ঈদের কিছু দিন আগেই তৃপ্তি সুমনকে বলে দিল আমি কিন্তু বাবার বাড়িতে ঈদ করব। কিছু বলতে পারবে না। আর তুমি আমার সঙ্গে যাবে। কতদিন দেখি না মা বাবাকে।
সুমন কিছু বলতে গিয়েও বলল না। ভাবল এখন না বলে পরে বুঝিয়ে বলবে তৃপ্তিকে। সঙ্গে সঙ্গে যদি না করি তাহলে ওর রাগ হবে। পরে একটু পটালেই হবে। খুব বেশি হলে একটা পিজা যাবে পটাতে। অফিসে চলে গেল সুমন। তৃপ্তিও দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে কোচিং-এ চলে গেল।
রাতে সুমন একটা পিজা আনল। তৃপ্তি তখনই বুঝতে পেরেছে। এটা তাকে পটাতে এনেছে সুমন। তাই সুমনকে বলল, লাভ হবে না এসবে। মন চাইলে পিজা ফিরিয়ে দিতে পার। সুমন উঁকি দিয়ে দেখল বাচ্চারা কোথায়। কাছে কোথাও নেই দেখে জড়িয়ে ধরে বলল, কী যে বলো না এসব। তোমার জন্য আনলাম। অন্য কিছু না। গরম গরম খাও।
বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়েছে দেখে সুমন তৃপ্তির চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, তুমি যখন তোমাদের বাড়িতে ঈদ করতে চাচ্ছো। তখন একটা কাজ করি। তোমাদেরকে সেখানে আগেই পাঠিয়ে দেই। আমি ঈদের দিন রাতে আসব। তাহলে সবার সঙ্গেই ঈদ করা হলো। তবে তোমরা ঈদের পরের দিন না হলেও দ্বিতীয় দিন আমাদের বাড়িতে আসবে আমার সঙ্গে। মা বাবাও অনেক দিন বাচ্চা দুটোকে দেখে না। ঢাকায় তাদের ভালো লাগে না। তাই আসতে চায় না। আর ঈদের দিন তাদের রেখে আমার পক্ষে তোমাদের বাড়িতে যাওয়া সম্ভব নয় লক্ষ্ণীটি। একটু বুঝতে চেষ্টা কর।
তৃপ্তি এবার উঠে বসল। তোমাকে ছাড়া আমরা ঈদের দিন খুশিতে ঈদ করতে পারব? আমার বাবা-মা কী তোমার বাবা মা না? আমারও তো তাদের সঙ্গে ঈদ করতে ইচ্ছা করে। বিয়ের পর এই ১০ বছরে মাত্র দুবার বাবার বাড়িতে ঈদ করেছি। তাও কারণ ছিল। আমি প্রেগন্যান্ট ছিলাম। ওখানের ছিলাম তাই। বাচ্চাদের স্কুল থাকে। ইচ্ছা করলেও তো যেতে পারি না।
এবার সুমন উঠে বসে তৃপ্তির হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলল, আমিও তো বলছি যাও তুমি। এটা খুবই স্বাভাবিক যে তোমার ইচ্ছা করবে। আমি তোমাদেরকে ছাড়া ঈদ করব কেন? আমি তো ঈদের দিনই যাচ্ছি। আর আজ যেমন তুমি তোমার বাচ্চাদের জন্য চাইলেও বাবার বাড়িতে যেতে পার না। আমার মাও তো ঠিক সেইভাবে আমাদের জন্য তার বাবার বাড়িতে যেতে পারত না। মায়ের বিয়ে হয়েছিল তার বয়স যখন ২০ বছর। তারপর থেকে মা কখনোই বাবার বাড়িতে ঈদে যেতে পারেনি। গেলেও ঈদের এক সপ্তাহ পরে গেছে। তখন ঈদের কোনো আমেজ থাকত না। আমার মামা-খালারা ততদিনে ঈদ করে চলে যেত। আমাদের খুব কষ্ট লাগত। মায়েরও খুব কষ্ট হতো। কিন্তু দাদার বাড়িতে ঈদে সবাই আসত। মা ছিল বড় বউ। তার ওপর সব দায়িত্ব ছিল। সে কিছুতেই যেতে পারত না। বাবাকে বললেও লাভ হতো না। কারণ বাবা কখনো দাদার মুখের ওপর কথা বলতেন না। আমি চাই না তুমিও সেই কষ্ট পাও। তুমি যাও। আর ইদানীং বাবার শরীরও ভালো না। কতদিন আর এক সঙ্গে বাবা আর আমি ঈদের নামাজ পড়তে পারব জানি না। কথাটা বলতেই সুমনের গলা ধরে আসল। চোখ ভিজে গেল।
তৃপ্তির তখন খুব কষ্ট লাগল। সুমনের চোখ মুছে দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল, সরি। তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি। এভাবে ভাবিনি আমি। আমরা এক সঙ্গে ঈদ করব। আগে যাব তোমাদের বাড়িতে। ঈদের দিন রাতে আমার বাবার বাড়িতে যাব। আর আমরা তো গ্রীষ্মের ছুটিতে আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম, সমস্যা নেই।
এবার সুমন তৃপ্তিকে শক্ত করে বুকে চেপে ধরে বলল, তুমি সত্যি আমার লক্ষ্ণী বউ। তৃপ্তি সুমনকে সরিয়ে দিয়ে বলল, কিন্তু তুমি খুব খারাপ হাসবেন্ড। আমাকে কাঁদিয়ে দিলে। সুমন তৃপ্তির নাক টেনে দিয়ে বলল, হাসবেন্ডরা একটু খারাপ হতেই হয়। খারাপ হাসবেন্ডের বউ ভালো হয়। এবার দুজনেই হেসে দিল।
আজ ঈদের জন্য বাড়িতে যাচ্ছে সবাই। বাচ্চাদের আনন্দ সবচেয়ে বেশি। বাড়ির সবার জন্য কেনাকাটা করা হয়েছে। গাড়িতে গান গাচ্ছিল বাচ্চারা। এবার ওদের সঙ্গে যোগ দিল সুমনও।
বগুড়ায় এসে তৃপ্তি গাড়ির ড্রাইভারকে ভালো মিষ্টির দোকানে গাড়ি থামাতে বলল। সুমনকে নামতে নিষেধ করে নিজেই নেমে গেল। শ্বশুর আর শাশুড়ির পছন্দের রসমালাই আর দই নিল নিজের টাকায়। এগুলো দেখে সুমন বলল, আরে এগুলো তো আমিই নিতাম। তুমি কিনতে গেলে কেন?
তৃপ্তি হেসে বলে, বারে তুমি যতবার আমাদের বাড়িতে যাও। আমার মা, বাবা, ভাইয়ের বাচ্চাদের পছন্দের মিষ্টি, চকলেট এগুলো নিয়ে যাও। সেই প্রশংসা মা সারা বছর করে। ও বাড়ির বাচ্চারা তোমার ভক্ত। আর আমি এতটুকু পারি না? এটা আমি নিলাম আব্বা আর মায়ের জন্য। তাদের পছন্দের।
সুমন সত্যি অনেক খুশি হলো তৃপ্তির ওপর। তৃপ্তিকে বলল, তারাও তো আমার বাবা মায়ের মতোই। আর বাচ্চারা সত্যি অনেক ভালোবাসে আমাকে। আমরা ওখানে গেলে ভাই ভাবিও তো আমাদের জন্য অনেক কিছু করে। আমার মাকে দেখেছি নিজের জমানো টাকায় মিষ্টি কিনে নিয়ে যেত নানার বাড়িতে। বলত, আব্বা তাদের পছন্দের মিষ্টি কিনে দিয়েছেন। আমি এখন বুঝতে পারি বিষয়গুলো। অথচ বাবা কোনোদিন আলাদা করে টাকা দিতেন না কিছু কিনতে। এজন্য আমি যেদিন প্রথম তোমাদের বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছিলাম। মা আগেই বলে দিয়েছিল। যাওয়ার সময় তোমাকে জিজ্ঞেস করে সবার পছন্দের কিছু না কিছু যেন নিয়ে যাই। তৃপ্তি সুমনের হাত ধরে বলল, মা সত্যি তোমাকে একজন খুব ভালো মানুষ করে গড়ে তুলেছেন। আমিও এমনটাই চেষ্টা করব। সুমন বলল, অবশ্যই করবে। তুমিই অনেক ভালো মা। তোমার সন্তানেরাও মানুষের মতো মানুষ হবে।
সুমন, তৃপ্তি আর বাচ্চাদেরকে দেখে সবাই অনেক খুশি। ঈদের দিন যেন আজ থেকেই শুরু হয়ে গেছে। দাদা-দাদির সঙ্গে বাচ্চাদের আনন্দ দেখার মতো। ঈদের দিন সুমন, তার বাবা আর ছেলেকে নিয়ে ঈদের নামাজ পড়তে যাচ্ছে। একই রকম পাঞ্জাবি পড়েছে তিনজন। দাদা ও বাবার মাঝে ছেলে হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে। এটা এক শান্তির ও আনন্দের দৃশ্য। অনেক ছবি তোলা হলেও তৃপ্তি পেছন থেকে কয়েকটা ছবি তুলে রাখল। এটা একটা আনন্দের স্মৃতি।
জীবনে কিছু আনন্দ বা সুন্দর মুহূর্তগুলো আসে ভালোবাসা আর দুজনের বোঝাবুঝির কারণে। বোঝাতে পারলে সবাই বুঝতে পারে। বুঝতে পারলে শান্তি আর আনন্দ বাড়ে, কমে না।