বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সাদী মহম্মদ ১৩ মার্চ, ২০২৪ এই পৃথিবীর রৌদ্র ছায়া ছেড়ে অনন্তলোকে পাড়ি দিয়েছেন। তিনি স্বেচ্ছা মৃতু্যকে বেছে নিয়েছেন। তার এই চলে যাওয়া বড় বেদনার, বড় হাহাকারের। অত্যন্ত প্রতিভাময় এই শিল্পী ভেতরে ভেতরে যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছিলেন তা কেউ আগে থেকে বুঝতে পারেনি। জীবিতাবস্থায় দুইটি পুরস্কার ছাড়া তেমন আর কিছুই তার ভাগ্যে জোটেনি। তার স্বজন ও অনুরাগীরা হয়তো বলবেন জাতীয় পুরস্কার না পাওয়ায় তার মধ্যে এক ধরনের অভিমান তৈরি হয়েছিল। এ যুক্তি মেনে নিয়েও বলা যায়, শিল্পীতো পুরস্কারের জন্য চর্চা করেন না। সাদী মহম্মদের ভাই শিবলী মহম্মদ ভাইয়ের মৃতু্যর পর বলেছেন, 'আমার ভাই অভিমান নিয়ে চলে গেল।'
একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার সাদী মহম্মদ পেতেই পারতেন। যদু-মধুরা যেখানে পুরস্কার পায় সেখানে সাদী মহম্মদ পান না এটা দুঃখজনক। ফেসবুক জুড়ে সাদী মহম্মদকে নিয়ে আবেগঘন স্ট্যাটাস এক ধরনের বিষণ্নতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। প্রতিনিয়ত তার সঙ্গীতের ভিডিও, সাক্ষাৎকার বিধুরতা সৃষ্টি করছে। সাদীর তাজমহল রোডের বাড়িটি নিঃসঙ্গতা নিয়ে কাঁদছে। সাদী মহম্মদ না থেকেও থেকে যাচ্ছেন আমাদের অনুভবে, স্মৃতিতে।
যে রবী ঠাকুরের গান নিয়ে তার ঘর, গেরস্থালী ছিল, সেই রবীন্দ্রনাথ নিঃসঙ্গ ছিলেন। তিনি হারিয়েছিলেন তার প্রিয় বৌদি ও স্ত্রী'কে। তার প্রিয়জনরা একে একে মৃতু্যর কোলে ঢলে পড়ছে- তবু তিনি ছিলেন অটল হিমালয়ের মতো একাকী। দুঃখ-বেদনা একাকিত্বের ভার বহন করেছেন আজীবন। বেঁচে থাকার সৌন্দর্য ধারণ করেছেন তার সঙ্গীতে ও সাহিত্যে। অথচ সাদী মহম্মদ রবীন্দ্রনাথ থেকে শিখলেন না কিছুই। এক ধরনের বিষণ্নতা তার স্বেচ্ছা মৃতু্যকে প্ররোচিত করেছে। অনেক জায়গায় পুরস্কারের জন্য ফরম পূরণ করতে হয়। তিনি এসব করতে চাইতেন না। শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কারের জন্য একটি ফরম পূরণ তাকে করতেই হয় সেই ফরমটি তার মৃতু্যর দিন কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে।
সাদী মহম্মদ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫৭ সালের ০৪ অক্টোবর। ছোটবেলা থেকে অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হন। রবীন্দ্রসঙ্গীত অন্তঃপ্রাণ সাদী মহম্মদ ১৯৭৫ সালে সঙ্গীত বিষয়ে লেখাপড়ার জন্য শান্তি নিকেতন গমন করেন। পরে বিশ্বভারতী থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
২০০৭ সালে 'আমাকে খুঁজে পাবে ভোরের শিশিরে' এলবামের মাধ্যমে তার সুরকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে। ২০০৯ সালে 'শ্রাবণ আকাশে' ও ২০১২ সালে 'সার্থক জনম আমার' তার গীত ও সঙ্গীত এলবাম প্রকাশিত হয়। তিনি 'রবী রাগ' সাংস্কৃতিক সংগঠনের পরিচালক ছিলেন।
২০১২ সালে চ্যানেল আই সাদী মহম্মদকে আজীবন সম্মাননা প্রদান করেন। ২০১৫ সালে বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাবিরোধীরা তার পিতা সলিমউলস্নাহকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তিনি পিতা হত্যার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। পাপিয়া সারোয়ার ও অন্যন্য শিল্পীদের সঙ্গে পরিবেশিত দ্বৈত সঙ্গীত এক অনবদ্য সুরের মূর্ছনায় পৌঁছে দিয়েছে তাকে। মৃতু্যর দিন ২০২৪ সালের ১৩ মার্চ তানপুরা নিয়ে বসেছিলেন। রোজা শেষে ইফতারও সেরেছিলেন। প্র্যাকটিস শেষে তিনি স্বেচ্ছামৃতু্য বেছে নেন।
দীর্ঘদিন ধরে সাদী মহম্মদ ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন। ২০২৩ সালে জুলাই মাসে মা জেবুন্নেসা সলিমুলস্নাহ ও পরে বড়বোনের মৃতু্যর পর সাদী মহম্মদ এক ধরনের বিষণ্নতায় আক্রান্ত হন। সাদী মহম্মদ নির্ভৃতচারী আত্মমগ্ন শিল্পী ছিলেন। অবিবাহিত এ ব্যক্তি ব্যস্ত ছিলেন সঙ্গীতের সৃষ্টিতে। নিঃসঙ্গতা ছিল তার নিত্যদিনের সঙ্গী। মানসিক যন্ত্রণায় কুড়ে কুড়ে আত্মদহনের শিকার সাদী মহম্মদ নিভৃত গৃহকোণ বেছে নেন।
তার সতীর্থ, অনুরাগী ও আপনজনরা জানে না কী একাকিত্বের বেদনা তিনি বহন করেছেন। মন বিচিত্রমুখী। গভীর বিষণ্নতার ভার বহন করতে সে অক্ষম। নগর সভ্যতার ভিড়ে সাদী মহম্মদ ছিলেন চলনে, বলনে, ব্যবহারে জাদুকরী এক ব্যক্তিত্ব। মোহাম্মদপুরের বাড়িটি একাত্তুরে ছিল মুক্তিসংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু। নানা জাত, রঙের ফুলে ভরা টব ছিল তার প্রিয়। গীতাঞ্জলী আর নীল রঙের গানের খাতাগুলো দুঃসহ স্মৃতি ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছে। সময়ই বিচার করবে তার গীত সঙ্গীত কতদিন বেঁচে থাকবে।
সাদী মহম্মদ ব্যক্তিগতভাবে আমার কেউ ছিলেন না। তিনি ছিলেন সদালাপী। অনেক দিন পর দেখা হলে তার মধুর হাসি ও ব্যবহার দিয়ে আপন করে নিতেন সবাইকে। মনে হতো কতদিন প্রতিদিন তার সঙ্গে দেখা হচ্ছে। তার ব্যবহার যেমন মধুর ছিল শিল্পীদের সঙ্গে ছিল তেমনি ছিল অন্যদের সঙ্গেও। তিনি অনেকের আত্মীয় ছিলেন না। তবুও অনেকের দুঃসময়ে দুর্দিনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন নীরবে। অনেকেই জানতো না তার এই গোপন সাহায্যের কথা। অনেকের জন্য অনেক কিছু ছিল এ গোপন সাহায্য।
মৃতু্য এক অনিবায সত্য। এই সত্যকে মেনে নিয়ে আমাদের পথ চলা। কিছুদিন হয়তো তাকে নিয়ে হইচই হবে। তারপর তিনি একদিন অনেকের মতো বিস্মরণের যাত্রা শুরু করবেন। এখন তার কাছে পুরস্কার, পদক ও সংবর্ধনা অর্থহীন। তিনি অনেক কিছুর ঊর্ধ্বে চলে গেছেন। তিনি মৃতু্যর আগে মরণোত্তর পুরস্কার না নেওয়ার অনুরোধ প্রিয়জনদের করে গেছেন।
শিল্পী কলাকুশলী, বুদ্ধিজীবীদের মৃতু্যর পর শহীদ মিনারে মরদেহ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। সাদী মহম্মদের মরদেহ শহীদ মিনারে নেওয়া হয়নি। তার সঙ্গীতের গীত ধারা নিয়ে কেউ কি গবেষণা করবেন?
সাদী মহম্মদ হয়তো জানতেও পারবেন না তাকে আমরা কীভাবে স্মরণ করছি! তাকে প্রতিনিয়ত স্মরণ করা জরুরি। তার সুর ও সঙ্গীতে তিনি চির জাগরুক থাকবেন অনন্ত সময়ে মানুষের হৃদয়ে।
জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তন কিংবা এই শহরের কোনো এক সন্ধ্যায় তুমুল বৃষ্টির মতো ঝরে পড়তো সাদী মহম্মদের কণ্ঠ। শোকার্ত হৃদয়ে তুমুল অনুরণন শোনা যাবে অনন্তকাল। বিদায় সাদী মহম্মদ। আপনি অনন্তলোকে শান্তিতে থাকুন।
শিল্পীদের অহংকার থাকে। কখনো কখনো তাদের এমন অহংকার ব্যবহারে প্রকাশ পায়। সাদী মহম্মদ ছিলেন ব্যতিক্রমী। বিনয় ছিল তার ব্যবহারের ভূষণ। যে যায় সে চলে যায়। কেবলই তার স্মৃতি পড়ে থাকে। বিধুর ধূপের মতো আজো পড়ে আছে তার সঙ্গীত। স্মরণে স্মৃতিতে তিনি জ্বলজ্বল করবেন ধ্রম্নব তারার মতো অনন্ত আকাশে।
জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তন কিংবা এই শহরের কোনো এক সন্ধ্যায় তুমুল বৃষ্টির মতো ঝরে পড়তো সাদী মহম্মদ। শোকার্ত হৃদয়ে তুমুল অনুরণন শোনা যাবে অনন্তকাল। বিদায় সাদী মহম্মদ। আপনি অনন্তলোকে শান্তিতে থাকুন।