণ, ফলাফল, ভূত-ভবিষ্যৎ চুলচেরা বিশ্লেষণের সময় তখন কোথায়? দেহ ছাড়া তার মনটাকে তো একটু বোঝার চেষ্টাও হয়নি। মন বোঝার মগজ তখন কই? চারপাশের বন্য প্রকৃতির মাঝে শক্ত কাঠামোয় দীর্ঘদেহী লোমশ পুরুষের চোখে মাদকতাময় বুনো চাহনি, শরীর জুড়ে মহুয়ার সুবাস আর কী অনির্বচনীয় জাদুর ফলাফল ছিল ওই পর্ণশয্যা!
দিনগুলো কাটতে থাকে। স্মার্ট পিলের যুগ সেটা নয়। কাজেই অনিরাপদ সঙ্গমের পর নায়িকার দিনরাতগুলো কাটতে থাকে চাপা টেনশনে। তিন সপ্তাহ অপেক্ষার কালÑ একেকটা দিনকে মনে হয় বছর...
তুমি কি নায়িকাকে গর্ভবতী করতে চাও? অমিয় ফুটকাটা স্বরে হেসে বলে।
করলে কেমন হয় বলো তো? শহুরে-শিক্ষিত-অবিবাহিত মেয়ে। বন-জঙ্গলে বেড়াতে এসে কোন বনরক্ষকের দ্বারা কুমারী মা হতে চললে ঘটনা কেমন হয়...
এটা খুব ক্লিশে একটা ব্যাপার রুচিতা। বহু সিনেমা-গল্প-উপন্যাসেই এমন দেখানো হয়। এরপর নায়ক কী করে তাও খানিকটা গৎবাঁধা।
নায়ক পালায়। তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। পেলেও সে দায়িত্ব অস্বীকার করে।
তোমরা যারা গল্প-উপন্যাস লিখিয়ে তারা সচরাচর এভাবেই লেখো। কিন্তু এমন কি হয় না যে নায়ক পিতৃত্ব স্বীকার করে নায়িকাকে নিয়ে সংসার পাতে?
নায়করা এতো সহজ হয় না অমিয়। এসব কেসে সংসার পাতার ঘটনাটা সাধারণত পরিবার-সমাজের চাপে হয়। আসলে আচমকা নাজিল হওয়া পিতৃত্বকে কোনো পুরুষই স্বাগতম জানাতে পারে না। আচমকা মাতৃত্বকেই কি মেয়েরা মানতে পারে? মেয়েদের মানতে হয়, কারণ ব্যাপারটা তার শরীরের। পালিয়ে নিষ্কৃতি পাওয়ার উপায় থাকে না বলেই মেয়েরা যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়।
তার মানে তোমার নায়িকা গর্ভবতী হয়ে মামুলি পরিচিত নায়কের কাছে মাতৃত্বের স্বীকৃতির দাবি নিয়ে হাজির?
এমন ঘটলে তাই তো হওয়ার কথা। ঘটনা দুজনে মিলে ঘটিয়েছে। মেয়েটা একা বিপদে পড়বে কেন?
এখন তোমার নায়ক যদি ভিলেন স্বভাবের হয় তাহলে তো সে পালাবে। তখন কি মেয়েটা গর্ভপাত করবে?
নায়ককে বশে আনতে না পারলে মেয়েটার সামনে আর কী পথই বা খোলা থাকে?
গল্পটা বড্ড বেশি সেকেলে আর গতানুগতিক হয়ে যায় না রুচি? এমন একটা গল্প লিখতে তোমার অরুচি হবে না?
অরুচি কী বলছ? রীতিমতো বমি পায়। এজন্যই তো আমি প্রেমের গল্প লিখতে পারি না।
তা কেন? সরল প্রেমের গল্প লেখ। যেখানে নায়ক-নায়িকা কেউ কাউকে ঠকায় না।
‘অতঃপর তাহারা সুখে-শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল’ টাইপ গল্প তো আমার আরও আসে না। জীবন কি এতো সহজ অমিয়? প্রেম কি এতো সরল হয় কখনো?
অমিয় চুপ থাকে। জানে, এখন তর্ক করা মানে রুচিতার ব্যথার জায়গাগুলোকে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করা। পারতপক্ষে অমিয় রুচিতাকে আহত করতে চায় না। জাগতিক সব ব্যথা-বেদনার ঊর্ধেŸ রুচিতাকে তুলে রাখতে চাওয়ার যে বাসনা তার আছে এটাকেই তীব্র ভালোবাসা বলে সে মনে করে। যদিও এ বিষয়ে রুচিতা একমত হয় না কখনো। তার এক কথা, তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কটাই তো এক টনটনে ব্যথা। এটাকে ব্যথা-বেদনার ঊর্ধেŸ বলে তুমি কী করে ভাব?
অমিয় জানে কথার পিঠে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। শেষ কথাটা সব সময় রুচিতাই বলবে, বলে থাকে। অমিয় বিবাহিত, সন্তানের জনক। রুচিতাও অন্যের ঘরনী, জননী। রুচিতার মতে, দায়িত্ববান স্বামী ও পিতা অমিয় যে রুচিতা বলতে দিওয়ানাÑ এটা ¯্রফে একটা ভান বা খেয়াল। আর এই খেয়ালটাকে অমিয় পেলে-পুষে বড় করতে পারছে কারণ এতে তার প্রিয়জনদের কোনো স্বার্থহানির ব্যাপার নেই। অমিয় এসব কথায় দুঃখ পায়। কিন্তু মনে মনে এটা স্বীকার না করে পারে না যে রুচিতার মতো আত্মনির্ভরশীল অহঙ্কারী মেয়ে তার প্রেমিকা না হয়ে হতো যদি কোনো নরম-শরম কলাবতী তবে অ্যাদ্দিনে সুলতার কপালে দুঃখ ছিল অনিবার্য। রুচিতা অমিয়কে যতখানি ভালোবাসে ততখানি আর কোনো মেয়ে বাসলে অমিয়র ঘর-সংসারের সামাজিক কাঠামো এতো সুন্দর চেহারা নিয়ে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত না।
আমার প্রথম প্রেমিকের বিষয়ে তুমি তো জান অমিয়। খুব নামকরা ছাত্র ছিল বলে তাকে আমি মনে মনে কী সম্মানটাই না করতাম। নিজেকে তার অযোগ্য ভেবে হীনম্মন্যতায় ভোগার পাশাপাশি তার ব্যাপারে এক দারুণ গৌরববোধ আমাকে সবসময় আচ্ছন্ন করে থাকত। অথচ একদিনের একটা কথায় আমার মনের চোখ থেকে মায়াপর্দাটা কেমন ছিঁড়ে গেল!
অমিয় অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করে। প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার জন্য সে কথা খুঁজতে থাকে। সে জানে যে এখন একটা করুণ রসের গল্প হৃদয়ের সবটুকু করুণা ঢেলে বলে চলবে রুচিতা। বলতে বলতে তার চোখ ভিজে যাবে, কণ্ঠ বাস্পাকুল হবে। গলায় জমাট বাঁধা কান্নাকে সে বহুকষ্টে গিলে ফেলবে। তবে কাছে থাকলে অমিয় তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে সে অমিয়র কাঁধে মাথা রেখে নিঃশব্দে কেঁদে ভাসাত।
এই আবেগতাড়িত মিষ্টি অথচ কঠোর মেয়েটাকে অমিয় ভালোবাসে। কতটা যে ভালোবাসে তা ঠিক নিজেও বুঝতে পারে না, দয়িতাকেও বোঝাতে পারে না। শুধু এটুকু বোঝে যে এটা সেই ভালোবাসা যা বাসবার জন্য তার হৃদয়টা ব্যাকুল ছিল আযৌবন। কেবল ভালোবাসা পাওয়া নয়, ভালোবাসা দেয়ার জন্যও মানুষের অন্তর কাঙ্গালের মতো ভালোবাসাযোগ্য আধারটাকে খুঁজে বেড়ায়। সময়ের আগেই যারা তেমন কাউকে পেয়ে যায় তারা অনেকেই সেই ইপ্সিতকে সারাজীবনের তরে ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। যারা পরিণত যৌবনে পায় এবং কাক্সিক্ষতকে আপনার করার সুযোগ যাদের ঘটে তারা কেউ কেউ সুখী হয়, কারও কারও হয় দিল্লিকা লাড্ডু ভক্ষকের দশা। তবু তো তারা খেয়েই পস্তায়। কিন্তু সবচেয়ে খারাপ দশা হয় তাদের, যারা যৌবনের শেষপ্রান্তে এসে এতকালের মানসলোকের কল্পমূর্তিকে বাস্তবলোকে আবিষ্কার করে। ‘সময়ে কেন তোমার দেখা পেলাম না’ বলে আফসোস করে তীব্র আবেগে ভালোবাসার চেয়ে বেশি কিছু এদের খুব কম জনাই করতে পারে। তবে যারা সাহসী ও একরোখা, যারা তিক্ত-কঠিন কর্তব্যকে অবশ্যকর্তব্য না ভেবে নিজের ভালোলাগার চাহিদাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার ক্ষমতা রাখে পরিবার-সমাজের কাকুতি-মিনতি রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে; যাদের জীবনের পুরোটাই যৌবনÑ তারাই পারে কাজের কাজটা করতে।
অমিয় জানে যে এই ‘কাজের কাজ’ করার যোগ্য পুরুষ সে নয়। রুচিতাও কি তেমন নারী? দয়িতের টানে সংসার ভাসিয়ে দয়িতের হাত ধরে নতুন কোনো দ্বীপে ঘর বাঁধার সাহস কি আদৌ আছে রুচিতার? আর অমিয়ও কি তা চায়?
কী চাও, অমিয়? কী চাও? আমি চিরদিন এমনি করে তোমার ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকি এই কি তোমার চাওয়া? কিন্তু এমন চাওয়া তো আরও কত পুরুষেই চায়। ধর্ম ও আইনের সীল-ছাপ্পর মারা, সাইনবোর্ড আঁটা সম্পর্কটাকে বেশ যতেœ জিইয়ে রেখে একটা কালো পর্দা ঢাকা ‘অতিরিক্ত’ সম্পর্ককে অনেকেই আবশ্যকীয়ভাবে এবং যাঞ্চা করে। তোমার এই অভিলাষে তো অভিনবত্ব কিছু নেই।
অভিনবত্ব না থাক, অস্বাভাবিকতাও নেই রুচিতা। ছকে আঁটা জীবনের ফ্রেমটাকে মানুষ হয়তো ছকেই রেখে দেয়, কিন্তু যা ফ্রেমে আঁটবার নয়, তা মানুষ কেমন করে ছকবদ্ধ করে রাখতে পারে?
তাহলে আর পাঁচজনের মতো তোমারও একই বাসনাÑ ছকে বাঁধা জীবনযাপন করে মাঝেমধ্যে ছকের বাইরে শরীর ও মনটাতে ফুরফুরে হাওয়া খেলিয়ে নেওয়া।
শরীর! অমিয় ঠোঁট মোচড়ায়।
কেন, তা কি উদ্দীষ্ট নয়?
কেন নয়? কিন্তু শুধুই কি সেটা?
শুধু শরীর নয় জানি, মিষ্টি মনযুক্ত মায়াবী শরীর। আহা!
রুচি, প্লিজ, অমন করে খুঁচিও না বলছি।
লাগে?
অভ্যাসবশে কাঁধ ঝাঁকায় অমিয়। আর অমনি তার মনে হয় তার এই দেহভাষ রুচিতা খুব পছন্দ করে। কথা কম বলে চোখের ইঙ্গিত বা দেহের কোনো মুভমেন্ট দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়ার যে ব্যাপার তা অমিয়র এতটাই সহজাত যে ব্যাপারটায় চোখে লাগার মতো কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। বরং এটা তার ব্যক্তিত্বে আলাদা মাত্রা যুক্ত করে তাকে করে তুলেছে রীতিমতো নারী আকর্ষী।
নারীদের আকৃষ্ট করার কায়দা-কানুন অমিয়র বেশ রপ্ত। সে এটা খুব ভালো জানে যে মেয়েরা আসলে পুরুষের কাছে কী চায়। অর্থ নয়, বিত্ত নয়, যশ-খ্যাতির মোহ তো নয়ই, কোন সে অনির্বচনীয় যার গোপন তপস্যা মেয়েদের আযৌবন তা যে পুরুষ জানে মেয়েরা তার বশীভূত হয় আপনা থেকে। মেয়েদের দুর্ভাগ্যÑ একে তো এমন পুরুষ জগতে কম, তার ওপর ব্যাটে-বলে মিল করার দিকে জগৎপিতার আগ্রহ আরও কম। কাজেই লাখে একটা জোড়ায় হয়তো জোড়ে জোড়ে ঠিকঠাক মেলে। রুচিতার মনে হয়, তেমন মিল তার ঘটেছে অমিয়র সঙ্গে। আর অমিয় বলে, তারা আসলে একে অপরের জন্যই সৃষ্টি। অথচ এমন স্বার্থক জুটির সামাজিক পরিচয় এমনই খাপছাড়া যে তাদের মেলার সম্ভাবনা দিগন্তের কোনে কোনে একটুখানি সোনালি রেখার মতোও দৃষ্ট হয় না। অমিয় ব্রাহ্মণ, রুচিতা ক্যাথলিক খ্রিষ্টান। উভয়েই সন্তানের পিতা-মাতা, উভয়েরই ধর্মত-আইনত জীবনসঙ্গী সাড়ম্বরে বিদ্যমান।
রুচি, আমার রুচি, আমার রুচি।
আর সোহাগ করতে হবে না। বলে ফেল।
আমাকে তুমি এভাবেই ভালোবাসবে চিরদিন?
চিরদিনটা কতদিন অমিয়?
যতদিন আমরা বেঁচে আছি।
আমরা কি একই দিনে মারা যাব?
তা কী করে বলি! তবে তুমি মারা গেলে আমি হয়তো সেদিন সুইসাইড করব।
হয়তো কেন? নিশ্চয় নয় কেন?
মরা-বাঁচার কথা কি আর নিশ্চিত করে বলা যায়? দেখা গেল আমি মরতে চেয়েও মরতে পারলাম না।
কেন? কিসে আটকাবে?
আমার বন্ধু সালেহকে চেন না? ওই যে লম্বা-ফর্সা, তুমি বলেছিলে কাশ্মিরী চেহারা...
হ্যাঁ, চিনেছি, বল।
সে তখন অনার্সে পড়ে। ওই সময় আমার সঙ্গে তার তেমন যোগাযোগ ছিল না। ও আনন্দমোহনে ভর্তি হয়েছিল ঢাবিতে চান্স না পেয়ে। একটা মেয়েকে ভালোবেসেছিল। দুই পরিবার ঘোরবিরোধী হওয়ায় একদিন দুইজন মিলে বিষ খেল।
অ্যা! বলো কী! এও হয়?
হবে না কেন? পত্রিকায় এমন খবর আমাদের সময়ে বছরে দু’চারটে আসত। তবে সালেহর ব্যাপারটা কেচে গেল।
কী রকম?
গোঙ্গানির আওয়াজ পেয়ে দরজা ভেঙে দু’জনকেই নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালে। ওয়াশ করা হলো। সালেহা বেঁচে গেল।
আর মেয়েটা?
বুঝতেই পারছ।
তারপর?
তার আর পর কী! সালেহ এখন ধর্মের ষাঁড় হয়ে দিব্যি চরে বেড়ায়। শুনেছি কবিতা লেখে।
একটা দীর্ঘশ^াস ত্যাগ করে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে রুচিতা। অমিয়ও হঠাৎ গল্পটা বলে ফেলে কেমন ¤্রয়িমাণ হয়ে পড়ে।
রুচি!
বলো।
আমরা একসঙ্গে মরেও কোনো লাভ নেই। ধর্মমতে তোমার সমাধি হবে, এপিটাফ থাকবে। আমাকে পুড়িয়ে ছাইভষ্ম গঙ্গায় ঢেলে পঞ্চভ‚তে বিলীন করে দেবে।
তাতে কী? আত্মা তো আর কেউ পোড়াতে পারবে না। আমার কী মনে হয় জান? মরার পর আমরা একসঙ্গে থাকতে পারব।
তোমার-আমার ধর্ম সে কথা বলে না রুচি। তাছাড়া আমি আত্মায় বিশ^াস করি না।
বাদ দাও তো ধর্ম। আর তোমার আত্মায় বিশ^াস না থাকলেও আমার কিন্তু আছে। আমি আমার মন থেকে যে ঈশ^রকে বিশ^াস করি তিনি অত নিষ্ঠুর সংকীর্ণমনা নন।
তোমার মনসিজ ঈশ^র তাহলে বেশ প্রেমময় পুরুষ।
পুরুষ কেন? নারী নয় কেন?
পৃথিবীর মতো এডেনেও তুমি নারীবাদের জয় দেখতে চাও?
বাদসাধ বুঝি না। আমি নারীকে সর্বত্র সর্বময় ক্ষমতায় দেখতে চাই। গত কয়েক হাজার বছর ধরে যে সুবিধাটা তোমরা ভোগ করে আসছ আমি সেই সুবিধায় নারীকে দেখতে চাই।
আর পুরুষকে দেখতে চাও আজকের নারীর জায়গাতে?
হুম।
কেন এমন প্রতিশোধমূলক চিন্তা করছ রুচি? মানবিক মন থেকে চাইলে সমতা চাইবে।
দেখ, মেয়েদের অবস্থায় নিজেদের তোমরা ভাবতে পর্যন্ত পার না। অথচ আমাদের এই জীবনকে তোমরা ভাব স্বাভাবিক।
আমি তা ভাবি না রুচি। পরিস্থিতি বদলানো খুবই দরকার। বদলাচ্ছেও। খুব ধীরে হলেও মানুষের মনে বদল আসছে।
বদলের গতিমুখ আমি উল্টো দিকে দেখছি অমিয়। আমার দাদি হাঁটু অবধি ঝুলের স্কার্ট পরে গীর্জায় যেতেন। আমার মা পরতের ¯িøভলেস বøাউজের সঙ্গে শাড়ি। আর আমি পরছি ফুল ¯িøভ লংকামিজ, সালোয়ার, ওড়না।
কেন? তুমি প্যান্ট-শার্ট পরলেই বা আটকাচ্ছে কে?
তোমরা। জিন্স-টিশার্ট পরা নিয়ে কত কাÐ ঘটে গেল দেখনি?
পোশাক নিয়ে বুলিং সব দেশে বা সমাজেই কম-বেশি হয় রুচি। ইউরোপে যখন কোনো মেয়ের স্কার্ফ পরার স্বাধীনতা হরণ করা হয় তখন সেটা আমার কাছে অন্যায্য মনে হয়। আর পোশাকের দৈর্ঘ্য-প্রস্থের কম-বেশি দিয়ে প্রগতির মাপজোখ খুবই হাস্যকর। বরং আর পাঁচটা বিষয়ের মতো পোশাক পরার স্বাধীনতাকে তুমি প্রগতি পরিমাপের একটি একক ভাবতে পার।
সেটা মন্দ বলনি। কিন্তু আবহাওয়া ও সঙ্গতির সঙ্গে পোশাকের আকার-আয়তন ও মানের সম্পর্ক আছে। বর্তমানে অবশ্য এর সঙ্গে ফ্যাশনেরও সম্পর্ক আছে। তারপর এসব সম্পর্কগুলো একসময় দাঁড়িয়ে যায় সংস্কৃতিতে।
আমরা কিন্তু আমাদের আসল গল্প ছেড়ে বহুদূরে চলে এসেছি।
আর সে গল্পে ফিরে কাজ নেই। তুমি বরং আমাকে বল, এ পৃথিবী নারীশাসিত হলে তার রূপ কেমন হবে বলে তোমার মনে হয়?
শাসকরা যদি তোমার মতো হন, তবে এ পৃথিবী হবে প্রেমপূর্ণ। আর তারা যদি হন পুরুষতন্ত্রে লালিত-পালিত-জারিত আজকের নারী শাসকদের মতোই, অর্থাৎ তারা যদি রক্তে বহন করেন পুরুষতান্ত্রিক সিস্টেমের উত্তরাধিকার, তবে পৃথিবী হয়ে উঠবে আরও ভয়ংকর।
কেন?
অনুকরণপ্রবন ও দুর্বলের শাসন ভয়ংকর হয় সোনা।