শ্যামল বঙ্গদেশের হাজার বছরের ইতিহাসে মহান মুক্তিযুদ্ধকেই বাঙালির জীবনের শ্রেষ্ঠ ঘটনা ও অর্জন বলে দ্বিধাহীন চিত্তে চিহ্নিত করা যায়। বাংলাদেশের সংগ্রাম আর বঙ্গবন্ধুর জীবনের সংগ্রাম এক হয়ে মিশে গেছে বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী ও মহৎ উপাদান।
বিশ্ব সাহিত্যে অনেক দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সে দেশের কবি সাহিত্যিকরা সাহিত্য রচনা করেছেন। আমাদের আধুনিক বাংলা কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ প্রবলভাবে উঠেছে এসেছে। জীবনবোধকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নাড়া দিয়েছে। আধুনিক বাংলা কবিতার মুক্তিযুদ্ধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকায় রয়েছে বাংলাদেশের সুদীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস। বাংলা কবিতায় চিরায়ত ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত কবিতাগুলো দলিল হিসেবে থেকে যাবে চিরদিন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতীয় চেতনা উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রখ্যাত গীতিকার গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার লিখেছিলেন, 'শোনো একটি মুজিবরের থেকে/ লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠ/ স্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি/আকাশে বাতাসে ওঠে রণি।'
বঙ্গবন্ধু কালজয়ী বীর বাঙালির ইতিহাসের মহানায়ক হয়ে বেঁচে আছেন। বেঁচে থাকবেন চিরকাল পৃথিবীর মানবমুক্তির ইতিহাসে। অনন্য এ বীর বাঙালিকে নিয়ে রচিত হয়েছে কবিতার অসংখ্য অমর পঙ্ক্তি। পলস্নী কবি জসীমউদ্দীনের 'বঙ্গবন্ধু' শীর্ষক কবিতায় তারই প্রতিধ্বনি আমরা দেখতে পাই, 'মুজিবুর রহমান/ওই নাম যেন ভিসুভিয়াসের অগ্নিউগারি বান/বঙ্গদেশের এপ্রান্ত হতে সকল প্রান্ত ছেয়ে/জ্বালায় জ্বলিয়ে মহাকালানল ঝঞ্ঝা অশনি বেয়ে/বিগত দিনের যত অন্যায় অবিচার ভরা যার/হৃদয়ে হৃদয়ে সঞ্চিত হয়ে সহ্যের অঙ্গার;/দিনে দিনে হয়ে বর্ধিত স্ফীত শত মজলুম বুকে/দগ্ধিত হয়ে শত শত লেলিহান ছিল প্রকাশের মুখে;/তাহাই যেন বা বিমূর্ত হয়ে জ্বলন্ত শিখা ধরি/ওই নামে আজ অশনি দাপটে ফিরিছে ধরণী ভরি।'
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নৃশংস হত্যা কান্ডের পর প্রতিটি বাঙালির হৃদয় শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে। 'বাংলা দেশ', 'বাঙালি' ও 'স্বাধীনতা' প্রভৃতি শব্দের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত বিধায় বাঙালির মন এসবের মধ্যে শেখ মুজিবুরের স্পর্শ পায়। অনাথ হৃদয় তাকে ফিরে পেতে চায়। কবি সুফিয়া কামালের 'ডাকিছে তোমারে' কবিতাটি সে ভাবের বাণী মূর্ত- 'এই বাংলার আকাশ-বাতাস, সাগর গিরি ও নদী/ডাকিছে তোমারে বঙ্গবন্ধু? ফিরিয়া আসিতে যদি।'
১৯৭১-এর যুদ্ধে যেমন শিল্পী-কবিরা সরাসরি যুদ্ধ করেছেন রণাঙ্গনে পরবর্তীকালের শিল্পী-কবিরা ও ষড়যন্ত্রকারীদের হাত থেকে মুক্তির জন্য সমভাবে অংশ গ্রহণ করেছেন নতুন যুদ্ধে। ১৯৭১-এর যুদ্ধ উপাখ্যান লিখতে কবি জসীমউদ্দীন লিখেছেন, 'কি খবর আর লিখিয়া পাঠাব বৌ ছেলেমেয়ে লয়ে/আছি প্রস্তুত কার আগে কেবা যাইব যে যমালয়ে/আছি প্রস্তুত চোখে দেখিবারে নারীর শ্লীলতাহানি/ আছি প্রস্তুত কখন পুড়িবে পৈতৃক বাড়িখানি/প্রতিটি ঘণ্টা আসিছে যাইছে খুনে রঞ্জিত হয়ে/প্রতিদিন আসে ভয়াবহ কত জ্বালা বয়ে/চোখের সামনে দেখছি মৃতু্য জালিমের হুঙ্কারে/জ্বলিতে দেখেছি শহর পলস্নী আগুনের ফুৎকারে।'
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কবি নির্মলেন্দু গুণের কাছে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীকরূপে মূর্ত। কবি সত্যিকার অর্থে শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের মুক্তি প্রত্যাশা করেছেন- সমাজতন্ত্রের প্রতি নির্মলেন্দুগুণের অনুরাগ প্রবল। শেখ মুজিবের মধ্যেও কবি এসব গুণের সমন্বয় লক্ষ্য করেছেন। তাই তার কণ্ঠে উদাত্ত উচ্চারণ,
'মুজিব মানে আর কিছু না এক যমুনা রক্ত/মুজিব মানে সমাজতন্ত্র/আমি মুজিব ভক্ত।' কবি নির্মলেন্দু গুণের অসাধারণ সৃষ্টি ও বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য সংযোজন 'স্বাধীনতা এ শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো' কবিতাটি। এ কবিতাটিতে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটির আবেগময় প্রকাশ ঘটেছে। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের বাণীবদ্ধ এ কবিতায় ঐতিহাসিক ঘটনার সংস্থান সুবিন্যস্ত। সেদিন কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-যুবক, নারী-পুরুষ, বিত্তহীন-মধ্যবিত্ত মানুষ যথাসম্ভব স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিতেই সমাবেশের উত্তাল জোয়ারে সমবেত হয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধ বা মুক্তি সংগ্রামের ঘোষণার ইঙ্গিতপূর্ণ এ কবিতাটিতে বাঙালির আবেগও আকাঙ্ক্ষার স্ফুরণ ঘটেছে-
'কপালে কব্জিতে লাল সালু বেঁধে/এই মাঠে ছুটে এসেছিল কারখানা থেকে লোহার শ্রমিক/লাঙল জোয়াল কাঁধে এসেছিল ঝাঁক বেঁধে উলঙ্গ কৃষক/পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে এসেছিল প্রদীপ্ত যুবক/শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে/রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে/অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।'
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি-'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।'
১৯৪৭ সালের পর থেকেই বাংলা সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব পড়ে। ভাষা আন্দোলনের থেকে ছয় দফা, ঊনসত্তরের নির্বাচন, মুজিবের ভাষণ ইত্যাদির সিঁড়ি বেয়ে আসে স্বাধীনতা যুদ্ধ। তাই বলা চলে, বাঙালি সমাজকে মুক্ত করার জন্যই অনেক কবিতা রচিত হয়েছে। '৭১-এর যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রেরণা জুড়িয়েছে এসব কবিতা ও সাহিত্যকর্ম। শামসুর রহমানের 'স্বাধীনতা তুমি', সৈয়দ শামসুল হকের 'গেরিলা', অসীম সাহার 'পৃথিবীর সবচেয়ে মর্মঘাতী রক্তপাত', রফিক আজাদের 'একজন মুক্তিযোদ্ধার আত্মসমর্পন', মুহম্মদ নূরুল হুদার 'আমরা তামাটে জাতি', মহাদেব সাহার 'ফারুকের মুখ', মিনার মনসুরের 'কী জবাব দেব', আবিদ আজাদের 'এখন যে কবিতাটি লিখব আমি', জসীমউদ্দীনের 'দগ্ধ গ্রাম', সিকান্দার আবু জাফরের 'বাংলা ছাড়ো', হাসান হাফিজুর রহমানের 'যখন উদ্যত সঙ্গীন' নির্মলেন্দু গুণের 'স্বাধীনতা এ শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো', আবিদ আনোয়ারের 'আমার মায়ের নামে তোপধ্বনি চাই', সুফিয়া কামালের 'আজকের বাংলাদেশ', শহীদ কাদরীর 'নিষিদ্ধ জার্নাল', আবুল হাসানের 'উচ্চারণগুলো শোকের', সানাউল হক খানের 'সাতই মার্চ একাত্তর', আসাদ চৌধুরীর 'রিপোর্ট ১৯৭১', দাউদ হায়দারের 'বাংলাদেশ', মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের 'শহীদ স্মরণে', আহসান হাবীবের 'মুক্তি যোদ্ধারা দেখতে কেমন', হেলাল হাফিজের 'নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়'। এসব কবিতায় আমরা পাই বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা, মানবিক আবেগ, স্বদেশপ্রেম, সাম্য চেতনা, ক্ষোভ ও মুক্তির তীব্র চেতনা।
বঙ্গবন্ধু বাঙালির কালজয়ী ইতিহাসের স্রষ্টা। তিনি ইতিহাসের অতুলনীয় মহানায়ক। বাঙালির পরিচয় আর বঙ্গবন্ধু হৃদয় জুড়ে বাঙালি একাকার। তাই সঙ্গতকারণেই কবি সৈয়দ শামসুল হক লিখলেন তার 'আমার পরিচয়' কবিতাটি, 'আমি তো এসেছি সার্বভৌম বারো ভূঁঁইয়ার থেকে/আমি তো এসেছি 'কমলার দীঘি'; 'মহুয়ার পালা' থেকে/আমি তো এসেছি তিতুমীর আর হাজী শরীয়ত থেকে/আমি তো এসেছি গীতাঞ্জলি ও অগ্নিবীণা থেকে/এসেছি বাঙালি ক্ষুদিরাম আর সূর্যসেন থেকে/এসেছি বাঙালি জয়নুল আর অবনঠাকুর থেকে/এসেছি বাঙালি রাষ্ট্রভাষার রাজপথ থেকে/এসেছি বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর থেকে/আমি যে এসেছি জয় বাংলার বজ্রকণ্ঠ থেকে/আমি তো এসেছি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে।'
বাংলার মাটি, মানুষ আর মানুষের ভালোবাসাই শেখ মুজিবকে করেছে মহান। আগুনঝরা দিনের কথা সুফিয়া কামালের কবিতা 'মুজিব মৃতু্যঞ্জয়' এটি সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে 'শোণিত সাগরে রক্তকমল সহস্র দল প্রাণ/শত মানবের নিত্যস্মরণে প্রীতিতে করিছে ম্স্নান/বাংলাদেশের মাটির মানুষ মাটিরে বাসিয়া ভালো/সে প্রাণ প্রদীপ জ্বালিয়া জ্বালিয়া ছড়াইয়া দিল আলো/যত দুর্গম বিপদ সিন্ধু পাড়ি দিয়া দিয়া তরী/কূলে এনে দিল বাংলা মায়ের ছিন্ন আঁচল ভরি/ ফসলের ঘ্রাণে, তাজা তাজা প্রাণ হে নাবিক নির্ভয়/উদার বক্ষ কপাট মেলিয়া অন্তর করি জয়।'
বঙ্গবন্ধুর মৃতু্যর করুণ বিষাদময় ঘটনার কথা লিখতে গিয়ে সমকালীন বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমান ঘাতকদের চিত্রিত করেছেন এভাবে, 'কতিপয় কর্কশ অমাবস্যা, অন্ধকার থেকে/বেরিয়ে আসছিল পরিকল্পিত উন্মত্ততার বীভৎস জিভ/তার দিকে ছুড়ে দিল একঝাঁক দমকা বুলেট।'
কবি সিকদার আমিনুল হক বাংলাদেশের অর্থ করতে গিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে বুঝিয়েছেন। তিনি তার 'অভিন্ন রূপক ও বাস্তবে' কবিতায় লিখেছেন,
'...পৃথিবীর কাছে বাংলাদেশ মানে শুধু রক্তরঞ্জিত মানচিত্র নয়/বাংলাদেশ হলো একটি সংযত রূপক ও বাস্তব/এখানে সূর্য করোজ্জ্বল মুখে দন্ডায়মান জাতির জনক।'
কোনো এক কবি তার প্রাণের আবেগে বলেছেন, 'বঙ্গবন্ধু মরেনি, কেউ বলেছেন, এই তো সেদিন দেখা/আসলে বঙ্গবন্ধু তো তার কীর্তির মাঝেই বেঁচে থাকবেন/তিনি যে মৃতু্যঞ্জয়ী।'
কবি মহাদেব সাহা এ কবিতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অনন্য সাধারণ চরিত্র বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। তিনি কতখানি বাঙালি ছিলেন, কতটা উদার ছিল তার বুকের পরিধি আর কত খানিই ভালোবাসতেন তিনি বাংলাকে কবির কালির আঁড়ে তা ফুটে উঠেছে, 'সহসা দেখি আমার ছোট্ট ঘরখানির দীর্ঘ দেয়াল জুড়ে/দাঁড়িয়ে আছেন শেখ মুজিব/গাঁয়ে বাংলাদেশের মাটির ছোপ লাগানো পাঞ্জাবী/হাতে সেই অভ্যস্ত পুরনো পাইপ/চোখে বাংলার জন্য সজল ব্যাকুলতা/এমন কি আকাশকেও আমি কখনো এমন গভীর ও জল ভারানত দেখিনি।'
কবি দাউদ হায়দারের 'তুমি নেই বলে' কবিতায় তীব্র দাবদাহের ন্যায় সেই যন্ত্রণা প্রস্ফুটিত। 'তুমি নেই বলে সমস্ত আকাশ ধোঁয়ায় ধোঁয়াকার হয়ে আছে/চৈত্রের প্রচন্ড দাবদাহে যখন গ্রাম জনপদ পুড়তে থাকে/চরাচরে কোনো প্রাণ নেই মনে হয়/ব্যাপ্ত নিখিলে শুধু জড় ও মৃতের উত্থান।'
বরেণ্য অমর কবি সিকানদার আবু জাফর 'সে নাম মুজিব' কবিতায় লেখেন, 'সদ্য ফোটা শাপলার পরিতৃপ্ত আত্মসমর্পনে/অংকিত বিচিত্র ছবি মুছে গেছে পুকুরের নিটল দর্পণে/কবরের শ্মশানের অকস্মাৎ লাঞ্ছনা যখন/বন্দি করে নিয়ে যায় ঘরে ঘরে/মূর্চ্ছাহত বাঙালির মন/তখন যে নাম/পিতার বক্ষের মতো, নির্ভরতা/মেলে ধরে বলে/ভয় নেই জনকল্যাণের ধ্রম্নব পদ তলে/চূর্ণ হবে অসত্য অশিব/সে নাম মুজিব।'
ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর ইতিহাসের এক স্বণোজ্জ্বল অধ্যায় বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের এক বিজয়স্তম্ভ। এ বাড়িটি থেকেই ১৯৭১-এর মার্চে বাংলাদেশ পরিচালিত হতো। আবার এখানেই পনেরো আগস্ট ঘাতকের বুলেট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর জন্ম হলো বাঙালির আরেক বিষাদের মর্ম, বেদনার গাঁথা। এ নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক বিখ্যাত পঙ্ক্তিমালা। কবি রফিক আজাদ তার 'এই সিঁড়ি' কবিতায় লিখেছেন, 'এই সিঁড়ি নেমে গেছে বঙ্গোপসাগরে/সিঁড়ি ভেঙে রক্ত নেমে গেছে/বত্রিশ নম্বর থেকে/সবুজ শস্যের মাঠ বেয়ে/অমল রক্তের ধারা বয়ে গেছে বঙ্গোপসাগরে।'
কবি বেলাল চৌধুরী 'বত্রিশ নম্বর' কবিতায় বর্ণনা করেছেন, 'এই এ বাড়িটির ইতিহাস ইটেগাঁথা রয়েছে/বাঙালি জাতির গৌরবগাঁথা ও শৌর্যের কথা।'
১৫ আগস্ট জাতির জনক শেখ মুজিবের হত্যাকান্ড বিশ্বময় বাঙালি জাতিকে হেয় করেছে, পিতৃহন্তা কলংকিত জাতিরূপে চিহ্নিত করেছে। পিতা হত্যার অন্যায় ও দায়বোধে কবির মনোবেদনা বিদ্ধ হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করেন কবি ত্রিবিদ দস্তিদার 'বাংলাদেশের হৃদয় পতাকা কাঁদে' কবিতায় তিনি বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পরের চিত্র এঁকেছেন, 'কীভাবে দাফন করবে ঘাতকেরা এই লাশ/বাংলাদেশের মানচিত্র জুড়ে যার দেহ/বাংলাদেশের পতাকাজুড়ে যার হৃদয়/তবুও স্টেন গানের মুখে কবর খুড়লে ওরা/তোমার বাড়ির ছোট্ট আঙ্গিনায়/পাশেই বটবৃক্ষের একটি সবুজ পাতা খসে/প্রতিবাদ জানালো লাশের কাফন কোথায়?/হাসপাতালে শাড়ির পাড় ছিঁড়ে একজন/কাফন বানালো তারপর... এভাবে সেদিন দাফন করল ওরা/ আমাদের বাংলাদেশের মানচিত্রতম পতাকা কাঁদে/খেঁাঁজে দেহ-মানচিত্র- শেখ মুজিব বলে।'
ষাটের দশকের কবি অসীম সাহা পিতার হত্যাকারীদের প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন তার 'প্রতিশোধ' কবিতায়, 'অন্ধকারের কালো শেয়ালেরা আজ/ঘোরে এই দেশে হাতে ঘাতকের চুরি/এখানে এখন প্রয়োজন অগণিত পিতার প্রেমের প্রিয় উত্তরসূরি/প্রতিশোধ ছাড়া প্রেমে সবকিছু জয়/হয় না কখনো কেড়ে নিতে হবে চাবি/রক্তের ঋণ শোধ করে দিতে হবে/প্রতিধূলিকণা জানায় প্রবল দাবি।'
বাংলাদেশের কবি ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের অনেক প্রথিতযশা কবি বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গ নিয়ে ঋদ্ধ কবিতা লিখেছেন, অন্নদা শঙ্কর রায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, মনীশ ঘটক, দক্ষিণারঞ্জন বসু, বিনোদ বেরা, মণীন্দ্র রায়, অমিতাভ চৌধুরী, নলিনীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়, বিমলচন্দ্র ঘোষ, অমিত বসু, শান্তিকুমার ঘোষ, নির্মল আচার্য প্রমুখ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁদের কবিতায় বঙ্গবন্ধু মহাজাগরণের মহাউদ্গাতা, সংগ্রামরত মহানায়ক রূপে চিত্রিত।
বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিমানুষ মাত্র নন, তিনি একটি অগ্নিগর্ভ চেতনা, মুক্তির চেতনা, স্বাধীন-সার্বভৌম জাতি গঠনের চেতনা, অসাম্প্রদায়িক-প্রগতিবাদী-চেতনা, সর্বোপরি অধিকার আদায়ে সোচ্চার হওয়ার চেতনা, যে চেতনার মৃতু্য নেই- বঙ্গবন্ধু তাই মৃতু্যঞ্জয়।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যত কবিতা রচিত হয়েছে পৃথিবীর অন্য কোনো নেতাকে নিয়ে এত কবিতা রচিত হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই।