ভাষা-সাহিত্যে কেন এই দৈন্য?
প্রকাশ | ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
বাঙালি জাতির কাছে ঐতিহাসিক একটি মাস হলো ফেব্রম্নয়ারি মাস। এ মাসেই লড়াই করে, জীবন দিয়ে, শরীর থেকে রক্ত ঝরিয়ে বাঙালি জাতি তাদের মায়ের ভাষার অধিকার এবং মর্যাদা রক্ষা করেছিল। পৃথিবী নামক ভূখন্ডে একমাত্র বাঙালিরাই ভাষার জন্য লড়াই করেছে, জীবন দিয়েছে। তাইতো বাংলা ভাষা আজ বিশ্ব দরবারে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। আমাদের ভাষা দিবসকে সারা বিশ্ব সম্মান দিয়েছে। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো এটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা দিয়েছে। বিশ্বে প্রায় ৩০ কোটি মানুষের ভাষা বাংলা আর তাই এটি বিশ্বে চতুর্থ ভাষার খেতাবটি অর্জন করেছে। এই ভাষা আমাদের অহংকার। এটি আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত। আবুল ফজল তাইতো বলেছিলেন, ভাষা ও সাহিত্যকে অবলম্বন করেই সম্ভব হয় সব রকম উন্নতি আর প্রগতি। একটি দেশ ও জাতির সবচেয়ে বড় সম্পদ তাদের ভাষা ও সাহিত্য। আর এই ভাষা ও সাহিত্যের দৈন্য একটি জাতিকে ধীরে ধীরে পঙ্কিলতায় ডুবিয়ে দেয়। ভাষা, সাহিত্য এবং সংস্কৃতি হলো একটি দেশ ও জাতির দর্পণ স্বরূপ। ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুলস্নাহর মতে, বড় হতে হলে চাই জাতীয় সাহিত্য, আর জাতীয় সাহিত্য পারে জাতীয় উন্নতি নিশ্চিত করতে। মনের ভাব প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম হলো ভাষা। বাংলা ভাষায় আমরা আমাদের আবেগ, অনুভূতি, ইচ্ছা আর মনের ভাব ব্যক্ত করি। কিছু দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা এখনো চালু করা সম্ভব হয়নি। তবে দারুণ একটি সংবাদ হলো- নতুন বছরের ভাষার মাসের শুরুতেই উচ্চ আদালতের একটি রায় বাংলায় লেখা হয়েছে। এটা আমাদের বড় পাওয়া। বাংলা ভাষার বিকৃতি, অবমাননা এবং দূষণ রোধে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু তবুও যেন এটা থামছে না। সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদে বলা আছে, 'প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা'। সংবিধানের এই নির্দেশনা আমরা কতটুকু পালন করছি? নিজেদের ভাষাকে যদি নিজেরাই শুদ্ধভাবে চর্চা না করি তবে কে সেটা করে দেবে? শুদ্ধ বাংলা বলা ও লিখা একটি দীর্ঘ মেয়াদি প্রক্রিয়া। কিন্তু এই কাজ করার দায় যাদের ওপর বেশি তারা কি করছেন। শিক্ষিত মহলেও শুদ্ধ বাংলা চর্চার বড্ড অভাব লক্ষ্য করি। বাংলা ভাষার স্বকীয়তা রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ছে বিদেশি ভাষার আগ্রাসনে। চীন বিদেশি ভাষার আগ্রাসন রুখে দিতে শক্তিশালী আইন করেছে। আমাদের দেশেও আইন আছে। কিন্তু আমরা কজন সেই আইন মেনে চলি? বাংলাদেশে ১৯৮৭ সালে 'বাংলা ভাষা প্রচলন আইন' তৈরি করা হয়েছে। ২০১৪ সালে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন এবং দূষণ রোধে আদালতের রুল জারি হয়েছে। কিন্তু সেটার বাস্তবায়ন আর জবাবদিহিতা তেমন দৃশ্যমান নয়। একটি দেশের ভাষা ও সাহিত্যের যথাযথ চর্চা না হলে সেটা দুর্বল হয়ে যায় এমন কি সেটার বিলুপ্তি ঘটতে পারে। ভাষার বিলুপ্তির নজীর বিশ্বে অনেক আছে। ভাষার বিকৃতি, দূষণ, রূপান্তর, অপব্যবহারে ভাষার বিলুপ্তি ঘটে। এক সময় সংস্কৃত ভাষা দাপুটে ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু আজ সেটাকে বিলুপ্তই বলা যায়। একটি দেশের ভাষার সঙ্গে সেই দেশের সাহিত্যের আত্মিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে। একটি শক্তিশালী ভাষা পারে একটি শক্তিশালী সাহিত্য উপহার দিতে। মার্কিন লেখক ইমারসন তাই বলেছিলেন, ভাষা হলো ইতিহাসের দলিল এবং কবিতার জীবাশ্ম। ভাষা হলো সাহিত্যের প্রাণ। সাহিত্য হলো তাই যা একটি নান্দনিক ভাষার চয়নে সাধারণকে অসাধারণ করে তুলে, মূর্তকে বিমূর্ত করে তোলে। সাধারণ কিছু শব্দ চয়নে অসাধারণ কিছু অভিব্যক্তি ঘটে থাকে। আনুমানিক খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর মাঝামাঝি বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনার সূত্রপাত হয়। খ্রিষ্টীয় দশম-দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে চর্যাপদ রচিত হয়- যা বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন। মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্য ছিল কাব্য প্রধান। ইসলামী ধর্ম সাহিত্য, বাউল পদাবলি, মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলি, রামায়ণ, মহাভারত, নাথ সাহিত্য ছিল এ যুগের অন্যতম নিদর্শন। ১৯৪৭-এর পর বাংলা সাহিত্যে দুটি ধারা দৃশ্যমান হয়ে উঠে। ঢাকা কেন্দ্রিক বাংলাদেশের সাহিত্য ও কোলকাতা কেন্দ্রিক পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য। তবে বাংলা সাহিত্যকে বিশ্ব দরবারে নিয়ে গেছেন উভয় বাংলার কিংবদন্তি লেখকরা। উইলিয়াম শেক্সপিয়ার, ক্রিস্টোফার মার্লো, জন মিল্টনসহ বিখ্যাত লেখকদের সৃষ্টিকর্ম যখন সাড়া দুনিয়ায় ঝংকার তুললো তখন বাঙালি লেখকরা হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি। মৌলিক এবং নন্দিত সৃষ্টিকর্মে বাঙালি লেখকরাও মুনশিয়ানা দেখালেন। তারা বিশ্বকে দেখিয়ে দিলেন বাংলা ভাষা আর সাহিত্যের ওজন। ধ্রম্নপদী সাহিত্য রচনা করে শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে অগ্নিমূর্তি ধারণ করলে শোষকগোষ্ঠীর কাঁপুনি ধরে যায়। অমর সৃষ্টির জন্য কবি গুরু নোবেল জিতে বিরল সম্মান বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য বয়ে আনলেন। সারা দুনিয়ার সাহিত্যবোদ্ধাদের একটি ধারণা হয়েছিল যে গ্রিক, ইংরেজ এবং ফরাসিরাই পারে মানসম্মত মহাকাব্য আর সনেট উপহার দিতে। কিন্তু তাদের সেই ভুল ধারণাকে ভেঙে দিলেন আমাদের মাইকেল মধুসূদন দত্ত। মেঘনাথবধ মহাকাব্য রচনা করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিলেন। শত শত বছর ধরে গড়ে ওঠা বাংলা সাহিত্যের অনেক মহিরুহকে আমরা দেখি যারা এখনো জীবন্ত হয়ে আছেন পাঠক হৃদয়ে। তাদের মধ্যে হরপ্রসাদশাস্ত্রী, ভারতচন্দ্র, রামাই পন্ডিত, চন্ডীদাস, মালাধর বসু, বিদ্যাপতি, কৃত্তিবাস, কাশীরাম দাশ, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, শাহ মুহাম্মদ সগীর, দৌলত কাজী, ফকির গরীবুলস্না, আলাওল, লালন, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিম, ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মানিক বন্দোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, মধুসূদন দত্ত, মীর মশারফ, জীবনানন্দ দাশ, সুকুমার রায়, অমিয় চক্রবর্তী, বদ্ধুদেব বসু, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ, ফররুখ আহমেদ, সুফিয়া কামাল, আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান, সৈয়দ ওয়ালিউলস্নাহ, সৈয়দ শামসুল হক, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু, হুমায়ূন আহমেদ, এমদাদুল হক মিলনসহ আরো অনেকে। এরা প্রত্যেকেই তাদের স্ব স্ব লেখনী দিয়ে বাংলা সাহিত্যে জাগরণ সৃষ্টি করেছেন। এনে দিয়েছেন বাংলা সাহিত্যে স্বর্ণযুগের স্বাদ। একটি সাহিত্য কত মধুর হতে পারে, কত ডাইমেনসনাল হতে পারে, কত মৌলিক হতে পারে কত সার্বজনীন হতে পারে সেটা প্রমাণ করেছেন মান্যবর এসব কিংবদন্তি লেখকরা। কেউ দুনিয়াতে বেঁচে থাকে না। কিন্তু কারো সৃষ্টি কর্ম মরে না। তবে সেই সৃষ্টি কর্মকে হতে হয় কালজয়ী। হুমায়ূন আহমেদের মৃতু্য বাংলা সাহিত্যে এক বড় শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। গত বছর চলে গেলেন কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। আরো শুন্যতার সৃষ্টি হলো বাংলা সাহিত্যে। কবি নির্মলেন্দু গুণ এখনো বেঁচে আছেন। বয়সের ভারে তিনি আজ বড় ক্লান্ত। কিন্তু এর পরে কারা ধরবেন বাংলা সাহিত্যের হাল? কেউ কি এ বিষয়ে সত্যি ভাবেন? কেন এখন বাংলা সাহিত্যে বড় কবি, উপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার তৈরি হচ্ছে না। দুর্বলতা তবে কোথায়? নজরুল, রবী ঠাকুরের কথা বাদ দিলাম। হুমায়ূন আহমেদ, শামসুর রাহমান, হাসান আজিজুল হকের মতো লেখকও কি দেশে আর তৈরি হবে না? আমাদের দৈন্য ঠিক কোথায়? এ বিষয়ে কি কোনো রাষ্ট্রীয় মাথাব্যথা আছে? সেটাতো মনে হয় না। কিংবদন্তি লেখকরা যেটুকু রেখে গেছেন সেটুকু যত্ন করে রাখতে পারবতো আমরা? একটি সাহিত্য কর্মের বিভিন্ন শাখা আছে। সেগুলোর মধ্যে কবিতা, উপন্যাস, ছোট গল্প, নাটক, গান, ছড়া, প্রবন্ধ ইত্যাদি। বর্তমানে কবিতার অবস্থাতো খুবই নাজুক। নাটকের অবস্থাও লেজেগোবরে। কোথায় গেল সেই নাটকের মান? কোথায় গেল নাটকের সেই শুদ্ধ ভাষা আর কাহিনীর মাধুর্যতা? কোথায় গেল প্রাণ জুড়ানো সেই সুরেলা গান? কোথায় গেল সেই শিশুতোষ ছড়া? কোথায় গেল আজ সেই অনুবাদ আর তুলোনামূলক সাহিত্যের গবেষণা? সাহিত্যের অতি পুরাতন এবং অভিজাত শাখা হচ্ছে কাব্য। গ্রিক দার্শনিক এ্যারিস্টিটল কাব্যকে সমাজ বদলের এক বড় হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করেছেন। কাজী নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা শুধু সাহিত্য নয়, ইতিহাসের এক অনন্য সম্পদ। একটি কবিতা একজন কবির জীবন খেয়ে বেঁচে থাকে। একটি কবিতার প্রতীকধর্মিতা, বিষয়ের গভীরতা, বিষয় ব্যঞ্জনা, শিল্প প্রকরণ, নান্দনিকতা, সাহিত্য রস একটি কবিতাকে অমর করে রাখে। একটি ভালো কবিতা বহু সময় ধরে পাঠকের মননশীল মানসিকতা তৈরিতে অবদান রাখে। এক সময় তরুণরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রহমানের কাব্যের প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত ছিল। কিন্তু কালের পরিক্রমায় তরুণদের সেই আগ্রহে ভাটা পড়ছে।
সাহিত্যের একটি ধ্রæপদী মাধ্যম কবিতা। সাহিত্যের পাঠক মানেই কবিতা পাঠক নন। একুশে বইমেলায় কবিতার বই বিক্রির হার উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। প্রচুর কবিতার বই তৈরি হচ্ছে কিন্তু পাঠক সমাদর মিলছে না। জীবনকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে কবিতা টনিক হিসেবে কাজ করে। তবে সে কবিতা যদি পাঠক হৃদয়ে নাড়া দিতে না পারে, তবে তা কালের গর্ভে হারিয়ে যায়। তরুণ শিক্ষিতদের মধ্যে একটি বিশেষ শ্রেণি থাকে যারা কাব্য ভালোবাসে। কিন্তু সেই শ্রেণিও এখন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেÑ কেননা, তাদের মনোপযোগী কাব্যের আজ বড় আকাল। বিখ্যাত কবিদের বাইরেও বহু কাব্য রচিত হয়। কিন্তু পরিবেশ ও সুযোগের অভাবে সেগুলো হারিয়ে যায়। এ দায় কি শুধু কবির বা পাঠকের? রাষ্ট্রেরও এক্ষেত্রে কিছু দায় আছে। কাব্য শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা বড় প্রয়োজন। অনেক ভালো কবিতা আছে যেগুলো পরিবেশ ও সুযোগের অভাবে আলোর মুখ দেখে না। আজ তরুণ প্রজন্মের হাতে মাদক উঠেছে, অথচ তাদের হাতে কাব্যের বই শোভা পাওয়ার কথা ছিল। একটি কবিতার বই একজন তরুণের মাঝে জীবনবোধ, পরিমিতিবোধ, দায়িত্ববোধ, ও সামাজিক মূল্যবোধ তৈরি করে। কিন্তু কেন তাদের হাতে কাব্যের বই উঠে না? এটা কি শুধু তাদের দায় নাকি রাষ্ট্রেরও বড় দায় আছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে কাব্য সম্মেলন তেমন একটা চোখে পড়ে না। ব্যক্তিগত উদ্যোগে যেটুকু হচ্ছে তা দিয়ে কাব্যের বিস্তার সম্ভব নয়। বর্তমানেও অনেক নাম না জানা কবি ভালো কবিতা লিখছেন। তাদের এই লেখা যদি পাঠ্য পুস্তকে ঠাঁই করে দেয়া যায় তবে তারা আরও উৎসাহিত হবে, আরও সৃষ্টিশীল কাব্য তৈরি হবে। তরুণ প্রজন্মকেও দায়িত্ববোধের পরিচয় দিতে হবে। বাবা-মায়ের কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে মাদক না কিনে একটি ভালো কবিতার বই কিনলে সে নিজেও উপকৃত হবে এবং সমৃদ্ধ হবে কাব্য শিল্প। ১০০/২০০ টাকায় একটি কবিতার বই কেনা যায়। অভিভাবকরা যদি তাদের সন্তানদের বই কিনে দেন তবে তারা বিপথগামী হবে না। অভিভাবকদের মনে রাখতে হবে যে কবিতা একজন তরুণের মনে বিশেষ প্রভাব ফেলে এবং মার্জিত রুচিবোধ তৈরি করে।
আধুনিক কবিতা পড়ে কিশোর আর তরুণরা কোনো মজা পায় না, কোনো ছন্দ খুঁজে পায় না, কবিতার ভাষা তারা বুঝে না। তাদের মজা না পাওয়ার পেছনের কারণগুলো হলোÑ ১. মানহীন লেখা। ২. ভাষার জটিলতা ৩. ছন্দের অভাব ৪. সঠিক মাত্রা বিন্যাসের অভাব ৫. অন্তঃসারশূন্য বিষয়বস্তু ৭. লেখার মান যাচাই না করেই নির্বিচারে কবিতার বই ছাপানো ৮. মিডিয়া কাভারেজ কাক্সিক্ষত পর্যায়ে না পাওয়া ৯. যেন তেন লিখে বড় কবি হওয়ার বাসনা ১০. লেখার মৌলিকত্বের দিকে নজর না দেয়া ১১. কাব্য আন্দোলন তৈরিতে ব্যর্থ হওয়া ১২. যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাব্য রচনা করতে না পারা।
১৩. কবিতা পড়া নয়, শুধু লিখে কবি পরিচিতি নেওয়ার বাসনা। ১৪. ছাপানো সব বই সৌজন্য দিয়ে নিজেকে কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ব্যর্থ চেষ্টা ১৫. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কবিতা লিখে রাতারাতি কবি হয়ে যাওয়ার স্বপ্ন। ডরষষরধস ডড়ৎফংড়িৎঃয রোমান্টিক যুগের শুরু করলেনÑ যা সাহিত্যের এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছিল। তার মূল কথা ছিল কাব্যিক ভাষা হবে সহজ সরল যেন সাধারণ মানুষ তা বুঝতে পারে। তাল নেই, লয় নেই, ভাষার মাধুর্য নেই, সারসত্তা নেই এমন কাব্য কেউ রচনা করলে তা কাব্য হয়ে উঠবে না। যে কাব্য পাঠক হৃদয়ে নাড়া দিতে পারে না সে কাব্য মানুষ বর্জন করে। আজ কাব্য জগতে খরা চলছে।
কবিদের কর্মকাÐ দেখে কি বলবো তা ভেবে পাই না। বর্তমানে হাজার হাজার অন লাইন কাব্য পরিষদ। কবিতা গ্রæপগুলো সদস্য বাড়ানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। কবিতার মান তো দূরের কথা, নিজের মান নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে যায়। কবিতা না পড়ে কপি পেস্ট মন্তব্য করার যে হিড়িক প্রতিটি গ্রæপে চলে তা এখন ওপেন সিক্রেট। আর এ ধরনের মন্তব্য পেয়ে পোস্টদাতা কবি আবেগে ফেটে পড়ে এবং সর্বোচ্চ ভাষা প্রয়োগ করে কৃতজ্ঞতা জানাতে থাকে। অনলাইন কাব্য গ্রæপগুলো বছরে হয়তো একটি অনুষ্ঠান করে এবং আর্থিক অনুদান নিয়ে অথবা অন্য কোনো উপায়ে একটি ক্রেস্ট হাতে ধরিয়ে দেয়। ক্রেস্টটি পেয়ে (যদিও নিজ অর্থ ব্যয়ে) সে নিজেকে মহাকবি ভাবতে শুরু করে। মরীচিকার পেছনে ছুটে চলা এসব কবি কি আসলেই কবি? প্রশ্ন হলো লেখার মানের দিকে কজন নজর দিতে পারছেন। এবার আসি মিডিয়া কাভারেজ নিয়ে। অনেক কবির মানসম্মত লেখাও কালের গর্ভে হারিয়ে যায় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে। মিডিয়া কাভারেজ না থাকলে পরিচিতি বাড়ে না। পাঠকরা ওই লেখকের লেখা সম্পর্কে জানতে পারে না। কবি শামসুর রহমান, কবি সৈয়দ শামসুল হক, নির্মলেন্দু গুণ, এমদাদুল হক মিলনসহ অনেক কবি আছে যারা তাদের মৌলিক লেখার গুণে খ্যাতি পেয়েছেন। কিন্তু তারা সাংবাদিক হওয়াতে তারা সহজে মিডিয়া কাভারেজ পেয়েছেন। পাঠ্য বইতে কারও একটি কবিতা যুক্ত হলেতো কথাই নেই। দেশের জাতীয় পত্রিকাগুলোরও কিছু দায়িত্ব আছে এক্ষেত্রে। অনেক ভালোমানের লেখা চাপা পড়ে যায়, অথচ শক্ত যোগাযোগের কারণে অনেক সময় মানহীন লেখাও ছাপা হয়ে যায়। ফেসবুকে কাব্য চর্চার একটি অবাধ ক্ষেত্র। কিন্তু সেখানে লেখার মৌলিকত্ব দেখার কেউ নেই। যে যার মতো করে লেখে যাচ্ছে। সবাই সস্তা এবং দ্রæত জনপ্রিয়তার পেছনে অবিরাম ছুটে চলেছে। যেসব প্রতিষ্ঠানগুলো সাহিত্যের সেবা করে তাদের দায়িত্ব অনেক বেশি। যোগ্য লেখাকে পুরস্কৃৃত করা ও লেখককে সম্মান দেয়া তাদের নৈতিক দায়িত্ব। আমার নগণ্য জ্ঞানে এতটুকু বুঝি যে, মানসম্মত ও মৌলিক লেখা উপহার দিলে পাঠক সেটা লুফে নেবে। পাঠকদের এত বোকা ভাবার কোনো কারণ নেই।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক বাংলা একাডেমির দায় অনেক বেশি। বছরে কয়েকটি পুরস্কার দিয়ে দিলেই বড় লেখক তৈরি হবে না। বাংলা একাডেমিকে লেখক তৈরির সুযোগ করে দিতে হবে। রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে সাহিত্য সম্মেলনের বড় অভাব লক্ষ্য করি। আগে রাজ কবির প্রচলন ছিল। রাজ প্রাসাদে কবি, লেখক থাকতেন। এর ফলে, লেখকরা সরাসরি অনুপ্রেরণা পেত। আজ সেটাও নেই। লেখকরা মনে হচ্ছে বড় এতিম হয়ে পড়ছে। কলম চালানোর ক্ষেত্রেও লেখকরা অনেকটা ভয়ে থাকেন। আইসিটি আইনের ঝামেলায় পড়তে পারেন ভেবে অনেকে লেখেন না। কিন্তু ভয় করেতো আর লেখক হওয়া যায় না। অনলাইন সাহিত্য সংগঠনগুলোর দৌরাত্ম্য বন্ধ করা উচিত। এরা সাহিত্যের মান নষ্ট করছে। পাঠকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। তারা আজ আর ছাপা বই, পত্রিকা পড়তে চায় না। এ দায় কি শুধু পাঠকের? রাষ্ট্রের কি দায় নেই? প্রযুক্তি বিপ্লব কি তবে সাহিত্য চর্চার গতিকে থামিয়ে দিচ্ছে? বঙ্গবন্ধু কবি, সাহিত্যিক আর লেখকদের খুব ভালোবাসতেন। তিনি কাজী নজরুলকে জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়েছেন। তার নির্দেশে বাংলা একাডেমি চালু হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা লেখকদের জন্য ভালো কিছু করবেন এটা আশা করতেই পারি। আজ পর্যন্ত একটি কবি ভবন তৈরি হলো না। ঢাকা শহরে কত কিছু হলো, কিন্তু কবি ভবন হলো না। আমি কবি ভবনের দাবিতে কিছুটা সোচ্চার ছিলাম। কিন্তু আমার মতো নগণ্য ব্যক্তির কথা কে শোনে। এখনো অনেক সাহিত্যকর্ম তৈরি হচ্ছে। কিন্তু কেন সেগুলো সাড়া জাগাতে পারছে না? কেন আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারছে না। দায় কার? পাঠক, লেখক না রাষ্ট্রের? আজ আমাদের সংস্কৃতির মরণদশা শুরু হয়েছে। ভালো সাহিত্য তৈরি না হলে সংস্কৃতিও বাঁচবে না। তরুণদের হাতে কেন আজ মাদক? কেন তাদের হাতে একটি বই তুলে দেয়া যাচ্ছে না? বই পড়া আন্দোলনকে কেন চাঙা করা যাচ্ছে না? শুধু বছরে একটি বইমেলা করে সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করা যাবে না। একটি সাহিত্য কমিশন গঠন করা যেতে পারে। সাহিত্য কমিশন শব্দটি অনেকের কাছে হাস্যকর মনে হতে পারে। কিন্তু আজ এর আর কোনো বিকল্প নেই। রাষ্ট্রীয়ভাবে কবি সাহিত্যিকদের বই ছাপানোর ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলা একাডেমি বছরে একবার পত্রিকায় সার্কুলার দিয়ে লেখা আহŸান করতে পারে। যে লেখাগুলো জমা হবে সেগুলোর একটি যাচাই কমিটি থাকবে। ভালো লেখাগুলোকে পাঠ্য বইয়ে ঠাঁই করে দিতে হবে। জাতীয় পত্রিকাগুলোও ছাপানোর উদ্যোগ নিতে পারে। বিচ্ছিন্নভাবে সৃষ্ট সাহিত্য কর্ম অনেক ক্ষেত্রেই আলোর মুখ দেখে না। তাই প্রয়োজন একটি সমন্বিত উদ্যোগ। যে উদোগটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক হবে রাষ্ট্র।