১৮৭৭ সালে মার্কিন বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন (১৮৪৭-১৯৩১ খ্রি.) শব্দ যন্ত্র আবিষ্কার করে নামদেন ফোনোগ্রাফ। একদিন তিনি টেলিফোন যন্ত্রের ট্রান্সমিটার মুখের সামনে ধরে গান গাইছিলেন। হঠাৎ কণ্ঠস্বরের শব্দের শক্তিতে ট্রান্সমিটারের সুক্ষ্ণ ইস্পাতের টুকরাটি তার আঙ্গুলে স্পর্শ করল। এডিসন ভাবতে লাগলেন ব্যাপার কি? তার মনে হলো ইস্পাত পিনটির গতিবিধি রের্কড করে রেখে ওটাকে যদি একই সমতলে আবার উল্টো ঘোরানো হয়, তাহলে জিনিসটিকে দিয়ে নিশ্চয় কথা বলানো যাবে।
এডিসন পেন্সিল দিয়ে নকশা আঁকতে শুরু করলেন। নকশা এঁকে কাগজটি তার যন্ত্র নির্মাতা জন ক্রুজিকে দিয়ে বললেন- এই যন্ত্রটি তৈরি করে নিয়ে এসো।
জনক্রুজি যন্ত্রটি তৈরি করে নিয়ে এলো। বড় কাঠের বাক্সে অদ্ভুদ একটা যন্ত্র। দু'পাশে দু'টো ঠেস। তার ওপরে একটি লোহার দন্ড। মধ্যে ধাতুর তৈরি গোলাকার বস্তু। দন্ডের একপাশে হাতল সমেত একটি চাকা। হাতলটা ঘুরিয়ে দিলে গোলাকার বস্তুটি সামনের দিকে ধীরে ধীরে ঘোরে। এ গোলাকার বস্তুর ওপর দিকে টেলিফোনের ট্রান্সমিটারের মতো একটা যন্ত্র। যন্ত্রটাতে একটা ডায়াফ্রাম আছে। এটির শেষদিকটি তীক্ষ্ন। ডায়াফ্রামটা হালকাভাবে গোলাকার বস্তুটার ওপর বসানো। যন্ত্রটি এডিসনের হাতে দিয়ে জনক্রুজি জিজ্ঞেস করল- এটা দিয়ে কী হবে? এডিসন বললেন- এ যন্ত্র কথা বলবে আর গান গাইবে। জনক্রুজি এবং কারখানার অন্যদের কথাটি বিশ্বাস হলো না, ভাবল মনিব বুঝি তাদের সঙ্গে ঠাট্টা করছেন।
এডিসন কাজ শুরু করলেন। প্রথমবার ব্যর্থ হলেন। দ্বিতীয়বার আবার শুরু করলেন। একটা নতুন পাত সিলিন্ডারের খাঁজে খাঁজে সমান করে বসিয়ে দিলেন। আস্তে করে পিনটাকে চকচকে টিনের পাতের ওপর বসিয়ে হাতলটা ঘুরিয়ে দিলেন। আর যন্ত্রের চোঙের কাছে গিয়ে একটি ছড়া আবৃত্তি করলেন। এরপর ডায়াফ্রামটা পিছন দিকে সরিয়ে নিয়ে শুরুতে পিনটা বসিয়ে হাতল ঘুরিয়ে দিলেন। ল্যাবরেটরির সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সূচের অগ্রভাগ টিনের পাতের ওপর চলতে লাগল। অকস্মাৎ যন্ত্রটি কথা বলে উঠল। এডিসনের কণ্ঠের সেই ছড়া আবৃত্তি- মেরী হ্যাড এ লিটল ল্যাম্ব (মেরীর ছিল একটি ছোট মেষ)। গ্রামোফোণে মানুষের এ কথাটিই প্রথম রেকর্ড হলো। বিস্ময়ে ল্যাবরেটরির সবাই চেঁচিয়ে উঠল, অলৌকিক! অলৌকিক! যন্ত্রটা কথা বলে।
পরের দিন নিউইয়র্কে প্রবল উত্তেজনা। সবার মুখে একটি কথা- এডিসন এমন একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন, যা কথা বলে। এডিসন হলেন বিভিন্ন সংবাদপত্রের আকর্ষণ।
১৮৭৮ সালে এডিসন তার আবিষ্কৃত গ্রামোফোনের পেটেন্ট পেলেন। কয়েক বছরের চেষ্টার ফলে তিনি মনের মতো করে গ্রামোফোন তৈরি করলেন। পরে এ যন্ত্রের সঙ্গে একটি চোঙাও লাগিয়ে দিলেন। এডিসনের তখন বয়স মাত্র ৩০ বছর। সৃষ্টি হলো ফোনোগ্রাফ বা আধুনিক কলের গ্রামোফোন রেকর্ড।
১৮৮১ সালে আলেক জান্ডার গ্রাহামবেল এবং টেইনটার মিলিতভাবে ফোনোগ্রাফের উন্নতি সাধনে সক্ষম হন। তারা রেকর্ড করার জন্য টিনের পাতের বদলে মোম ব্যবহার করেন। তাতে শব্দ কিছুটা স্পষ্ট হয়। তবু ফোনোগ্রাফের শব্দ বিক্ষেপে ভুলত্রম্নটি থেকেই যায়।
এ সময় এমিল বার্লিনার নামে এক জার্মান যুবক ওয়াশিংটনে বাস করতেন। তিনি কাপড়ের দোকানের কর্মচারী ছিলেন। বিজ্ঞানের ওপর তার অত্যন্ত আগ্রহ ছিল। টমাস এডিসনের ফোনোগ্রাফকে আরও উন্নত ও কার্যক্ষম করে তোলার জন্য ১৮৮৭ সালে এমিল বার্লিনার এগিয়ে আসেন।
বেশ কিছুদিন চেষ্টার পর ১৮৮৮ সালে বার্লিনার এক নতুন ধরনের রেকর্ড উদ্ভাবনে সক্ষম হন। তিনি রেকর্ড সিলিন্ডারের আকৃতির পরিবর্তন ঘটিয়ে পেস্নটের মতো সমতল রেকর্ডের প্রবর্তন করেন। ফোনোগ্রাফের ডায়াফ্রামের সঙ্গে চোঙা লাগিয়ে স্বর বিস্তারের ব্যবস্থা ছিল বার্লিনারেরই আবিষ্কার। যা টমাস এডিসনের ফোনোগ্রাফেরই উন্নত সংস্করণ।
এডিসনের সময় থেকে বার্লিনারের সময় পর্যন্ত ফোনোগ্রাফ বাজতে একটি হাতল অনবরত ঘোরাতে হতো। বার্লিনার চাইলেন এই অসুবিধা থেকে মুক্তি পেতে। স্প্রিংয়ের সাহায্যে রেকর্ড ঘোরানো যায় কি না এ ব্যাপারে বার্লিনারের সহকর্মী এফ ডাবিস্নউ গেইসবার্গ পরামর্শ দেন। এফ ডাবিস্নউ গেইসবার্গের পরামর্শ বাস্তবায়নে বার্লিনার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তিনি শত চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরবর্তী সময়ে লেদ ওয়ার্কশপের কর্মচারী এলরিজ জনসন সফল হন। ১৮৯৮ সালের এলরিজ জনসনের উদ্ভাবিত স্প্রিং চালিত ফোনোগ্রাফ সবার মন জয় করে নেয়। সে সময় থেকে ফোনোগ্রাফকে আদর করে গ্রামোফোন বা কলের গান নামে ডাকা হতে থাকে।
গ্রামোফোন আবিষ্কারের পরবর্তী দু'বছরের মধ্যে অনেক গ্রামোফোন কোম্পানী প্রতিষ্ঠিত হয়। এফ. ডাবিস্নউ গেইসবার্গ গ্রামোফোন জগতের সাথে বাংলাকে পরিচিত করেন। তিনি গ্রামোফোন কোম্পানীর প্রথম রেকডিং ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। ১৯০০ হতে ১৯০৭ সালের মধ্যে তিনি বহুবার ভারতের কলকাতাসহ অন্যান্য স্থান সফর করেন। এ শব্দধারণ প্রক্রিয়া চালু করার উদ্দেশ্যে গৃহীত তার উদ্যোগে অংশগ্রহণের জন্য ভারতের বিভিন্ন স্থানের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
১৯০২ সালের ৮ নভেম্বর গোটা ভারত ভূমিতেই গ্রামোফোন রেকর্ডিংয়ের ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন। এই দিনটিতেই গেইসবার্গ প্রথম বাঙালি শিল্পীর কণ্ঠে প্রথম বাংলা গান রেকর্ড করেন। সেই প্রথম গানটি ছিল কীর্তনের 'কাঁহা জীবন ধন' কণ্ঠ দিয়েছিলেন ক্ল্যাসিক থিয়েটারের চতুর্দশী নর্তকী মিস শশী মুখী। ওই একই তারিখে দ্বিতীয় গানের রেকর্ডিং হয় ক্ল্যাসিক থিয়েটারের আরেক নর্তকী মিস ফনী বালার কণ্ঠে। পরেবর্তীতে ১০ নভেম্বরে আরও কিছু শিল্পীর গানের রেকর্ড করার সুযোগ মেলে কিন্তু এরা কেউই তখন গানের জগতের বড় শিল্পী ছিলেন না। সে সুযোগ এলো কলকাতার বাঙালি রমণী গওহর জানের কল্যাণে। রূপের ছটা আর রেওয়াজি কণ্ঠের দৌলতে গওহর জান সেকালের সৌন্দর্যপিপাসু ও সঙ্গীত রসিক মানুষের মন কেড়েছিলেন। গোটা ভারতবর্ষে তখন তার নাম-ডাক ছড়িয়ে পড়েছিল। এই গওহর জানই ছিল গেইস বার্গের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার নিঃসন্দেহে। ১৯০২ সালের ১১ নভেম্বর গেইসবার্গ গওহর জানের কণ্ঠে গান রেকর্ড করেন। সাত ও দশ ইঞ্চি ব্যাসের রেকর্ডে তার গানগুলো ধারণ করা হয়। গওহর জান হিন্দুস্তানি ভাষায় দাদরা তালে প্রথম গানটি রেকর্ড করেছিলেন। গওহর জানের ধারণ কৃত তার প্রথম বাংলা গানটি ছিল 'ভালো বাসিবে বলে ভালো বাসিনে'। পরের দিন আবারও গওহর জানের কণ্ঠে গান রেকর্ড করা হয়। এই রেকর্ডই তাকে অল্পদিনের মধ্যে খ্যাতি এনে দেয়। কলকাতার সব সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় তার ছবি ছাপা হয়। এভাবেই গোটা ভারত বর্ষে অতিশীঘ্র গ্রামোফোন রেকর্ডের এক বিশাল বাজারে পরিণত হয়। উলেস্নখ করা যেতে পারে সে আমলে গওহর জান একজন সফল চলচ্চিত্রের নামকরা নায়িকাও ছিলেন।
১৯০২ সালের ১৪ নভেম্বর বাংলা রঙ্গমঞ্চের দুই নামকরা শিল্পী হরিমতী ও সুশীলা ও গেইস বার্গের নজরে পড়েন। তাদের দিয়েই গেইস বার্গ একের পর এক থিয়েটারের বাদক দলের সমন্বয়ে এই দুই শিল্পীর গানের রেকর্ড করে নেন।
রেকর্ডিংয়ের প্রথম পর্যায়ে গানের পুরুষ শিল্পী তেমন পাওয়া যায়নি। একমাত্র অভিজাত পরিবারের সন্তান গায়ক লালচাঁদ বড়াল ছাড়া। লালচাঁদ গ্রামোফোনের শিল্পী হিসেবে অল্প সময়ের মধ্যে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন। তার রেকর্ডের চাহিদা ছিল আকাশচুম্বী প্রায় শিল্পী গওহর জানের কাছাকাছি। ১৯০৭ সালে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে এই গুণী শিল্পীর অকাল মৃতু্য হয়।
গেইস বার্গ রেকর্ডিংয়ের জন্য মাত্র ছয় সপ্তাহ কলকাতায় অবস্থান করেছিলেন। এই সামান্য সময় তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ কার্য সম্পাদান করেছিলেন। সাত ও দশ ইঞ্চি মিলিয়ে তিনি মোট সে সময় ৬৫২ খানা কণ্ঠ ও যন্ত্র সঙ্গীতের রেকর্ড করেন। গেইস বার্গের শুভ সূচনায় এক দশকের মধ্যে গ্রামোফোন হয়ে উঠল সমগ্র ভারতবর্ষের আম-জনতার জনপ্রিয় বিনোদনের সামগ্রী। এভাবেই সমগ্র ভারতবর্ষে অতিশীঘ্র গ্রামোফোন রেকর্ডিং এক বিশাল বাজারে পরিণত হয়। ১৯০০ সালের মধ্য কলকাতার জোড়া সাঁকোর ঠাকুরবাড়ীতে ফোনগ্রাফ যন্ত্র পৌঁছে যায়। ১৯০৩ সাল নাগাদ সাহিত্য সেবী 'বিষাদ সিন্ধু' রচয়িতা কুষ্টিয়ার লাহিনীপাড়া গ্রামে মীর মোশাররফ হোসেনের বাড়িতে ও কলের গান পৌঁছে যায়। সম্ভবত এর আগে কোনো মুসলমান ঘরে কলের গান পৌঁছানোর নির্দিষ্ট কোনো তথ্য অদ্যাবধি পাওয়া যায় না।
বিংশ শতকের প্রথম দশকে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি জনপ্রিয় বিদেশি গ্রামোফোন কোম্পানি হচ্ছে- হিজ মাস্টারস ভয়েজ (ব্রিটিশ), কলম্বিয়া (আমেরিকা) এবং পঠে (ফ্রান্স)।
গ্রামোফোনের রেকর্ড তৈরি করার ক্ষেত্রে প্রথম ভারতীয় উদ্যোক্তা হলেন হেমেন্দ্র মোহন বসু (১৮৬৪-১৯১৬ খ্রি.)। ময়মনসিংহের জয়সিদ্ধ গ্রামে তার জন্ম। তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজে লেখাপড়া করেন। হেমেন্দ্র মোহন সুগন্ধী দ্রব্যের প্রতি বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। তাই ১৮৯৪ সালে তিনি 'বোস পারফিউমারস' বাণিজ্যিক সনদে সুগন্ধী দ্রব্য প্রস্তুত করা শুরু করেন এবং অতি অল্প সময়ে এতে সফলতা অর্জন করেন। শীঘ্রই তিনি তার পণ্য সামগ্রীতে 'কুন্তলীন কেশ তৈল' ও অন্যান্য প্রসাধনী দ্রব্যযুক্ত করেন এবং কলকাতার ৬ নম্বর শিব নারায়ণ দাস লেনে একটি কারখানা স্থাপন করেন।
১৮৯৬ সালে হেমেন্দ্র মোহন বসু তার প্রস্তুত পণ্যদ্রব্য 'কুন্তলীন কেশ তেল'- এর নামানুসারে এক সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তন করেন। এটি ছিল ছোট গল্প রচনা প্রতিযোগিতা। বার্ষিক এই প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পাওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথ তার 'কর্মফল' গল্পটি লিখে পাঠান। ছদ্মনামে পাঠানো শরৎচন্দ্রের প্রথম গল্প 'মন্দির' কুন্তলীন সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিল। হেমেন্দ্র মোহন বসু প্রতিবছর প্রতিযোগিতার জন্য প্রাপ্ত গল্পগুলো সংকলন করে সেকালে 'কুন্তলীন সাহিত্য পুরস্কার' নামে গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বিজ্ঞাপন রচনায়ও বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। তার রচিত এমনি একটি বিজ্ঞাপন-
'কেশে মাখো কুন্তলীন/অঙ্গ বাসে দেল খোস,
পানে খাও তান্ব লীন
ধন্য হোক এইচ বোস'