মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

রক্তে লেখা বাংলাদেশ

আহমাদ কাউসার
  ২৯ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
রক্তে লেখা বাংলাদেশ

রাত তখনো হয়নি গভীর। আকাশের বুকে স্নিগ্ধ হাসি নিয়ে ঝুলে থাকা রুপালি থালার মতো চাঁদ জোছনা ছড়ায় প্রকৃতির পরতে পরতে। দূর গাঁয়ের গাছগাছালি যেন ধূসর চাদর গায়ে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জোনাকিরা উদ্দেশ্যহীন ছুটে চলছে এদিক- সেদিক। নির্জন বিলের প্রবীণ বট গাছটার নিচে বসে সাগরেদদের সঙ্গে শলা-পরামর্শে ব্যস্ত ডাকাত সর্দার তরক্ষমিয়া। এহন আর আমরা ডাহাতি করতাম না। মানুষের পাশে দাঁড়াইতে অইব। গাঁয়ে মিলিটারি আইছে। মা-বোনদের ধইরা লইয়া যাইতাছে ক্যাম্পে। যাকে সামনে পাইতাছে তাকেই গুলি করতাছে। এলাকার কিছু লোক রাইতে বাড়ি বাড়ি গিয়া লুটতরাজ করতাছে। আমরা সারাজীবন মানুষের ক্ষতি করছি, মানুষ মারছি। এহন দেশের অবস্থা ভালা না, আমরা মনুষের পাশে দাঁড়ায়াম, দেশের জন্য কাজ করাম।

সাগরেদ লাড্ডু ওস্তাদ তরক্ষ মিয়ার কথা শুনে উচ্ছ্বাসের সহিত বলল, 'হ, ওস্তাদ, এহন ডাহাতির সময় না, আমরা দেশের জন্য লড়াম। লাড্ডুর সঙ্গে বাকিরাও সম্মতি জানাল। ডাকাত সর্দার তরক্ষমিয়া শলা-পরামর্শ শেষে বিড়ি টানতেছিল আর কি যেন ভাবতেছিল। হঠাৎ সামনে দৃষ্টি যেতেই দেখল কে যেন দৌড়ে বটগাছটার দিকেই আসছে। হঁ্যা, একটি যুবতী মেয়ে; পাগলের মতো দৌড়ে আসছে বটগাছের দিকে। তরক্ষমিয়াদের উপস্থিতি টের পায়নি মেয়েটি। তরক্ষমিয়া একটু এগিয়ে গিয়ে যুবতী মেয়েটির সামনে দাঁড়িয়ে বলল, 'কেডা আফনে'?

চমকে গেল মেয়েটি, দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে। অতি ঘনঘন নিশ্বাস নিচ্ছে, ভয়ে কাঁপছে---কিছুই বলতে পারছে না। তরক্ষমিয়ার বুঝতে আর কোনো সমস্যা হলো না--- মেয়েটি হায়েনাদের কাছ থেকে বাঁচতে পালিয়ে এসেছে। তরক্ষমিয়া মেয়েটিকে অভয় দিয়ে বলল, 'তুমি আমডার বইনের মতন, এহানে বও, জিরাইয়া লও। আমডা তোমার কোনো ক্ষতি করতামনা। কি অইছে কও।' মেয়েটি তরক্ষমিয়ার কথা শুনে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ বসার পর, তরক্ষমিয়া জিজ্ঞেস করল, 'তুমি কই থাইক্কা আইছো, কই যাইবা?' যুবতী মেয়েটি কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে একটু থেমে থেমে বলল, 'পাশের গাঁয়ে আমার হওর বাড়ি। আমার হওর বাড়িতে একটু আগে মিলিটারিরা ঢুকছে। আমার হওর টের পেয়ে আমাকে পলাইয়া যাইতে কইছে। আমি ঘরের পেছনের দরজা দিয়া বাইর অইয়া চইলস্না আইছি।'

তোমার জামাই কই আছিল?

হে ইন্ডিয়া গেছে, যুদ্ধের ট্রেনিং লইতে।

তুমি এদিকে কই যাইতাছিলা?

সামনের গাঁয়ে আমার বাবার বাড়ি।

কও কী?

তোমার বাপের নাম কী?

সুবল দাস?

তুমি বনমতী গাঁওয়ের সুবল দাসের মাইয়া?

হ।

বনমতী গাঁয়ে তো আইজক্কা মিলিটারি আইছে।

মেয়েটি তরক্ষমিয়ার কথা শুনে চুপ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর তরক্ষমিয়া বলল,

'ঠিক আছে লও আমি তোমাকে তোমার বাপের বাড়িতে দিয়া আই।'

তরক্ষমিয়ার কথা শুনে মেয়েটি কিছুটা ভরসা পেল। মেয়েটির ভয় কিছুটা কেটে গেলেও রাতের বেলায় এতগুলো পুরুষ মানুষের সঙ্গে একটা অপরিচিত মেয়ে পুরোপুরি ভয়হীন না থাকতে পারাঁই স্বাভাবিক। তাছাড়া মেয়েটির আর কিছুই করার নেই। কিছুটা ভয় আর আতঙ্ক নিয়েই মেয়েটি তরক্ষমিয়ার পেছনে পেছনে ছুটল। তরক্ষমিয়া বাকি সাগরেদদের বলল, 'তরা যার যার বাড়ি চইলস্না যা।' তরক্ষমিয়ার সব পথঘাঁ চেনা। তিরিশ বছর এ এলাকায় ডাকাতি করে। তরক্ষমিয়া মেয়েটিকে নিয়ে হঁাঁটতে হঁাঁটতে চলে এল বনমতী গাঁয়ে। বনমতী গাঁয়ে ঢোকার সময় তরক্ষমিয়া মেয়েটিকে বলল, 'খুব সাবধানে আড। কেউ যেন টের না পায়। গাঁওয়ে মিলিটারি আছে'। মেয়েটি ক্ষীণস্বরে বলল, 'ঠিক আছে।' মেয়েটি তার বাড়ির কাছাকাছি আসতেই ভয় ভেঙে গেল। আস্তে আস্তে ঢুকল বাড়িতে। বাড়িতে ঢুকে ওরা দেখতে পেল কেউ নেই, নির্জন এক ভুতুড়ে অবস্থা। ঘরের দরজা খোলা। মেয়েটি প্রত্যেকটি ঘর খুঁজে কাউকে পেল না। তার মনে আবারও আতঙ্ক নেমে এল। তরক্ষমিয়া মেয়েটিকে বলল, 'বাড়িতে কেউ নাই, হয়তো কোথাও পালাইয়া গেছে।' তুমি এহানে একলা থাহা ঠিক অইব না। আমার সাথে লও, আমার বাড়িতে।' ময়েটি মেঝে বসে কাঁদতে লাগলো। তরক্ষমিয়া বলল, এহানে থাহা ঠিক অইব না আমার সাথে লও।' মেয়েটিকে নিয়ে তরক্ষমিয়া বাড়ি থেকে বের হবে এমন সময় ঘরের পাশে ঝোপে কি যেন লড়ে উঠল। তরক্ষমিয়া কিছুটা ভয় পেয়ে গেল। আবার নড়ে উঠল তরক্ষমিয়ার হাতে থাকা চর্ট জ্বালিয়ে দেখতে পেল একটি মেয়ে ঝোপে লুকিয়ে আছে।

কে ওইহানে?

মেয়েটির সারা-শব্দ নেই।

তরক্ষমিয়ার সঙ্গে থাকা মেয়েটি তরক্ষমিয়ার হাতের টর্চ নিয়ে জ্বালিয়ে দেখতে পেল তার ছোট বোন মিতা।

মিতা রে?

ক্ষীণ স্বরে জবাব এলো।

হ।

আমি রিতা, এহানে কি করছ? বাইর অইয়া আয়।

মিতা বেরিয়ে এলো।

বাবা-মা কই?

মিতা কাঁপতে কাঁপতে বলল,

কিছুক্ষণ আগে বাড়িতে মিলিটারি আইছিল। বাবা-মাকে ধইরা নিয়য়া গেছে। আমি কোনো রকম এহানে পলাইয়া ছিলাম।

দেবেন কই?

দাদা, ইন্ডিয়া গেছে ট্রেনিংয়ে। দাদা ইন্ডিয়া যাওয়ার খবরডা রহমত মাতব্বর মিলিটারিদের জানাইয়া দিছে। তাই ওরা আইয়া বাবা-মাকে ধইরা লইয়া গেছে।

রিতা মিতাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল।

রিতা মিতার সঙ্গের লোকটির কথা জানতে চাইলে তরক্ষমিয়া মিতাকে থামিয়ে বলল, 'আমি তরক্ষ, পাশের গাঁওয়ে আমার বাড়ি। সে ডাকাতি করে সেটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। ডাকাত শব্দটা শুনলেই ওরা ভয় পেয়ে যাবে। বটগাছের নিচে মিতা তরক্ষ-ও তার সাগরেদদের দেখে বুঝতে পারেনি ওরা ডাকাত, তাই তরক্ষ তার পেশাগত পরিচয়টা গোপন করে বলল, 'আমরা ক'জন বিলের বটগাছের নিচে বসে যুদ্ধে যাবার পরিকল্পনা করছিলাম। তখন তোমার দিদিকে দেখলাম দৌড়ে এদিকে আইতাছে। তার কাছে সবকিছু জাইন্না তাকে আমি নিয়ে আইলাম। তোমরা এহানে থাকাডা ঠিক অইব না। আমার লগে লও।' রিতা আর মিতার মন সায় দিচ্ছে না তরক্ষমিয়ার সাথে যেতে। তরক্ষমিয়া মেয়েগুলোকে একা রেখে যেতে চাচ্ছে না। তরক্ষমিয়া মেয়েগুলোকে বুঝিয়ে বলার পর ওরা তরক্ষমিয়ার সাথে নির্বিবাদে হাঁটতে শুরু করল। রিতা আর মিতা অসহায়ের মতো অনিচ্ছার বাঁধা ভেঙে তরক্ষমিয়ার পেছনে ছুটছে। অচেনা তরক্ষমিয়াই এখন ওদের ভরসা। বনমতী গাঁ পেরিয়ে নন্দ গাঁয়ের ছোট একটা কুঁড়েঘরে এলো ওরা। এই কুঁড়েঘরেই থাকে তরক্ষমিয়া ও তার স্ত্রী জোহরা বানু। জোহরা বানুকে তরক্ষমিয়া মেয়েগুলোর হালবৃত্তান্ত জানাল। জোহরা সব কথা শুনে মেয়েগুলোর প্রতি মায়া লেগে গেল। ছোট কুঁড়েঘরে জোহরার সাথে ওরা থাকতে লাগল। চারদিকে আতঙ্ক আর হাহাকার। পাক হায়েনারা নির্বিচারে মারছে সহজ-সরল মানুষকে। রিতা আর মিতার চোখে ঘুম নেই। মিতার স্বামী ট্রেনিং শেষে হয়তো কোথাও যুদ্ধ করছে। বাবা-মা'র তো কোনো খবরই নেই। তরক্ষমিয়ার যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল এখন আর তার সেই ইচ্ছে নেই। কারণ এখন সে যে দু'টি অসহায় মেয়ের দায়িত্ব নিয়েছে। সে চলে গেলে ওদের কে দেখবে। নানারকম ভাবনা তরক্ষমিয়ার মনে। যুদ্ধে যেতে না পারার কষ্ট তাকে নাড়া দেয়। তরক্ষমিয়া রাত জেগে ট্রানজিস্টরে যুদ্ধের খবর শুনে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান শুনে। এক রাতে তরক্ষমিয়া ট্রানজিস্টর শুনছিল হঠাৎ শুনতে পেল ঘরের বাহিরে মানুষের পায়ের শব্দ। তরক্ষমিয়া ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

কে?

কাকা আমরা মুক্তিযোদ্ধা।

তরক্ষমিয়া দেখতে পেল তিনজন যুবক। দুইজন সুস্থ আরেকজন রক্তাক্ত অবস্থায় কাতরাচ্ছে। তরক্ষমিয়া এগিয়ে গেল ওদের কাছে। অসুস্থ যুবকটি অজ্ঞান অবস্থায় আছে। শরীরের গুলি লেগেছে। বাকি দুইজন ওকে কাঁধে করে নিয়ে এসেছে।

একজন যুবক তরক্ষমিয়াকে বলল, 'চাচা ছেঁড়া কাপড় থাকলে আনেন।' তরক্ষমিয়া ঘর থেকে জোহরা বেগমের একটা পুরনো কাপড় আনল। কাপড় দিয়ে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করল কিন্তু কিছুই কাজ হচ্ছে না।

রিতা আর মিতা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। রিতা আহত যুবকটিকে দেখে চিৎকার দিয়ে জড়িয়ে ধরল। যুবকটি তার স্বামী শুভেন্দু। মিতার কান্নায় গভীর রাতে চরের আশপাশ ভারী হয়ে উঠল। কিছুক্ষণ পর শুভেন্দু চোখ খুলল। মিতার দিকে অপলক তাকিয়ে রইল, ঠোঁট দুটো কাঁপছে শুভেন্দুর। কিছু বলার চেষ্টা করছে কিন্তু বলতে পারছে না। রিতার ডান হাতে শুভেন্দু তার রক্তাক্ত হাত দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে লিখে দিল, বাংলাদেশ। আরও কিছুক্ষণ রিতার দিকে অপলক তাকিয়ে থেকে চিরতরে চোখ বুজে ফেলল শুভেন্দু। ক্ষণিকের জন্য নয় চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল শুভেন্দুর চোখ। রিতার কোলে শুয়ে পরপারে যাত্রা করল শুভেন্দু।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে