তিনি ছিলেন একাধারে অধ্যাপক, লোকসংস্কৃতি গবেষক, গ্রামীণ জনপদের সাহিত্য-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ও প্রশাসক। শামসুজ্জামান খান বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তার উলেস্নখযোগ্য সম্পাদনা গ্রন্থ 'বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা' ৬৪ জেলায় ৬৪ খন্ডে প্রকাশিত হয়। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মীর মশাররফ হোসেনের জীবন কর্ম ও বিভিন্ন সাহিত্যিকদের ওপর বিশেষ গবেষণা গ্রন্থ রচনা করেছেন।
শামসুজ্জামান খান শিশুসাহিত্য, গল্প, বাংলা লোকসাহিত্য থেকে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সম্পদ আহরণ করেছিলেন। কিশোর বয়স থেকেই তার লেখালেখি শুরু। ছাত্রাবস্থায় হাতে লেখা পত্রিকা 'পূর্বাভাষ' সম্পাদনা করেন। ১৯৫৭ সালে তার লেখা প্রকাশিত হয় দৈনিক আজাদের মুকুলের মাহফিলে। শহীদ রফিকের জীবন কাহিনী নিয়ে রচিত হয়েছিল 'লালশার্ট' শীর্ষক গল্পটি। একই এলাকায় বেড়ে ওঠা জনাব খান নিপুণভাবে রফিককে তুলে ধরেছিলেন গল্পে। তার রচনা ভাষা আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধ, শেরে বাংলা ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিয়ে তথ্যসমৃদ্ধ।
শামসুজ্জামান খান রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থমালা: বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা, ফোকলোর সংগ্রহমালা, দুনিয়া মাতানো বিশ্বকাপ, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপ ও প্রাসঙ্গিক কথকতা।
তার আগ্রহ ও পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা একাডেমিতে বহুতল ভবন নির্মিত হয়। অনুবাদ, ফোকলোর ও সাহিত্যের নানা ক্ষেত্রে তার সবিশেষ আগ্রহ ছিল। শামসুজ্জামান খান বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। তার মধ্যে উলেস্নখযোগ্য অগ্রণী ব্যাংক পুরস্কার (১৯৮৭), কালুশাহ পুরস্কার (১৯৮৭), দীনেশ চন্দ্র সেন ফোকলোর পুরস্কার (১৯৯৪), আব্দুর রউফ চৌধুরী পুরস্কার (১৯৯৮), দেওয়ান গোলাম মোর্তজা পুরস্কার (১৯৯৯), মীর মশাররফ হোসেন স্বর্ণপদক (২০০১)।
তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার (২০০১), একুশে পদক (২০০৯) ও স্বাধীনতা পুরস্কার (২০১৭)-তে ও ভূষিত হন।
শামসুজ্জামান খান ফোকলোরবিদ, গবেষক ও প্রশাসক। তিনি শেকড় সন্ধানী গবেষক ছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একজন অনুরাগী হিসেবে তার অন্তরগত চেতনা, রাষ্ট্রচিন্তা ও উন্নয়নমূলক ভাবনা ছিল তার গবেষণার প্রধান বিষয়। লোকসংস্কৃতির বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ, গ্রামবাংলার সাহিত্য নিয়ে বিস্তর কাজ করেছেন। মীর মোশাররফ হোসেনসহ অসংখ্য সাহিত্যিকদের নিয়ে তিনি কাজ করেছেন।
শামসুজ্জামান খানের জন্ম ১৯৪০ সালের ২৯ ডিসেম্বর, মানিকগঞ্জে। অসংখ্য রচনার কৃতী স্রষ্টা। উইকিপিডিয়া থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশের লোকজ গ্রন্থমালা সিরিজে ৬৪ জেলার ইতিহাস ও সংস্কৃতি ও ১৪৪ খন্ডে বাংলাদেশের গ্রন্থমালা সম্পাদনার বিশেষ কাজটি তিনি সম্পন্ন করেন।
পারিবারিকভাবে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমী চিন্তার অধিকারী। তার পিতা এম আর খান বিদ্বান ছিলেন। অনুবাদক হিসেবে খ্যাতিমান। দুই বছর বয়সে শামসুজ্জামান খান পিতৃহারা হন। মা ও দাদির তত্ত্বাবধানে তার শৈশব, কৈশোরের পাঠ ও মানস গড়ে ওঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাবিভাগে পড়ার সময় তিনি একঝাঁক শিক্ষক ও তরুণ বন্ধুদের অনুপ্রেরণায় লেখালেখিতে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি ১৯৬৩ সালে অনার্স ও ১৯৬৪ সালে এম. এ. ডিগ্রি লাভ করেন। শামসুজ্জামান খান ১৯৬৪ সালে হরগঙ্গা কলেজে বাংলা বিভাগের প্রভাষক ও পরে একই বছর জগন্নাথ কলেজে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রশাসনে তার একাধিক কাজের অভিজ্ঞতা ছিল। ১৯৬৮ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ, ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যুক্ত হন। বাংলা একাডেমির ফোকলোর বিভাগের যাত্রাকালে তিনি যোগ দেন। পরে তার নিত্যনতুন পরিকল্পনা নিয়ে প্রতিষ্ঠানকে সমৃদ্ধ করেন। তিনি যখন বাংলা একাডেমির চাকরিতে যোগদান করেন তখন ছিলেন একঝাঁক তরুণ তুর্কী রশীদ হায়দার, রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরী, মুহাম্মদ নুরুল হুদা, সেলিনা হোসেন। উত্তরাধিকার নামের একটি সাহিত্য পত্রিকা ঘিরে তরুণদের আগ্রহ। প্রথম থেকে শামসুজ্জামান খান ছিলেন সিরিয়াস ধরনের গবেষক। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু রচিত 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী', 'কারাগারের রোজনামচা' সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন সাংবাদিক বেবী মওদুদের সঙ্গে। 'আমার দেখা নয়া চীন' গ্রন্থ সম্পাদনায় ও তার অবদান রয়েছে। শামসুজ্জামান খানের জ্ঞান ভান্ডার ছিল সমৃদ্ধ। তাকে চলন্ত বিশ্বকোষ হিসেবে সবাই সমীহ করত। অসম্ভব স্মরণ শক্তির অধিকারী ছিলেন তিনি। অচেনা শব্দ দিয়ে তিনি যে রচনা সৃষ্টি করতেন তা সহজে হৃদয়ে গেঁথে যেত। তার পরিচিত জগৎ ছিল বিস্তৃত। তরুণ থেকে শুরু করে প্রবীণ পর্যন্ত সবার খবর রাখতেন তিনি। তার সেলফোন থেকে কিংবা সরকারি ফোন থেকে তার কথামালা তরুণদের আলোড়িত করত।
আফ্রিকা ভ্রমণকালে একবার তিনি মৃদু হৃদরোগে আক্রান্ত হন। পরে হৃদযন্ত্রের চিকিৎসার জন্য তার বাইপাস সার্জারি করা হয়।
শামসুজ্জামান খান ২০০৯ সালে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক নিযুক্ত হন। পরপর তিন দফা তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০১৮ সালের ০১ অক্টোবর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার হিসেবে তাকে নিয়োগ দেয়া হয়। তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমী ব্যস্ত মানুষ। মন্ত্রী, আমলা, সাহিত্যিক, উঁচু স্তর, মধ্য স্তরের নানান মানুষের সঙ্গে তার ব্যবহার, আতিথেয়তা ছিল মুগ্ধ করার মতো। প্রশাসনিকভাবে ব্যস্ত থেকেও সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখে কীভাবে লীন থাকা যায় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ছিলেন শামসুজ্জামান খান। কিছু সময় সাহিত্যিকদের সঙ্গে সময় কাটানো তার কাজের অংশ ছিল। স্নেহ করতেন। পরামর্শ দিতেন নতুন কিছু পড়ার। শুধু পাঠ, গবেষণা, তত্ত্ব তালাশ কীভাবে একেকজন মানুষকে মানবিক ও সৃজনী করে তুলতে পারে তার মূর্ত প্রতীক ছিলেন শামসুজ্জামান খান। তিনি ছিলেন পরোপকারী। কিন্তু কখনো ভুলে যাননি। যাদের জন্য কিছু করছেন তারা তাকে নতুন অভিজ্ঞতার সন্ধান দিতে পারেন। কিছু না পাওয়ার আশা নিয়ে অকাতরে কল্যাণ করে গেছেন তিনি। তার কোনো অনুতাপ ছিল না। বাংলা একাডেমি ছিল তার ধ্যান, জ্ঞান ও আরাধনা। বাংলা একাডেমি সম্প্রসারণে তিনি নিরন্তর কাজ করেছেন। এর মধ্যে যেমন ছিল অবকাঠামো উন্নয়ন পাশাপাশি বিভিন্ন বিভাগ, সম্প্রসারণ। অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান ২০২১ সালের ১৪ এপ্রিল করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃতু্যবরণ করেন।
গবেষণা, দেশ প্রেম, লোকসাহিত্য অনুরাগ ও মনোযোগ তাকে ইতিহাসে স্মরণীয় করে রাখবে। তার প্রিয়জনরা চাইতেন তিনি একটি নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠুন। তিনি বলতেন বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করা বাকি। মৌলবাদীরা সক্রিয়। বাংলা নববর্ষ, বাংলা পঞ্জিকা, নববর্ষের ইতিহাস, বাঙালির আত্মপ্রকাশ ও পরিচয়ে শামসুজ্জামান খান নিরন্তর কাজ করেছেন। একজন অভিভাবক প্রকৃত অর্থে নির্লোভ, নিরাহংকারী ও পরোপকারী শামসুজ্জামান খান বেঁচে থাকবেন স্মরণে, স্মৃতিতে পাঠে। তার অসংখ্য লেখা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এগুলো গ্রন্থাবদ্ধ করা জরুরি।