চয়ন হাঁপাতে হাঁপাতে দৌঁড়ে এসে মায়ের হাতটি ধরে টানতে লাগল। মা, মা জলদি এস, দেখবে রাস্তায় কত মানুষের জটলা। অনেক লোক হাত উঁচু করে এক সঙ্গে কি যেন বলতে বলতে যাচ্ছে। চলো না মা পিস্নজ। শাহানা বলল, চল তো দেখি, কি হচ্ছে? শাহানা ছেলেকে নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়ালো। তাই তো, স্স্নোগানে স্স্নোগানে রাজপথ প্রকম্পিত করছে ছাত্রসমাজ। আমার ভাষা মায়ের ভাষা, বাংলা ভাষা বাংলা ভাষা। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, বন্দি ভাইয়ের মুক্তি চাই। এমন নানা ধরনের স্স্নোগান দিচ্ছে। শাহানা বিমুগ্ধ নয়নে দেখছে এবং শুনছে। শাহানার শরীরেও রক্ত যেন টগবগ করে ফুটছে। দেখতে দেখতে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলে মিছিলে মিছিলে। কখনো সে নিজেকে দেখে মিছিলের সারিতে আবার কখনো দেখে স্স্নোগান দিতে। চয়ন তখন শাহানাকে ধাক্কা দিয়ে বলল, মা এরা কি বলছে? কেন বলছে? শাহানা একটু থতমত খেয়ে ছেলেকে বলল, কিছু বলছিলে বাবা? চয়ন বলল, হ্যাঁ মা। এরা এসব বলছে কেন? শাহানা উত্তর দিল, ওরা প্রতিবাদ করছে হুঁশিয়ারি বাক্য দিয়ে। চয়ন ভ্রম্ন-কুঁচকে বলল, কীসের প্রতিবাদ মা!
ওরা আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নেবে। তোমাকে আর মা বলে ডাকতে দেবে না। তার প্রতিবাদে ছাত্রসমাজ জেগে ওঠেছে। চয়ন আবারো কৌতূহল দৃষ্টি নিয়ে মাকে প্রশ্ন করল ওরা কারা মা? কেন আমার মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চায়? এমনই নানা রকম প্রশ্ন একটার পর একটা করে চলেছে চয়ন মাকে। শাহানা সব প্রশ্নের উত্তর খুবই চমৎকারভাবে দিতে লাগল। এমন সময় শাহানা শ্বশুরের ডাক শুনতে পেল। শাহানা, কোথায় মা?
শাহানার বিবাহিত জীবন দশ বছর। স্বামী চলে যাওয়ার পর আর বিয়ে করেনি। অল্প বয়সেই বিধবা হয়েছিল সে। একমাত্র সন্তান চয়নকে বুকে আগলে ধরেই শ্বশুরবাড়ি রয়ে গেছে। স্বামী অফিস থেকে ফেরার সময় রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়। চয়ন তখন মাত্র চার। শ্বশুর-শাশুড়ি, বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনেরা অনেক পীড়াপীড়ি করার পরও শাহানাকে দ্বিতীয় বিয়ের জন্য কেউ রাজি করাতে পারেনি। সেই থেকে স্বামীর ভিটায় পড়ে আছে। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর বিয়ে হয় শাহানার। সুখের সংসার ছিল পরিবারের সবাইকে নিয়ে। শ্বশুর মিজানুর রহমান শাহানাকে মেয়ের স্থান দিয়েছে। কাউকে বলে না শাহানা তার বৌমা। বলে, সে তার মেয়ে।
শাহানা কি করে অন্যত্রে বিয়ে করবে? সে তো জড়িয়ে আছে এক মায়ার বাঁধনে। স্বামীর স্মৃতিটুকু নিয়ে। এক মহা দায়বদ্ধতায়।
কত আঁধার সবার অন্তরালে কেটে যায় চোখের পানিতে, শাহানা কাউকে বুঝতে দেয় না। আজ কেন বারবার মনে পড়ছে তার স্বামী রাসেলকে। শাহানা কখনো ভাবতেই পারিনি এই সুদৃঢ় বন্ধন ত্যাগ করে রাসেল চলে যাবে তাকে একাকিত্ব করে। রাসেলের মৃতু্যর পর পাড়া-প্রতিবেশীর কত কথা শুনতে হয় শাহানাকে। কখনো নানা রকম কটূূক্তি, কখনো সমালোচনা, আবার কখনো বাঁকা নজরে দেখা। রাসেলের মৃতু্যর জন্য যেন শাহানাই একমাত্র দায়ী। হায়রে আজব সমাজ! কবে মুক্তি পাব আমরা এই সমাজ থেকে জানি না। আবার নিজেকে সান্ত্বনা দেয় এই ভেবে, কিছু কুলাঙ্গার তো থাকবেই সমাজে। তারা নিজেরা যেমন কিছু করে না আবার অন্যকেও কিছু করতে দেয় না। যাক, এসব কথায় কান দিলে আমার চলবে না। আমার সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করতে হবে। চয়নের কথা ভেবে সে নিজের মনকে আরও শক্ত করে। শত ভাবনার মধ্যেও সেই মিছিলের প্রতিধ্বনি তার কানে বারবার বাজতে থাকে।
এদিকে শাহানা রাতের পর রাত আর ঘুমাতে পারে না। তার একটাই ভাবনা। কি করে সে ওদের আন্দোলনে সামিল হবে। নিজের অস্তিত্ব মাতৃভাষাকে টিকিয়ে রাখবে। আমাকে কিছু একটা করতেই হবে। এভাবে ভাবতে ভাবতে দুইটা দিন কেটে গেল। শ্বশুরবাড়ির কাউকে কিছু বলে না। তার একই ধ্যান একই গান। সংসারে আর মন দিতে পারছে না সে। বারবার তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তার মন ওই রাজপথের মিছিলে। ভাবনাগুলো যেন তার বুকের ভেতর কুরে কুরে খাচ্ছে। কোনো কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না। দিনে দিনে মন বিদ্রোহী হয়ে উঠছে। না, এভাবে আর হাত গুটিয়ে বসে থাকা যায় না, কিছু একটা করতে হবে তাকে। এভাবে আনমনে সে ভাবতে থাকে।
এমন সময় পাশের বাড়ি মিশু আসল শাহানার কাছে।
মিশু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিল। তুখোড় নেত্রী। সেদিন মিশুকে দেখেছিল শাহানা মিছিলের প্রথম সারিতে। মিশুকে দেখে তার মনে শক্তি, সাহস আরও জেগে ওঠেছিল। মিশুর সঙ্গে টুকিটাকি কথা হলেও তেমন অন্তরঙ্গ ছিল না। তবুও আজ মিশুকে সবচেয়ে বেশি আপন মনে হচ্ছে তার কাছে। মিশুকে বলল, বস। আমি তোমার জন্য একটু চা করে নিয়ে আসি। চা খেতে খেতে দু'জন কথা বলব। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে নানা প্রসঙ্গ শুরু করল মিশু। ভাষার কথা, ভাষা আন্দোলনের কথা। পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারের অবহেলা, বঞ্চনা, শোষণ, নির্যাতন, ভাষা সংস্কৃতি, অর্থনীতি, বৈষম্যমূলক আচরণের কথা তুলে ধরল মিশু। শাহানাকে বলল, বুঝলে শাহানা ভাবি, এই কারণেই আজকের এই আন্দোলন। এজন্যই নারী থেকে শুরু করে শিশু-কিশোর, বৃদ্ধ, যুবক, ছাত্রসমাজ সর্বস্তরের জনসাধারণ আজ রাজপথে নেমেছে। মিশু লক্ষ্য করল, তার কথা শুনতে শুনতে শাহানার চোখ দুটো যেন লাল হয়ে ওঠছে। চোখেমুখে বিদ্রোহের ছাপ। থরথর করে কাঁপছে তার শরীর। চায়ের কাপ শেষ করে মিশু শাহানাকে বলল, কি করবে বলে ভাবছ? শাহানা ক্রোধভরা চোখে জবাব দিল, এখন আর ভাবাভাবির সময় নেই। রাজপথে নামতে হবে এটাই চূড়ান্ত। মিশু বলল, কিন্তু তোমার সন্তান! আরেকটু ভালো করে ভাব শাহানা ভাবি। শাহানার একই জবাব। আমি স্বার্থপরের মতো আমার সন্তানের কথা ভেবে আমার সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটতে পারব না। এদেশের হাজারও সন্তান যখন রাজপথে তখন কেন শুধু আমি আমার সন্তানকে নিয়ে ভাবব, মিশু? এদেশের সব সন্তানই আমার।
আমার সন্তানেরা আমাকে মা বলে ডাকতে পারবে না এর চেয়ে সবচেয়ে বড় নির্যাতন আর কি হতে পারে বল! এটা আমার সন্তানের অস্তিত্বও বটে। ওরা আমার মুখের ভাষাকে কেড়ে নেবে আর আমি লেজ গুটিয়ে বসে থাকব সেটা কখনো হবে না। আমাদের সর্বোচ্চ দিয়ে লড়তে হবে। প্রাণের ভয় আমি করি না মিশু। হাজার বছর লেজ গুটিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে, বীরের মতো একদিন বাঁচাই শ্রেষ্ঠতর। মিশু পিঠে চাপড় মেরে বলল, সাবাস! শাহানা ভাবি সাবাস। আমি তো এমনই চেয়েছিলাম। শাহানা বলল, তুমি শুধু আমাকে আদেশ কর মিশু, আমাকে কি করতে হবে। মিশু বলল, ওকে ভাবি, কাল আবার দেখা হবে। তবে তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। কাল রাত বারোটার পরে তোমার ঘরের পিছনের দরজাটা খুলে রেখ। আমার সঙ্গে আরও তিনজন লোক আসবে। তুমি জেগে থেক। এই বলে দ্রম্নত প্রস্থান করল মিশু।
শাহানা কাউকে কিছু বলল না। সে ঠিক রাত ১২:০০টা পর্যন্ত সবার অগোচরে দরজাটা খোলা রাখল। যথাসময়ে মিশু তার দলবল নিয়ে শাহানার ঘরে আসল। তারপর দরজা বন্ধ করে তারা ফিসফিস করে কথা বলতে লাগল। তাদের ফিসফিসের কথায় চয়নের ঘুম ভেঙে গেল। চয়ন ভাবল এত রাত্রে এরা কারা আমার মায়ের ঘরে? চয়ন ঘুমের ভান করে তাদের সব কথা শুনল। তাহলে কি মা এদের সঙ্গে আন্দোলনে যাবে? মা যদি রাজপথে নামে আমিও নামব রাজপথে। না, এ বিষয়ে মাকে কিছু বলা যাবে না। আমি যে জানতে পেরেছি মাকে বুঝতে দেওয়া যাবে না। তাহলে মা কিছুতেই রাজি হবে না। আমাকে যেতে দেবে না। সব কাজকর্ম শাহানাকে বুঝিয়ে দিল মিশু। মিশু বলল, তোমার প্রথম কাজ হবে এদেরকে নিরাপত্তার সঙ্গে গোপন করে রাখা। এক সপ্তাহে এরা তোমার এখানে থাকবে। রাত্রে আবার বেরিয়ে যাবে। তবে সাবধান কেউ যেন কোনো রকম টের না পায়। গোপনে গোপনে প্রথম দায়িত্বগুলো সফলতার সঙ্গে শাহানা করতে পারল। ফলে সে আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠল। তার চোখেমুখে যেন এক আনন্দ জোয়ার। এতটা সুখ, এতটা অনুভূতি, এতটা আনন্দ সে এ জীবনে কখনো পায়নি। এত বছর পর সে বুঝতে পারল বেঁচে থাকার মানে। জীবনের মানে। এভাবে সে কখনো মিছিল মিটিং, কখনো আশ্রয় দিয়ে, কখনো খাবার দিয়ে আন্দোলনে সাহায্য করতে লাগল। তার বুদ্ধিমত্তা, দূরদর্শিতা, পারদর্শিতা এক নতুন পথের জন্ম দিল সবার মনে। শাহানা যেন আন্দোলনের প্রাণ। এভাবে কয়েকটি মাস কেটে গেল। চার বছরের চয়ন এখন সে দশ বছরে পা দিয়েছে। প্রতি রাত্রে তাদের কথা শুনতে শুনতে এক সময় চয়নও মায়ের মতো হয়ে ওঠে বিদ্রোহী। বিদ্রোহের দাবানলে পুড়তে থাকে চয়ন।
এদিকে আন্দোলন দমাতে পাকিস্তানি পুলিশেরা ১৪৪ ধারা আইন জারি করে। সেদিন রাত সাড়ে বারোটায় মিশুসহ আরও দশজন লোক শাহানার বাড়িতে আসে। ১৪৪ ধারা আইন ভঙ্গ করার মিটিং চলে শাহানার বাড়িতে। কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত করে মিশু দায়িত্ব দিয়ে চলে যায়। চয়ন বলে, তুমি যাও মা, আমি আসছি। এ আন্দোলন, এ দাবি, তোমার একার নয়, আমাদের সবার।
দু'টি দল দু'দিকে চলে যায়। শাহানা তৃতীয় দলের প্রথম সারিতে থাকে। হঠাৎ চোখ পড়ে চয়নের দিকে। একটা দলের প্রথম সারিতে চয়ন। সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। এটা কি করে সম্ভব! আমি কি ভুল দেখছি? না না এটা তো সত্যি আমার চয়ন। চয়নের কথা ভাবতে ভাবতে তার গর্বে বুক ভরে যায়। একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে শাহানা। পুলিশের ব্যারিকেড, লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেল শাহানা সবকিছু উপেক্ষা করে তার দল নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। শাহানা হঠাৎ লক্ষ্য করল, চয়নের দিকে বন্দুক নিয়ে তাক করে আছে একটা পাকিস্তানি সৈন্য। গুলিটা ছুঁড়তেই ছেলের সামনে বুক পেতে দেয় শাহানা। চয়ন রক্ষা পেলেও গুলিটি শাহানার বুক ভেদ করে বেরিয়ে আসে। সেদিন আরও ছাত্র আহত হয়, কেউ কেউ নিহত হয়, কেউ কেউ এরেস্ট হয়। শাহানার তরতাজা রক্তাক্ত দেহটি লুটিয়ে পড়ে সবুজ দূর্বাঘাসে। চয়ন মায়ের রক্তাক্ত দেহটা বুকের সঙ্গে জাপটে ধরে চিৎকার করে বলে, মা, তোমার বুকের তাজা রক্ত দিয়ে আমার মা ডাক ফিরিয়ে দিলে।
মায়ের রক্তাক্ত দেহটা শুয়ে দিয়ে স্যালুট জানাই মাকে। তারপর রক্তে ভেজা একমুঠো মাটি নিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে চয়ন। শাহানার রক্তে রঞ্জিত হয় থোকা থোকা দূর্বাঘাস। আজও থোকা থোকা রক্তে ভেজা দূর্বাঘাসের ওপর শাহানা মিনার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চয়ন প্রতিবছর ফুলে ফুলে সাজিয়ে রাখে সেই মিনার। চয়ন কাঁদতে কাঁদতে মিনার ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করে, আজ থেকে তোমার দেওয়া পথে চলব মা, যে পথে এতদিন হয়নি চলা।