বিশ্বের হাতেগোনা কয়েকটি সাহিত্য কর্মের কথা যদি বলতে চাই তবে ফ্রাঞ্জ কাফকার 'মেটামরফসিসের' কথা বলতেই হয়। এটি নিঃসন্দেহে একটি ধ্রম্নপদী সাহিত্য কর্ম। সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে জোনাথন সুইফটের 'গালিভারের ভ্রমণ কথা' যখন মহাপ্রাচীরের মতো রুখে দাঁড়াল, ঠিক একইভাবে বিশ্বব্যাপী গড়ে ওঠা পুঁজিবাদী ফাঁদের বিরুদ্ধে কাফকার মেটামরফসিস যেন এক অদম্য একিলিস। পুঁজিবাদ যখন ইউরোপীয় সভ্যতার বুকে জগদ্দল পাথরের মতো গেড়ে বসেছে, যান্ত্রিক শহরের অলিগলিতে দিশেহারা মানুষের ছোটাছুটি, উদ্ভট প্রতিযোগিতায় অসহায়ত্বের করুণ চিত্র, তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছিল যখন মানবিক মূল্যবোধ, বিশ্ব যখন ধাবিত হচ্ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দিকে ঠিক তখনই ফ্রাঞ্জ কাফকা লিখলেন তার অনবদ্য নোভেলা মেটামরফসিস যেখানে দেখানো হলো মেরুদন্ডী কীভাবে মেরুদন্ডহীন হয়। তৈরি হলো অ্যাবসার্ড আখ্যান। ভোগবাদী ধনতান্ত্রিক সমাজে অ্যাবসারডিটি নতুন কিছু নয়। জীবনের রসদটুকু যেখানে জোঁকের মতো চুষে নেয়া হয় সেখানে অ্যাবসারডিটি খুব স্বাভাবিক মেটামরফসিস খুব বৃহৎ আকারের কোন লেখা বা মহাকাব্য নয়। এটি মূলত একটি ছোট গল্প তবে সাহিত্যের ক্যাটাগরিতে এটিকে নোভেলা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ক্ষুদ্র পরিসরের এই লেখনীটি এতোটাই ঝাঁঝালো যে সমগ্র সাহিত্য দুনিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে এক চরম কুঠারাঘাত এই মেটামরফসিস। নিষ্ঠুর ও নির্মম বাস্তবতার; এতে নান্দনিক চিত্রায়ন বিশ্বের খুব কম সাহিত্যেই দেখা যায়। কাফকা একজন অস্তিত্ববাদী দার্শনিক। অস্তিত্ব এবং অনস্তিত্বের সংকট মানব জীবনে কতটা প্রকট, কতটা দানবীয় তার নিখুঁত চিত্রায়ন হলো মেটামরফসিস। অস্তিত্ববাদ-পুঁজিবাদ-মানবতাবাদ এই ত্রয়ের যে সাংঘর্ষিক রূপ এবং সেটার পরিণতির মূর্ত ছাপ মেটমরফসিসে দৃশ্যমান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী ও যুদ্ধ পরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতির ডামাডোলে, পুঁজিবাদের করাল গ্রাসে দিশেহারা মানুষের মুক্তির বারতা নিয়ে দুনিয়া কাঁপাল কাফকার মেটামরফসিস। পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্য যে কতটা ভয়াবহ তা মেটামরফসিস না পড়লে বুঝা যাবে না। পুঁজিবাদের বিধ্বংসী আগ্রাসন ধীরে ধীরে সমাজের সব কিছুকে পণ্যে রূপান্তর করছে। এর ভয়াল থাবায় মানবিকতা, মনুষ্যত্ব, আবেগ, অনুভূতি, মায়া, দয়া সব ভোঁতা হয়ে যায়। বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদ একটি সংস্কৃতি চালু করতে চায় আর সেটা হলো কেনাবেচার বাজারি সংস্কৃতি। শ্রমকে শোষণ করে পুঁজিবাদ মানবিকতাকে পঙ্গু করে দেয়। মূল্যবোধ শব্দটি যেন পুঁজিবাদের সঙ্গে একেবারেই বেমানান।
ফ্রাঞ্জ কাফকা ছিলেন জার্মান ভাষার একজন উপন্যাসিক ও ছোট গল্প লেখক। ১৯১৫ সালে বিশ্ব সাহিত্যের ধূমকেতু হিসেবে পরিচিত তার মেটামরফসিস প্রকাশিত হয়। এটি এমন এক ধরনের সাহিত্য কর্ম যেটি সাহিত্য বোদ্ধাদের চিন্তার জগতকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ব্যতিক্রমী বিষয় নিয়ে কাফকার আগ্রহ ছিল। আধুনিক সমাজের বিচ্ছিন্নতাবোধ, মানুষের ওপর ক্ষমতাধরদের শারীরিক ও মানসিক নিষ্ঠুরতা, স্পর্শকাতর বাস্তবতা, আতঙ্ক, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, মানব জীবনে আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ, রহস্যময় রূপান্তর, ক্রোধ- আবেগের দ্বান্দ্বিক প্রকাশ ছিল তার সাহিত্য কর্মের উপজীব্য। জীবনের অন্ধকারময় দিকগুলোকে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন। কাফকার বাবা ছিলেন একজন ফেরিওয়ালা। তাই নিজের চোখে নিষ্ঠুরতা দেখার ও উপলব্ধির সুযোগ হয়েছে তার। ৬ ভাইবোনের মধ্যে বড় ছিলেন কাফকা। ৭ বছর বয়সে দুই ভাইকে হারান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তিন বোনের মৃত্যু হয়। শোকে পাথর কাফকা নিজেও বেশিদিন বাঁচেননি। কাফকার শৈশব একাকিত্ব, শূন্যতা আর নিঃসঙ্গতায় কেটেছে। পারিবারিক টানাপোড়নে বড় হওয়া কাফকা রুঢ় বাস্তবতাকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। মাত্র ৪০ বছরে যক্ষ্ণায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। তবে এই ক্ষুদ্র জীবনে মেটামরফসিসের মতো সাহিত্য কর্ম রচনা করে বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছেন। মেটমরফসিসের কাহিনি খুব জটিল নয়। এলিগরিক ধাঁচে লেখা এই নোভেলায় পুঁজিবাদের ভয়াল থাবার সূক্ষ্ন বিশ্লেষণ দেখা যায়।
নোভেলাটির মূল চরিত্র গ্রেগর সামসা। পেশায় সে একজন সেলসম্যান। একদিন সকালে সে ঘুম থেকে উঠে দেখে সে একটি তেলাপোকায় পরিণত হয়েছে। কাফকা এটাকে জায়ান্ট বাগ বলেছেন। কিন্তু কেন সামসার এমন শারীরিক রূপান্তর হলো এবং বাস্তবে এমনটি হওয়া সম্ভব কিনা? এমন প্রশ্নের উত্তর কাফকা এড়িয়ে গেছেন। তবে কাফকা এটা নিশ্চিত করে দেখিয়েছেন যে বিমূর্তের মাঝে মূর্ত কীভাবে ফুটে ওঠে। বিমূর্ত থেকে মূর্তের রূপান্তর কীভাবে নিষ্ঠুর সমাজের প্রতিচ্ছবি হতে পারে কাফকা সেটা সৃজনবোধে চিত্রিত করতে পেরেছেন। গ্রেগর সামসা প্রথমে ভেবেছিল যে সে স্বপ্ন দেখছে এবং দ্রম্নত স্বপ্ন থেকে জেগে উঠে আবার সে তার কাজে ফিরবে। অফিসে যাবে। সে জানে কাজে না গেলে তার পরিবার চলবে না। নিজের অস্তিত্ব থাকবে না। তাই সে তার দৈহিক রূপান্তরকে পাত্তা না দিয়ে অফিসে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু নিষ্ঠুর বাস্তবতা যে সামসাকে ঘিরে ফেলেছে সে তখনই বুঝতে পারে যখন দরজা খুলতে পারে না এবং তার কণ্ঠস্বর বদলে যায়। কিম্ভূতকিমাকার শারীরিক গঠন তাকে নড়তে দিচ্ছে না, কিন্তু মানসিকভাবে শক্ত গ্রেগর সামসা তখনো অফিসে যেতে বদ্ধপরিকর। কারণ অফিসে তাকে যেতেই হবে। ম্যানেজার তাকে ছুটি দেবে না। কিন্তু নিষ্ঠুরতার জালে বন্দি এক অসহায় আত্মা সামসা। তার জীবনে নেমে এসেছে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মানুষ থেকে সে তেলাপোকায় পরিনত হয়েছে। সে সেটা বুঝতে পারছে কিন্তু করার কিছুই নাই। যে পরিবারের জন্য সামসা ছিল নিবেদিত প্রাণ, সেই পরিবার এখন তাকে অবহেলো করতে শুরু করল। ধীরে ধীরে পরিবারের সহানুভূতি হারাল, যে পরিবারের সদস্যরা তাকে দেবতুল্য মনে করতো, তারাই আজ তার অস্তিত্বের বিনাশ চাচ্ছে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সামসা শারীরিক রূপান্তরের কারনে ধুঁকে ধুঁকে মারা যায়। পরিবারের কেউ তার ঘরে আসতো না। তার বোন তার খাবার দিয়ে যেত তবে সেও অনিহা দেখাতো। সামসা যখন মারা যায় তখন পরিবারের সদস্যরা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। সামসার মৃত দেহ ময়লার সঙ্গে ভাগারে ফেলে দেয়া হয়। সামসার তেলাপোকায় পরিণত হওয়া এবং পদে পদে অসহায়ত্ব আর যন্ত্রনা ভোগ করাকে কাফকা বহুমাত্রিক আঙ্গিকে চিত্রায়নের চেষ্টা করেছেন।
শারীরিক অক্ষমতা সত্ত্বেও সামসার মধ্যে অফিসে যাওয়ার যে তাড়না ছিল সেটাকে কাফকা পুঁজিবাদের নগ্ন থাবা হিসেবে দেখিয়েছেন। সামসার রূপান্তরের মধ্য দিয়ে কাফকা দেখান মস্তিষ্ক ঠিক কীভাবে মানুষ থেকে রূপান্তরিত হয়ে যন্ত্র বা মেশিনে পরিণত হয়। সামসার দেহ কীটে পরিণত হয়েছে কিন্তু সেদিকে তার নজর নেই, তার একটাই চিন্তা তার চাকরির কি হবে? চাকরি হারালে তার ও তার পরিবারের অস্তিত্ব কী হবে? কাফকা দেখান দৈহিক পরিবর্তনের সঙ্গে মানসিক ও সামাজিক রূপান্তরও অনিবার্যভাবে ঘটতে থাকে। পরিবারের সদস্যদের কাছে থেকে তীক্ষ্ন ঘৃণা আর অবহেলা সামস্যাকে দুনিয়ার দোজখে নিক্ষেপ করেছিল। জীবনের এক জটিল সমীকরণের চিত্রটি খুব যত্নের সঙ্গে মেটামরফসিসে তুলে ধরলেন কাফকা। সামসা তেলাপোকায় পরিণত হলো। কিন্তু বোধশক্তি মানুষের মতোই রইল সামসার। বোধশক্তির রূপান্তর কেন হলো না সামসার? ভোগবাদী পুঁজিবাদের মরণকামড় বুঝাতেই হয়তো কাফকা এমনটি করেছেন। রক্তচোষা পুঁজিবাদ ধীরে ধীরে পঙ্গু করে ফেলে। ভুক্তভোগী সব বুঝতে পারে কিন্তু করার কিছুই থাকে না তার। সামসা একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে আগাচ্ছিল। তার পরিবার চাইছিল সে দ্রম্নত মরে যাক। কারণ ভোগবাদী সমাজে সামসার আর প্রয়োজনীয়তা তখন নেই। যেমন প্রয়োজনীয়তা নেই পুঁজিবাদী সমাজে দুর্বলদের। পুঁজিপতিদের জন্য যতক্ষণ কাজ করে যাবে ততক্ষণই টিকে থাকা যাবে। অক্ষম হলেই তাকে ছেঁটে ফেলা হবে। যেমনটি হলো সামসার ক্ষেত্রে। গ্রেগর সামসার দৈহিক রূপান্তর তাকে অক্ষম করে তুলেছে। পুঁজিবাদী সমাজে সে এখন আবর্জনা মাত্র। তার চার পয়সার মূল্য নেই। পুঁজিবাদী সমাজ কতটা নির্দয় ও নির্মম হয়ে উঠে অক্ষম শ্রমিকের জন্য তার একটি সার্বিক চিত্র ফুটে উঠেছে মেটামরফসিসে। পুঁজিবাদী সমাজ শুধু টাকা চিনে, মুনাফা চিনে, ভোগের বাসনায় উম্মাদ থাকে, কিন্তু মনুষ্যত্ব আর মানবিকতাকে দেখার চোঁখ পুঁজিবাদে নেই। শ্রমিকের জীবন নিয়ে নির্মম খেলায় মেতে উঠে পুঁজিবাদ। গ্রেগর সামসার নানা বিড়ম্বনা ধনতান্ত্রিক সমাজের অন্ধকারময় নগ্ন দিক। ধনতান্ত্রিক সমাজে মানবিক সম্পর্ক পথের আবর্জনার মতো। সামসার নিয়োগকারী একজন স্বৈরাচারী পুঁজিপতি। তিনি কোনভাবেই অফিসে সামসার অনুপস্থিতি মেনে নেবেন না। আর তাইতোৈ দহিকভাবে অক্ষম সামসা অফিসে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠে। কারও কাছ থেকে সহানুভূতি পাননি সামসা। তার রূপান্তরে সব বদলে গেল রাতারাতি। পরিবার, কর্মস্থল, সমাজ, প্রতিবেশী সবাই ঘৃণাভরে মুখ ফিরিয়ে নিল। পুঁজিবাদের পরিণতি কি তবে এটাই। সামসাকে ঘরে তালাবদ্ধ করে রেখে তার প্রতি নিষ্ঠুরতার শেষ পেরেক ঠুকে দেয়া হলো। সমাজ বিচ্ছিন্ন এক সত্তা হিসেবে সামসা চিত্রিত হলো মেটামরফসিসে।
কীট পতঙ্গের চিত্রটি গ্রেগর সামসার বঞ্চিত অস্তিত্বের একটি কঠোর অভিব্যক্তি হয়ে ওঠে। সে পেশাগত জীবনে একটি প্রাণী, একটি পুতুল। সামসার দৈহিক পরিবর্তন আমাদের অবাক করলেও এটা একেবারে নতুন কিছু নয়। জোনাথন সুইফটের গালিভারের ভ্রমণ কথায় গালিভারের শারীরিক রূপান্তর লক্ষ্য করা যায়। চারটি জার্নিতে বিভক্ত এই উপন্যাসে গালিভারকে চারটি ভিন্নরূপে দেখা যায়। লিলিপুটের দেশে গালিভার এক দৈত্য আকৃতির মানুষ। তার দেহ এতোটাই বড় যে লিলিপুটিয়ানদের সে পকেটে ভরে রাখতে পারে। আবার দ্বিতীয় ভ্রমণ যাত্রায় গালিভারকে অতি ক্ষুদ্র মানুষ হিসেবে দেখানো হয়েছে। চারটি ভ্রমণে গালিভারকে চারটি রূপে চিত্রিত করা হয়েছে এবং সাম্রাজ্যবাদের সার্বিক চিত্র ও জটিল মানব চরিত্রের অজানা দিককে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তবে গ্রেগর সামসার মতো গালিভার মারা যাননি। প্রতিটি ভ্রমণেই গালিভার জয় পেয়েছে এবং ভ্রমণ অঞ্চলের মানুষকে কিছু শিখিয়েছেন। কিন্তু গ্রেগর সামসা সেটা পারল না। পুঁজিবাদের গ্রোতে অতলে হারিয়ে গেল সে। পুঁজিবাদের বিপক্ষে দাঁড়ানো যে কত কঠিন সামসা জীবন দিয়ে সেটা প্রমাণ করলেন। ফ্রাঞ্জ কাফকা হয়তো কার্ল মার্কসের সুরেই বলতে চেয়েছেন যে, পুঁজিবাদকে হারানো অসাধ্য। তবে পুঁজিবাদের থাবা যখন সীমা অতিক্রম করবে তখন নিজ থেকে ধ্বংস হবে। কাফকা কি তবে রূপকথার আদলে পুঁজিবাদের মুখোশ খুলতে চেয়েছিলেন? পুঁজিবাদী সমাজে বাস করে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কাফকা অসীম সাহসের পরিচয় দিলেন। পুঁজিবাদের বিকৃত আর নগ্নরূপ সামসার জীবন ও স্বপ্নকে চুরমার করে দিয়েছে। সামসার ট্র্যাজেডি কি তবে বিশ্বমানবতার পড়ন্ত রূপকে নির্দেশ করল? তাহলে কি ডারউইনের সেই কথাই বলতে হবে- যোগ্যতমের বাঁচার অধিকার। পুঁজিপতিরাই কি যোগ্য হবেন শুধু? না, তা হয় না। আর হয় না বলেই তো কার্ল মার্কসের সেই শ্রেণি দ্বন্দ্ব, বিল্পবকে মানতে হয়। যে বিপস্নবের দ্বারা সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। পুঁজিবাদী সমাজের অভ্যন্তরে মানুষের মূল্যহীনতা আর কত কাল চলবে? মূল্যহীন হয়ে পড়বে কি তবে মানুষের অস্তিত্ব? মানুষ বেঁচে থাকবে কিন্তু মনুষ্যত্বের মৃতু্য হবে তা কি হয়? পুঁজিবাদীর লোলুপ দৃষ্টি, বিষাক্ত নখদন্তের হিংস্র কালো থাবা, বোয়ালের মতো অহনিশি আপন প্রজাতিকেই করে কুপোকাত।
কাফকা তার নোভেলায় সামসাকে একেবারে মেরে ফেলতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। সামসার ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকার মধ্য দিয়েই কাফকা পুঁজিবাদের নরকীরূপ দেখাতে চেয়েছেন। জীবনান্দ দাশ বলেছিলেন, যে জীবন শালিকের, দোয়েলের, মানুষের সঙ্গে তার হয় নাকো দেখা। বুর্জোয়াদের তৈরি জালে মানুষ তার অস্তিত্ব নিয়ে বিপন্ন। কাফকার প্রভাব বিশ্বসাহিত্য ছিল অতিমাত্রায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পুঁজিবাদের সমস্যা নিয়ে কলম ধরেছেন তবে এর বিপক্ষে শক্ত অবস্থান নেননি। কিন্তু কাজী নজরুল ইসলাম সেই দুর্গম প্রাচীর ভেদ করেছিলেন। পুঁজিবাদের শেকল ভাঙতে চেয়েছিলেন। ১৯১৭ সালে রুশ বিপস্নবে উজ্জীবিত হয়ে নজরুল 'লাল ফৌজ' গল্প লিখেছিলেন। বিদ্রোহী কবিতায় তিনি পুঁজিবাদের মুখোশ উন্মোচন করলেন। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, রবীন্দ্র প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে এসে নজরুল পুঁজিবাদের গায়ে পেরেক মেরেছিলেন। বিদ্রোহী কবিতায় তিনি লিখলেন, শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হলেই তিনি শান্ত হবেন। কাফকা বেঁচে নেই, নজরুল বেঁচে নেই, কিন্তু পুঁজিবাদের দাপট এখনো চলছে বিশ্বজুড়ে। পুঁজিবাদের উত্তাপে পুড়ছে মানবিকতা। বাংলার জনগণও আজ পুঁজিবাদী অর্থনীতির করাল গ্রাসে বন্দি। দরিদ্র আর শ্রমজীবীদের জীবন যেন অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে দিন দিন। অস্তিত্বের বিসর্জন দিয়ে পুতুল হয়ে বেঁচে থাকার নামই কি জীবন? নাকি কার্ল মার্কসের সেই ভবিষ্যৎ বাণীর জন্য পথ চেয়ে থাকতে হবে- পুঁজিবাদ নিজেই নিজের ধ্বংস ডেকে আনবে।