বাংলাভাষার ক্রমবিবর্তন
প্রকাশ | ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
অমল বড়ুয়া
মানবজাতির আন্তঃযোগাযোগ, ভাব-বিনিময়, আত্মপ্রকাশ ও সৃজনশীলতার অনবদ্য মাধ্যম হচ্ছে ভাষা। পুরো পৃথিবীই উর্বর বিবিধ ভাষার আতিশয্যে। মানুষের ভাষা, পশুপাখির ভাষা, কীটপতঙ্গের ভাষা ও প্রকৃতির ভাষা। এত এত ভাষার মধ্যে কেবল মানুষের ভাষার মধ্যে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে- যা অন্যান্য প্রাণীর ভাষায় দেখা যায় না। আর মানুষের ভাষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো 'সৃজনশীলতা বা সঞ্জননী' ক্ষমতা। প্রতিটি মানুষ তার নিজ নিজ ভাষা আয়ত্ত করার সহজাত গুণ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন এবং সে যেই নির্দিষ্ট ভৌগোলিক পরিবেশ বেষ্টিত ভাষিক সমাজের অন্তর্গত, সেই সমাজে সে দৈনন্দিন ভাষাপ্রয়োগের মাধ্যমে তার নিজস্ব ভাষাজ্ঞান বিকশিত করে। দেশ, কাল ও পরিবেশভেদে ভাষার পার্থক্য ও পরিবর্তন ঘটে।
বাংলাভাষা এলো কোথা থেকে ?
বাংলাভাষা খুঁজে পাওয়া যায় খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা গোত্রে। সরাসরি সংস্কৃতভাষা থেকে উৎপত্তির কিংবদন্তি থাকলেও বাংলা ভাষাবিদরা বিশ্বাস করেন, বাংলা মাগধী প্রাকৃত এবং পালির মতো ইন্দো-আর্য ভাষা থেকে এসেছে। বাংলা ও সংস্কৃত একই গোষ্ঠী থেকে এসেছে। বাংলাভাষার আদিগোষ্ঠীর নাম 'ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী' বা 'আদি আর্য-ভাষাগোষ্ঠী'। এই ভাষাগোষ্ঠী থেকে উৎপত্তি হয়েছে অনেক ভাষার। বাংলাভাষাকে নব্য-ভারতীয় আর্যগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তও করা হয়। বাংলাভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে পূর্বদিকের ভাষা এবং সবচেয়ে প্রান্তিকও বটে। এর পশ্চিম দিকে ওড়িয়া, মাগধী, মৈথিলী, এবং পূর্বদিকে অসমিয়া ভাষাভাষী বসবাস করে। এছাড়া সাঁওতালী, মুন্ডারী, খাসি প্রভৃতি ভাষা অস্ট্রিক গোত্রের ভাষা এবং কাছারী, বোড়ো, গারো, ত্রিপুরী, প্রভৃতি বর্মী গোত্রভুক্ত ভাষা।
বাংলাভাষা হচ্ছে ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষাবংশের সদস্য। যার উৎপত্তি আজ থেকে প্রায় সাত হাজার বছর আগে খ্রিষ্টাপূর্ব ৫০০০ অব্দে। খ্রিষ্টাপূর্ব ৩৫০০ অব্দে এই ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষাবংশ থেকে জন্ম নেয় 'শতম'। এর প্রায় একহাজার বছর পর খ্রিষ্টাপূর্ব ২৫০০ অব্দে 'শতম' ভাষাটি রূপান্তরিত হয় 'আর্য' ভাষায়। তবে তখন পর্যন্তও উপমহাদেশে আর্যভাষার চল হয়ে ওঠেনি। ভারত উপমহাদেশে আর্যভাষার চল শুরু হয় খ্রিষ্টাপূর্ব ১৮০০ অব্দে আর্যজাতি আগমনের পর। উপমহাদেশে আর্যভাষা চালু হবার পরবর্তী তিনশো বছরে পরিবর্তনের উপমহাদেশীয় হাওয়া লাগে আর্যভাষায়। আর্যজাতির পাশাপাশি ধীরে ধীরে উপমহাদেশর সাধারণ মানুষও আপন করে নেয় এই প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা। তখন আরো কিছুটা রুপান্তরিত হয়ে এ ভাষা হয়ে ওঠে 'প্রাচীন ভারতীয় আর্য কথ্য' ভাষায় (খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ অব্দ) যা 'আদিম প্রাকৃত' নামেও পরিচিত। এরপর খ্রিষ্টাপূর্ব ৮০০ অব্দ হতে ৪৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে আদিম প্রাকৃতের রুপান্তর ঘটে প্রথমে 'প্রাচীন প্রাচ্য প্রাকৃত' এবং পরবর্তী সময়ে 'গৌড়ি প্রাকৃত' ভাষা দুটির উৎপত্তি হয়। আর এই গৌড়ি প্রাকৃত থেকে ৪৫০ খ্রিষ্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে জন্ম হয় 'গৌড়ি অপভ্রংশ' ভাষার। এই গৌড়ি অপভ্রংশ থেকেই ৯০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে উৎপত্তি হয় 'বাংলা' ভাষার। শুরুর দিকে অবশ্য বাংলাভাষা ঠিক শতভাগ এমন ছিল না। ভাষাবিদগণের ভাষায় সে সময়ের বাংলাকে বলা হয় 'প্রাচীনবাংলা'। এরপর ১৪০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে আসে 'মধ্যবাংলা' এবং ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে সেটা রুপ নেয় 'আধুনিকবাংলা' ভাষায়। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী দুটি ভূখন্ডে বিভক্ত হওয়ার কারণে এই ভাষাগোষ্ঠীকে দুটি শাখাতে ভাগ করা হয়- শতম ও কেন্তুম। শতম শাখাটি থেকে ভারতের, আর কেন্তুম শাখা থেকে ইউরোপের বিভিন্ন ভাষা এসেছে।
ভারতীয় আর্যভাষা
ভারতীয় আর্যভাষার ইতিহাসে তিনটি প্রধান স্তর লক্ষ্য করা যায়। প্রথম স্তরটির নাম হলো বৈদিকভাষা, যার সময় খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ অব্দ। পরের স্তর হলো সংস্কৃতভাষা, যার সময় খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫০ অব্দ পর্যন্ত। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ অব্দের দিকে ব্যাকরণবিদ পাণিনির হাতে এটি চূড়ান্তভাবে বিধিবদ্ধ হয়। বৈদিক ও সংস্কৃত এই দুই ভাষা হলো প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা। এর পরের স্তর প্রাকৃতভাষা। এই ভাষাগুলো মধ্যভারতীয় আর্যভাষা হিসেবে পরিচিত। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫০ থেকে ১০০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এ ভাষাগুলোই কথ্য ও লিখিত ভাষা হিসেবে ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রচলিত থাকে। ধারণা করা হয়, প্রাচীন ভারতের প্রাকৃত ভাষাগুলোর মধ্যে পালি অন্যতম- যার জন্ম খ্রিষ্টের জন্মেরও কমপক্ষে ছয়শ বছর আগে। গৌতম বুদ্ধ এই ভাষাতেই ধর্মপ্রচার করেছিলেন। মূলত, একটি সাধারণ প্রাদেশিক ভাষা হয়েও এটি ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী ভাষা হয়ে উঠেছিল, যা তাকে বসিয়েছে চিরায়ত ভাষার আসনে। ফলে এই ধর্মমত সহজেই সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে উঠতে সক্ষম হয়। এই প্রাকৃত ভাষাগুলো থেকে অপভ্রংশ বা বিকৃত হয়ে বিভিন্ন ভাষা, যেমন: বাংলা, হিন্দি, গুজরাটি, মারাঠি, পাঞ্জাবি প্রভৃতির জন্ম। সংস্কৃত ব্যাকরণবিদ পতঞ্জলির মহাভাষ্য গ্রন্থে সর্বপ্রথম 'অপভ্রংশ' শব্দটির উলেস্নখ পাওয়া যায়। ভাষাবিদদের মতে, সমস্ত প্রাকৃত ভাষারই শেষ স্তর হলো অপভ্রংশ, এবং এই অপভ্রংশগুলো থেকেই সমস্ত নব্য ইন্দো-আর্য ভাষার জন্ম।
১৭৮৬ খ্রিষ্টাব্দে 'এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল' এর প্রেসিডেন্ট স্যার উইলিয়াম জোনস- সোসাইটির এক বার্ষিক সভার এক ভাষণে তিনি ল্যাটিন, গ্রিক, ইংরেজি, ফরাসি, জার্মানি, পাহলবি, সংস্কৃত প্রভৃতি কতিপয় ভাষার অনেকগুলো শব্দ ও ধাতুরূপ বিশ্লেষণ করে দেখান যে, ঐসব ভাষার মূলে ঐক্য রয়েছে। তিনি তাই অনুমান করেন, ঐসব ভাষাভাষীজনরা আদিতে একই স্থানে বাস করত এবং এক-ই ভাষায় কথা বলত। কালে কালে বংশবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তারা নানা দেশে ছড়িয়ে পড়িতে বাধ্য হয়। এরূপেই বিভিন্ন জাতি ও বিভিন্ন ভাষার সৃষ্টি হয়। এই ইংগিত পেয়ে জার্মান পন্ডিতদের মনে এক নতুন চিন্তার উদ্রেক হলো। তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের আলোচনায় তারা প্রবৃত্ত হলেন। ম্যাক্সমুলার, বপ, কোলাপ্রথ প্রভৃতি পন্ডিত এই বিষয়ে বহু গবেষণা করলেন। অতঃপর ১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দে স্যার থমাস ইয়ং নামক জনৈক মিশরীয় ভাষাবিদ পন্ডিত আলোচ্য ভাষাগুলোকে 'ফ্যামিলি অব ইন্দো-ইউরোপিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ' বলে অভিহিত করেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ওই সব ভাষাভাষী জনগণকে ইন্দো-ইউরোপিয়ান রেস নামে পরিচয় দেন। এরপরই ইন্দো-আর্য্য এবং আর্য্য নামের উৎপত্তি।
বাংলা ভাষার রূপান্তর
ইন্দো-আর্য হল ইন্দো-ইরানীয় ভাষা উপবিভাগের একটি প্রধান শাখা, যা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা গোত্রের পূর্বাঞ্চলীয় ধরন। মধ্য ইন্দো-আর্য ভাষাগুলোর মধ্যে আছে পালিসহ প্রাকৃতের বিভিন্ন রূপ, যেগুলো পাওয়া যায় সম্রাট অশোক এবং থেরবাদ বৌদ্ধ শাস্ত্রে। পালি ভাষা সম্পর্কে শ্রীঈশানচন্দ্র ঘোষ মত দেন যে, 'শব্দগত, উচ্চারণগত, এমনকি ব্যাকরণগত সাদৃশ্য দেখিলে মনে হয়, ইহা (পালি) উৎকল, বঙ্গ প্রভৃতি কতিপয় প্রাচ্যভাষার জননীও হইতে পারে। অধ্যাপক অটো ফ্রাঙ্ক বলেন যে, একসময়ে ভারতবর্ষে ও লঙ্কাদ্বীপে পালিই আর্য্যাদিগের সাধারণ ভাষা ছিল।'
খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দ থেকে বাংলায় হিন্দু-ব্রাহ্মণরা সংস্কৃত ভাষার চর্চা করত, কিন্তু স্থানীয় বৌদ্ধরা প্রাকৃত ভাষায় কথা বলত, যাকে ডঃ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় মাগধী প্রাকৃতের পূর্বরূপ হিসেবে উলেস্নখ করেছেন। প্রথম সহস্রাব্দে বাংলা যখন মগধ রাজ্যের একটি অংশ ছিল তখন মধ্য ইন্দো-আর্য উপভাষাগুলি বাংলায় প্রভাবশালী ছিল। এই উপভাষাগুলিকে মাগধী প্রাকৃত বলা হয় এবং এটি আধুনিক বিহার, বাংলা ও আসামে কথিত হত। এই ভাষা থেকে অর্ধ-মাগধী প্রাকৃতের বিকাশ ঘটে। প্রথম সহস্রাব্দের শেষের দিকে অর্ধ-মাগধী থেকে অপভ্রংশের বিকাশ ঘটে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাভাষা একটি স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে বিকশিত হয়। ষষ্ঠ শতাব্দীর আশপাশে অর্ধ-মাগধী থেকে অবহট্ঠ ভাষার বিকাশ ঘটেছে বলে ধারণা করা হয়, এই অবহট্ঠ ভাষা কিছু সময়ের জন্য বাংলাভাষার পূর্বপুরুষ প্রোটো-বাংলার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। প্রোটো-বাংলা ছিল পালসাম্রাজ্য এবং সেন রাজবংশের ভাষা। আর পালসাম্রাজ্যের সময়েই বাংলাভাষার আদি নিদর্শন চর্যা রচিত হয়। বাংলাভাষার রূপান্তর ক্রমকে এভাবে বর্ণনা করা যায়-
ইন্দো-ইউরোপিয়ান- য়ুস এক্ব্যোম্ স্পেক্যিএথে
শতম- য়ূস এশ্বোম্ স্পেশিএথে।
আর্য- য়ূস অশ্বম্? স্পশ্যাথ্।/প্রাচীন ভারতীয় আর্য- য়ূয়ম অশ্বম্? স্পশ্যাথ্।
আদিম প্রাকৃত- তুষ্মে ঘোটকং দৃক্ষথ্।
প্রাচীন প্রাচ্য প্রাকৃত (পালি)- তুমহে ঘোটকং দেক্?খথ্।
গৌড়ি প্রাকৃত- তুমহে ঘোড়াঅং দেক্?খহ।
গৌড়ি অপভ্রংশ- তুমহে ঘোড়অ দেক্?খহ।
প্রাচীন বাংলা- তুমহে ঘোড়া দেখহ।
মধ্য বাংলা- তুমহি ঘোড়া দেখহ।
আধুনিক বাংলা- তুমি ঘোড়া দেখ।
বাংলাভাষার এই বিবর্তনকে আমরা তিনটি সময়ে ভাগ করতে পারি- প্রাচীনযুগের বাংলা, মধ্যযুগের বাংলা এবং আধুনিক যুগের বাংলা। প্রাচীনযুগ (৬৫০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দ) এখন পর্যন্ত বাংলাভাষার সর্বপ্রাচীন যে নমুনা পাওয়া গেছে, তা হলো চর্যাপদ। চর্যাপদের অন্য অনেকগুলো নামের মধ্যে উলেস্নখ্যযোগ্য হলো চর্যাগীতিকোষ, দোহাকোষ, চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয় এবং চর্যাগীতিকা। ধারণা করা হয়, এটি পাল-আমলে রচিত। আচার্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় ও ড. মুহম্মদ শহীদুলস্নাহ গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেন- এই চর্যাপদই বাংলাসাহিত্যের আদি নিদর্শন। মধ্যযুগ (১৩৫০-১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ) মুসলমানরা বাংলায় আসার আগে বাংলাভাষায় যেসব শব্দের প্রভাব ছিল, তা মূলত তৎসম, অর্ধ-তৎসম, তদ্ভব, অস্ট্রিক (মুন্ডারি, সাঁওতালি) এবং দ্রাবিড় শব্দ। ১৪০০-১৮০০ সালের মধ্যে মুসলমনাদের হাত ধরেই বাংলাভাষায় আরবি, ফারসি, তুর্কি ইত্যাদি ভাষার প্রচুর শব্দ প্রবেশ করেছিল। আস্তে আস্তে এই শব্দগুলো বাংলাভাষার শব্দ ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। আধুনিকবাংলা (১৮০১-বর্তমান) আধুনিকবাংলা ভাষার দুটি প্রধান রূপ আছে: সাধু ও চলিত। ১৮০০ সালে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আধুনিকবাংলার যাত্রা শুরু। ১৮০১ সালে উইলিয়াম কেরিকে প্রধান করে এখানে বাংলা বিভাগ খোলা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে উইলিয়াম কেরি ও তার সহকর্মীগণ গদ্যের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন, এবং তাদের প্রচেষ্টায় বাংলায় গদ্যের আবির্ভাব হয়। আর এ সময়ই সাধু ভাষার আবির্ভাব ঘটে। মূলত সাধুভাষার আবির্ভাব হয়েছিল ভাষাকে একটি বিধিবদ্ধ রূপ দেয়ার প্রয়াসে। চতুর্দশ শতকে বাংলায় শুরু হয় মুসলমানদের সালতানাত। সালতানাত বাংলাকে এই অঞ্চলের সরকারী দরবারী ভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। এই ধারাবাহিকতায় ক্রমেই বাংলার স্থানীয় ভাষায় পরিণত হয় বাংলা।
ষোড়শ শতকে মুঘলরা বাংলা দখল করলে বাংলাভাষার সঙ্গে যোগসাজশ ঘটে ফার্সিভাষার। বর্তমান বাংলাভাষার আধুনিক রূপটি পাওয়া যায় ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের সময় বাংলার নদীয়া অঞ্চলে কথিত উপভাষায়। এই ভাষাটির দুটি ভাগ; শুদ্ধ এবং চলিত। এগুলোর ভিত্তি গড়েছে প্রধানত মাগধী প্রাকৃত এবং পালিসহ তুর্কি, পর্তুগিজ, ফার্সি ও ইংরেজি। প্রায় ১৩০০ বছরের দীর্ঘ বিবর্তনে বাংলাভাষার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রচুর পরিমাণে দেশীয় এবং বিদেশি শব্দ। বহু শতাব্দীর পর ১৯শতকে এসে রাজা রাম মোহন রায় ও বিদ্যাসাগরের হাতে বাংলাভাষা চূড়ান্ত রূপ পায়। আজ বাংলা মানব সভ্যতার ইতিহাসে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে একটি স্বতন্ত্র ভাষা।
ভাষাগত সাম্রাজ্যবাদ
একটি ভাষা ঠিক কতটা শক্তিশালী হবে, তা নির্ভর করে ভাষাটির ব্যবহারের ওপর। একটি ভাষা সমাজের কোন শ্রেণির মানুষ ব্যবহার করছে, তার উপর ঐ ভাষার শক্তিমত্তা নির্ভর করে। একটি ভাষা শক্তিশালী হয়ে উঠার পিছনে ঐ রাষ্ট্রের আর্থিক ও রাজনৈতিক সক্ষমতা, ঐ ভাষায় জ্ঞান উৎপাদন, প্রযুক্তি পণ্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একটি ভাষাকে শক্তিশালী করতে হলে দীর্ঘ সময় নিয়ে এর পৃষ্ঠপোষকতা করতে হয়। এর জন্য যেমন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা করতে হয়, তেমনি এগিয়ে আসতে হয় সচেতন নাগরিকদের। ভাষা শক্তিশালী হয়ে উঠার পেছনে সিনেমা, গণমাধ্যম, বই ইত্যাদি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কোন ভাষায় কত মানুষ কথা বলেন, শুধু তার নিরিখেই সেটির অবস্থান নির্ণয় করা হচ্ছে না; বরং অর্থনৈতিক প্রয়োজনে কতটা বেশি কাজে লাগছে, সেটার মাধ্যমে নির্ধারিত হচ্ছে সেই ভাষার গুরুত্ব। এমনকি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কোন দেশ কতটা ক্ষমতাধর, সেটাও সেই দেশের ভাষার গুরুত্ব বা অবস্থান সমপর্যায়ে নিশ্চিত করতে পারে না।
বিশ্বে প্রায় সাত হাজার ভাষা এখনো টিকে আছে। কিন্তু অর্থনৈতিক গুরুত্বের বিচারে বহু দশক ধরে ইংরেজির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং তারা তা উপনিবেশ তৈরির সময়ে সম্প্রসারিত করেছে; উপনিবেশ-উত্তর যুগেও টিকে আছে। এখন যে বিশ্ব প্রযুক্তনির্ভর হয়ে পড়েছে, সেই প্রযুক্তির বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ অনেকাংশেই ইংরেজিনির্ভর হয়ে আছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টারের হিসাব বলছে, বিশ্বে প্রায় দেড়শ কোটি মানুষ এখন ইংরেজি বলে। এরপর দ্বিতীয় অবস্থানে আছে চীনের মান্দারিন-ভাষা, তৃতীয় ভারতের হিন্দি। এ দুটো ভাষার লোকসংখ্যা যথাক্রমে ১১০ কোটি ও ৬০ কোটি ২২ লাখ। চতুর্থ হচ্ছে স্প্যানিশ (৫৪ কোটি ৮৩ লাখ), পঞ্চম ফরাসি (২৭ কোটি ৪১ লাখ) ও ষষ্ঠ আরবি (২৭ কোটি ৪০ লাখ) আর সপ্তম অবস্থানটি হচ্ছে বাংলাভাষীদের, যাদের সংখ্যা হচ্ছে ২৭ কোটি ২২ লাখ। বাংলাদেশ বিশ্বের ৬০টিরও বেশি দেশের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বাণিজ্য করে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশি ৭০ লাখেরও বেশি শ্রমশক্তি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছে। জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বিভিন্ন দেশে সর্বাধিক সৈন্য প্রেরণকারী দেশ। তাই বাংলাভাষার ব্যবহারিক আন্তর্জাতিকায়ন কোনও স্বপ্ন নয়, এটি প্রয়োজন হয়ে উঠছে। বাংলাভাষার অভিভাবক বাংলাদেশকেই সে প্রয়োজন মেটানোর দায়িত্ব পালন করতে হবে।
ভাষার জন্য আত্মদান
আধুনিক বাংলাভাষার জন্যেই ১৯৫২ সালে প্রাণ দিয়েছিলেন বাংলার সূর্য-সন্তান রফিক, বরকত, আব্দুস সালাম, আব্দুল জব্বারেরা। পঞ্চাশের দশকে ভারতের বিহার রাজ্যের (এরাও বাঙালি) মানভূম জেলায়ও হয় বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন। ১৯৬১ সালে ভারতের শিলচরেও বাংলা ভাষার আন্দোলনে ১১ জন শহীদ হন। ১৯৯৯ সালের ১৭ মে ইউনেস্কো আমাদের ভাষা এবং ভাষা শহীদদের সম্মানে 'একুশে ফেব্রম্নয়ারি'কে আন্তর্জাতিক মার্তৃভাষা দিবসের মর্যাদা দেয়। শুধু তাই নয় আফ্রিকা মহাদেশের সিয়েরা লিওন নামের দেশটিও সম্প্রতি বাংলাকে তাদের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিয়েছে। পুরো পৃথিবীজুড়ে প্রায় সাড়ে সাতাশ কোটির বেশি মানুষ বাংলায় কথা বলে। ভাষাভাষী লোকসংখ্যার দিক থেকে পৃথিবীর সপ্তম এবং একই সঙ্গে তিনটি দেশের রাষ্ট্রভাষা 'আমাদের প্রাণের বাংলা'!