আ-মরি বাংলা ভাষা
প্রকাশ | ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
আরিফ আনজুম
মাইকেল মধুসূদন দত্ত একবার বাংলা ভাষাকে বলেছিলেন- ন?্যাস্টি ল্যাঙ্গুয়েজ। সে সময় হিন্দু কলেজে ভর্তি হওয়ার পর ইংরেজি সাহিত্য পড়ে ভীষণভাবে তিনি প্রভাবিত হন, ইংরেজিতে কবিতা লিখতে শুরু করেন, তিনি মনে করেন বাংলা নয়, ইংরেজি সাহিত্য সাধনা করেই তিনি বিখ্যাত হতে পারবেন। তাই স্পষ্টভাবেই এই উক্তিটি করেন। পরে ভুল বুঝতে পেরে আফসোসও কম করেননি, নিজেকে অবোধ বলেছেন এবং বাংলা ভাষা যে রত্নের আকর সেকথাও স্বীকার করেছেন-
\হ'হে বঙ্গ ভান্ডারে তব বিবিধ রতন;
তা সবে, (অবোধ আমি), অবহেলা করি,
পরধন লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।'
কিন্তু আমরা যারা তথাকথিত ইংরেজিয়ানায় বিশ্বাস করি, আধুনিক বিশ্বায়নের যুগে বাংলা ভাষাকে সঙ্গে নিয়ে চলতে লজ্জাবোধ করি, তারা প্রথমত স্পষ্ট করে ভাষাটির প্রতি ঘৃণাও প্রকাশ করি না। আবার তার মধ্যে যদি কোনো সম্পদ লুকিয়ে থাকে, সে নিয়ে গর্ব বা উৎসাহও প্রকাশ করি না। ফলে পৃথিবীতে প্রায় ২৮ কোটি মানুষ এই ভাষায় কথা বললেও এবং এটি বিশ্বের সপ্তম কথিত ভাষা হওয়া সত্ত্বেও এই ভাষাটির প্রতি অনীহা যেন দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। পাশ্চাত্য ভাষা বিশেষত ইংরেজির প্রতিই আমরা বেশি আকৃষ্ট হচ্ছি। এমনকি ভাষাটির ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও যেন আমরা সন্দিহান হয়ে উঠছি। ফলে ভাষাটির মধ্যে যেমন অন্য ভাষার অনাকাঙ্ক্ষিত অনুপ্রবেশ ঘটছে, তেমনি ভাষাটি থেকে মূল শব্দগুলোও আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। নতুন নতুন শব্দের উদ্ভাবন বা সংযোজন সেভাবে হচ্ছে না। সামাজিক মাধ্যমগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগের ফলে ভাষা নিয়ে নানারকম খেলা করাটা আরো সহজ হয়েছে। সেখানে অবাধ স্বাধীনতা। ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ বা টুইটার জুড়ে ভাষাকে বিকৃত করে অবিরাম ঠাট্টা তামাশা চলছে। ইংলা বা হিংলা শব্দের প্রচুর উদ্ভাবন ও প্রয়োগ হচ্ছে।
ইংরেজি 'টেনশন' কথাটি তো এখন, বাড়ির ঝি থেকে নিরক্ষর মানুষ সবাই ব্যবহার করছেন। সিনেমা, সিরিয়াল, রিয়ালিটি শো ইত্যাদিতে তো এরকম বহু শব্দ ব্যবহারের যেন প্রতিযোগিতা চলছে। 'এক্সাক্টলি', 'লিসেন' ইত্যাদি শব্দগুলো বেমালুম বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলা 'কুর্সি বা কেদারা' শব্দটিকে 'চেয়ার' সম্পূর্ণ আত্মসাৎ করে নিয়েছে। ফেসবুকে ঊীপবষষবহঃ মন্তব্যটিও দিতেই আমরা বেশি ভালোবাসি। 'ধন্যবাদ' বললে নিজেকে কেমন সেকেলে সেকেলে লাগে, তাই 'থ্যাঙ্ক ইউ' এর জুড়ি নেই। 'সেবা' কথাটি কত সুন্দর, কিন্তু আমরা 'সার্ভিস' বলতেই বেশি অভ্যস্থ। কেমন আছিস জিজ্ঞেস করলে বাঙালি এখন উত্তর দেয়, 'মস্ত' বা 'বিন্দাস' আছি গুরু। 'কলম' কবেই যেন 'পেন' হয়ে গেছে। 'হেবি দিয়েছিস তো' বলতে বাঙালির এখন একটুও বাধে না। 'আমার ফল্ট কি আছে' বললে কেউ কিছু মনে করে না। 'বাট, আমার কথাটা শোন্' এ তো হামেশাই চলছে। ভালো বলতে আরেকটা শব্দ এখন আমদানি হয়েছে 'ঝাক্কাস' এটাও বেশ চলছে। 'শিক্ষক' আর ক'জনই বা বলে এখন 'টিচার বা স্যার' বলায় আলাদা সুখ। 'মস্তি' শব্দটি যেন বাংলা ভাষায় কোনো দিনই না থাকা হয়নি। 'তরকারি' শব্দটি খুব বিপদ সংকুল অবস্থায় আছে। যে কোনো সময় 'সবজি' তাকে খেয়ে নেবে। এভাবে বাংলা শব্দগুলো ক্রমশ প্রতিস্থাপিত হয়ে বাংলা ভাষাকে এক অদ্ভুত জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন শব্দ সংযোজিত না হওয়ায় বাংলা ভাষাকে আরো সংকটে ফেলে দিচ্ছে। এক সময় বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরী, সুকুমার রায়, জসীমউদ্দীন, কাজী নজরুল ইসলাম, কুমুদ রঞ্জন মলিস্নক, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, জীবনানন্দ দাশ এরা অনেক নতুন নতুন শব্দ সংযোজন করেছিলেন। তথ্য প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন শব্দগুলোর যেমন 'লিংক', 'নেট' উপযুক্ত বাংলা প্রতিশব্দও যথেষ্ট তৈরি হয়নি। কেউ কেউ 'নেট'-এর বাংলা প্রতিশব্দ 'অন্তর্জাল' বলতে চেয়েছেন, কিন্তু সেটি সর্বজন গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে কিনা সন্দেহ।
এরপরও আছে বাংলা শব্দকে বিকৃত করে ব্যবহারের হিড়িক। 'কিছুই হচ্ছে না'কে 'কিসু্য হচ্ছে না' বললেই যেন বেশি ভালো লাগে। 'তাহলে' হয়ে যাচ্ছে 'তাইলে', 'বেহালা' হয়ে যাচ্ছে 'ব্যায়লা'। 'ওভাবে আমি বোলতে পাড়ি না'- এ রকম বলার চেষ্টা হয়। 'কোথা থেকে এলি' বলতে আমাদের কষ্ট হয়, বলি 'কোত্থেকে এলি'। গানের ক্ষেত্রে যে এই বিকৃতি কতভাবে ঘটছে কে তার হিসাব রাখে। কেউ হয়তো 'পাখি' শব্দটি উচ্চারণের শেষটা বাউল ভাটিয়ালি মিলে এমন করে দিচ্ছে যে শেষ পর্যন্ত সেটা ডানাওয়ালা পাখি আর থাকছে না। আসলে সবার থেকে আলাদা করার প্রতিযোগিতায় বাংলা ভাষা জেরবার হয়ে পড়ছে। প্রসঙ্গত সুকুমার রায়ের 'খুড়োর কল' কবিতাটির মতো।
'আর তো সবাই 'মামা', 'গাগা' আবোল তাবোল বকে-
খুড়োর মুখে 'গুংগা' শুনে চমকে গেল লোকে।'
\হআলাদা কিছু একটা হলেই হলো। আধুনিকতার দোহাই দিয়ে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের আবহে নাভিমূল থেকে জোরে উ... উ... উচ্চারণ করতে পারলেই হলো, বাকিটা বাজনা সামলে নেবে। আমরা যেন ভাষার উৎপত্তির যুগে আবার ফিরে যাচ্ছি। আজ থেকে প্রায় ৮০ লাখ বছর আগে আফ্রিকার জঙ্গলে 'অ্যাপ' জাতীয় এক প্রকার প্রাণী থাকত, তাদেরই কোনো একটা প্রজাতি ছিল মানুষের পূর্ব পুরুষ। তারা পরস্পর যোগাযোগের জন্য কম করে ৩০টি সাংকেতিক শব্দ ব্যবহার করত। বলা হয় সেগুলোই ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়ে ভাষার উৎপত্তি হয়। ভাষার সংজ্ঞায় যে বলা হয়, 'অর্থবহ ধ্বনি প্রবাহকেই ভাষা বলে' তার শুধু ধ্বনি প্রবাহের দিকটিতেই আমরা বেশি জোর দিয়েছি, অর্থবহ বা ভাব বিনিময়ের উপযুক্ত কিনা সে ব্যাপারে চিন্তাই করছি না।
ভাষার পরিবর্তন হবে, ভাষার মধ্যে অন্য ভাষা প্রবেশ, ভাষা পরিমার্জিত, পরিবর্ধিত হবে এটাই তো স্বাভাবিক। বাঙালি বলে যেমন কোনো মৌলিক জাতি ছিল না, 'বাংলা ভাষা' বলেও তেমন কোনো মৌলিক ভাষা ছিল না। বহু শতাব্দী ধরে বহু ভাষার সংমিশ্রণে এই ভাষা তৈরি হয়েছে এবং বলা যায় এখনো হচ্ছে। আর্যরা আসার আগেই ভারতবর্ষে মানুষ ছিল যারা দ্রাবিড়, অস্টিক, ভোটচিনীয় প্রভৃতি গোষ্ঠীভুক্ত ছিল। এই দ্রাবিড়রাই হরপ্পা সভ্যতার গোড়াপত্তন করেছিল। এই গোষ্ঠীভুক্ত 'কীরাত' বা 'নিষাদ' সম্প্রদায় বাঙালির পূর্বপুরুষ ছিল। তাদের ভাষার সঙ্গে ইন্দো ইউরোপিয়ান আর্যদের ভাষার বহুকাল ধরে পরিবর্তিত রূপের সঙ্গে সংমিশ্রণ ঘটে। এক সময় বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়। ইন্দো ইউরোপীয়-শতম-আর্য ভাষা, তার সঙ্গে পাণীনি সংস্কারিত সংস্কৃত যোগ হয়ে প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা তার সঙ্গে উপমহাদেশীয় বহু ভাষা যুক্ত হয়ে আদিম প্রাকৃত, তার থেকে গৌড়ীয় অপভ্রংশ এবং ৯০০ খ্রি. নাগাদ এই গৌড়ীয় অপভ্রংশ থেকে বাংলা ভাষার জন্ম হয় বলে পন্ডিতরা মনে করেন। তন্ডুল, নীর, পানি, পূজা, চন্দন, কাজল, খাট, খাল প্রভৃতি দ্রাবিড় শব্দগুলোই সংস্কৃতে প্রবেশ করেছে। যার কিছু কিছু এখনো বাংলা ভাষা বহন করে যাচ্ছে। এভাবে পশ্চিমবঙ্গে পর্তুগিজরা যখন বসবাস শুরু করল তখন বালতি, বয়াম, বোতল, ইস্ত্রিরি, আলমারি, সাবান, গামলা, চাবি ইত্যাদি শব্দগুলো হয়ে গেল বাংলা ভাষা। সেভাবে খাসা, ফায়সালা, আসামি, মামলা, হুকুম ইত্যাদি আরবি শব্দগুলো সংযোজিত হলো বাংলা ভাষায়। ফরাসি থেকে সংমিশ্রণ ঘটেছে জামা, শাল, রুমাল, মোজা প্রভৃতি শব্দ। কিন্তু কথা হচ্ছে, সংযোজিত হলো, তাতে ভাষা সমৃদ্ধ হলো, পরিবর্তিত হলো, কিন্তু মূল সুরটি হারিয়ে যায়নি। ফলে আর্য ভাষারীতির 'য়ুয়ম অশ্বম্ স্পশ্যাথ' আদিম প্রাকৃত হলো 'তুষ্মে ঘোটকং দৃক্ষ', প্রাচীন পালিতে হলো 'তুমহে ঘোটকং দেকখখ', মধ্যযুগীয় বাংলায় হলো 'তোম্েহ ঘোড়া দেখহ' আর আধুনিক বাংলায় (১৮০০খ্রি.) হলো 'তুমি ঘোড়া দেখ'।
হিন্দি ভাষাও আমাদের খুব নিকটস্থ। 'হিউয়েন সাং'-এর বিবরণ থেকে জানা যায়- পুন্ড্র, রাঢ়, বঙ্গ, বিহার ও উত্তর পশ্চিম ভারতের ভাষা এক সময় এক ছিল। এই ভাষা মাগধী প্রাকৃত- এক অতি প্রাচীন হিন্দি ভাষাই ছিল। সেই মাগধী প্রাকৃত ভাষা থেকেই হিন্দি, অসমীয়া বা বাংলা ভাষার জন্ম হয়। তাই দেখা যায়, বিদ্যাপতি মূলত মৈথিলী ভাষায় কবিতা রচনা করলেও তাতে বাংলার সুর খুঁজে পাওয়া যায়-
মাধব বহুত মিনতি করি তোয়।
দেই তুলসী তিল দেহ সমর্পিলুঁ
দয়া জনি ছোড়বি মোয়।।
গনইতে দোষ গুনলেস না পাওবি
জব তুহুঁ করবি বিচার।/তুহুঁ জগন্নাথ জগতে কহায়সি
জগ বাহির নহ মুঞি ছার।।/কিএ মানুষ পশুপাখিয়ে জনমিয়ে
অথবা কীটপতঙ্গ।/করম বিপাক গতাগত পুনপুন
মতি রহু তুয়া পরসঙ্গ।।/ভনই বিদ্যাপতি অতিশয় কাতর
তরইতে ইহ ভবসিন্ধু।/তুআ পদপলস্নব করি অবলম্বন
তিল এক দেহ দীনবন্ধু।।
(পদকর্তা: বিদ্যাপতি, সংকলন: দেবহূতি সরকার)
অন্তঃকথন:
জীবনের শেষে এসে বিদ্যাপতি মাধবের শ্রীচরণে নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করে বলছেন, মাধব তোমায় বহু মিনতি করে তিল তুলসী দিয়ে তোমার পায়ে আমার এই দেহ সঁপে দিলাম। আমার প্রতি তোমার দয়া তুমি প্রত্যাহার করো না। তুমি যখন বিচার করবে তখন আমার দোষ গণনা করে গুণের লেশমাত্রও পাবে না, তবু তুমি আমার প্রতি নির্দয় হয়ো না। তুমি জগতের নাথ, আমি যত দোষই করি জগতের বাইরে তো নই! মানুষ, পশুপাখি ও কীটপতঙ্গ যে রূপেই জন্মাই না কেন, দেখ যেন তোমার চরণে মতি থাকে। সব শেষে অতিশয় কাতর হয়ে বিদ্যাপতি বলছেন, এই ভবসিন্ধু উত্তরণে তোমার পদপলস্নব অবলম্বন করব, দীনবন্ধু এক তিলের জন্যও সেই অবলম্বন দাও!
আসলে এই কবিতাগুলো বৈষ্ণব কবিরা বারবার উচ্চারণ করতে করতে ভাষাটিকে বাংলার দিকে অনেকটাই টেনে আনতে পেরেছিলেন। যদিও দশম শতাব্দীতে রচিত চর্যাপদের 'সান্ধ্য' ভাষাকেই বলা হয় লিখিত আকারে প্রথম বাংলা ভাষা-ঢেন্ডনপাদানাম এ পাওয়া যায়-
'টালত মোর ঘর নাহি পড়বেষী।
হাঁড়িত ভাত নাহি নিতি আবেশী'
বাংলার বহু কবি সাহিত্যিক নিজেদের রচনায় নানাভাবে হিন্দি শব্দ ব্যবহার করেছেন। প্রমথ চৌধুরী 'তোয়ের করা' (হিন্দি তৈয়ার) কথাটি ব্যবহার করেছেন। বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায় 'কাহেগে মাইয়া তেরা এইসন হালৎ, কাহেগে তোরা এইসন বেশ' প্যারডি গেয়েছিলেন। কিন্তু এসবই তারা করতেন বাংলা ভাষার মর্যাদাকে মনে রেখে। এখন যদি বাংলা 'মোষ' শব্দটিকে আমরা 'ভেঁইষ' দিয়ে প্রতিস্থাপিত করি তাহলে তা বাংলা ভাষার পক্ষে গৌরবের হবে না। এখন বাঙালি ঘরের ছেলেমেয়েরা কোনো অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র সঙ্গীত হলে, চিৎকার করে বলে 'হিন্দি হোক, হিন্দি হোক'। আর ইংরেজরা প্রায় দু'শো বছর আমাদের দেশে উপনিবেশ স্থাপন করে মগজের মধ্যে ইংরেজি এমনভাবে ঠুসে দিয়ে গেছে যে, আমরা তার থেকে কিছুতেই বেরোতে পারছি না। 'সরি' কথাটি ফেরত করে 'দুঃখিত' আর কোনো দিনই আসবে না। বাংলা মাধ্যমের স্কুলগুলোতে শুরু হয়েছে ছাত্রাভাব, মোটামুটি সচ্ছল সবাই সন্তানকে প্রাইভেট স্কুলেই পড়াতে চাইছে, কারণ সেখানে ইংরেজি আছে। ইংরেজি ছাড়া ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত মনে করছে তারা। জীবনে উন্নতি হবে না, চাকরি হবে না, এই শঙ্কা কাটানোর কোনো বিকল্প রাস্তাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই ইংরেজি হয়ে উঠেছে তুরুপের তাস। প্রসঙ্গত, ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের কবিতাটি মনে পড়ে গেল-
'ইংলিশ ওর গুলে খাওয়া,
ওটাই ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ
হিন্দি সেকেন্ড, সত্যি বলছি
হিন্দিতে ওর দারুণ তেজ।
কী লাভ বলুন বাংলা পড়ে
বিমান ছেড়ে ঠেলায় চড়ে
বেঙ্গলি থার্ড ল্যাঙ্গুয়েজ, তাই
তেমন ভালোবাসে না
জানেন দাদা, আমার ছেলের
বাংলাটা ঠিক আসে না।
রামনিধি গুপ্ত (নিধুবাবু) তার 'স্বদেশী ভাষা' কবিতায় বলেছেন-
'বিনে স্বদেশি ভাষা,
পুরে কী আশা'
একমাত্র মাতৃভাষার মাধ্যমেই সম্ভব মনের ভাব মনের মতো করে সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করা। বাংলা ভাষায় আমরা আমাদের ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, আবদার ইত্যাদি যেমন প্রকাশ করতে পারব, পৃথিবীর আর অন্য কোনো ভাষায় তা সম্ভব নয়। এক সময় বাংলা ভাষা সংস্কৃতের খোলস থেকে কিছুটা মুক্তি পেলেও, সমাসবদ্ধ পদ না থাকলে তা ওজনদার হতো না। বাংলা যেন তখনো বাঙালির নিজের ভাষা, যাতে সে নিজের মনের ভাব উজাড় করে বলতে পারবে তা হয়ে উঠছিল না। কথ্য ভাষা প্রয়োগ পন্ডিতদের পছন্দ ছিল না। এই অচলাবস্থা থেকে ভারতচন্দ্র রায়গুনাকর, ঈশ্বর গুপ্তসহ আরো অনেক কবিরা সাহস দেখিয়ে ছিলেন। ঈশ্বরগুপ্ত লিখেছেন-
\হ'মুরগির ডিম গন্ডা গন্ডা
\হখেয়ে কর প্রাণ ঠান্ডা।'
বলা বাহুল্য বাঙালিরা অনেকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পেরেছিল। পরবর্তীকালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত এসে বাংলাকে মুক্ত পৃথিবীর অঙ্গনে নিয়ে আসেন। তারপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলাকে এনে দিলেন বাঙালির ঘরে ঘরে। গদ্যে রাজা রামমোহন যে কাঠামো তৈরি করে দিলেন সেখানে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর গদ্যের প্রাণ সঞ্চার করলেন। তিনি বাংলাকে সহজ ও অনেকটা কোমল করে তোলেন। সাহস দেখালেন প্যারিচাঁদ মিত্র। তিনি 'আলালের ঘরে দুলাল' লিখলেন একেবারে চলতি আটপৌরে ভাষায়। তার ভাষার নামই হয়ে গেল 'আলালী ভাষা'। এরপর 'হুতোম পঁ্যাচার নক্সা' লিখলেন কালিপ্রসন্ন সিংহ। বাঙালির মুখের ভাষাকে তুলে দিলেন কাগজে। বঙ্কিমচন্দ্র বিদ্যাসাগরীয় ভাষা ও আলালী ভাষাকে সমন্বিত করে সুললিত ও আকর্ষণীয় করে উপন্যাস লিখে ফেললেন। রবীন্দ্রনাথ ইউরোপ ভ্রমণে গিয়ে যে চিঠিপত্র লিখলেন তা হয়ে উঠলো নিখুঁত বাংলা গদ্য। এভাবেই লিখিত বাংলা ভাষার পথ চলা শুরু হলো। তারপরও বহু কবি সাহিত্যিক আসলেন, কিন্তু সাহিত্য ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকে নিয়ে সেই ধারার আন্দোলন আর চোখে পড়ল না।
মনে রাখতে হবে, এই বাংলা ভাষার জন্যই ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রম্নয়ারি এ দেশের জব্বর, রফিক, সালাম, বরকত প্রভৃতি তরতাজা যুবকরা বাংলা ভাষার জন্য বুকের রক্ত দিয়ে নিজেকে দেশের মাতৃভাষা রক্ষা করার নিমিত্তে উৎসর্গ করেছেন। তাদের এই আন্দোলনে সারা বিশ্ব চমকে উঠেছিল। বিশ্ববাসী ভাবলো, মাতৃভাষার জন্য এমনও আন্দোলন করা যায়! বাংলা ভাষার গুরুত্ব বুঝলো পৃথিবী। বুঝলো মাতৃভাষার কত দম। জাতিসংঘ ২১ ফেব্রম্নয়ারিকে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছেন। কে বলতে পারে এখন যে সিনেমায় ইংরেজি বই ছাড়াও কোরিয়ান প্রভৃতি সিনেমা ওস্কার পাচ্ছে তা তারই প্রভাব। আমরা তাই সেই দিনটির অপেক্ষা করে থাকব যখন বাংলা ভাষাতেও উচ্চশিক্ষা লাভ করে সম্মান পাওয়া যাবে, বাংলাতেও চিকিৎসা শাস্ত্র, কারিগরি শিক্ষা প্রভৃতি পড়া যাবে, বাংলা ভাষা নিয়ে পড়েও চাকরির অভাব হবে না, আমরা আবার গর্বের সঙ্গে বলতে পারব-
'আমি বাংলায় গান গাই/আমি বাংলার গান গাই
আমি আমার আমিকে চিরদিন/এই বাংলায় খুঁজে পাই।'