গভীর রাত। তারেক হাসান স্বপ্নে বিভোর। অনেকদিন পর স্ত্রীর সাক্ষাৎ পেয়েছে। তবে মনে হচ্ছে অসুস্থ এবং বেশ শান্ত। তারেক হাসান দরদভরে অসুস্থ স্ত্রীর যন্ত্রণা বুঝতে পারে। স্ত্রী পরিপাটি বিছানায় বসে সংসারের চাবির গোছাটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। অনেকদিন পর এলেও থাকতে যে আসেনি তা নিশ্চিত জানে তারেক হাসান। তাই সে ভাবে, এতদিন পরে আসা স্ত্রী মুখে কিছু না দিয়ে চলে যাবে- তা কেমন করে হয়! শহরতলির ঝিলপারের বাসা থেকে কাছেই জেলা শহরের বাজারে গিয়ে কিছু ফলমূল কিনে আনবে- এ কথা ভেবে ঘর থেকে বের হয়। দু'কদম এগিয়েই থমকে দাঁড়ায়। মনে মনে বলে, আ হা! ঘর থেকে বের হওয়ার সময় পকেটে তো টাকা নেওয়া হয়নি। তাহলে কেনাকাটা করব কী দিয়ে। এই ভেবে ফিরে এসে আবার ঘরে ঢুকে। তখন দেখতে পায় অসুস্থ স্ত্রী ঘর গোছগাছ করছে। এ দৃশ্য দেখে তারেক বলে, এ কী! অসুস্থ শরীর নিয়ে তুমি কাজ করছ? -পুরাতন কিছু জিনিসপত্র পাল্টানো দরকার। -তাই? স্বপ্নযোগে দেখা পাওয়া স্ত্রীর কথাগুলো শেষ হতে না হতেই স্বপ্ন যায় টুটে। তারেক হাসানের ঘুম ভেঙে যায়। অমনি সে স্বপ্নের বিষয় নিয়ে হাপিত্যেস করতে থাকে। তার মন তো চেয়েছিল, স্ত্রীকে ঘিরে এমন স্বপ্নের ঘোরে আজীবন আচ্ছন্ন থাকুক। কিন্তু তা তো হবার নয়। স্বপ্ন তো এক সময়ে শেষ হয় কিংবা ভেঙে যায়। তবে এমন একটি স্বপ্ন দেখার পর রাতের অন্ধকারে দু'চোখের দু'টো নদী তর্জন-গর্জন করে ফুঁসে ওঠে। নোনা জল মুখমন্ডলে প্রবাহিত হয়ে এলোপাথাড়ি এক মানচিত্র এঁকে দেয়। প্রতিক্রিয়ায় তারেক হাসান অশান্ত আবেগে পাশে শায়িত পনের মাসের শিশু কন্যাটিকে নিবিড়ভাবে বুকে জড়িয়ে ধরে। অতঃপর দু'চোখে বেপরোয়া জলে পস্নাবন বইয়ে দেয়। স্মৃতির ধারালো করাত যেন বারবার তার লোমশ বুকের চত্বর ব্যবচ্ছেদ করে। তাই অভিমান ভরা মনে একাকি প্রশ্ন করে। বলে, তোমার হাস্যোজ্জ্বল মুখ শেষবারের মতো কবে আমি দেখেছিলাম, ঠিক মনে নাই। একথা বলে কিছুক্ষণ সময় নেয়। তারপর আবার বলে, চলেই যদি যাবে তবে এভাবে লুকিয়ে গেলে কেন? জমাটবাঁধা অন্ধকারের কালো পর্দাটার ওপাশ থেকে তারেক হাসানের এসব প্রশ্নের কোনো জবাব আসে না। বাকি রাত তার দু'চোখের আঙিনায় ঘুম আসেনি। সকালবেলায় তার মা এসে অনুযোগ করে বলে, দিনদিন তুমি কেমন যেন অইয়া যাইতেছ। বাসা-বাড়ি, ঘর-সংসার, গ্রামের জমাজমি কোনো কিছুরই তেমন খোঁজখবর রাখ না। সব ভুইল্যা যাইতেছ। এমনে কি সংসার চলব? জবাবে তারেক হাসান কোনো কথা বলে না, কেবল একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে। ছেলের এমন উদাসীনতা আঁচ করে মা দিন দিন চিন্তিত হয়ে ওঠেন। কপালের বলিরেখায় একাধিক তার ভাঁজ পড়ে। বুক ভরে দীর্ঘশ্বাস টেনে নেন। তারেক হাসানকে নিয়ে বাড়ে মায়ের উৎকণ্ঠা। ওদিকে বন্ধুরাও বলে, তারেক দিনকে দিন আত্মভোলা হয়ে যাচ্ছে। মা ও বন্ধুদের কাছ থেকে এমন অনুযোগ শুনে নিজেকে কিছুটা আত্মশাসন করে তারেক। মনে মনে বলে, একেবারে উদাসীন হয়ে সংসার-চিন্তা ছেড়ে দিলে চলবে কেমন করে! বাস্তবকে তো মেনে নিতে হবে। \হএসব ভাবনায় প্রায়ই বন্ধু জয়নালের কথাটা মনে পড়ে। দাম্পত্যজীবনের ভিতটা হঠাৎ এমন তছনছ হয়ে গেল যে, ক'দিনের মাঝেই তারেক হাসানের একমাত্র কন্যাশিশুকে নিয়ে লেজেগোবরে অবস্থা হয়। তার এ অবস্থা দেখে জয়নাল বলে, যাই বলিস না ক্যান, নিজের মা কিংবা বোনেরাও সংসারকে ততটা গোছাতে পারে না, যতটা পারে একজন স্ত্রী। তারেক মাঝেমধ্যেই বন্ধু জয়নালের ওকথা খুব ভাবে। অতন্ত্র প্রহরীর মতো যে স্ত্রী সবসময় সংসার আগলে রাখত, তাকে হারিয়ে তারেক বড় একা...। একাকী কোনো সিদ্ধান্তই নিতে পারে না। যাপিত জীবনের দুর্বহ যাতনায় সে এমনি ক্ষত-বিক্ষত হয় যে, এই মায়াময় পৃথিবী, এই জীবন তার কাছে কখনো কখনো অর্থহীন মনে হয়। ভাঙা বুকের গভীরে দাবানলের নিরন্তর লেলিহান শিখা প্রতিমুহূর্তে তাকে পোড়ায়। সে আর পেরে ওঠে না। তাই দিন দিন কেমন যেন সংসারবিরাগী হতে থাকে তার আপনভোলা মন। শুধু একটা বিষয়ে তার উদাস মনোতরী গতি হারিয়ে জীবন নদীর চরে গিয়ে আটকে যায়। একমাত্র শিশুকন্যাটি তার বৈরাগী মনের সামনে বিরাট প্রশ্নবোধক হয়ে দাঁড়ায়। তাই তারেক হাসান না পারে ঘর-ছাড়া হতে, না পারে ঘরে তার মন বসাতে। এদিকে আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবেরা তাকে আবার বিয়ে করে সংসারী হতে পরামর্শ দেয়। যেসব স্বজন-শুভানুধ্যায়ী এ ব্যাপারে এগিয়ে এসেছে, তাদের একজন নজরুল ইসলাম। তারেক হাসানের অফিসেরই জুনিয়র সহকর্মী। একদিন একটি মেয়ের ছবি নিয়ে আসে। তারেক হাসানের হাতে ছবিটি দিয়ে বলে, অনানুষ্ঠানিকভাবেই আগে মেয়েটিকে দেখেন। আমার আত্মীয়া। আমাদের বাসাতেই না হয় মেয়েটিকে দেখানোর ব্যবস্থা করব। নজরুল ইসলামদের বাসা দুর্গাপুর উপজেলা সদরেই। উভয়ে আলোচনা করে একটা তারিখ নির্ধারণ করে। ময়মনসিংহ থেকে ভোর ছ'টায় ঝারিয়াগামী ট্রেন। প্রায় দু'ঘণ্টায় ট্রেনটা গিয়ে ঝারিয়ায় পৌঁছে। নজরুল ইসলামের দেওয়া ভ্রমণ নির্দেশনা অনুযায়ী তারেক হাসান ট্রেন থেকে নেমেই পায়ে হেঁটে ট্রেনযাত্রীর স্রোতের টানে উত্তর দিকে যেতে থাকে। পথই নিয়ে যায় কংস নদীর তীরে। নদী পার হলেই ওপারে ঝাঞ্জাইল বাজার। ওখানে দাঁড়িয়ে বিরিশিরিগামী বাস। যাত্রীবোঝাই হয়ে গেলে অল্প সময়ের ব্যবধানেই বাস ছাড়ে। তারেক এই প্রথম গারো পাহাড়ের পাদদেশে সীমান্তবর্তী কোনো উপজেলা সদরে যাচ্ছে। বাস উত্তর দিকে ছুটছে। বাসটা যতই সমানে এগোচ্ছে, তারেক হাসান ততই গারো পাহাড়ের চিরহরিৎ দৃশ্য দেখে অভিভূত হয়। ক্রমেই পাড়াড়ের বুকের নানা দৃশ্য দু'চোখের দৃষ্টিতে ভাস্বর হয়। দূর থেকে পাহাড়ি নিসর্গের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে দেখতেই বাসটা বিরিশিরি বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে থামে। অনেকগুলো বৃষ্টিগাছের বিশাল শাখা-প্রশাখার ছায়ায় সুশোভিত বিরিশিরি দাঁড়িয়ে আছে সোমেশ্বরীর দু'টি শাখার জঙ্গায়। অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্যে বিরিশিরি যেন সীমান্তের রানি। বাস থেকে নামার পর একজন সহযাত্রীর কাছে জিজ্ঞেস করে ঠিকানার অবস্থান জেনে নেয় তারেক। বিরিশিরি বাসস্ট্যান্ড থেকে কয়েক কদম উত্তর দিকে এগিয়েই সোমেশ্বরী নদীর। নদী পার হলে উত্তর পাড়ে দুর্গাপুর উপজেলা সদর। তারেক হাসান অনেকটা আগ্রহভরে ঢালু পথে নদীতে নেমেই বিস্ময়ে থ বনে যায়। পাহাড়-নদী আর সমতলভূমির এমন নান্দনিক সম্মিলন আর কোথাও দেখেনি। সোমেশ্বরীর পাড়ঘেঁষা পথে আরও কিছুটা পশ্চিমে যায়। ওখান থেকে মনে হয় নদীটা প্রায় তিন কিলো দূরে গিয়ে পাহাড়ের ভেতর ঢুকে পড়েছে। এমন অনুপম দৃশ্য দেখে তার কেবলি মনে হয়, পাহাড়ি আবহে নদীনিসর্গকে এতটা রমণীয়রূপে আর কোথাও দেখা হয়নি। ফাগুনের সকালে কুয়াশার হালকা শাদা নেকাবের আড়ালে তখন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে লজ্জাবতী গারো পাহাড়। মেঘালয়ের দুরন্ত দর্পিণী কন্যা সোমেশ্বরী শীতের সুপ্ততায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। বুকে তার শুভ্র বলাকার পালক ঢাকা বালিয়াড়ির বিপুল কারুকার্য। পাহাড় ও নদীর চিরায়ত নৈসর্গিক দৃশ্য থেকে সে যেন দৃষ্টি ফেরাতে পারে না। পাহাড় ও নদী প্রকৃতির এমন অপার দৃশ্য খুব ভালো লাগে তার। ঐ মনোলাভা দৃশ্য তার সৌন্দর্যপিপাসু দৃষ্টি গোগ্রাসে যতই দেখে, ততই তৃষ্ণা বেড়ে চলে। তদুপরি যে উদ্দেশ্যে এখানে আসা, তা তো ভুলে যেতে পারে না। কিছুক্ষণের মধ্যে দুর্গাপুর যাবার পথে সোমেশ্বরীর শাখানদী পার হয়ে ওপারে পৌঁছে। নদীর তীর থেকেই রিকশা নেয়। থানা মসজিদের কাছেই একটা দোকানের সামনে রিকশা থামে। নজরুল সাহেবের পাঠানো একজন লোক সেখানে তারেকের অপেক্ষায় দাঁড়ানো। লোকটি রিকশায় ওঠে নজরুল ইসলামের বাসায় নিয়ে যায়। বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে সারা মুখে প্রসন্ন হাসি মেখে নজরুল বলে, আসেন আসেন! আপনার অপেক্ষাতেই বসে আছি। তারেক হাসান তখন নজরুল ইসলামের সঙ্গে তাদের বাড়িতে ঢুকে। ড্রয়িং রুমে সোফা সেটে আরাম করে বসে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। সঙ্গে সঙ্গেই চা-নাস্তার আপ্যায়ন। ফাঁকে ফাঁকে চলে গল্প। চা-পর্ব শেষ হলে নজরুল ইসলাম তাঁকে নিয়ে বাইরে বের হয়। দুর্গাপুর কলেজের পথ ধরে হাঁটে ওরা। সুসং দুর্গাপুরে সোমেশ্বরীর তীরে রাজবাড়িতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কলেজটি। নজরুল ইসলাম দুর্গাপুর রাজবাড়ির পুরো অংশটিই ঘুরেফিরে তারেক হাসানকে দেখায়। রাজবংশের কেউ আজ হয়তো বা নেই। আছে তাদের কিছু স্থাপত্য নিদর্শন। শানে বাঁধানো পুকুর ঘাট, দুর্লভ প্রজাতির নানা রকম গাছপালা ইত্যাদি। সেখান থেকে কিছুটা পথ হেঁটে তর্জনী উঁচিয়ে নজরুল বলে, ওটাই দুর্গাপুর মহিলা কলেজ। এ কলেজেই মেয়েটা শিক্ষকতা করে। তারপর আর কিছুক্ষণ ঘুরে ফিরে অনেকটা ক্লান্ত হয়ে ওরা ফিরে আসতে থাকে। নজরুলদের বাড়ির আঙিনার কাছাকাছি এসে নজরুল ইসলাম থমকে দাঁড়ায়। হাতের আঙুল দিয়ে বাড়ির সীমানাঘেঁষা স্থান দেখিয়ে বলে, ওখানেই শুয়ে আছেন বাবা। কথাটা বলেই নজরুল কেমন যেন বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। কবরখানার পশ্চিমেই একটা সীমানা প্রাচীর। সে ওয়ালঘেঁষে ছোট্ট একটা পথ চলে গেছে ভেতরের দিকে। ছোট্ট রাস্তার দক্ষিণ পাশের একটি বাসা দেখিয়ে নজরুল বলে, এটাই হলো কথিত কনেদের বাড়ি। তারেক হাসান নির্দেশিত বাড়িটা মনোযোগ দিয়ে নিরীক্ষণ করে। বুঝতে পারে নিম্নমধ্যবিত্ত একটি পরিবার। ততটা আর্থিক প্রাচুর্য হয়তো বা তাদের নেই। তবে নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে স্বচ্ছন্দে চলার মতো সঙ্গতি যে তাদের আছে, তা সুস্পষ্ট। সেখানে অধিকক্ষণ না দাঁড়িয়ে নজরুল তখন তারেক হাসানকে নিয়ে তাদের বাড়িতে ঢুকে। বসার ঘরে পুরনো মডেলের সোফা সেটে বসে তারেক। নজরুল ইসলাম প্রথমে খাবার পরিবেশন করে। পরে আসে কনে দেখার পর্ব। অনানুষ্ঠানিকভাবে সাক্ষাৎকার দেবে পাশের বাড়ির মেয়েটি। ক্রমে সময় গড়ায়, কনে আসে না। অথচ সেদিনই ফিরবে বলে তারেকের ভেতর অব্যক্ত একটা তাগিদ ক্রিয়াশীল। মাত্রাতিরিক্ত বিলম্ব দেখে তারেক এক সময় অতিষ্ঠ হয়। প্রতীক্ষার যন্ত্রণায় এক পর্যায়ে তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দেয়। ঠিক তখনি ভেতর থেকে দরজার পর্দাটা নড়ে ওঠে। অমনি পর্দা ফাঁক করে সালাম দিয়ে ঘরে ঢুকে কাঙ্ক্ষিত মেয়েটি। তারেক হাসানের সামনেই একটি চেয়ারে বসে। পাত্র-পাত্রীর মাঝে নিবিড় আলাপের সুযোগ দিয়ে নজরুল কক্ষ থেকে বের হয়ে ভেতরে চলে যায়। কক্ষে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই তারেক মেয়েটিকে আপাদমস্তক লক্ষ্য করে দেখে। তার মনে হয়, গ্রাম বাংলার অকৃত্রিম শ্যামলিমায় একাকার হয়ে আছে মেয়েটির গায়ের রং। অদ্ভুত সুষমামন্ডিত তার নিষ্কলুষ মুখ। তাতে আধুনিক প্রসাধনীর কোনো অতিরঞ্জন নেই। মনে হলো একেবারে খাঁটি এবং আসল বাঙালি ললনা। সকালের শিশিরভেজা পূর্ণ বিকশিত একটা গোলাপ হয়তো বা। মনেই হয় না এর আগে তার ওপর দিয়ে কোনো ঝড় বয়ে গেছে।
অপরিচিতের জড়তায় বেশ গম্ভীর মেয়েটি। অচঞ্চল ভঙ্গিমায় সামনে বসে আছে। তারেক হাসানই প্রথম জড়তার অদৃশ্য নেকাব টেনে বলে, আপনার নামটা বলবেন দয়া করে!
Ñকাজী শিউলি।
-শুনেছি, কলেজের শিক্ষক আপনি। কোন কলেজে শিক্ষকতা করেন?
-দুর্গাপুর গার্লস কলেজের অর্থনীতির শিক্ষক আমি।
-কোন ভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেছেন?
-ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে। দু’বছর আগে।
-দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করেছিলেন কতদিন আগে?
-মাস্টার্স পাস করার সঙ্গে সঙ্গেই।
-তারপর...?
জবাবে একটা গভীর দীর্ঘ নিশ^াস ছেড়ে তার দাম্পত্য বিচ্ছেদের করুণ কাহিনী বলতে শুরু করে শিউলি। সে যা বলল, তা হলো মোটামুটি এই-
বিয়ের পর মাত্র সতেরদিন স্বামীর সঙ্গে ঘর-সংসার করেছে এই তরুণী। তবে ঐ সতেরদিনের দাম্পত্যজীবন সুখকর ছিল না। বিয়ের শুরু থেকেই স্বামীর সঙ্গে বনিবনা হচ্ছিল না। অথচ কত স্বপ্ন আর কত আশা বুকে নিয়ে অভিভাবকদের মতামতের ওপর নির্ভর করে বিয়েতে মত দিয়েছিল। বিয়ের পর বাস্তবে যা পেয়েছে, তা শুধু অকল্পনীয়ই নয়, অবিশ^াস্যও। স্বামীপক্ষের ঐশ^র্য আর বিত্তবৈভব দেখে মা-বাবা বিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু নামী-দামী সেই স্বামীপ্রবর মাত্র সতেরদিনের পাতানো ঘর-সংসার করার পর চাকরির নাম করে যে ঢাকায় যায়, তিনমাস পরও বাড়ি ফিরেনি। স্বামীর সেই অপ্রত্যাশিত দেরি দেখে শংকিত হয় শিউলি। সরল মনে সে দেবরকে বলে স্বামীকে খবর পাঠাতে।
স্বামীর প্রতীক্ষায় কী কষ্টে যে দিন কাটে তার! নববিবাহিতা বধূ সে। রাতের নির্ঞ্ঝাট অন্ধকার প্রতি মুহূর্তে তাকে নীরব ভাষায় বিদ্রƒপ করে। দেবর-শ^শুর-শাশুড়ি খবর পাঠিয়েছে কিনা শিউলি জানতে পারেনি। তবে ক’দিনের মাঝেই স্বামী বাড়ি আসে।
নবপরিণীতা স্ত্রী। দীর্ঘ বিরহের প্রচÐ উত্তাপে তেতে ওঠা পুরুষ যেখানে নববিবাহিতা স্ত্রীর নিবিড় সান্নিধ্য খুঁজবে, প্রসারিত করে দেবে স্ত্রী-সোহাগের দু’বাহু, সেখানে শিউলি এ কী চেহারা দেখেছে স্বামীর! কী রুক্ষ মেজাজ তার। ভালোবাসাহীন পাশবিক মেজাজ দেখে মুহূর্তেই শিউলি স্তম্ভিত হয়ে যায়।
নতুন দাম্পত্যজীবনের প্রারম্ভেই দীর্ঘ বিরহের খরায় তৃষ্ণাদগ্ধ হয়ে প্রতীক্ষার যে অধীর সময় কাটাচ্ছে শিউলি, সেই প্রতীক্ষা বিফলে যায়। প্রস্ফুটিত গোলাপের সুবাস নিয়ে যাকে শিউলি অভিবাদন জানায়, সে স্বামীই শিউলির বহুল আকাক্সিক্ষত গোলাপ দল দু’পায়ে মাড়িয়ে দেয়। তাই অন্তর্গত অভিমান আর ক্ষোভে নিজের ভেতর নিজে দুমড়ে-মোচড়ে যায়, কঁকিয়ে ওঠে।
স্বামীর পেশল বাহুবন্ধনে হারিয়ে যাবার লালিত বাসনা, স্বামী-শয্যায় রাতের প্রত্যাশা সবই শূন্যে মিলায়। কারণ বিরহদগ্ধ স্ত্রীর দারুণ তৃষ্ণা মেটাতে স্বামী প্রবর প্রায় ব্যবহার অনুপযোগী, নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর গøাসের সামান্য জলই সরবরাহ করে। যা স্ত্রীর তৃষ্ণা তো মেটাতে পারেইনি, বরং তা যেন তৃষ্ণাকাতর স্ত্রীর পেটের পীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে নিঝুম রাতের নিবিড় অন্ধকারে বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে শিউলি। ওদিকে শয্যাসঙ্গী স্বামী অভিধায় অভিহিত অথর্ব কাপুরুষ নাক ডেকে ঘুমিয়েছে। শিউলি ভেবেছিল রাতের গভীরে স্বামীর প্রবল সোহাগে তার সব রাগ-অভিমান উবে যাবে। কিন্তু তা আর হয়নি। স্বামীর শক্ত বাহুর আলিঙ্গন প্রত্যাশায় কাটল বিফল রাত।
শেষ রাতের শেষ প্রহরে যখন মসজিদে মসজিদে আজান হাঁকে, তখন শিউলির সারা গায়ে আগুন ধরে যায়। ক্ষিপ্ত বাঘিনীর মতো চাপা গর্জন করে দু’হাতে সে সজোরে ধাক্কা মারে স্বামীকে। ঘুমের ঘোরে বেসামাল ধাক্কা খেয়ে ওঠে বসে। আড়মোড়া ভেঙে স্বামী দেখে স্ত্রী অদম্য কান্নায় দু’চোখ ভাসিয়ে নিজের চুল নিজেই টেনে ছিঁড়ছে। স্বামীকে ওঠে বসতে দেখে শিউলি ‘গরম তেলে ফোড়ন’ দেওয়ার মতো জ¦লে ওঠে বলে, প্রতারক- কাপুরুষ! বিয়ের নামে কীসের জন্য আমার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছ।
জবাবে লোকটা তাৎক্ষণিক কোনো জবাব দেয়নি। তবে থুম ধরে ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে থাকে। ক্ষুব্ধ শিউলি লোকটার চোখের দিকে তাকায়। স্বামীর ধীর দৃষ্টিতে দেখতে পায় গভীর ষড়যন্ত্রের সুস্পষ্ট ছাপ। লোকটার চোখের সেই ভয়াল দৃষ্টি দেখে শিউলি ফুটো হওয়া বেলুনের মতো মুহূর্তেই চুপসে যায়।
শেষে শিউলির অনুমানই সত্য হয়। ধূর্ত স্বামী তখন স্ত্রীকে ঘায়েল করার জন্য শিউলির দুর্বল জায়গায় আঘাত করে। শিউলির মা-বাবাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ভরে নানা মন্তব্য করে এমন হেয় প্রতিপন্ন করে, যা আর শিউলি সইতে পারেনি। প্রচÐ ক্ষোভে শেষে শিউলি চলে আসে বাপের বাড়ি।
মাত্র সতেরদিনের প্রায় বিফল দাম্পত্যজীবন যাপন করলেও ততদিনে তার মাঝে আর একটা নতুন প্রাণের ইঙ্গিত পায়। সন্তানসম্ভবা হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে শিউলি। গর্ভাবস্থায় বাপের বাড়ি চলে আসা শিউলির কোনো খোঁজখবরই নেয়নি তার স্বামী।
গভীর দুঃখবোধে কথাগুলো তারেক হাসানের সঙ্গে বলতে বলতে শিউলি হঠাৎ আবেগে কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে যায়। দু’চোখের দু’টি নদী উছলে ওঠে। বেদনার অবিরল জলধারায় প্লাবিত হয়ে এক পর্যায়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে। তবে মুহূর্তের মাঝেই নিজের ভেতর অদ্ভুত পরিবর্তন এনে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নেয়। শাড়ির আঁচলে দু’হাতে মুখ চেপে ধরে মুছে ফেলে বেদনাশ্রæ। তারপর মুখ থেকে আঁচল সরিয়ে স্বাভাবিক হয়ে বলে, শেষে বাধ্য হয়ে আদালতের আশ্রয় নিই।
শিউলির অন্তর্গত আবেগের সঙ্গে নীরবে একাত্ম হয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো সব শুনে যায় তারেক হাসান। এ পর্যায়ে এসে তারেক বলে,
Ñতারপর বুঝি ছাড়াছড়ি হয়ে গেল!
-হ্যাঁ। পরে শুনেছি লোকটা শুধু মাদকাসক্তই ছিল না, অর্থের প্রাচুর্যে অনেকগুলো গার্লফ্রেন্ড লালন করত। বউ পরিচয় দিয়ে ঢাকায় ওদের সঙ্গে করত লিভ টুগেদার।
-আপনি কি মনে করেন, লোকটার দ্বারা প্রতারিত হয়েছেন?
-শুধু প্রতারিতই হইনি, হয়েছি দারুণভাবে অপমানিতও।
-জীবনের এমন একটা মুহূর্তে আপনার স্বপ্ন এবং প্রত্যাশার কথা যদি বলেন...
-আমার বাঁচার অবলম্বন, একটামাত্র মেয়ে। তাকে ঘিরেই আমার স্বপ্ন এবং প্রত্যাশা।
-পুনর্বার দাম্পত্যজীবন সম্পর্কে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
একটা দীর্ঘ নিশ^াস ফেলে শিউলি বলে,
Ñভাবছিলাম আর দাম্পত্য জীবনে ফিরে যাব না। কিন্তু এ সমাজব্যবস্থায় আমি একজন মেয়ে হয়ে এখন মা-বাবার আশ্রয়ে আছি। তারপর তো একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। মেয়েটা বড় হয়ে এক সময়ে স্বামীর ঘরে চলে যাবে। তখন আমি হয়ে যাব বড় একা। একজন নারী হিসেবে জীবনের বাকি সুদীর্ঘপথ একা পাড়ি দেওয়া বড় কষ্টকর হবে। তাই ভাবছি, আমার এ মেয়েটাকে যদি কেউ পিতৃত্ব দেয়, তার জন্য আমি সবকিছু করব।
এই বলে শিউলি তার আস্থাপূর্ণ দৃষ্টি নিবেদন তারেক হাসানের বিশাল চোখ দুটোয় নিবদ্ধ করে। তারপর এক ধরনের লজ্জা এবং জড়তায় তার দৃষ্টি ক্রমে নিচের দিকে নামায়। তারেক হাসানও তার ইচ্ছেটা প্রবল আত্মবিশ^াসের সঙ্গে ব্যক্ত করার জন্য ছাদের দিকে তাকায়। তারপর বলে, এমন একটি শিশু মেয়ের জন্য আমিও একজন মা খুঁজছি।
দীর্ঘ শীতের পর মাঘের শেষে যেমন ফাগুন আসে, তেমনই তাদের মুগ্ধ চেতনায় ফের টোকা দিয়ে যায়, একটা স্বপ্ন-সম্ভাবনা।