কবিতা উৎসবের দ্বিতীয় দিন, টিএসসি চত্বর। তখন দুপুর সাড়ে ৩টা। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত কবিরা বসে আছেন। ঘোষক একটু পরপর ঘোষণা দিয়ে কোন কবি কখন তার স্বরচিত কবিতা পাঠ করবেন, জানিয়ে দিচ্ছেন। আরিফ কবিতা লেখেন না। তবে পড়তে ভালোবাসেন। শুনতেও তার ভালো লাগে। কবিতার প্রতি তার একটা বাড়তি টান আছে। এ জন্য কবিতা উৎসবে আসা। কিছুক্ষণ মফস্বলের কবিদের কবিতা পাঠ শুনেছেন। মনে হয়েছে বেশির ভাগই আনাড়ি। তাই স্বরচিত কবিতা পাঠপর্ব তাকে বেশি টানেনি। তবে নবীন কবিদের আনাড়ি কবিতা পাঠ উপচে মাঝে-মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ দুয়েকজনের কণ্ঠে সম্ভাবনার পঙক্তি শুনে ভালো লেগেছে তার। এ জন্যই কিছুক্ষণ বসেছিল। বসেছিল সে দর্শক-শ্রোতা সারির একেবারে পেছনে। কোনো বন্ধু-বান্ধব সঙ্গে নেই বলে কবিতা উৎসবের এত লোকের মাঝেও বড় একা মনে হচ্ছে। হঠাৎ ভাবে, একবার না হয় বাংলা একাডেমির বইমেলা থেকে ঘুরে আসা যাক। ততক্ষণে নিশ্চয়ই বইমেলা জমে উঠেছে। আরিফ যখন উঠি উঠি করছেন তখনই পাশে দিয়ে একজন ঝালমুড়ি ওয়ালা যাচ্ছেন। আরিফ কাছে ডাকেন। বলেন, ভালো করে ঝালমুড়ি বানিয়ে দাও তো! খাঁটি সরিষার তেল, কড়কড়ে কাঁচামরিচ, লবণ আর অন্যান্য মসলা দিয়ে বানাচ্ছেন ঝালমুড়ি। সঙ্গে টমেটু এবং গাজরের সালাদ। আহ! ম ম গন্ধেই জিহ্বায় পানি এসেছে। কাগজের ঠোঙায় ঝালমুড়ি দিয়ে হকার চলে যান। আরিফ মুঠি মুঠি ঝালমুড়ি মুখে দেন। কড়কড়ে কাঁচা মরিচের ঝালে 'হু-হা' করতে করতে অল্প সময়ের মাঝেই ঠোঙার সব মুড়ি খেয়ে শেষ করেন। ফেলে দেওয়ার আগে খালি ঠোঙার এক জায়গার একটি লেখা দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা একটি মেয়ের নামের নিচে মোবাইল ফোন নম্বর লেখা। নাম নাসিদা সুলতানা। মোবাইল ফোন নম্বরের পরে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ক্লাসের নাম ছাড়া আর কোনো ঠিকানা লিখা নেই। আরিফ পকেট থেকে নিজের মোবাইল সেটে নম্বরটি তুলে সেইভ করে রাখে। তারপর দর্শক সারির পেছন থেকে উঠে কয়েক কদম হেঁটে গেটের কাছে একটি চায়ের স্টলে বসেন। এককাপ চা পান করে আরিফ বইমেলার উদ্দেশে রওনা হন। টিএসসি থেকে কত আর দূর! ফুটপাত ধরে হাঁটেন আরিফ। কিছুক্ষণ হেঁটে বইমেলায় পৌঁছেন। বইমেলায় কড়া পুলিশ পাহারা। গেটে ঢোকার সময় প্রত্যেকের ব্যাগ তন্নতন্ন করে দেখে ভেতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছে। আরিফের হাতেও একটা ব্যাগ। একটানে চেইন খুলে পুলিশকে বলে, এই নেন, দেখেন! -হ্যাঁ, দেখলাম। আপনি যেতে পারেন। আরিফ ভেতরে ঢুকেন। গতকালই প্রধানমন্ত্রী মেলার উদ্বোধন করেছেন। ভেতরে ঢুকে আরিফ বুঝতে পারেন মেলা এখনো জমে উঠেনি। একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত সবক'টি স্টলই ঘুরেফিরে দেখছেন। সবগুলো স্টলে এখনো বই উঠানোর কাজই শেষ হয়নি। তবে শতকরা ৮০ ভাগ স্টলই খোলা। ২০ ভাগ স্টল এখনো খুলেনি। স্টলে স্টলে ঘুরে আরিফ বই দেখেন। তার মতো এমন আরও কিছু আগ্রহী দর্শক-ক্রেতা স্টলগুলো ঘুরে দেখছেন। বর্ণায়ন স্টল থেকে আরিফ একটি বই কিনে হাতে নেন। ইউপিএল থেকে বাংলাদেশের নির্বাচিত কবিতার একটি বই কিনেন। সবগুলে স্টল ঘুরে হাঁপিয়ে উঠেন। তারপর মনে মনে বলেন, আজ আর নয়। ক'দিন পর না হয় আবার আসব। এই ভেবে বইমেলা থেকে বের হন। অস্থির চিত্তের মানুষ আরিফ। সদ্যকেনা বই দু'টি ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে ভাবেন, এখন কোথায় যাব! ভেতর থেকে উত্তর আসে, না হয় আবার কবিতা উৎসবে যাই। যে কথা সেই কাজ। অরিফ ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকেন। ততক্ষণে মসজিদে মসজিদে আসরের আজান ধ্বনিত হচ্ছে। অরিফের কেন যেন মনে হয়, কবিতা উৎসবে যেহেতু এসেছি, প্রাণপ্রিয় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবরের পাশের মসজিদে নামাজ পড়ে যাই না কেন? আসরের নামাজ পড়ার জন্য ভিন্ন রকম একটা পুলক জাগে মনে। ওজু করার সময় 'মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই' মহান কবির গানের এই পঙক্তি মনে পড়ে। নামাজ আদায় করে আরিফ মনে মনে বলেন, কবিতা উৎসবের দ্বিতীয় দিনে কবির কবরের পাশের মসজিদে নামাজ আদায় করার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। তারপর ফুটপাত ধরে?হাঁটতে থাকেন। কৌতুলবশে পকেট থেকে মোবাইল ফোন সেটটি বের করেন। মুড়ির ঠোঙা থেকে সংরক্ষণ করা নম্বরটি বের করে ফোন করেন। দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করে। ওপাশে ফোন বাজার শব্দ হয়। তাই কানে নিয়ে অপেক্ষায়...। অমনি ওপাশ থেকে মেয়েলি একটি কণ্ঠ সাড়া দেয়, হ্যালো! হ্যালো কে বলছেন পিস্নজ? জবাবে আরিফ কোনো কথা বলার সাহস করেন না। সংশয়ে বরং লাইন কেটে দেন। প্রতিক্রিয়ায় আরিফের বুকটা ছঁ্যাৎ করে উঠে। বড় আশা নিয়ে ফোন করেছিলেন আরিফ। কিন্তু প্রথমদিন কথা বলেই আশাহত। মনে বেশ কষ্ট পান। মেয়েটির তুচ্ছার্থক আচরণ আরিফের ব্যক্তিত্বে লাগে। তাই মনে মনে জেদ এঁটে বসে। ভাবেন, আচ্ছা! আমিও তোমাকে বশে এনে-তারপর উপেক্ষা করে প্রতিশোধ নেব। এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে আরিফ পরদিন আবার একই সময়ে ফোন করেন। ওপাশ থেকে ঝাঁজালো কণ্ঠে বলেন, হ্যালো! কে...? -আমি। মুড়ির ঠোঙায় যার নাম এবং মোবাইল নম্বর পেয়েছি-সেই আমি। -আজও তুমি...? -হ্যাঁ ম্যাডাম। তবে আপনার কণ্ঠে তুচ্ছার্থে উচ্চারিত ওই তুমি শব্দটি স্থান-কাল-পাত্র ভেদে মধুরও হতে পারে। মনে রাখবেন, আমি ঝাল-মুড়ি বিক্রেতা নই। নাম আরিফ। রাজধনাীর অভিজাত এবং স্বনামধন্য একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়ছি। বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, আমার মাঝে কোনো শঠতা নেই। মফস্বলের ছেলে আমি। এই বলে প্রতু্যত্তর শোনার আগেই মোবাইল-ফোনের লাইন কেটে দেন। পরদিন আর মোবাইল ফোন করেননি আরিফ। তৃতীয় দিন ফের বিকাল ৪টায় ফোন করেন আরিফ। নাশিদা সাড়া দিয়ে বলেন, হ্যালো! কে বলছেন পিস্নজ! -মুড়ির ঠোঙায় যে পেয়েছে আপনার নাম। -কবিতা আবৃত্তির মতো বলছেন যে, কবিতা লেখেন নাকি? -কী যে বলেন, আপনার মতো বাংলায় পড়ি নাকি যে, কবিতা লিখতে পারব। -তা বলুন, ফোন করার হেতুটা কী? -আগেই তো বলেছি, আমি মফস্বলের ছেলে। কিলবিল করা পোকার মতো এ রাজধানী শহরে লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড় উপছে দুঃসহ একাকিত্ব আমাকে অতিষ্ঠ করে তুলছে। ছেলে বন্ধু দুয়েকজন আছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো মেয়ে বন্ধু এ কপালে পদচিহ্নটুকু রাখেনি। -ছিঃ ছিঃ! এভাবে নিজেকে এত অসহায় করে বলছেন কেন? -হৃদয়ে হাহাকার না থাকলে কি আর কারও মনের গভীর থেকে এমন স্বতোৎসারিত কথামালা বের হয়ে আসে? -কী জানি, আমারও তো কোনো অভিজ্ঞতা নেই। -আজ তুমি বলছেন না যে! হোক তা তুচ্ছার্থে। তবু আমার কাছে তা ভিন্ন রকম ব্যঞ্জনা দেয়। -দেখুন, সঠিক পরিচয় পাইনি বলে... নাশিদা কথা শেষ করার আগেই আরিফ লাইন কেটে দেন। তাতে নাশিদা কিছুটা হতাশ হন। হয় কিছুটা অভিমানও। মনে মনে বলেন, কোথাকার কোন আরিফ। তার সঙ্গে এত কথা বলার কী আছে? এই মনে করে সেও মোবাইল রাখে। আরিফ তো মনে মনে লালিত একটা জেদ সাধনের জন্যই নাশিদার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে চান। সেভাবে, আমিও দেখে নেব, কী করে তুমি আমাকে উপেক্ষা করে থাকতে পার! এমন একটা ভাবনা থেকেই আরিফ নাশিদার হৃদয়রাজ্য দখল কওে; তবে নিজের ভুবনে ফেরার অঙ্গীকার নিয়ে প্রণয় অভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নেন। তিনি চান নাশিদাই হোক তার জীবনে প্রণয়াভিনয়ের নাট্যমঞ্চে পর্যবেক্ষণের প্রথম গিনিপিগ। পরদিন সকালে আরিফ মুঠোফোনে নাশিদার ফোনে একটি ম্যাসেজ পাঠান। ম্যাসেজ পাঠাতে গিয়ে লেখেন, আপনার একজন ত্যাগী বন্ধু হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করব নাশিদা। তারপর জবাব পাওয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকেন। কিন্তু কোনো জবাব পাননি। বিকাল ৪টায় আবার ফোন করেন। নাশিদা যেন অপেক্ষায়ই ছিলেন। সাড়া দিয়ে বলেন, হ্যালো, আরিফ সাহেব নিশ্চয়! -হ্যাঁ। কেমন আছেন নাশিদা? -ভালো। আপনি কেমন আছেন? মুঠোফোনে একটা ম্যাসেজ পাঠিয়েছেন আপনি! -হ্যাঁ। রাগ করলেন বুঝি।/-না-না। রাগ করব কেন! -খুশি হয়েছেন? -তা-ও না। আচ্ছা বলুন তো, আমাকে ঘিরে আপনি এতটা মরিয়া হচ্ছেন কেন? -আপনাকে খুব উত্ত্যক্ত করছি, তাই না? -হ্যাঁ, করছেনই তো। আমাকে দেখেন নি, চিনেন না-জানেন না... -মনে করেন আমি আপনার নামের একজন মুগ্ধ ভক্ত। -এতটা সমর্পিত হয়ে আপনি কেন কথা বলেন, বলুন তো? জানেন না... -কী জানব? -মেয়েদের একটা নরম মন আছে। ওখানে কষ্ট জমা হয়। -যাক, এতদিনে আপনার কষ্টের কাঁটা হয়ে দাঁড়ালাম। -না, শুধু কষ্টই দিচ্ছেন না; নাছোড়বান্দা হয়ে জ্বালাচ্ছেনও। এত বলার পরও... এ পর্যন্ত বলে নাশিদা লাইন কেটে দেন। আরিফ তাতেই খুশি। তবে তার চোখে-মুখে আশার ঔজ্জ্বল্য যেমন দেখা দেয়, নিরাশার চকিত দোলাচল থাকে। রাতে আরিফ আবার মুঠোফোনে ম্যাসেজ পাঠান। নাশিদা জবাব পাঠান। এভাবে চলে কয়েক মাস। ততদিনে তাদের মাঝে গড়ে ওঠা বন্ধুত্ব ক্রমে প্রণয়ে রূপ নেয়। পরস্পরের সম্বোধন আপনি থেকে তুমিতে উন্নীত হয়। মুঠোফোনে ওদের প্রণয়ঘটিত বিষয়টি আস্তে আস্তে বন্ধু মহলে ছড়ায়। আরিফের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সুজন বলেন, তা বন্ধু তোর হৃদয়-রানিকে না দেখে এভাবে আর কতদিন চালাবি? একবার তো প্রেমিকাকে এক নজর দেখে নে। -হবে বন্ধু, সবই হবে। তবে আর কিছুদূর এগিয়ে নিই। ম্যাসেজ পাঠাচ্ছি, ও জবাব দিচ্ছে। এবার প্রেমপত্র লিখে পাঠাব। তাছাড়া প্রতিদিন বিকালে মুঠোফোনে কথা বলার জন্য তো সময় বরাদ্দ থাকছেই। -তুই তো ধীরে ধীরে মেয়েটার সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছিস। -জড়াচ্ছি না ছাই। ও আমাকে অবমূল্যায়ন আর অবজ্ঞা করেছে। তাই ওর হৃদয় ভুবন দখল করেই পিছু হটব। -তোর হৃদয় ভুবনও যে -সে দখল করে নিচ্ছে না, তার প্রমাণ কী? -কী প্রমাণ চাস? -দাঁড়া একটু ভেবে নিই। সজিব আর রাশেদের সঙ্গে কথা বলে নিই। -ঠিক আছে। দেখিস, আমি দেখিয়ে ছাড়ব, এসব আমার অভিনয় ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে আমাকে আর একটু এগোতে দিবি তো! -আচ্ছা দেখা যাবে।
এই বলে সুজন নিজের পড়াশোনায় মন দেয়। আরিফ সত্যিই স্মার্টফোনে স্বল্প কথায় একটা প্রেমপত্র লেখে পাঠান। নাশিদা জবাবে ম্যাসেজ পাঠান। চ্যাটিংয়ে ওদের মাঝে প্রণয়ঘটিত সম্মোহিত কথামালাও হয়। বিকালের গÐি পেরিয়ে গভীর রাতেও ওরা চ্যাটিংয়ে মগ্ন থাকেন। ততদিনে সত্যিই নাশিদা আরিফের প্রতি অস্বাভাবিকভাবে ঝুঁকে পড়েছে। এক পর্যায়ে এমন হয়, কখন আরিফ ফোন করবেন, সেই অপেক্ষায় উন্মুখ থাকেন নাশিদা। আরিফ ফোন করে যখন কথা বলেন তখন সে প্রাণ ফিরে পায়। কিন্তু অরিফ যদি ফোন করতে দেরি করে নাশিদা খুব অস্থির হয়ে উঠে। এক সময়ে আরিফকে পাগলের মতো ভালোবাসতে শুরু করে নাশিদা। নাশিদার এ অবস্থা আঁচ করে আরিফ তার বন্ধুদের বলে, এই উপযুক্ত সময়।
আরিফ বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করে নাশিদাকে মুঠোফোনে বলে, এখন উভয়ের সাক্ষাতের প্রয়োজন। এতদিন হয়ে গেল তাদের সম্পর্ক শুধু ফোনে ফোনে। কিংবা তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমেই। কোনো দেখা-সাক্ষাৎ নেই। নাশিদারও মনের আকুতি- আরিফকে এক নজর দেখবেন। উভয়েই আলোচনার পর স্থির করেন তাদের দেখা হবে রমনা পার্কের মূল ফটকে। একুশে ফেব্রæয়ারির দিন বিকাল ৩টায়। আরিফ বলেন, তুমি লাল পারের একটা শাড়ি পরে এসো। আর আমি কালো প্যান্ট আর নীল জামা পরে আসব।
ওপাশ থেকে নাশিদা ইতিবাচক সাড়া দেন। আরিফের বন্ধুদের অভিমত, নাশিদাকে দেয়া কথামতো সে পোশাক পরবে না। তাহলে তো নাশিদা তাকে চিনেই ফেলবে। বরং মেয়েটা তাকে না চিনে কী ধরনের আচরণ করে- তা সবাই মিলে উপভোগ করবে। নাশিদা প্রভাত ফেরির পোশাকেই বিকেল ৩টায় নির্ধারিত স্থানে উপস্থিত হয়। কিন্তু এ কী? সময় বয়ে যায়, আরিফকে তো খুঁজে পায় না। নাশিদা কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর আরিফকে ফোন করে। সাড়া দিয়ে অরিফ বলেন, নাশিদা আমি এক বন্ধুর বাসা থেকে আসার পথে পল্টনে যানজটে আটকে আছি। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো, আমি আসছি।
আধা ঘণ্টা চলে যায়, নাশিদা অতিষ্ঠ হয়। আরিফ তার বন্ধুদের নিয়ে স্বল্প দূরে অবস্থান নিয়ে তা উপভোগ করেন। নাশিদা আবার ফোন করে। আরিফ সাড়া দিয়ে বলেন, সামনে মনে হয় একটা সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকবে। এজন্য যানজট ছাড়ছে না। তুমি আর মিনিট দশেক অপেক্ষা করো। যদি এর মাঝে আসতে না পারি, তাহলে আজকের মতো চলে যেও। কথা রাখতে পারিনি বলে আমি দুঃখিত। অন্যদিন না হয় আবার...
আরিফের কথা শেষ হয়নি, তার আগেই লাইন কেটে দেন নাশিদা। সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্ভেদী কষ্টে সে কেঁদে ফেলে। কেঁদে কেঁদে মনে মনে বলে, এত আশা নিয়ে এলাম, অথচ...। অব্যক্ত কান্নায় দু’চোখের নদী প্রবল বেগে বইতে থাকে। অল্পক্ষণেই তার চাঁদমুখটা শ্রাবণধারায় সিক্ত হয়। নিঃশব্দ কান্নায় দু’টি চোখ তার ফুলে উঠে। নাশিদার এ অবস্থা দেখে বন্ধুরা হেসে উড়ায়। কিন্তু তার অসহায় কান্না দেখে আরিফের বুকে হাহাকার দেখা দেয়। মনে মনে বলেন, বন্ধুদের পরামর্শে-এ আমি কী করলাম! নাকি কাছে গিয়ে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইব। আরিফ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই নাশিদা রিকশা ডেকে চেপে বসে। মুহূর্তেই যানবাহনের ভিড়ে সে হারিয়ে যায়। এতে আরিফের ভেতর দেশে ভাঙন শুরু হয়। চকিতে তার চোখে-মুখের উচ্ছল অভিব্যক্তি উবে গিয়ে তাতে কালবোশেখের ঝোড়ো মেঘ হানা দেয়। আরিফ থ বনে নাশিদার গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকেন। হঠাৎ আরিফের আচরণে এমন পরিবর্তন দেখে বন্ধু সুজন বলে, কি রে আরিফ, কী হলো তোর?
-কিছু না।
-চল ফিরে যাই। কতক্ষণ আর এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবি?
- কিছুই আমার ভালো লাগছে নারে!
-তো চল ফিরে যাই। তুই-ই না বলছিলি, নাশিদা হবে তোর প্রণয়াভিনয়ের নাট্যমঞ্চের গিনিপিগ। তাহলে তার জন্য এতটা মায়া দেখাচ্ছিস কেন?
-সে-ও তো একজন মানুষ নাকি?
-এসব নিয়ে পরে ভাবিস, এখন চলত।
বন্ধু সজিব এ কথা বলে তার এক বাহু ধরে। সুজন ধরে অন্য বাহু। দু’জন দু’বাহু ধরে রাস্তার পাশে গিয়ে রিকশা ডাকে। রিকশা ছুটে চলে। কিন্তু আরিফের মুখে কোনো রা ফোটে না।
এ ঘটনার পর নাশিদার নিষ্কলুষ মনটা ভেঙে দুমড়ে-মুচড়ে তচনচ হয়। বাসায় গিয়ে নিজের বিছানায় পড়ে শুধু কাঁদে আর কাঁদে। তার নিঃশব্দ কান্নায় বালিশ ভিজে। শেষ বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। নাশিদা নিজেকে মানাতে পারে না। থেকে থেকে বুকের সাগরে উছলে উঠে অনিরুদ্ধ কান্নার গমক। কান্নার ভেতর মনে গভীর থেকে একটা প্রশ্নই কেবল বারবার উঁকি দেয়। বলে, কী অপরাধ করেছিলাম আমি! আরিফ কেন আমাকে নিয়ে এমন একটা খেলা খেলল?
এসব ভাবনায় সারা রাত নাশিদার ঘুম হয়নি। কেমন যেন গুমোট বিষণœতায় গ্রাস করে তাকে। কেউ যদি এভাবে প্রচÐ নাড়া দিয়ে বিশ্বাসের গাছটা ভেঙে ফেলে তাহলে কি স্বাভাবিক থাকা যায়?
ওদিকে সে ঘটনার পর থেকে আরিফের অবস্থা আরও করুণ। ঘটনার রাতে সে খায়নি। মেসের বন্ধুরা তাকে প্রবোধ দিয়ে মানাতে বিফল হয়েছে। সারা রাত চলে তার আর্ত অনুশোচনা। রাতে শুয়ে শুধু হা-হুতাশ আর এপাশ ওপাশ করে। আর বলে, হায় আমি এ কী করলাম, কী করলাম রে আমি!
এরপর থেকে আরিফ আর তার বন্ধুদের সহ্য করতে পারে না। একেবারে স্তব্ধবাক হয়। সারক্ষণ শুধু শুয়ে থাকে। ক্লাসে যায় বিষণœ মনে। ফিরে এসে আবার গুমোট মনে শুয়ে থাকে। পড়ালেখায় মন নেই তেমন। বাড়ির কারও সঙ্গেও তেমন যোগাযোগ করেন না। বন্ধু মহলে একই জিজ্ঞাসা, এ কী হলো আরিফের?
ক্লাসেও ছড়ায় আরিফের বিষণœতার কারণ। বন্ধুরা তাকে স্বাভাবিক হতে সাহায্য করে। তার মনের গুমোট আবহ কাটাতে বন্ধুরা তাকে নিয়ে পিকনিকের আয়োজন করতে বলে। আরিফ সম্মত হন না। সুজন তাকে পরামর্শ দিয়ে বলে, তুই না হয় আবার নাশিদাকে ফোন করে ভুল স্বীকার কর!
-চেষ্টা করি নাই মনে করছস! সে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে বসে আছে।
ওদিকে নাশিদার মাঝেও বর্ষায় পাহাড়ি ঢলের উচ্ছ¡াস আর নেই। কেমন যেন শীতের নদীর মতো হয়ে গেছে। আরিফ ফোন করলে বুঝতে পেরে মোবাইল ফোন অফ করে রাখে। নাশিদার বুকে এখন চাপচাপ কষ্ট। কখনো সে কষ্টের বরফ সামান্য গলে চোখের নদীতে প্রবাহের সৃষ্টি করে। মানুষের কষ্টমাখা চোখের এত জল সচরাচর গড়ায় না। ভেতরে জমে ওঠা কান্নাগুলো ঝরাতে না পারায় সেগুলো পাথর হয়ে প্রথম যৌবনের বেসামাল অনুভ‚তিগুলোকে কেমন যেন ভোঁতা করে দিচ্ছিল। হঠাৎ এক বিকেলে মুঠোফোন বেজে উঠে। অনুভ‚তিহীন মানুষের মতো মোবাইল ফোনটা কানে তুলে। তখন ওপাশ থেকে আরিফ বলেন, আমি জানি, ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছি নাশিদা। ভুল করেছি, তাই বলে কি ক্ষমা করবে না। বিধাতাও তো ক্ষমা চাইলে পাপীকে ক্ষমা করে দেয়।
এভাবে আরিফ সমর্পিত কণ্ঠে বলে যায়। কিন্তু নাশিদা ততক্ষণে মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেয়। নাশিদার বিষণœতা পরিবারের সদস্যদের উদ্বেগের কারণ হয়। ক্লাসের বান্ধবীদের মাঝেও আলোচনার প্রসঙ্গ হয়। নাশিদাকে এভাবে স্তব্ধবাক হয়ে বসে থাকতে দেখে মা চিন্তিত। কারণ উদ্ঘাটনের জন্য তার এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবীকে ফোন করে বাসায় আসতে বলেন। বান্ধবী শাহরিন নাশিদার মাকে বলে, ঠিক আছে, আমি বিষয়টা দেখতেছি খালাম্মা।
শাহরিন যদিও নাশিদার প্রণয়ঘটিত বিষয়টা কিছুটা জানত। তবে বিস্তারিত জানত না। বিকালেই নাশিদার সঙ্গে বসে শাহরিন। নাশিদা বিশ্বস্ত এ বান্ধবীকে সব খুলে বলে। সব শেষ প্রসঙ্গটি উল্লেখ করে বলে, আরিফ তার ভুলের জন্য ক্ষমাও চাচ্ছে।
সব শুনে শাহরিন বলে, তাহলে আর বাধা কোথায়? আমার এক কাজিনের নাম সজিব। সে-ও সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ক্লাসে পড়ে। ওকে বলব, আরিফের বাড়ির খোঁজখবর নিতে। যদি যুথসই হয় তাহলে আরিফের ডাকে সাড়া দিবি; নচেৎ না।
এই বলে শাহরিন চলে আসে। দু’দিন পর আবার বিকালে উপস্থিত হয় শাহরিন। নাশিদাকে ইতিবাচক তথ্য দিয়ে শাহরিন বলে, বেচারা আরিফ নাকি তোর জন্য পাগলপ্রায় হয়ে গেছে। আহার-নিদ্রা ঠিকমতো করে না। বাড়ির সঙ্গেও নাকি যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। এ জন্য তার পরিবারও নাকি বেশ উদ্বিগ্ন। তুই আর বেচারা আরিফের প্রতি অবিচার করিস না। এ ব্যাপারে আমি খালাম্মার সঙ্গে আলোচনা করেছি। ছেলেটির ব্যাপারে খালাম্মারও দ্বিধা নেই। বলেছেন, পড়ালেখা শেষ হলে একটা চিন্তা তো করতেই হবে। এখন তুই ভেবে দেখ!
এই বলে শাহরিন চলে যায়। আরিফের বিপন্ন আবস্থার কথা শুনে নাশিদা নিজের বুকের কষ্টের বাটখারায় কষ্ট মাপে আরিফের। ঠিক তখনি পাগলপারা আরিফের ফোন আসে। নাশিদা ভাবে, আজও কি নিরুত্তর থাকবে?