জখমগুচ্ছ
প্রকাশ | ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
সৈয়দ নূরুল আলম
শূন্য দশকে সাহিত্যে, বিশেষ করে কবিতায় নান্দনিকতা ও সরলতায় আভা ছড়িয়ে যারা জনপ্রিয় হয়েছেন তাদের মধ্যে দ্বীপ সরকার অন্যতম একজন। তার কবিতায় উঠে আসে জীবনবোধ, নস্টালজিয়া, জীবনের সুখ-দুঃখ, ঘাত-প্রতিঘাত, সার্থকতা-ব্যর্থতার চিত্র। সমাজের অসঙ্গতি, মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব, কলহ, হিংসা-বিদ্বেষ, দরিদ্রতার রোষানল, শোষণ, এসব বিচলিত করে কবিকে। আর এসব নিয়েই কবি কবিতা লেখেন।
এ ধরনের কবির বই যখন বের হয়, তখন পাঠক একটু ঝাড়া দিয়ে ওঠেন। প্রকাশককে খোঁজেন। এরকম একটা সংবাদ- দ্বীপ সরকারের কাব্যগ্রন্থ 'জখমগুচ্ছ' সম্প্রতি অনুপ্রাণন থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
৬৪ পৃষ্ঠায় ৫৬টি কবিতা রয়েছে। কবিতাগুলোর চমৎকার চমৎকার নাম। যেমন- শুক্রবার, চিল, পাপফুল, সন্ধ্যা, বউ বউ খেলা, নেতা, উপকথা, চিঠি, ছায়া, বোবা ছাদ, ইত্যাদি। এসব কবিতা তার পাঠকদের অতীতের ভালোলাগার মুহূর্তগুলিতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। দৈনন্দিন অভিজ্ঞতাগুলো আয়নার প্রতিবিম্ব হয়ে পাঠক আরো গভীর এবং আবেগময় হয়ে ওঠে। জীবনবোধের কবিতা জাগতিক সৌন্দর্য আর মানুষের সংযোগের গভীরতা, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উদযাপিত হয়।
দ্বীপ সরকারের একটা কবিতা দেখে নিই- ' বাবুর প্যান্টের চেন খুলে রাখার অভ্যাস। ও পথে বাতাস আর কিছু / রোদ যায় আসে। অনন্ত অফিস করে। সমুখে ফাইল, টেবিল। ল্যাপটপে/ আঙুল চাপলেই নিচের দিকে ভোর নামে। শরৎ নামে। গা শিন শিন করে। চেনটা উদোম নাচঘর যেন (কবিতা- অনন্ত বাবু ও পাখিরা, পৃ: ১০)।'
\হএকজন কবি প্রকৃত অর্থে বহুমুখী শব্দশিল্পী। কবি তার আবেগের বর্ণালীকে বিস্তৃত করেন, মননের চিন্তাকে উদ্দীপিত করেন। প্রেমের কবিতাগুলি আবেগের একটি জলাশয়, যেখানে রোম্যান্স এবং ঘনিষ্ঠতার অনুভূতি গীতিময় হয়ে ওঠে। যা পাঠকদের মুগ্ধ করে। এ ধরনের একটি কবিতা- 'নিরিবিলি এক সন্ধ্যার কাছে/ আমার অনেক কথা জমা আছে/ সন্ধ্যাগুলো সে কথা রাখতে পেরেছে কিনা, জানি না/ খুব গোধূলির কাছাকাছি সময়ে/ বিনীত হাত স্পর্শ করেছিল/ তখন সন্ধ্যা সন্ধ্যা ভাব- (কবিতা- সন্ধ্যা, পৃ: ২৫)'
আবেগ এবং প্রেমের সৌন্দর্য হচ্ছে কবিতার অলঙ্কার। তাই কবিতায় যখন আবেগ এবং প্রেমের সৌন্দর্য প্রকাশ পেতে দেখা যায়, তখন সে কবিতা হয়ে উঠে মায়াময়, সার্বজনীন। দ্বীপ সরকারের কবিতা পড়লে পাঠকদের সেই উপলব্ধির দরজা একটু একটু করে খুলতে থাকে। একজন নির্ভীক শব্দকার সব সময় চান তার কবিতা পাঠ করে অন্যের মধ্যেও জেগে উঠুক কাব্যমন। সেক্ষেত্রে অবিচ্ছিন্ন সততার সঙ্গে তিনি মূল্যায়ন করেন প্রতিটা শব্দের ব্যবহার, বাক্যের তাৎপর্য।
কবির মধ্যে জেগে থাকা নৈঃশব্দ্য, মনোজগতের হর্ষ বিষাদ, নৈর্র্সগিক সৌন্দর্য এসব কবিতার অবয়ব নিয়ে যখন পাঠকের চেতনায় ফুটতে থাকে জ্বলন্ত নক্ষত্র হয়ে, তখন সেই কবিতায়,পাঠকের একটা ভালোলাগার জায়গা তৈরি হয়। পাঠক কবিতায় মগ্ন হন সহজাতভাবে। এটাই কবির কৃতিত্ব। যার সবটাই দ্বীপ সরকারের কবিতায় উপস্থিত। প্রায় প্রতিটি কবিতাই আমাদের আপন বলয়ের মধ্য থেকে উঠে এসেছে। সে কারণে কবিতাগুলো পাঠান্তে অনুরণন থাকে বহুক্ষণ। এ ধরনের একটা কবিতা, 'নববধূ সুইয়ে সুতো ভরাতে গিয়ে আঙুলে ফোঁড় দেয়/ সুইটা সুতো না দেখে, দ্যাখে আঙুল/ নববধূ কাঁদে-'(কবিতা- কুসংস্কার, পৃ: ৩২)। এখানে নববধূ এবং সুই ওতপ্রতভাবে জড়িয়েছে বাঙালির জীবনে। তবে সুইটা সুতো না দেখে, দ্যাখে আঙুল- এটাই কবিতা। এটাই দ্বীপ সরকারের বিশেষত্ব।
এ কথা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই, জীবন স্বীকৃতির কবিতা লেখার জন্য পর্যবেক্ষণের গভীর অনুভূতি থাকতে হবে, পাশাপাশি মানুষের জটিল জীবনকে পড়ার জন্য গভীর উপলব্ধি থাকতে হবে। তাই পর্যবেক্ষণ বলি, আর উপলব্ধি বলি, মননের গভীরতা থেকে যার কবিতার প্রতিটি অক্ষর অনুরণিত হতে দেখা যায় তিনিই জাত কবি। আর দ্বীপ সরকারকে এ ধরনের একজন কবি বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। অভিনন্দন কবিকে।