১. রেণুপোনা ধরার মৌসুমে ঘরে কেউ থাকে না। নদীর তীরবর্তী গাঁয়ে সবাই তখন নেমে পড়ে নদীর দু'বাহুর নিচে, পথের দু'পাশে সরু খালে। ভাটার সময় যখন পানিতে টান পড়ে তখন বিড়বিড় করে কাঁপতে থাকা পোনার ঝাঁক চোখে পড়ে। সবাই টিনের বাসন, হাঁড়িতে যতটুকু পারা যায় ধরতে থাকে গলদা চিংড়ির পোনাগুলোকে। মেঘলা আকাশে মেঘের গম্ভীর গর্জনে জলাভূমির ছোটো ছোটো কৈ মাছগুলো লাফিয়ে ওঠে আসতে থাকে ওপরে। তখন পোনাগুলোর ছোটাছুটি বেড়ে যায়। কেউ কেউ নিষেধ সত্ত্বেও জাল মশারি বা চাদর দিয়ে ঠিকই ধরে ফেলে তিড়িংতিড়িং লাফানো পোনাগুলোকে। সিধুদাস খুব ভোরে বেরিয়ে পড়ে। কাঁধে জাল। ঘর থেকে বেরিয়ে এই নদীর ধার। প্রথমেই চোখে পড়ে একটি ছোট্ট স্কুল। স্কুল বলতে যা বুঝায় এটি ঠিক তা নয়। গোলপাতার একটি ঘর। জেলেপলস্নীর লোকজনে কোনোমতে তৈরি করে নিয়েছে সেটি। মাঝে মাঝে কোনো এক এনজিও থেকে বই খাতা দেওয়া হয়। এভাবেই চলছে স্কুলটি। মধুবালা বড় হয়ে উঠেছে এই জেলেপলস্নীতে। সবে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেছে সে। নিজে থেকেই আগ্রহ নিয়ে এসেছে, পলস্নীর হাড়-হাভাতে পরিবারের বাচ্চাগুলোকে পড়াবে বলে। কাছাকাছি কোনো বড় ইস্কুল নেই। আশপাশের ঘরগুলোর সব ছেলেপুলেই এই ছোট্ট, গোলপাতার তৈরি স্কুলে এসে পড়ে। প্রতিদিন সকালে কিছু সময়ের জন্য শিশুকণ্ঠের কিচিরমিচির শব্দে নদী তীর সচকিত হয়ে ওঠে। সিধু দাস যখন আশপাশে থাকে, কান পেতে শোনে শিশুকণ্ঠের কলকাকলি। তার ভালো লাগে। কেন লাগে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। দ্রম্নত পা চালিয়ে সে এগোয় হানিফ মহাজনের কাচারি ঘরের দিকে।
২. খিলখিল করে হাসছে মধুবালা। এই মানুষটাকে দেখলেই তার হাসি পায়। কালো ছিপছিপে শরীর। ডোরাকাটা লাল হলুদ একটি গেঞ্জি গায়ে। পরনে সবুজ লুঙ্গি। শুকনো তামাটে দুটো হাত। লুঙ্গিটি পায়ের গোড়ালি থেকেই একটু উঁচু করে বাঁধা। ডোরাকাটা গেঞ্জি আর সবুজ লুঙ্গিপরা ছিপছিপ গড়নের সিধুকে কারোর চোখে পড়ার কথা নয়। কিন্তু মধুবালার চোখে পড়েছে। সেটি তার পোশাকের গাঢ় রঙের কারণে নয়। বরং তার ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল আর টানা মেয়েলি চোখ সিধুকে অন্যদের থেকে একেবারে আলাদা করে দিয়েছে। জেলেপলস্নীর পুরুষগুলো কি কারণে যেন সবকিছুর ওপর, সবার ওপর রেগে থাকে। কথায় কথায় খিস্তি আর সবকিছুর ওপর চরম বিরক্তি। মাছধরার মৌসুম যত কাছে আসে পালস্না দিয়ে তাদের মেজাজ চড়তে থাকে। কিন্তু সিধু তেমন নয়। তার চোখের দৃষ্টি নরম, কণ্ঠ অনুচ্চ। অপরদিকে মধুবালা উচ্ছল, প্রাণবন্ত। এই এলাকার মানুষজনের তুলনায় তার গায়ের রঙ ফরসা। সে কারণে সে কিছুটা অহংকারীও বটে। তবে সিধুদাস কাছে এলে তার ভালো লাগে। সিধু দাসের গায়ে নদীর ঘ্রাণ। বাতাসের গন্ধ। তার লম্বা চুলে নদীর খোলা বাতাস। মধুবালার মন চায় হাত দিয়ে তার কপালের চুল নিয়ে খেলা করে, তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মধুবালার হাসির কারণ অবশ্য ভিন্ন। গতরাতে বৃষ্টি হয়েছিল। পথে কাঁচা এটেল মাটির পথ। বৃষ্টির পর জায়গায় জায়গায় এখনো পানি জমে আছে। সম্ভবত তার কোনো একটি গর্তে সিধুর পা পড়েছে। তারপর সে হোঁচট খেয়ে ঝপাং করে গড়িয়ে পড়েছে পাশের খালে। ফলে কাদামাটিতে মাখামাখি হয়ে সিধুদাস যখন ওঠে দাঁড়িয়েছে তখন তাকে চেনার উপায় নেই। মধুবালা তাই হাসি চেপে রাখতে পারেনি। একটু দূরে দাঁড়ালেও হাসির শব্দ সিধুদাসের ঠিক কানে যায়। রেগে গিয়ে দপদপিয়ে হাঁটতে গিয়ে আবারও মাটিতে পড়ে যায় সে। তাতে মধুবালার হাসির গমক আরও বাড়ে। কাঁধ থেকে ছিটকে পড়া জাল মাটি থেকে কুড়িয়ে নেয় সিধু। কোনো দিকে না তাকিয়ে আবারও হাঁটা দেয়। এবার ঘাট বরাবর। গা ধুয়ে নিতে হবে। এ অবস্থায় মহাজনের বাড়ি যাওয়া চলবে না। মধুবালা ডেকে ওঠে, ও রসিক, শুনতিছ? সিধুকে রসিক বলে সম্বোধন করে মধুবালা। কিন্তু এ মুহূর্তে মধুবালার মুখে রসিক ডাক মোটেও শ্রম্নতিমধুর ঠেকে না সিধুর কাছে। সে পেছনে না তাকিয়ে হন হন করে এগিয়ে যায় সামনে। পেছনে মধুবালার হাসির তোড়ে সিধুর কান ঝাঁঝা করতে থাকে। পশ্চিম সুন্দরবনের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে নদী খোলপেটুয়া। এটি আরও বড় হয়ে মিলেছে কপোতাক্ষের সঙ্গে। ওপারে কালিন্দী। দূরে সমুদ্রের নোনা বাতাসের ঝাপটা। মাঝে মাঝে তার ঝাপটা এসে পড়ে হরিনগর জেলেপাড়ার গায়ে। এখন জোয়ারের সময়। এই সময়টায় একটু কান পাতলেই শোনা যায় নদীর বিপুল জলরাশির ঢেউয়ের গমক। এ সময় জেলেপাড়ার ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া সরু খালগুলোর ভেতরে সেই জলরাশি ঢুকে পড়ে। এ পাড়ায় অন্তত ৪০-৫০ ঘর জেলে পরিবার রয়েছে। সিধু জানে সে যে কদিন এ পাড়ায় থাকবে, মধুবালার হাত থেকে তার নিস্তার নেই। হাঁটতে হাঁটতে তার মুখেও কিঞ্চিত হাসির রেখা ফুটে ওঠে। এই অঞ্চলের নামি গায়েন অমল গায়েনের দুটো কলি বের হয়ে আসে তার গলা থেকে- কেডা তুমি ও সুন্দরী কারুগ বাড়ির মাইয়ে কেমনে যাবা দু'কূল রোদি একা এ গড় বাইয়ে রে একা এ গড় বাইয়ে। এই গানের কলি তার খুবই প্রিয়। মন ভালো থাকলেও গায়, না থাকলেও গায়। গুনগুন করে গায় সিধুদাস। জাল নামিয়ে রেখে গায়ের গেঞ্জি খোলে। শরীরের আঠালো কাদা শুকোতে শুরু করেছে। পাশের খালটিতে নেমে পড়ে সে। শরীরের ময়লা পরিষ্কার করে দ্রম্নত ওপরে ওঠে আসে। হানিফ মহাজন বাড়িতে আছে আজ। তার সঙ্গে দেখা করতে হবে। বেলা বাড়লে তাকে আবার পাওয়া যাবে না। আজও তাকে না পাওয়া গেলে উপোস করতে হবে। মহাজনের সঙ্গে দেখা হওয়ার দুশ্চিন্তায় মধুবালার চিন্তা মাথা থেকে তার দ্রম্নত উবে যেতে থাকে। ৩. হানিফ মহাজনের নৌকো মোট সতেরটি। তিন ধরনের নৌকাই রয়েছে তার। ডিঙ্গা, চান্দি এবং বালাম। বালাম নৌকা সবচে' বড়। তবে এর সব কয়টিই মাছ ধরার উপযোগী। নৌকার ভেতর জাল রাখার জায়গাসহ ছাউনিও রয়েছে প্রায় সবক'টিতে। ডিঙ্গা বা চান্দি নৌকা যেগুলো মাঝারি এবং ছোট সাইজের সেগুলোও রয়েছে খানদশেক। তাই জেলেপাড়ার পুরুষগুলো মৌসুমের সময় নৌকার জন্য হত্যে দিয়ে বসে থাকে তার কাচারি ঘরের সামনে। তারা কখনো দল বেঁধে আসে। কখনো একা, বিশেষত যার হাতে নৌকা ভাড়ার নগদ টাকা রয়েছে। তবে মহাজনের সঙ্গে দুই রকমেরই চুক্তি হয়ে থাকে। কখনো নৌকা চুক্তি অথবা কখনো মাছ চুক্তি। নৌকা ভাড়া চুক্তি হলে মাছ পাবে জেলে। আর মাছ চুক্তি হলে মহাজনকে মাছের একটি অংশ দিতে হবে, তবে নৌকার জন্য কোনো খরচ নেই। মাছের পাশাপাশি আবার গোলপাতা নয়তো মধুর চাকভাঙ্গারও চুক্তি হয়ে থাকে মহাজনের সঙ্গে। হানিফও এক সময় ছিল মাঝি। সবার দিন এক রকম থাকে না। এখন নিজেই লোক লাগিয়ে ব্যবসা করে। নদীতে যায় না। বা বনেও ঢোকে না। অন্যদের সঙ্গে অবস্থা ও সুযোগ বুঝে এভাবেই চুক্তি করে হানিফ মহাজন। এলাকার জেলেরাও তাকে তোয়াজ করে চলে। নৌকা হাতে রয়েছে, এমন মালিকও খুব বেশি নেই এদিকে। জেলেপলস্নীর ভরসা বলতে তাই হানিফ মহাজনকেই বুঝে সবাই। ফলে মৌসুমে নৌকার চাহিদা যত বাড়ে হানিফের ব্যস্ততাও তত বাড়ে। আর ঘরে যত্নে রাখা লোহার সিন্দুকটির ভেতরে ময়লা ঘামচিটচিটে নোট উপচে পড়তে থাকে। হানিফের বয়স হয়েছে। সামনে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। এবার চেয়ারম্যান পদে দাঁড়াতে চাইছে সে। মেম্বারগিরিতে আর মন ভরছে না। তার সব চিন্তা এখন নির্বাচন ঘিরে। তাই ব্যবসায়ও আর আগের মতো মন বসাতে পারছে না। তার প্রথম স্ত্রীরও বয়স হয়েছে। হাঁটু আর কোমরের যুগপৎ ব্যথায় সারাদিন কোঁকায়। তবে হানিফের মূল ঝামেলা তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে। উপজেলা সদরের এক পলস্নী ডাক্তারের মেয়ে। বছরখানেক আগে এক মামলার কাজে সদরে গিয়েছিল। চিকিৎসার সুবাদে সেখানেই পরিচয় তার সঙ্গে। পরিচয় থেকে তুমুল আকর্ষণ। অবশেষে হানিফ মহাজনের তুমুল আগ্রহে পলস্নী ডাক্তার মেয়েকে তুলে দেয় তার কাছে। পাত্রের বয়স বেশি তাতে ক্ষতি কী, দ্বিতীয় বিয়ে, সমস্যা কী? তার মেয়ে তো ধনী ঘরে খেয়ে পরে দাপটে ভালো থাকবে। আর মেয়ে যে গ্রামের কলেজে সহপাঠীর সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল একথাও বা পাত্রকে বলার কি আছে? তবে হানিফ মহাজন ঘটনাটি জানত। গ্রামে এসব কথা চাপা থাকে না। তবে শুনেও না শোনার ভান করে কবুল বলে দ্বিতীয় পক্ষকে একবারেই সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। প্রথম স্ত্রী দু'দিন রাগ করে ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখে। তিন দিনের দিন হানিফ মহাজনের কড়া ধমক খেয়ে দরজা খুলে নতুন বউয়ের সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর হাত ধরে টেনে বলে, আসো বইন, তোমার ঘর দরজা দেহায়া দেই। হানিফ মহাজন বউকে ধমকালেও মনের ভেতর নানা শংকা কাজ করছিল। কিন্তু তার শান্তি দ্রম্নত উবে যায় যখন একদিন জেনে যায়, তার নতুন স্ত্রীর সঙ্গে এখনো প্রেমিক ছোকরার যোগাযোগ আছে। ৪. বনের ভেতর সরু খাল। দু'পাশে ঘন বন। তীরের কাছে যেখানে পানি খুব কম, সেখানে কাদাপানির ভেতর গাছের শ্বাসমূল মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার ওপর কারো পা পড়লে রক্ষা নেই। রক্তারক্তি কান্ড ঘটে যেতে পারে। গত ত্রিশ বছর ধরে এ অঞ্চলে মাছ ধরছে বজলু। মাথার চুল সব পেকে গেছে। চিবুকের নিচ থেকে দাড়ি নেমেছে। সেটা আবার মেহেদি মাখানো। বউ লাগিয়ে দিয়েছে। একবার নদীর ভেতরে এলে এখানেই প্রায় দুই তিন মাস কাটিয়ে দেয় সে। বনের ভেতরে, খালের পানিতে জাল পেতে টংঘরে শুয়ে থাকে। সকালের দিকে অথবা সন্ধ্যার আগে জাল পরখ করে নেয়। কখনো কখনো দিনের পর দিন কেটে যায় মাছের জন্য। যেদিন প্রচুর মাছ ওঠে নৌকার পাটাতনে লাফাতে থাকে জ্যান্ত ভেটকি, কাইন মাছগুলো। মাঝে মাঝে বড় কাঁকড়াও ওঠে, পচা লতাপাতাও কম হয় না। তাতে কী, সবাই তখন মাছ বেছে নেওয়ার কাজে লেগে যায়। তারপর বড় মাছগুলো চালান করে পাটাতনের নিচে। সেখানে কিছুটা পানি থাকে। জাল থেকে বেরিয়ে শ্বাস নিতে থাকা জ্যান্ত মাছগুলো পাঠাতনের নিচে পানি পেয়ে যেন কিছুটা স্বস্তি ফিরে পায়। খালের ভেতর মাছ পাওয়া না গেলে নৌকা নিয়ে চলে যেতে হয় উজানে। সেখানে ভরা মৌসুমে ইলিশ ধরা পড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে। সেদিনটা ঈদের দিনের মতো লাগে বজলুর কাছে। যদিও ঈদ বা পুজোপার্বনের আনন্দ কোনো অর্থ বহন করে না জেলেপাড়ার কারও কাছে। মাছ ধরা পড়লেই তাদের আনন্দ। রুপালি ইলিশের আভায় তখন তাদের রোদে পোড়ামুখগুলো চকচক করতে থাকে। তারপর নৌকা বোঝাই ইলিশ নিয়ে চলে আসে বাজারে। পাইকারদের হাতে মাছ বুঝিয়ে দিয়ে নগদ টাকা ট্যাঁকে গুঁজে বউ পোলাপানের জন্যে কেনাকাটা। কিন্তু এ মৌসুমে এখনঅব্দি ইলিশ দূরের কথা, কোনো মাছেরই দেখা নেই। এক সপ্তাহ ধরে জাল ফেলে বসে আছে বজলু। মাছ নেই। সঙ্গের লোকজন একে একে সটকে পড়েছে নৌকা থেকে। ঙ্গুশ্চিন্তায় তার কপালের ভাঁজ বাড়ছে। সে খবর পাঠিয়েছে সিধুকে। মাছ ধরতে সিধুর মতো হাত এ তলস্নাটে কোনো জেলের নেই। ছেলেটাকে খুবই পছন্দ বজলুর। সিধু এলে তাকে নিয়ে মাঝনদীতে গিয়ে জাল ফেলার কথা। কিন্তু যতদূর শুনতে পেয়েছে সিধুর ধান্দা অন্যত্র। সে মহাজনের কাছ থেকে নাকি নৌকা নেওয়ার কথা ভাবছে। একাই মাছ ধরবে। ছেলেটার মাথা হঠাৎ বিগড়ে গেল কেন বুঝে উঠতে পারে না বজলু। কয়েকবার লোক পাঠিয়ে দেখেছে কিন্তু সিধু আসেনি। ভাবতে ভাবতে টংঘর থেকে নেমে পড়ে সে। জাল পরীক্ষা করার সময় হয়ে গেছে। ৫. হানিফ মহাজনের বাড়ির কাছে এসে পড়ে সিধু। এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় ঘর হানিফ মহাজনের। সামনে বড় পুকুর। পুকুরের ধারে মুখোমুখি তিনটে বাড়ি। সবগুলো পাকা বাড়ি। সামনেরটি কাচারিঘর, তবে এটি পাকা নয়। আটচালার একটি ঘর। এটি ছিল তার পুরনো বাড়ির একটা অংশ। এটিকে ভাঙেনি সে। হানিফ মহাজন এই চালাঘরটিতেই অধিকাংশ সময় বসে। তার সঙ্গে জেলেপলস্নীর মানুষজন যারা দেখা করতে আসে তারাও এ ঘরের সামনে বসে অপেক্ষা করে। ভেতরের দিকে আরও দুটো বাড়ি। একটিতে হানিফ মহাজন সপরিবারে থাকে। অপরটি ব্যবহৃত হয় ধানচাল রাখার আড়ত হিসেবে। এ বাড়ির কোথায় কি আছে পুরোটাই সিধুর মুখস্থ। ছোটবেলায় এ বাড়িতেই আশ্রিত ছিল সে। সিধু আর সিধুর মা কবে কীভাবে এই বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিল তা ঠিক পরিষ্কার নয় সিধুর কাছে। তার ছোটবেলার যতটুকু স্মৃতি তার মনে পড়ে সেখানে শুধু এক নারীমূর্তির ছায়া। যার পেছনে পেছন সর্বক্ষণ সে খাবারের জন্য ঘুরঘুর করত। কখনো খাবারের বদলে চড়থাপড় খাওয়ার কথাও তার মনে আছে। মার খেয়ে তারস্বরে চিৎকার করতে করতে সে আশ্রয় নিত এ পুকুর ঘাটে এসে। রাতে পরম মমতায়, কুপির আলোয়, সেই নারীমূর্তি তাকে মাছের ঝোল দিয়ে মাখানো গরম ভাত খাইয়ে দিত। কুপির লকলকে হলুদ-কমলা আলোয় শুধু তার নাকের চকচকে নথটি ছোট্ট সিধুর চোখে পড়ত। ভাত খেয়ে সিধু গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ত তার গা ঘেঁষে। আরেকটু বড় হয়ে সে বুঝতে পেরেছিল মমতাময়ী নারীটি আর কেউ নয় তার জন্মদাত্রী মা। ততদিনে দুরারোগ্য কোনো মানসিকব্যাধি তার মাকে আক্রমণ করেছে। সিধুর তখন শুধু ভাতের ক্ষুধা। তার পেটজুড়ে চিনচিনে খিদের কষ্ট তাকে অবসন্ন করে ফেলত। এত বড় বাড়িতে আশ্রিত এক শিশুর দিকে কেউ তাকিয়ে নেই। সিধু খিদে নিয়ে ঘুরে বেড়াত সারা বাড়ি আর উঠোন। বাড়ির পেছনে গরুর ঘর। সেখানেই মাটিতে মাদুর পেতে সারাক্ষণ তার মা শুয়ে থাকত। আর ঘন ঘন কাশত। শেষের দিকে সিধু মায়ের কাছে আসলেই কাশি আর কফ জড়ানো গলায় তাকে তাড়িয়ে দিত, যা যা বলে। মা যতই তাকে দূরে সরে যেতে বলত ক্ষুধার্ত সিধু ততই জেদ করতে থাকত ভাতের জন্যে। সে বুঝতে পারত মায়ের ওঠে বসার শক্তি নেই, ভাত দেবে কীভাবে? শুধু মনে হতো, কোনো এক অলৌকিক শক্তিতে তার মা ওঠে এসে তাকে গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত খেতে দেবে। এ অবস্থার মধ্যে এক ভোরে ঘুম ভেঙে যায় সিধুর। কেউ তাকে জোরে জোরে গায়ে ধাক্কা দিচ্ছে আর কিছু বলছে। সিধুর কানে প্রথমে স্পষ্ট হয় না। পরে ঘুম কিছুটা কেটে এলে বুঝতে পারে, কেউ বলছে, তোর মা মইরে গেছে সিধু, ওঠ্ ওঠ্। কথাটা কানে স্পষ্ট হতে সিধুর ঘুম ভাঙে। তবে সেটি মারা যাওয়ার খবরে নয়, বরং পেটে সুপ্ত খিদের কষ্টের মোচড়ে। আত্মস্থ হয়ে সিধু যখন ওঠে বসে, তার মুখ দিয়ে বের হয়ে আসে, মা কোনে? ঘুমজড়ানো চোখে সিধু টের পায় কেউ তাকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে নিয়ে যাচ্ছে বাড়ির উঠোনে। উঠোনের ঠিক মাঝখানে সিধু তার মাকে চিত হয়ে শোয়া অবস্থায় দেখতে পায়। মায়ের চোখ খোলা, নিষ্পলক। একটি মাছি নির্বিঘ্নে তাকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে। সিধু এলে উঠোন ভর্তি সবার দৃষ্টি এসে পড়ে তার ওপর। বরাবর আড়ালে থাকা সিধু এতগুলো মানুষের দৃষ্টির সামনে কুঁকড়ে যায়। মায়ের মৃত শরীর নয়, বরং তাকে ঘিরে এত মানুষের উপস্থিতি তাকে ভীত করে তোলে। সিধুর বয়স তখন কত হবে, নয় কি দশ। এরপরও সে আরও বছরদশেক হানিফ মহাজনের বাড়িতে থেকে গিয়েছিল। বাড়ির ফাইফরমেশ, হাট-বাজারে যাওয়া, মহাজনের বউয়ের পা টেপা, সবকিছুতেই ডাক পড়ত সিধুর। মায়ের মৃতু্য শোক দ্রম্নত ভুলে গিয়ে এরপর থেকে একটি নতুন জগতের যাবতীয় কর্মকান্ডের ভেতর প্রবেশ করেছিল সিধু।
৬.
মধুবালা জানত না, সে কে। কৃষ্ণবর্ণ এক অন্ধকার রাতে বজলুর স্ত্রী জমিলা তাকে জানায় যে, বনের ধারে কোনো এক পরিত্যক্ত নৌকায় তাকে খুঁজে পেয়েছিল বজলু। সদ্যজন্ম নেওয়া এক শিশু হাতপা ছুঁড়ে কাঁদছে নৌকায় পাটাতনের ওপর। চারপাশে কেউ নেই। অনেক খোঁজাখুজি করেও কাউকে না পেয়ে বজলু গামছায় পেঁচিয়ে নিয়ে আসে তাকে বাড়িতে।
তার নৌকায় মধুবালাকে কে বা কারা ফেলে গিয়েছিল। মধুবালার স্বজনদের বাঘে টেনে নিয়েছে না বনদস্যুর হাতে মৃত্যু হয়েছে তারও কোনো চিহ্ন কোথাও পায়নি সে। নাকি লোকলজ্জার ভয়ে অনাকাক্সিক্ষত সন্তানকে নৌকায় ফেলে রেখে আত্মঘাতী হয়েছে তার মা, এরূপ নানা সন্দেহ মাথায় এলেও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি বজলু। শুধু মধুবালাকে খুঁজে পেয়ে বনরক্ষীদের কাছে নিয়ে গেলে তারাও কোনো দায়িত্ব নিতে অপারগতা জানায়। নিরুপায় বজলু স্ত্রীর কাছেই নিয়ে এসেছিল শিশুটিকে।
মধ্যরাতে, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বজলু বাড়িতে ফিরে ফিসফিস করে ডাকে স্ত্রীকে। কুপির আলোয় স্বামীকে দেখে চমকে যায় জমিলা। নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসার কথা নয় মানুষটির। স্বামীর ভেজা শরীর আর হাতে জড়ানো কাপড়ের পুটলি থেকে শিশু কণ্ঠের ক্ষীণ কান্না তাকে যুগপৎ বিস্মিত ও বিচলিত করে তোলে। বজলুর সঙ্গে জমিলার বিয়ে হয়েছে তখন মাসখানেকমাত্র।
গামছার পুটুলি বিস্মিত স্ত্রীর হাতে কোনোমতে তুলে দিয়েছিল বজলু। শরীর কাঁপিয়ে তার জ্বর এসেছিল। শরীর মুছে ঘরে বিছানো মাদুরে শরীরটা এলিয়ে দিতে দিতে বলেছিল, জমিলারে, বাচ্চাডারে বাঁচা। তারপর ঘোর জ্বরে জ্ঞান হারিয়োছিল।
পরদিন সকালে চোখ মেলে দেখেছিল পাশে জমিলা। তার মুখের দিকে উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে রয়েছে। চোখের নিচে কালো দাগ, পাতা ফোলা। বজলুর গায়ে আর জ্বর নেই তখন।
এবার স্ত্রীর কাছে ঘটনার সবিস্তারে বর্ণনা দেয় বজলু। গভীর শ্বাস নিতে নিতে বজলু বলে, বুঝলি রে জমিলা মাইয়াডা মনে হয় হিঁদুর ঘরের। নৌকায় ভাঙা শাখার টুকরো, সিঁদুরের কৌটো পইরেছিল।
এতে জমিলার ভাবান্তর হয় না। বলে, কুইড়ে পাওয়া গ্যান্দার আবার পরিচয় কী?
বজলুকে চিন্তিত দেখায়। বলে, তারে ডাকব কি বলি?
কেনে, মোর নাম জমিলা হলি তার নাম দ্যাপো কাজলা, নয়তো হালিমা। হালিমা মোর দাদির নাম ছেল। হেইডি দেব। সোজাসাপটা উত্তর দিয়েছিল জমিলা।
বজলু গামছায় হাত মুছতে মুছতে ততোধিক চিন্তিত গলায় বলেছিল, নারে জমিলা এইডা ঠিক হবি না। ঘুমন্ত শিশুটির দিকে তাকিয়ে সে শিশুটির গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস দেখতে দেখতে বলেছিল, ওর নাম হবে মধুবালা, ওরে আমরা মধুবালা বইলেই ডাকপো।
এই ঘটনার পর জমিলা নিজে তিনবার পোয়াতি হয়েছিল বটে, কিন্তু কোনো সন্তানই তার বাঁচেনি। প্রথমটির মৃত্যুর কারণ জমিলার অধিক পরিশ্রম। চিংড়ির হ্যাচারিতে কাজ নিয়েছিল সে। তখন বজলুর হাতে টাকা নেই, নৌকা নেই, মাছও নেই। পোয়াতি থেকেও দিনে রাতে প্রায় আঠারো ঘণ্টা কাজ করেছিল জমিলা।
এক সন্ধ্যায় সে নিজেকে আবিষ্কার করেছিল রক্তে ভেসে যাচ্ছে তার শরীর। প্রথম সন্তান এভাবেই নষ্ট হওয়ার পর দ্বিতীয় সন্তান মৃতই প্রসব করে জমিলা। এরপর অন্তঃসত্ত¡া হলে সদরের ডাক্তার তাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বজলুকে জানায়, তার স্ত্রীর জরায়ুতে টিউমার। এটি অপসারণ না করলে তার স্ত্রীর জীবন বিপন্ন হতে পারে। অগত্যা শল্যচিকিৎসকের হাতে স্ত্রীকে তুলে দিয়েছিল বজলু। কিন্তু তাতে যেটা হলো টিউমার অপসারণ করতে গিয়ে ডাক্তার তার পুরো জরায়ুটাই ফেলে দিয়েছিল। ততদিনে মধুবালাকে নিয়েই নিজ সন্তানের অভাব ভুলে গিয়েছিল জমিলা। কিন্তু বড় হতে হতে মধুবালা টের পেয়ে গিয়েছিল তার জন্ম নিয়ে কোনো রহস্য আছে, যেটি সে জানে না।
৭.
বাড়িতেই ছিল হানিফ। কথা বলছিল কাচারিঘরের চৌকিতে আধশোয়া হয়ে বসে। ঘরে আরও দু’জন রয়েছে। তারা সামনের বেঞ্চিতে না বসে মহাজনের চৌকির সামনে মাটিতে গোল হয়ে বসেছে। উত্তরপাড়ার বাওয়াল ওরা, ওদেরকে চেনে সিধু।
কথাবার্তা শেষ করে তারা বেরিয়ে গেলে হানিফ এবার তাকায় সিধুর দিকে। এতক্ষণ তার মুখে যে কৃত্রিম গাম্ভীর্য ছিল, সেটি আর নেই। বলে, কিরে, আমার কথা তোর এদ্দিনে মনে অলো!
হানিফ মহাজনের কথায় কিছুটা সংকুচিত হয় সিধু। মহাজনের বাড়িতে তার ও মায়ের আশ্রিত জীবনকে সে ভুলে যাবে কীভাবে?
সিধুকে চুপ করে থাকতে দেখে প্রসঙ্গ পাল্টায় মহাজন। সরাসরি মূল কথায় চলে আসে। বলে, কিরে, নুকো নিবি?
সিধু মাথা নিচু করে উত্তর দেয়, হয়।
হানিফ মহাজন গলা বাড়িয়ে ডাকে কাউকে। সে ঘরে ঢুকলে নির্দেশ দেয়, সিধুরে তিন নম্বর ডিঙ্গা দিয়ে দে। সঙ্গে লিফটজালডাও দিয়ে দিস। নয়লে ও জাল পাবে কোনে। তারপর সিধুর দিকে ফিরে আবারও জিজ্ঞেস করে, পাশ পেয়েচিস?
হয়। ছোট্ট করে উত্তর দেয় সিধু। নৌকোর ব্যবস্থা তো হলো, কিন্তু আজ মহাজনের কাছে আসবার আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল সিধুর।
হানিফ মহাজনের নৌকোয় কাজ করতো সিধুর বাপ। বাঘের কামড়ে তার মা অকালে বিধবা হলে, মহাজন তার বাড়িতেই আশ্রয় দেয় সিধুর মাকে। সিধু তখন কোলের শিশু। হানিফ মহাজনের তখন রমরমা অবস্থা সবে শুরু হয়েছে।
আশ্রিত হলেও সিধুকে সব সময় আগলে রেখেছিল হানিফ। কিন্তু কেন সেটি মাঝে মাঝেই সিধুকে ভাবাতো। সিধু যখন বুঝতে শিখল সবকিছু, তার আশ্রিত মা ও হানিফ মহাজনকে নিয়ে কিছু কথা তার কানে এসেছিল। অপ্রাপ্তবয়স্ক সিধুর কাছে প্রশ্নটি তখন তেমন প্রাসঙ্গিক মনে না হলেও, সিধু মহাজনের বাড়িতে যতই বড় হয়ে উঠেছে, ততই যেন ডালপালার মতো সিধুকে আঁকড়ে ধরেছিল। আজ মহাজনকে কিছুটা নিরিবিলিতে পেয়েছে সিধু। তাই প্রশ্নটা না করলে আর কখনো কী করা হবে?
সিধুকে তখনো মাথা নিচু করে বসে থাকতে দেখে হানিফ বলে ওঠে, কিরে নুকো তো পালি, আর কিচু বলবি?
সিধু এতক্ষণ তার গলার কাছে জমে থাকা শ্বাসটুকু ছেড়ে দিয়ে বলে, না আর কিচু চাইনে, তবে কিছু টাকারও প্রয়োজন ছেল।
কয়েকটা টাকার তোড়া তখনো মহাজনের চৌকির ওপর ছিল। একটু আগে নৌকো ভাড়ার টাকা দিয়ে গিয়েছিল দু’জন। সেখান থেকে একটা তোড়া নিয়ে সিধুর দিকে ছুঁড়ে দেয় হানিফ। বলে, নে রাখ। বড় চিংড়ি পালি কিছু আমারে দিয়ে যাস। তোর চাচি খাতি চেয়েচে।’
সিদু মাথা ঝাঁকায়। তারপর আগের মতোই মাথা নিচু করে মহাজনের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। যে প্রশ্নটি মহাজনকে করবে বলে ভেবেছিল, সেটি আজও করা হলো না।