বই আলোচনা
মঞ্চের কথা মঞ্চকথা
প্রকাশ | ২২ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
নৈরাশ্যবাদী বলে, ঢাকার নাট্যচর্চা সংকুচিত হতে হতে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আর মহিলা সমিতি কেন্দ্রিক। একাডেমিতে বই প্রকাশনা এবং বিক্রয় কেন্দ্র আছে বটে তবে তা সরকারি অফিস টাইম মেনে। নাটকের মানুষের আনাগোনাতো সন্ধ্যায়: ফলে তারা পড়বে কি আর কিনবেই বা কি? আবার আশাবাদী বলে, একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী যদি আর্ট মার্কেট খুলতে পারে তবে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জাতীয় নাট্যশালার সিঁড়ির পাশে একটা বেসরকারি বুক স্টল খোলা ওয়ান টু'র ব্যাপার। তাহলে নাটকের মানুষসহ নাট্যানুরাগী দর্শক শ্রোতা নাটকের বই, লিটিল ম্যাগ, বুলেটিন কিনতে পারবে, পড়তে পারবে আবার চোখ বুলাতেও পারবে। কে কি পারবে তার জন্য পা ভাঁজ করে বসে থাকার মতো পাত্র নাট্যকর্মী সম্পাদক ওয়াহিদুল ইসলাম না। অল্প বিজ্ঞাপন আর স্বল্পমূল্যে বিক্রয়ের সাধ্য নিয়ে বিভিন্ন অবয়বে, বহুমাত্রিক লেখার সন্নিবেশে থিয়েটার বিষয়ক সাময়িকী মঞ্চকথা প্রকাশ করে তিনি যাত্রা শুরু করেছেন পাঠকের দোরগোড়ে। পাঠকের মঞ্চভ্রমণ তার লক্ষ্য, মঞ্চকথাকে অস্ট ব্যাঞ্জনায় নব রূপায়ন তার কর্মযজ্ঞ আর মঞ্চকথাকে ঘিরে নাটকের মানুষের একত্রিত করতে চাওয়া ও পারা তার থিয়েটারের প্রতি ভালোবাসার অনমনীয় কর্মদক্ষতার স্মৃতিসাক্ষ্য। সেই সাক্ষ্যতার ধারাবাহিকতায় ওয়াহিদুল ইসলামের সম্পাদনা ও প্রকাশনায় প্রকাশিত হয়েছে সতেরো বছরের পদার্পণে মঞ্চকথার ফেব্রম্নয়ারি সংখ্যা-২০২৪। ২০-এর অধিক পর্ব বিভাগে ২৫-এর অধিক লেখকের লেখার সংকলনে এবারে মঞ্চকথা বইয়ের আকারে নান্দনিক এবং বহুমাত্রিক। বহুমাত্রিক তথা গ্রম্নপ থিয়েটার কেন্দ্রিক দলসমূহের মঞ্চায়ন, পেশাদার দলসমূহের মঞ্চায়ন, শিক্ষায়তনসমূহের মঞ্চায়ন, একাডেমির রেপার্টরি দলসমূহের মঞ্চায়নের আলোকে ২০২৩ সালে কার কি ভূমিকা তা নিয়ে তথ্যে উপাত্তে বিশ্লেষণ করেছেন ড. তানভীর আহমেদ সিডনী। মৈমনসিংহ গীতিকা প্রকাশের শতবর্ষে সম্পাদক দীনেশ চন্দ্র সেন এবং সমান্তরাল সংগ্রাহক চন্দ্র কুমার দে'র ওপর পাঁচ ব্যাটারীর তীক্ষ্ন আলো ফেলেছেন শিক্ষক আল্ জাবির। নিজের রচিত নির্দেশিত নাটক নেতা যে রাতে নিহত হলেন, তার প্রাপ্তি এবং প্রত্যাশা ফুটিয়ে তুলেছেন রেজানুর রহমান। বিষয়টা ছেলে মানুষী তথাপি তার দলগত টিকিট ক্রয় প্রসঙ্গ ভাবনার দাবি রাখে। বিলম্বে স্বীকৃতি কিন্তু অত্যাধিক পেয়ে বিভ্রান্ত কবি নাট্যকার আসাদুল ইসলাম শান্ত প্রশান্ত এবং প্রাজ্ঞ রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় বিজয়া রচনার অন্তরালের কথা তুলে ধরায়। থিয়েটারের ক্যাপ্টেন আলী জাকের যে সবিশেষ স্নেহ এবং নির্ভর করতেন মোহাম্মদ আলী হায়দারের নির্দেশনায় তার যোগ্য নিরূপণ, সখী রঙ্গমালা নির্মাণ নিয়ে ত্রিকাশদর্শীর মতো নান্দনিক ব্যাখ্যায়। চট্টগ্রামের নাট্যচর্চায় ইউসুফ ইকবালের লেখা চর্চিত কথার পুনঃরাবৃত্তি। রাজশাহীর নাট্যচর্চায় শিক্ষক আরিফ হায়দার অলিগলি রাজপথে আলো ফেলে ফেলে বিপস্নব হাঁকিয়ে দেওয়ার মতো নির্ভীক থিয়েটার কান্ডারি। চিরায়ত বাংলা নাটক নিয়ে আলি আহমেদ মুকুল ফাইল সাজাবার মতো পরিপাটি। পালা নাট্য নিয়ে সায়িক সিদ্দিকী মঞ্চের পালাকারের মতো লেখক হিসেবেও তাল লয় সুরে সামগ্রিক পালানাট্যের মানচিত্র ফুটিয়ে তুলতে ডুব ডুব ডুব ডুবসাঁতারী। পুনঃমুদ্রিত লেখায় স্তানিস্স্নাভাস্কর অভিনয়ের দশ পদ্ধতি সংক্ষেপে অভিজ্ঞতার আলোকে চিনিয়ে দিতে কাজী রফিক ধারালো কিন্তু বিবর্তিত সময়ে স্তানিস্স্নাভস্কির নবতর মূল্যায়নে তাকে হতে হবে আরও ভারবাহী এটাই যেন সময়ের দাবি। মাইকেলের ২০০ তম জন্মদিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পরিবেশনা নিয়ে কথক বিশ্বাস জয়ের লেখায় দৃশ্যমান, অ্যাবসার্ডের যন্ত্রণার দিন শেষ, রিয়েলিটির স্টোরি টেলিংয়ের দিন শুরু। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগ পঞ্চম আবর্তনের শিক্ষার্থীদের ৯টি নাট্য নির্মাণ পরীক্ষা প্রযোজনা নিয়ে স্পর্শ বনিকের লেখার গাথুনী থেকে পরিষ্কার, একাডেমি যদি ছাত্রছাত্রীদের ওপর পান্ডিত্যের বোঝা চাপিয়ে না দেয় তবে সৈয়দ শামসুল হক কিংবা আব্দুলস্নাহ আল মামুনদের যোগ্য উত্তরাধিকারদের ফুটে বেরিয়ে আসা মুহূর্ত কাল অপেক্ষা মাত্র। তবে আলফেয়াড এলিশায় জয়ের লেখায় ভাববার, কি লিখব সেটি লেখার আগেই জানা থাকা দরকার। নাট্য সমালোচনার হাল-হকিকত নিয়ে আবু সাঈদ তুলুর লেখা বইয়ের পাতার মতো এবং হকিকত স্পষ্ট কিন্তু হাল অস্পষ্ট। হালের টানে সমালোচনার পালে তিনি তার নিজের কথা লিখবে এটাই কাম্য। সমালোচক যে এক অর্থে আবিষ্কারক এবং শিল্প স্রষ্টার শাসক এবং বান্ধব এটি সত্যি বলেই তাকে নিয়ে আলোচনায় প্রাজ্ঞতার অত্যাধিক দাবি রাখে। আদম সুরত নিয়ে আশিস গোস্বামীর প্রশংসা প্রাসঙ্গিক কিন্তু মনে রাখতে হবে, অন্ধকার দিয়ে অন্ধকার হঠানো যায় না। প্রয়োজন হয় আলোর। অংশুমান ভৌমিক হৃৎপিন্ডে চাকুর খোঁচা দিয়েছে জ্যোতি সিনহার অভিনয় নিয়ে প্রশ্ন তুলে। কিন্তু যেহেতু তাকে দলের দাবি মেনে নাট্য সমালোচনা করতে হয় সে কারণে রিমান্ডের আলোচনা শেষ পর্যন্ত উদ্দেশ্যমূলক। হুমায়ূন আজম রেওয়াজের লেখনীতে ভাষার শাসন প্রবণতা পাঠে খানিকটা বিঘ্ন ঘটায় তবে নাট্যকারের উদ্দেশে তোলা প্রশ্ন তার সমালোচনা লেখার নিজস্ব দিক। মো. শওকত হোসেনের ঢাকার বাইরে নাট্যচর্চা নিয়ে লেখা যথারীতি পুনঃরাবৃত্তির। ড. ইস্রাফিল আহমেদের মূকাভিনয় নিয়ে লেখায় লিভিয়াস এন্ড্রোনিকাস, পার্থ প্রতিম মজুমদার, মশহুরুল হুদা, জিলস্নুর রহমান জন, জাহিদ রিপন, রিজোয়ান রাজন, মীর লোকমানদের নিয়ে আলোচনা যেমন মনোগ্রাহী তেমনি নান্দনিক কোরিয়ার অর্জন। কামরুন নূর চৌধুরী ভারাক্রান্ত মন নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন মঞ্চাভিনেতা জাহিদুর রহমান পিপলুকে। মঞ্চকথা ডেস্ক ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে নাট্যগ্রন্থ থিয়েটার পত্রিকা সম্পাদকীয় সংকলন, বাংলাদেশের নাট্যচর্চার পাঁচ দশক, বটতলার নাটক পথে নেটে সচেতনতায়নে, একটি মরা গাছ ও চারজন নারীর স্বপ্ন ভঙ্গ, বহুরূপী, হোমার ও হাফডজন পথনাটক। মঞ্চ কথার বিশেষ প্রতিবেদনে বিশেষভাবে তুলে ধরেছে থিয়েটার অঙ্গনে এবং বহিরাঙ্গনে ঝড় তোলা পুলিশ থিয়েটারের পথ প্রদর্শক পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমানকে। প্রশাসন এবং সাধারণের মাঝে শিল্প সুন্দরের উপকরণ দিয়ে তিনি যেভাবে সম্পর্কের সেতুবন্ধন করে চলেছেন, তাকে নিয়ে প্রতিবেদন এক কথায় অভিনন্দন। অ্যাওয়ার্ড ফেস্টিভ্যালের খবরা খবর দিয়ে যে মঞ্চ কথা সমাপন, উম্মে আফসানা সাইমুনের প্রচ্ছদে এবং ওয়াহিদুল ইসলামের সম্পাদনায় সেই মঞ্চকথা ফেব্রম্নয়ারি সংখ্যা হতে চলেছে দ্বিতীয়বারের মতো পুনঃমুদ্রণ। থিয়েটার বিষয়ক চর্চিত কথার পুনঃরাবৃত্তির মাঝে এই নতুন এবং মৌলিক পথ চলায় মঞ্চ কথা এবং সম্পাদক ওয়াহিদুল ইসলামকে সবশেষে অভিবাদন।