অভিমানী কবি আল মাহমুদের সনেট জাতীয় কাব্য সোনালী কাবিন ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয়- যা তাকে এনে দিয়েছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। ১৮ মাত্রার ১৪টি সনেটে সাজানো কবিতাটি নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্যের একটি কালজয়ী কবিতা। আল মাহমুদ যে সব সাহিত্য রচনা করেছেন তার মধ্যে সোনালী কাবিন তাকে বেশি পরিচিতি প্রদান করেছে। এতে মোট ১৪টি সনেট রয়েছে এবং ৪১টি কবিতা রয়েছে।
লোক-লোকান্তর, কালের কলসের পর সোনালী কাবিন আল মাহমুদকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। বাংলা কবিতায় লোকজ উপাদানকে অনুষঙ্গ হিসেবে নিয়ে কাব্যিক ভাষা সাজিয়েছেন নতুন আঙ্গিকে। সোনালী কাবিনে প্রসব বেদনায় কাতর বাংলাদেশের কাব্যিক সুসংবাদের পাশাপাশি অসঙ্গতির বিরুদ্ধে উচ্চারণ করেছেন সাহসী বক্তব্য, সুন্দরের স্বপ্ন বিনির্মাণ করেছেন নান্দনিক ভাষায়, স্বপ্নভঙ্গের মনোবেদনা প্রকাশ করেছেন শব্দের দীর্ঘশ্বাসে, নারীকে এঁকেছেন স্বচ্ছ কাঁচের পারদে, কামভাব প্রকাশ করেছেন সাবলীলভাবে।
কবি কখনো সুচিন্তিত শব্দ আবিষ্কারক ও কখনো সাহিত্যিক ঐশ্বর্যের চিন্তার বিস্তৃত ভাবনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন তার কবিতায়। কবি সুফিয়া কামাল, রোকনুজ্জামান ও কবি শামসুর রাহমানসহ আরও অনেকেই তার প্রকাশিত সোনালী কাবিনের দারুণ প্রশংসা করেছেন। এ কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতা তার অভিনব ভাষা ও ভঙ্গিমার লেখনীতে জমকালো কাব্যকীর্তি অলৌকিক প্রেরণার ফসল হলো 'সোনালী কাবিন'। কবি নানান ব্যঞ্জনা আর কামের শিল্পকলা এঁকেছেন সাবলীলভাবে, 'ক্ষুধার্ত নদীর মতো তীব্র দু'টি জলের আওয়াজ/তুলে নিয়ে যাই চলো অকর্ষিত উপত্যকায়/চরের মাটির মতো খুলে দাও শরীরের ভাঁজ/উগোল মাছের মাংস তৃপ্ত হোক তোমার কাদায়/ঠোঁটের এ লাক্ষারসে সিক্ত করে নম্র কারুকাজ/দ্রম্নত ডুবে যাই এসো ঘূর্ণায়মান রক্তের ধাঁধায়।' কবি আল মাহমুদের কবিতা মানেই সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার। সুন্দরের ও সাবলীল প্রতিধ্বনিতে বর্ণনা করেছেন অন্যায় ও অসুন্দরের বিপক্ষে। কবি আল মাহমুদের গভীরতর ভাবনা ও সৌন্দর্যের বর্ণনা করার সাহস যিনি করবেন তিনি নিজেই চমকে উঠবেন এবং দারুণ এক আধ্যাত্মিক জাদুর ঘোরে। তার কবিতা পাঠ করলে বুঝা যাবে কতটুকু মহার্ঘ্য চিত্রকল্পতে নারীগর্ভে মানবজন্মের বিচিত্র মননশীলতা দেখিয়েছেন। 'আমি যতবার আসি, মনে হয় একই মাতৃগর্ভে থেকে পুনঃ/রক্তে আবর্তিত হয়ে ফিরে আসি পুরোনো মাটিতে/ওঁয়া ওঁয়া শব্দে দুঃখময় আত্মার বিলাপ/জড়সড় করে দেয় কোন দীন পিতাকে।' আল মাহমুদের কবিতা আলাদা বৈচিত্র্যের। তার কবিতার জাত বিচিত্রগামী ও বিস্তৃত মেধা-মগজের খেলায় সৌরভ ছড়িয়েছেন।
কবির কবিতাগুলো পর্যালোচনা করলে বুঝা যায় যে, গ্রামীণ জীবনবান্ধব নদীর তীরঘেঁষা প্রকৃতির মানসপটে এঁকেছেন প্রকৃতিকে। তার কাব্যগ্রন্থ 'সোনালী কাবিন' প্রকৃতি কবিতাটিতে মানুষ নিয়ে আলাদা একটি শোক ও আফসোস প্রকাশ করেন। তার চোখের সামনে বিস্ময়কর অগ্রগতি দেখেও মানুষ যে অন্যের দয়াপরবশ হয়ে জীবন আঁধারে পরিণত করেছে তাই নিয়ে কবির আক্ষেপ- কতদূর এগোলো মানুষ! কিন্তু আমি ঘোরলাগা বর্ষণের মাঝে আজও উবু হয়ে আছি। এখানে চমৎকার দার্শনিকতার পরিচয় দিয়েছেন। আলাওলের কঠোর সমালোচনা করে লিখেছেন, 'পূর্ব পুরুষরা কবে ছিল কোন সম্রাটের দাস/বিবেক বিক্রি করে বানাতেন বাক্যের খোঁয়াড়;/সেই অপবাদে আজও ফুঁসে ওঠে বঙ্গের বাতাস/মুখ ঢাকে আলাওল-রোসাঙ্গের অশ্বের সোয়ার।' এখানে আলাওলের নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে বিভ্রান্তি নিরসনে তার পরিচয়ও সুস্পষ্ট করেছেন- 'রোসাঙ্গের অশ্বের সোয়ার!' পূর্ব পুরুষদের গৌরবময় সাহসিকতা ক্রমে বিলুপ্ত হওয়ায় উদ্বেগও প্রকাশিত হয়েছে। 'সাহসের সমাচার' শিরোনামে নজরুলকে নিবেদিত কবিতায় লিখেছেন, 'সাহসের সমাচার শেষ হয়ে যাচ্ছে ক্রমে ক্রমে/হে কবি, একদা/ ভেসে যেতে যেতে কালো তোমার চুলের মতো মেঘ/বড়ো অনুরোধ করে রক্তের ওপারে যেতে প্ররোচনা দিতো/কারাগার ভেদ করে দাঁড়াতো দন্ডিত।' 'সোনালী কাবিন' কবিতাটির প্রধান উপকরণ হলো প্রেম ও মানবিক সত্তা। প্রেম ও মানুষ এই দু'জনকে নান্দনিকতার সম্পর্কের এক সুতোয় বেঁধেছেন। যেমন- 'সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিণী যদিও নাও, দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দু'টি'। এখানে সুখকর ক্ল্যাসিকাল রূপের বর্ণনা পাওয়া যায়। তামার রঙের মতো শরীরের সঙ্গে তুলনা করে দারুণ এক স্বর্গীয় প্রেমের শিল্পবোধ ও সৃষ্টিশীলতাকে উচ্চতর স্থানে নিয়ে গেছেন। 'সোনালী কাবিন' প্রচন্ড স্বাতন্ত্র্য। এ কবিতায় সনেটের মৃদুস্বরে আবাহনে পাওয়া যায় প্রেমের শীতলতা। এর ছন্দবিন্যাস, গঠন ও বিষয়বস্তু কালের সাক্ষী এবং সে সময়ে কবিতার কণ্টক পথ দূর করে নতুনত্ব দিয়ে নিজেকে নানারকম প্রতিপক্ষ দিক অদল-বদল করে পাঠকের কাছে প্রমাণ করেছেন তিনিই কবিতার মাধ্যমে নতুন সৃষ্টি ও নতুন প্রত্যাশার জালের এক মহাকাব্যিক প্রণেতা। বাংলা কবিতায় সাম্যবাদের কথা সোনালী কাবিনে আল মাহমুদ যেভাবে বলেছেন, সে রকম সাহস ও বিচক্ষণতার সঙ্গে অন্য কেউ বলতে পারেননি। সাম্যবাদের সৌন্দর্য দেখিয়ে আল মাহমুদ শ্রমজীবী মানুষের বুকে এঁটে দিয়েছেন বীরের তকমা, 'শ্রমিক সাম্যের মন্ত্রে কিরাতেরা উঠিয়েছে হাত/হিয়েনসাঙের দেশে শান্তি নামে দেখো প্রিয়তমা/এশিয়ায় যারা আনে কর্মজীবী সাম্যের দাওয়াত/তাদের পোশাকে এসো এঁটে দিই বীরের তকমা।' এমন সাহসী উচ্চারণ আর ক'জন কবিই-বা করতে পারে! কবি আল মাহমুদ সবসময়ই শক্তিশালী চেতনাবোধের কারণে সতেজ কল্পনাশক্তিকে শান্ত রেখে অনাগত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়েছেন আপন দৃঢ়তায়। কবি আল মাহমুদ সোনালী কাবিনে এঁকেছেন কবিতার এক অপূর্ব কল্পচিত্র। জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়াবলিই কবিতার উপজীব্য। কবিতা এমন, 'কবিতা চরের পাখি, কুড়ানো হাঁসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস/স্নান মুখ বউটির দড়িছেঁড়া হারানো বাছুর/ গোপন চিঠির প্যাডে নীল খামে সাজানো অক্ষর/কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার।' গ্রামীণ বাংলার এমন কোনো লোকজ সংস্কৃতি নেই- যা সোনালী কাবিনের ক্যানভাসে ভেসে ওঠেনি। এখানেই আল মাহমুদের সার্থকতা। চিৎকার, কান্না ও হতাশার গোলকধাঁধা ছেড়ে/আমরা বেরিয়ে যাব। মৃতু্য আমাদের স্পর্শ না করুক।'
কবি গ্রামীণ বাংলার গণমানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত ভাষায় শপথের পর শপথ উচ্চারণ করে লিখেন, 'বৃষ্টির দোহাই বিবি, তিলবর্ণ ধানের দোহাই/দোহাই মাছ-মাংস দুগ্ধবতী হালাল পশুর/লাঙল জোয়াল কাঁস্তে বায়ুভরা পালের দোহাই/হৃদয়ের ধর্ম নিয়ে কোনো কবি করে না কসুর।' 'ছলনার পৃথিবীতে ভালোবাসার শুভ্রতায় কবির উচ্চারণ, 'ভালোবাসা দাও যদি আমি দেব আমার চুম্বন/ছলনা জানি না বলে আর কোনো ব্যবসা শিখিনি।' অকৃত্রিম ভালোবাসা প্রকাশ করে কবির পরাজয় নেই বলে দীপ্তকণ্ঠে ঘোষণা দিয়েছেন, পরাজিত নই নারী পরাজিত হয় না কবিরা/দারুণ আহত বটে আর্ত আজ শিরা-উপশিরা।' কবি আল মাহমুদ জাতীয় সংকটে রক্তদান, জীবনদান এবং গণজাগরণের প্রেরণা দিয়েছেন, 'আর আসব না বলে মিছিলের প্রথম পতাকা/তুলে নিই হাতে/আর আসব না বলে/সংগঠিত করে তুলি মানুষের ভিতরের মানুষ।' সোনালী কাবিনে কবি প্রাকৃতিক ঝড়ে গ্রামীণ বাংলার বীভৎস রূপও প্রকাশ করেছেন, 'ভাসে ঘর, ঘড়া-কলসী, গরুর গোয়াল/বুবুর স্নেহের মতো ডুবে যায় ফুল তোলা পুরনো বালিশ/বাসস্থান অতঃপর অবশিষ্ট' কিছুই থাকে না/জলপ্রিয় পাখিগুলো উড়ে উড়ে ঠোঁট থেকে মুছে ফেলে বাতাসের ফেনা।'
সমাজের স্তরে স্তরে থরে থরে সাজানো বৈষম্যের প্রাচীর গুঁড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াসে লিখেছেন, 'আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন/পরম স্বস্তির মন্ত্রে গেয়ে ওঠো শ্রেণির উচ্ছেদ/এমন প্রেমের বাক্য সাহসিনী করো উচ্চারণ/যেন না ঢুকতে পারে লোকধর্মে আর ভেদাভেদ।'