অদম্য
প্রকাশ | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
আকলিমা আক্তার সোমা
এক
মীনা। গায়ের রঙ কালো, লম্বা ছ'ফুট। খাটতে পারে খুব;? স্বামী ঢাকায় রিকশা চালায়। বাড়িতে খরচ দেয় না। খোঁজ-খবরও রাখে না। লোকমুখে শুনেছে লোকটা ঢাকায় বিয়ে করেছে আরেকটা। গ্রামে সে এর ওর বাড়িতে কাজ করে নিজের আর তিন সন্তানের অন্ন জোগায়। এর ধান ভানে, ওর চাল কোটে, তার লাকড়ি ফেড়ে দেয়। বিনিময়ে কেউ চাল দেয়, কেউ দেয় নগদ টাকা। ঈদে-পার্বণে দুটো ছাপের শাড়িও দেয় কেউ কেউ, তাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সারাবছর পরে। শ্বশুরবাড়িতে এক কোণে ছোট ঘুপচিতে তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকে। ঘরখানা তার মাটির, ছনের চালা।
সারাদিন বাড়ি বাড়ি ঘুরে কাজ করেও মুখে হাসি তার লেগেই আছে।
তিন সন্তানের বড়টা মেয়ে- নাম খাদিজা। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে ফাইভ পর্যন্ত পড়েছিল। তারপর পড়াশোনার পাট চুকেছে। ঘরদোরের কাজ-টাজ সেই সব করে রাখে। রান্না করা, বাসন মাজা, ছোট ভাইদের খাওয়ানো ধোওয়ানো। ছোট দুই ছেলে পিঠে পিঠি। একটা দুই বছর তো আরেকটা তিন। দুটোই ন্যাংটো ঘুরে বেড়ায়, কোমড়ে কেবল একটা ঘুঙসি বাঁধা থাকে। আর শীতের দিন মায়ের পুরোনো শাড়ি ছিঁড়ে দুই ভাঁজ করে গলায় বেঁধে দেয়?
খাদিজা গায়ে গতরে বড়ো হয়ে উঠেছে। বড়ো শান্ত মেয়ে। তবু এদিকে সেদিকে লোকে নানান কথা বলতে শুরু করেছে। বাপ তো থেকেও নেই, মা লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ করে বেড়ায়, সোমত্ত মেয়ে এভাবে ঘরে রাখা ঠিক না। লোকজন মেয়ের বিয়ে দিতে চাপ দেয় মীনাকে।
অনেক দেখেশুনে মীনা মেয়ের বিয়ে ঠিক করে পাশের গ্রামের করমালীর ছেলে জহরের সঙ্গে। করমালীর মস্ত সংসার। ৫০০ মণ ধানের গিরস্তি তার। বাড়িতে টিনের দুটো বড়ো বড়ো চৌচালা ঘর, লেপাজোকা প্রশস্ত উঠান। গোয়ালে গরু আছে। দু'পক্ষের ছেলেপিলে মিলে মোট ৮ জন। প্রথম পক্ষের ছোট ছেলে জহর। বিয়ে আগে একটা করেছিল। বছর ঘুরতেই বউটা মরেছে, বিয়েতে তারা তেমন কিছু চায় না কেবল মেয়েকে সাজিয়ে গুছিয়ে দিবে।
মীনার সারাজীবনের সঞ্চয় নগদ কুড়ি হাজার টাকা। মেয়েকে সোনার কানের দুল, গলার চেইন আর পায়ের মল গড়ে দিতে হবে। নাকফুলটা অবশ্য বরপক্ষ দিবে। তাছাড়াও বরযাত্রী আর গ্রামের গণ্যমান্য দশজন, পাড়া-প্রতিবেশিকে ভোজও তো দিতে হবে। বড়ো ঘরে মেয়ের বিয়ে হচ্ছে, নইলে যে মান থাকে না।
মেয়ের সুখের আশায় মীনা মোটা অংকের টাকা ধার নেয় সুদখোর মহাজন হাজী কাশেমের কাছ থেকে। হাজী কাশেমের সুদের কারবার। এছাড়া বাজারে ধান চালের আড়ৎ আছে তার। গেল বছর মক্কা থেকে হজ করে ফিরেছে। সুদের হারটা তার একটু চড়া, তবু মেয়ের বিয়ে তো দিতে হবে।
একদিন খুব বাদ্য-বাজনা বেজে খাদিজার বিয়ে হয়ে গেল জহরের সঙ্গে। বিয়ের পর মেয়ের বাড়িতে সাধ্যমতো তত্ত্বও পাঠাল মীনা। তবু মাস দুয়েকের মধ্যেই শরীরে প্রচুর মারধরের চিহ্ন নিয়ে ফিরে এল খাদিজা। কারণ জহর জুয়ারি। আধপেটা খেয়ে শ্বশুরের ঘরে কাজের মেয়ের মতো খাটলেও স্বামী জুয়ারি হওয়ায় প্রায়ই তাকে এর ওর মুখ ঝামটা শুনতে হতো। জুয়ায় হেরে এসে বউ পিটিয়ে রাগ ঝারত জহর। তিনটা পেটের ভাত যোগাতে আর মাসে মাসে মহাজনের সুদের দেনা মেটাতে মীনার অবস্থা তখন জালে আটকা মাছের মতো। এর মধ্যে আবার মেয়ে এসে হাজির। সোমত্ত মেয়েকে সে পরের বাড়ি কাজ করতে পাঠাতে পারে না। নিজে যা যোগাড় করে আনে তাতে চারজনে আধপেটা খাওয়ার পর আবার মহাজনের দেনা মেটাবার মতো কিছু বাকি থাকে না। বাজারে সবকিছুর দাম বাড়ছে হু হু করে, বাড়ে না শুধু মীনার শ্রমের দাম। খাদিজা আগের মতোই ঘর সংসার সামলায়। মাঝেমধ্যেই কেমন উদাস হয়ে যায়। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বুক ফাটে মায়ের। এত সুন্দর চাঁদের কণা মেয়ে তার, তবু শ্বশুরঘরের সুখ তার কপালে জুটল না।
দুই
গ্রামের চেয়ারম্যানের ছেলে হৃদয়। শহরে থেকে পড়াশোনা করে। ছুটিতে বেড়াতে এসেছে গ্রামে। খাদিজাকে একদিন ক্ষেতের আইলে শাক তুলতে দেখে তার ভালো লাগে। কিন্তু খাদিজার সাড়া পায় না। মনটা তার এক বৈশাখের ঝড়ে দুমড়ে মুচড়ে গেছে। নতুন করে ভাবতে তাই ভয় হয়। তাছাড়া হৃদয় বড় ঘরের ছেলে আর সে কাঙালের ঘরের ভাঙা চাঁদ, সামাজিক বৈষম্যের দ্বন্দ্বটা তাদের চিরকালীন। তবু খাদিজা একদিন প্রেমে পড়ে হৃদয়ের। বয়সটা তার নিতান্তই কাঁচা। গ্রামের দু-একজনের মধ্যে জানাজানি হয় তাদের প্রণয়ের কথা। গরিবের ঘরের মেয়ের দোষ সমাজের চোখে বিশাল আকারে ধরা পড়ে। খাদিজার দিকে নজর পড়ে গ্রামের আরও ছেলেদের। নানাভাবে উত্যক্ত করতে শুরু করে তারা। একদিন সালিশ ডেকে মীনাকে কড়াভাবে শাসিয়ে দেওয়া হয়। লজ্জায় ঘৃণায় অপমানে বাড়ি এসে সে মেয়েকে বেধড়ক পিটায়। হৃদয়ের সঙ্গে কথাবার্তা বন্ধ করে দেয় খাদিজা। কিন্তু গ্রামের ছেলেরা উত্যক্ত করেই চলে। বাইরে বেরুনো একেবারে বন্ধ হয়ে যায় খাদিজার। রাতে ঘরের চালে ঢিল ছুঁড়ে। মেয়েকে একা বাড়িতে রেখে লোকের বাড়ি কাজ করতে যেতে ভরসা পায় না মীনা। তবু কাজ তাকে করতেই হবে। একদিন কয়েকটা ছেলে মিলে মদ খেয়ে তার ঘরে ঢুকে পড়ে। মীনা রণচন্ডীর মতো দা নিয়ে তাড়া করে তাদের। কিন্তু তারা সব বড়ো ঘরের ছেলে। এর মধ্যে সুদখোর হাজী কাশেমের ছেলেও একজন। শোধ নিতে তারা তাই মিথ্যে অপবাদ দিয়ে পরদিন দুপুরে ঘরে ফেলে মা মেয়েকে খুব মারপিট করে আর একঘরে করার হুমকি দিয়ে যায়। হৃদয় খাদিজাকে পরামর্শ দেয় তার সঙ্গে পালিয়ে যেতে। কিন্তু মাকে ফেলে যেতে রাজি হয় না খাদিজা।
ওদিকে হাজী কাশেমের সুদের হার চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে বাড়তে বিরাট আকার ধারণ করেছে। লোকবল নিয়ে বাড়ি বয়ে এসে শাসিয়ে যায় মীনাকে। সাত দিনের মধ্যে দেনা শোধ করতে না পারলে ভিটেমাটি ছেড়ে পথে নামতে হবে। চোখে অন্ধকার দেখে মীনা।
রাতের অন্ধকারে পুঁটুলিটা বগলে নিয়ে পুত্র-কন্যার হাত ধরে পথে নামে। সামনে ঘোর অন্ধকার রাত। যেতে হবে অনেকটা দূর। ঝাপসা চোখে বেশিদূর তাকানো যায় না। ভেজা চোখ মুছে ফেলে হাতের উল্টো পাশে।