সাম্প্রতিক কালে আমার প্রিয় গল্পকারদের অন্যতম মোজফফর হোসেন। ওর লেখা গল্প নিয়ে ম্যাড থিয়েটার তাদের নতুন একক 'ঘরে ফেরা' দেখার ইচ্ছে তো ছিলই। সেটা কলকাতা শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরের কোনো আন্তর্জাতিক উৎসবে দেখতে পেয়ে ভালো লাগল। ভালো লাগার আরো কারণ হলো, আমতা পরিচয়ের এই উৎসব পরিসরকে ম্যাড থিয়েটার তাদের নতুন প্রযোজনার জন্য বেছে নিয়েছিল প্রথম অভিনয়ের মঞ্চ হিসেবে। ধন্যবাদ তাদের এই মঞ্চটি বেছে নেওয়ার জন্য। তাই শুরুতেই বলে নিতে চাই, প্রথম অভিনয় বলে কিছু খামতি থাকবে এটা বড় কথা নয়, বড় কথা এই সাহসটুকু। অচেনা পরিবেশ, খোলা মঞ্চ, আলো নিয়ে কোনো মহড়া হয়নি, শহর নয়, মফস্বলের থিয়েটার না দেখা দর্শকের সামনে অভিনয় করা খুব সহজ কাজ নয়। আসাদ-সোনিয়া এই সাহস দেখিয়েছে। সেই সাহসে ভর করে তারা যে ভুল করেনি সেটাও বুঝে নিতে পেরেছেন তারা।
মোজফফরের মূল গল্পটি কেবলমাত্র মুক্তিযুদ্ধের গল্প তা কিন্তু নয়। সারা বিশ্বজুড়ে চলমান এক যুদ্ধোন্মাদ পৃথিবীর কথা বলতে চেয়েছেন। বারবার একটি সংলাপ ঘুরে ফিরে আসে- যুদ্ধ মানুষকে একা করে দেয়। অনন্তকালীন এক যুদ্ধের কথা বলতে গিয়ে বাস্তবতা আর পরা বাস্তবতার মিশেল ঘটিয়ে নিতে হয়েছে এই প্রযোজনায়। তাই মূল অভিনেত্রী কথা বলেন, কিন্তু তার জিভ নেই, জিভ না থাকলে তো বাস্তবে কথা বলা যায় না, সে পারে কথা বলতে- কারণ সে জিহ্বাহীন মানুষের প্রতিনিধি হয়ে আসেন এই নাট্যে। সে ধর্ষিতা- সারা দেহ অসাড়, তবু সে উড়াল দেয় ঘরে ফেরার পথে। ফিরতে ফিরতে দেখা হয় চোখ উপড়ে ফেলা মানুষের সঙ্গে, যুদ্ধ সব কেড়ে নিয়েছে তাদের। কেউ কাউকে দেখতে পায় না, চেনে না কেউ অন্যজনকে। তবু সবাই ফিরতে চায় ঘরে। এ এক আশ্চর্য পৃথিবীর কথা- যেখানে যুদ্ধ যেন এক আশ্চর্য পরিণতি নিয়ে চলমান এই পৃথিবীতে।
এমন এক বিষয়কে সোনিয়া হাসান বহুশ্রমে গড়ে নিতে চেয়েছেন। পরিচালক তাকে মঞ্চে নিয়ে আসেন একেবারে অসুন্দর এক রূপে। বিবর্ণ এক রূপ-নাড়িভুঁড়ি ঝুলছে তার দেহের সঙ্গে, স্পষ্ট করে কথা বলে না সে। প্রথমেই অদ্ভুত লাগে- এমন করে বলছে কেন? যতক্ষণ না সে বলে ওঠে, আমার জিভ কাটা। এই যে শরীর ঝুলে আছে- তা আমার শরীরের থেকে খুবলে নেয়া নাড়ি-যকৃত-খাদ্যথলি। গুলিয়ে ওঠে শরীর। লেখক সমর্থ ভয়ংকর লেখায়। সেটা তার আরো অনেক গল্পে পড়েছি। কিন্তু পরিচালক আসাদুল ইসলাম সেই লেখক কল্পনাকে বাস্তবতা দিয়েছেন। সোনিয়া ভালো অভিনেত্রী। তবে সফিস্টিকেটেড চরিত্রে তাকে বেশি দেখেছি। মনে হলো, এ বিষয়ে তিনি সচেতন বলেই ভীষণ এনার্জি দিয়ে, শরীরের নির্মম ব্যবহার করে নিজেকে আলাদা করে নিতে চেয়েছেন। অনেক দিন ধরে দেখছি বলেই বলছি, নিজেকে আর এক রকম করে গড়ে নেওয়ার প্রয়াসকে সাধুবাদ জানাতেই হয়।
তবে আলো এবং ধ্বনি নিয়ে ভাবতে অনুরোধ করছি। সোনিয়ার কণ্ঠস্বর খুব উঁচুতে ওঠে না এবং ভারী গলার অধিকারীও নয়, তাই তার একক অভিনয়ে টেকনিক্যাল সহযোগিতা খুব দরকার। কথা যেন হারিয়ে না যায় আবহের দাপটে। অথচ এখানে আবহ খুব দরকারি একটি উপকরণ। বাস্তবতা- পর বাস্তবতার মিশেলে খুব প্রয়োজন আবহ আর অভিনেত্রীর সংলাপের প্রকাশ। সেই সংগে আমার নিজস্ব অভিমত, এই নাটকে আলোর রং যেন বেমানান লাগে। সাদা-কালেধার ব্যবহারটাই যুক্ত হলে ভালো মনে হয় আমার। তবে পরিচালকের ভাবনাই শিরোধার্য- এই হক কথা মেনে নিতে আমার আপত্তি নেই। বাংলাদেশের অভিনীত তালিকায় আর একটি একক নাটক যোগ হলো- ম্যাড থিয়েটার পরিবারকে তার জন্য সাধুবাদ জানাই।