শৈশবের স্মৃতি পরিণত বয়সে মানুষের বেড়ে ওঠায় প্রভাব রাখে। বিল ক্লিন্টন একবার ওয়াইট হাউসে শৈশবে যান এবং তখনকার রানিং প্রেসিডেন্ট জন অফ কেনেডিকে দেখে তার প্রেসিডেন্ট চেয়ারে বসার ইচ্ছা মনের গহিনে রোপণ করেন। অপর দিকে বিল ক্লিন্টনের দাদি তাকে শৈশবে কোলে পিঠে মানুষ করার সময় বারং বার বলতেন, 'বিল তোমার জীবনে যেন বলার মতো গল্প থাকে।' সেই সুপ্ত ইচ্ছা আর বলার মতো গল্প মিলে মিশে এক পরিণত বয়সে বিল ক্লিটন আমেরিকার দুই দুই বারের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এবং তার আসন জন এফ কেনেডির আসন, তার বলার মতো গল্প অসংখ্য। অনেকটা সে রকম স্মৃতির বাস্তবতা যশোরের কেশবপুরে অবস্থিত চুয়াডাঙ্গা কৃষ্ণনগর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু হাচান সরদারের জীবনে। শৈশবে এক গণক ঠাকুর তার হাতের রেখা পড়ে বলেছিলেন, 'খোকা তোর হাতের রেখায় বিদেশ গমনের যোগ আছে।' আর তার মা বলে ছিলেন, তোর পায়ের তলায় তিল বিদেশ যাওয়ার চিহ্ন। দেখিস একদিন তুই বিদেশ যাবি। গণক ঠাকুরের ভবিষ্যদ্বাণী আর মায়ের চিহ্ন শনাক্তকরণের শুভ প্রার্থনায় একদিন সত্যি সত্যিই প্রধান শিক্ষক আবু হাচান সরদার বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে শিক্ষা কর্মশালা-কন্টেন্ট ক্রিয়েট এবং মাল্টিমিডিয়া প্রেজেন্টেশনের ওপর অধিকতর প্রশিক্ষণ লাভের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালেন থাইল্যান্ডে ছাব্বিশ জন স্কলারের একজন হয়ে। শৈশবের ইংগিত যৌবনে স্বপ্নের বাস্তবতা, থাইল্যান্ডে অর্জিত অভিজ্ঞতার আলোকে সঞ্চিত উপলব্দি, চলতি পথে যাত্রী সহযাত্রীদের প্রতি কৃতজ্ঞতার মরমিয় স্মৃতিকথা তিনি যত্নে পরম মমতায় লিপিবদ্ধ করেছেন। পাঠকদের উদ্দেশে, ছাত্রছাত্রীদের কল্যাণের ভাবনা ভেবে আর থাইল্যান্ডের অর্থনৈতিক সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আবহকে আমাদের আরও কাছাকাছি এনে দেবেন বলে, শিক্ষকতার সমান্তরাল কবি-সম্পাদক ও লেখক আবু হাচান সরদারের ভ্রমণ বিষয়ক গ্রন্থ 'থাইল্যান্ড থেকে ফিরে', মোমিন উদ্দীন খালেদের প্রচ্ছদে, অগ্রদূত অ্যান্ড কোম্পানি প্রকাশ করেছে অমর একুশে বইমেলায়।
বইমেলা হোক আর গ্রাম্যমেলাই হোক নাগরদোলায় চড়তে কেউ কেউ ভয় পায়। গ্রন্থের লেখকের বিমান চড়ার ভীতি আরও দুই ডিগ্রি উপরে। তার হাই প্রেসার। বিমানে উঠলে যদি প্রেসার আরও বাড়ে। তাই অফার এলেও না যাওয়ার জন্য সব রকমের চেষ্টা প্রচেষ্টা। কিছুতেই কিছু হলো না। প্রসব বেদনার কথা ভেবে মা কি সন্তানকে আনবেন না? বিমানে তাকে চড়ে বসতেই হলো। ভীতির বিপরীতে বিমান ভ্রমণ নিয়ে তার কি লেখনীর গাঁথুনি। তিনি লিখছেন, 'আমার সামনে থাকা মনিটরে বসে বসে দেখছিলাম ৪১০০০ ফুট উপর দিয়ে ৬০০ কিলোমিটার গতি নিয়ে উড়ে যাচ্ছে বিমান। মাঝে মাঝে মেঘের কারণে কেঁপে কেঁপে উঠছে। প্রথম বিমান ভ্রমণ, তাই কিছুটা ভয়, কিছুটা শঙ্কা, কিছুটা আনন্দ নিয়ে চুপচাপ আকাশ পথের আনন্দটা উপভোগ করছি। ভালোই লাগছে মুহূর্তগুলো। মাঝে মাঝে ইয়ারফোনে গান শুনছি, মনিটরে নাটক দেখছি।'
নাটকীয় যাত্রাপথে থাইল্যান্ডের সুবর্ণ ভূমি বিমানবন্দরে ল্যান্ডিং, ব্যাংককের প্রেসিডেন্ট পার্ক হোটেলে অবস্থান আর ক্যাসেটসার্ট ইউনিভার্সিটিতে দক্ষ দেশ-বিদেশি প্রশিক্ষকদের কাছে হাতে কলমেসহ মাল্টি প্রজেক্টরে প্রশিক্ষণ গ্রহণ। ক্যাসেটসার্ট ইউনিভার্সিটি সাতটি ক্যাম্পাসের মধ্যে দিয়ে কৃষি, বিজ্ঞান, আর্টস, সোশ্যাল সায়েন্স, হিউম্যানেটিস শিক্ষা, ইঞ্জিনিয়ারিং, স্থাপত্য প্রভৃতি বিভাগে যে শিক্ষায় যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে তারই আলোকে এই প্রশিক্ষণ। থাইল্যান্ডের মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থার সংক্ষিপ্ত মানচিত্র, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ ও সাফল্য, মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার কার্যকারিতার সূচক, মাধ্যমিক শিক্ষার বিষয়, স্কুল পরিচালনা-মনিটরিং এবং গাইড কৌশল, প্রশিক্ষক-শিক্ষকের, উপস্থাপন-কৌশল, বাচনভঙ্গি, শারীরিক ভাষা প্রভৃতির ওপর দিকনির্দেশনার বিভিন্ন পর্যায় লিপিবদ্ধ করেছেন লেখক ও শিক্ষক আবু হাচান সরদার সহজ-নান্দনিক ও জীবন্ত সত্ত্বায়।
জীবন্ত সত্ত্বায় না বরং খানিকটা আত্মভোলায় ভুল পদক্ষেপে রাস্তা পার হতে গেলে যেভাবে থাই ড্রাইভাররা গাড়ি থামিয়ে তাকে আগে আগে পথ পার করালেন তা তাকে চিনিয়ে দিল থাইল্যান্ডের ট্রাফিকিং মাধুর্য। রেস্টুরেন্টে খেতে বসে বিলম্বে খাবার পেতে পেতে জানলেন, অর্ডারের খাবার রান্না করেই তবে পরিবেশনা। পচা-বাসি কিংবা ভেজাল কাবার থাই রেস্টুরেন্টে অচল। স্কুল পরিদর্শনে ক্লাসে একত্রে দুজন শিক্ষকের উপস্থিতি এবং প্রত্যেক শিক্ষকের জন্য আলাদা পড়ার ডেস্ক। অর্থাৎ মোমবাতি আগে নিজে জ্বলবে তবেই চারিদিকে আলো। জুয়েলারি শপে এত যে সস্তায় হীরা, নীলা, রুবি, পান্না, পোখরাজের সহজলভ্যতা সেতো হবেই- কারণ থাইল্যান্ডের রয়েছে নিজস্ব খনি আর দক্ষ কারিগরের মিলন মেলা। ব্যাংকক থেকে পাতোয়া সি বিচ ১৪৭ কিলোমিটারের দূরত্বে কিন্তু লেখক স্বপ্নের পাতোয়াকে উপভোগ করছেন সারাটা রাত্রি জেগে- কেন না পাতোয়া কখনো রাত্রে ঘুমিয়ে পড়ে না। তাই তিনি লিখছেন, 'সমুদ্রের হাতছানির সঙ্গে সঙ্গে দেখা মেলে অন্যরকম এক রঙিন রাতের শহরের। নিশাচর মানুষরা রাতের কোলে বুদ হয়ে পড়ে থাকে। আবার রাতের জীবন মিলিয়ে যায় ভোরের আলোয়। দিন আর রাতের এই খেলা এই শহরের সৌন্দর্যে ভরা শুক্লাপক্ষের পূর্ণিমার মতো।'
মনের মতো করে সবটা লেখা, বইটির সব প্রসঙ্গের কথা চাইলেও লেখা সম্ভব না শব্দ সংখ্যার সীমাবদ্ধতায়। তবে গ্রন্থের লেখক কোরাল দ্বীপে যেতে স্পিড বোর্ডের বর্ণনা, নং নুচ ট্রপিক্যাল গার্ডেনে হাতির খেলা, সায়েন্স সেন্টার মিউজিয়ামে রোবট প্রযুক্তি প্রাক-ইতিহাস জগৎ-মাল্টিমিডিয়া উপস্থাপন, থাইল্যান্ডের বিচিত্র সংস্কৃতি, দেশরক্ষক পান্না বুদ্ধ বিগ্রহ, জনপ্রিয় শপিং মলগুলোর পণ্যের সমাহার, থাইল্যান্ডের ভাষা শিক্ষার পরিক্রমা, থাই ফ্রুটসের রমরমা, স্কলার ২৬ জনের নামের তালিকাসহ প্রশিক্ষকদের নিয়ে লেখনী এক কথায় অনবদ্য। অনবদ্য আবু হাচান সরদারের গ্রন্থের নাম 'থাইল্যান্ড থেকে ফিরে' নামকরণের মতো তার লেখা সমাপনী পর্ব 'নীড়ে ফেরা'র অন্তিম সংলাপ যেখানে তিনি লিখছেন, 'যখন চুকনগর বাজারে এসে পৌঁছলাম তখন মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে আজানের মধুর ধ্বনি ভেসে আসছিল। বাস থেকে নেমে সোজা বাড়ির পথে পা বাড়ালাম। গাঁয়ের আঁকা বাঁকা মেঠো পথ ধরে হাঁটছি। পথের দুধারে শিশির-ভেজা সবুজ ঘাস আর এলোমেলো শিমের ডগার ওপর ভোরের নরম রোদের ঝিলিক মনে করে দিচ্ছিল আমার খুব প্রিয় গানের দুলাইন- 'গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ, আমার মন ভুলায়রে।'