আল মাহমুদের কবিতা-দর্শন
প্রকাশ | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
আবু আফজাল সালেহ
কবিতা রহস্যময় এক জিনিস। বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে প্রাচীন এ শাখাটির সংজ্ঞা নির্ধারণের চেষ্টা করেছেন অনেকে। ইংরেজি বা অন্যান্য বেশিরভাগ ভাষার প্রাচীনতম শাখা হচ্ছে কবিতা। অনেক কবি, আলোচকরা কবিতার সংজ্ঞা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কবিতার রহস্যময়তা এমনই যে, মতামতে এক হতে পারেননি। অ্যারিস্টটল থেকে লঙ্গিনাস, ওয়ার্ডসওয়ার্থ থেকে এলিয়েট-পাউন্ড বা রবীন্দ্রনাথ থেকে আল মাহমুদ- অনেকেই চেষ্টা করেছেন। কবি আল মাহমুদ (১১ জুলাই, ১৯৩৬-১৫ ফেব্রম্নয়ারি, ২০১৯) 'কবিতা এমন' কবিতায় কবিতার সংজ্ঞা দিয়েছেন বলে আমি মনে করি। এখানে কবিতার কী কী উপাদান থাকতে পারে বা কী কী বিষয় অন্তর্ভুক্তি হতে পারে তা সুন্দরভাবে বলেছেন। বলা যায়, কবিতায় উঠে আসা এ চিন্তাভাবনা তার কবিতার মূল দর্শন। মূলত এ কবিতা নিয়েই আলোচনা। আলোচনা করেই বের করার চেষ্টা করব আল মাহমুদের কবিতা-দর্শন।
গ্রামের গরুর গোয়াল থেকে বাছুর হারিয়ে গেলে নববধূর কী যে অবস্থা হয়! পুরুষ সদস্যরা হয়তো মাঠে বা কাজে। গরু রয়েছে কিন্তু বাছুর লাফিয়ে লাফিয়ে চলে গেছে অনেক দূর, অজানায়। এমন অবস্থায় পরিবারের নতুন সদস্য নববধূর মুখটা কী যে ম্স্নান হয়ে যায়, অস্থির হয়ে যায়! কবিতা ঠিক সে রকমই। টানটান উত্তেজনা সৃষ্টি করে কবিতা। কোনো এক বোধ কাজ করে, দায়বদ্ধতার কথা মনে করিয়ে দেয়। আল মাহমুদের বিখ্যাত 'সোনালি কাবিন' গ্রন্থের 'কবিতা এমন' কবিতার কিছু অংশ তুলে ধরছি:
'কবিতা চরের পাখি, কুড়ানো হাঁসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস
ম্স্নান মুখ বউটির দড়ি ছেঁড়া হারানো বাছুর
গোপন চিঠির প্যাডে নীল খামে সাজানো অক্ষর
কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার।'
কবিতায় লোকজ দর্শন তার অন্যান্য কবিতায় সঞ্চারিত হয়েছে। লোকজ উপাদানের অপূর্ব ব্যবহার পাঠককে মুগ্ধ করছে। চিত্রকল্পে নতুনত্ব এনেছেন। কবিতায় গ্রামীণ ও লোকজ উপাদানের কারুকার্যময় কবিতার জন্য দিন যত যাচ্ছে আল মাহমুদের পাঠকপ্রিয়তা ক্রমশ বাড়ছে। কবি লোকজ উপাদানে শৈল্পিক করে তুলেছেন প্রতিটি কবিতা। কৈশোরের স্মৃতি, মায়ের মুখ, হলুদ পাখি, পাতার আগুন, রাতজাগা ছোট ভাইবোন, সাইকেলের ঘণ্টাধ্বনি, হাঁটুজল নদী, কুয়াশা-ঢাকা পথ, ভোরের আজান, নাড়ার দহন, তিলের সৌরভ, মাছের আঁশটে গন্ধ, বাঁশঝাড়ে দাদার কবর, বইয়ের মলাট, অসুখী কিশোর, স্বাধীনতা, মিছিল, নিশান, দাঙ্গার আগুন, নিঃস্ব অগ্রজের কাতর বর্ণনা, চরের পাখি, হাঁসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস, দড়িছেঁড়া হারানো বাছুর, গোপন চিঠির প্যাড, নীল খাম, মক্তবের চুলখোলা মেয়ে, ঢেউয়ের পাল ইত্যাদির মতো স্মৃতিকথার উপাদান ব্যবহৃত হয়েছে তার কবিতায়। তার নস্টালজিক এমন কবিতা পড়লে পাঠক ফিরে যাবেন অতীতে। বাংলাদেশ গ্রামপ্রধান দেশ। নদীমাতৃক দেশ। গ্রামীণ বা লোকজ উপাদান কবিতার জন্য রসদ জুগিয়ে থাকে। জসীমউদ্দীন, জীবনানন্দ দাশরা লোকজ উপাদান থেকেই কবিতার শব্দ নিয়েছেন, চিত্রকল্প তৈরি করেছেন। আল মাহমুদের কবিতার প্রধান দর্শন হচ্ছে লোকজ উপাদান। লোকজ উপাদান ব্যবহারে তিনি জসীমউদ্দীন বা জীবনানন্দ দাশের মতো হননি। লোকজ উপাদান আধুনিকভাবে ব্যবহার করেছেন তিনি। কবিতা আসলে প্রকৃতিরই। প্রকৃতি থেকেই আসে কবিতার উপাদান। চর, ফুল, ঘাস...। তার কবিতায় লোকজ উপাদান বা গ্রামীণ চিরায়ত দৃশ্য নিয়ে কবিতা দর্শন এমন-
'কবিতা তো ফিরে যাওয়া পার হয়ে হাঁটুজল নদী
কুয়াশায়-ঢাকা-পথ, ভোরের আজান কিম্বা নাড়ার দহন
পিঠার পেটের ভাগে ফুলে ওঠা তিলের সৌরভ
মাছের আঁশটে গন্ধ, উঠানে ছড়ানো জাল আর
বাঁশঝাড়ে ঘাসে ঢাকা দাদার কবর।'
[কবিতা এমন/ সোনালি কাবিন]
আল মাহমুদের কবিতার আর একটি দর্শন হচ্ছে, সময় সময়ে ঘটে যাওয়াকে ফ্রেমবন্দি করা, গা বাঁচানোর জন্য এড়িয়ে না যাওয়া। তিনি বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়, মুক্তিযুদ্ধ এবং বিভিন্ন পর্যায় নিয়ে সোচ্চার ছিলেন। সশরীরের পাশাপাশি কবিতা ও সাহিত্যের এ দর্শনের ব্যাপক প্রয়োগ বা প্রমাণ আমরা লক্ষ্য করি। কবিতার যে কত শক্তি বিশ্বের অনেক আন্দোলন বা সংগ্রামে দেখা গেছে। ছোট্ট একটা কবিতা আগ্নেয়াস্ত্র হতে পারে, ঐক্যের প্রতীক হতে পারে, জীবনীশক্তি দিতে পারে, নতুন জীবন দিতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বে টালমাটাল অবস্থা সৃষ্টি হয়। ভারতবর্ষেও তার প্রভাব পড়ে। ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে দুর্ভিক্ষ দেখা যায়, রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। আসলে কবিতার বড় একটি অংশ হচ্ছে রাজনীতি, সংগ্রাম। দেশে দেশে বিভিন্ন দাবি আদায়ে বা সংগ্রামে কবিতা হয়ে ওঠে অন্যতম সহযোগী মাধ্যম। মিছিল, মিটিং প্রভৃতিতে কবিতা জেগে ওঠে, কবিতা জন্ম নেয়। সংগ্রামে বেঁচে থাকা, মাথা উঁচু করাদের বর্ণনা ইতিহাস হয়ে যায়, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে বেড়ায় স্মৃতি। এসব উপাদান কিন্তু কবিতার শৈলীকে সমৃদ্ধ করে। সময় ধরে রাখা কবিতার গুণ। বিশ্বসাহিত্যের অনেক কবিতা কিন্তু সময় বা সে জাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করেছে। এগুলোকে আমরা রাজনৈতিক কবিতা বলে থাকি। রাজনৈতিক-চেতনার কবিতার শক্তি অনেক বেশি। অনেক সময় মূলত রাজনৈতিক কবিতার শক্তি কবিকে টিকিয়ে রাখে। সময়কে যারা না-মেনে যারা কবিতা লেখেন তারা কম জনপ্রিয় হন বা হারিয়ে যান। আল মাহমুদও তাই মনে করেন; কবিতার অন্যতম প্রধান উপাদান হচ্ছে- স্বাধীনতা, সোচ্চার হওয়ার অনুপ্রেরণা, দেশ ও জাতির দুঃসময়ে এগিয়ে আসা এবং অধিকার/ দাবি আদায়ে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করা; ক্ষেত্রমতে লড়াই করা। এমন সব শক্তবান উপাদান মিলিয়েই ভালো কবিতা সৃষ্টি হতে পারে- এসবই তো কবিতার প্রধান উপাদান :
'কবিতা তো ছেচলিস্নশে বেড়ে ওঠা অসুখী কিশোর
ইস্কুল পালানো সভা, স্বাধীনতা, মিছিল, নিশান
চতুর্দিকে হতবাক দাঙ্গার আগুনে
নিঃস্ব হয়ে ফিরে আসা অগ্রজের কাতর বর্ণনা।'
[কবিতা এমন/ সোনালি কাবিন]
আল মাহমুদের 'এমন কবিতা' থেকে আরও একটি দর্শন দেখতে পেয়েছি- প্রেম ও রোমান্টিসিজম। নারী ও তার সৌন্দর্য অনন্য মাত্রা পেয়েছে। দারুণ সব চিত্রকল্প, ভাষা ও শব্দে পাঠকের হৃদয়ে গেঁথে গেছে। প্রেম বা নান্দনিকতা শাশ্বত একটা জিনিস। কবি আল মাহমুদের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে 'সোনালি কাবিন'। এ কবিতা গ্রন্থটি কবিকে অমর করে রেখেছে। শৈলী, অলংকার, ছন্দ, রস ইত্যাদি সাহিত্যগুণ এ কাব্যের কবিতাগুলোকে উন্নত করেছে। কবি যদি শুধু এ কাব্যের সনেটগুলোই লিখতেন তাতেও বাংলা কবিতায় তার স্থান শীর্ষেই থাকত। এ কাব্যের শুরুটাই কত নান্দনিক, প্রেমের অধিকার ভরা! 'সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিণী/ যদি নাও, দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দু'টি, (সোনালি কাবিন-০১)'। চমৎকার চমৎকার উপমা ও চিত্রকল্পে প্রেম, নারী, নারীর সৌন্দর্য অঙ্কন করেছেন কবি। কবির প্রথম দিককার কাব্যে (১৯৭৪ এর আগের) এ লক্ষণ দেখা যাবে। 'শঙ্খমাজা স্তনদুটি মনে হবে শ্বেতপদ্ম কলি' (সিম্ফোনি : লোক লোকান্তর), 'তার দুটি মাংসের গোলাপ থেকে নুনের হাল্কা গন্ধ আমার' (চক্রবর্তী রাজার অট্রহাসি : মায়াবী পর্দা দুলে ওঠে), 'চোখ যেন / রাজা মহীপালের দীঘি। আর বুক দুটি / মিথুনরত কবুতর'(অস্পষ্ট স্টেশন: আরব্যরজনী রাজহাঁস), 'তোমার নাভিমূলে দেখেছি একা আমি/ নরম গুল্মের কৃষ্ণ সানুদেশ' (শোনিতে সৌরভ : সোনালি কাবিন) ইত্যাদি চিত্রকল্প, উপমাগুলো পাঠকের কাছে আবেদনময়ী হয়ে উঠেছে। প্রেম-বিরহ-রোমান্টিকতা সাহিত্যে বেশি ব্যবহার করা হয় বা করা হয়েছে। প্রেমিক-প্রেমিকার রোমান্টিকতা কবিতার অন্যতম অনুষঙ্গ। কবিতা এ যেন আল মাহমুদের 'গোপন চিঠির প্যাডে নীল খামে সাজানো অক্ষর'। কিশোর-কিশোরীর আনন্দ-উলস্নাসে কোনো সীমা থাকে না। স্কুল হচ্ছে আবদ্ধ বিষয়। ফলে স্কুল থেকে ছুটি পেলে উলস্নাসে মেতে ওঠে শিক্ষার্থীরা। আয়েশা আকতাররা ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলে, পেছনে লম্বা চুল ওড়ে। কী যে অনাবিল দৃশ্য! কবিতাও কিন্তু এমনভাবেই স্ফুরিত হয় :
'কবিতা তো কৈশোরের স্মৃতি। সে তো ভেসে ওঠা ম্লান
আমার মায়ের মুখ; নিম ডালে বসে থাকা হলুদ পাখিটি
পাতার আগুন ঘিরে রাতজাগা ভাইবোন
আব্বার ফিরে আসা, সাইকেলের ঘণ্টাধ্বনি- রাবেয়া রাবেয়া
আমার মায়ের নামে খুলে যাওয়া দক্ষিণের ভেজানো কপাট!'
[কবিতা এমন/ সোনালি কাবিন]
আল মাহমুদ কবিতার প্রধান উপাদান লোকজ থেকে নেওয়া। লোকজ উপাদান নিয়ে প্রেম-রোমান্টিকতায় অনন্য মাত্রা নিয়ে এসেছেন। সময়কে তিনি এড়িয়ে যাননি। অধিকার আদায়ে সোচ্চার ছিলেন। কবিতার পাশাপাশি সশরীরেও বিভিন্ন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। লোকজ উপাদান ব্যবহার জীবনানন্দ বা জসীমউদ্দীন দেখিয়েছেন কিন্তু আল মাহমুদ নতুন করে ব্যবহার করে দেখিয়েছেন, নতুন স্বর সৃষ্টি করেছেন। কবিতায় ভাষাগুলোর প্রত্যেকটি যেন তার নিজস্ব শব্দ; অনুভূতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অন্য কবিদের থেকে তাকে পার্থক্য করেছে।