আধুনিক বাংলা সাহিত্যের জনক, বাংলা সাহিত্যের নবযুগের অনিন্দ্যসুন্দর প্রতিভার অধিকারী, বাংলা ভাষার প্রথম আধুনিক কবি, অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক, বাংলা নবজাগরণের কালজয়ী স্রষ্টা ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ এবং বাংলা কবিতার প্রথম বিদ্রোহী কবি মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের 'স্বদেশ চেতনা ও বাঙালি জাতীয়তাবোধ' নিয়ে বিষদ গুরুত্ব ও আলোচনার শুরুতেই তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য চিন্তাচেতনা ভাবভাবনা বিশ্বাস-অবিশ্বাস মানসিক গভীর আস্থাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। উলিস্নখিত বিষয়টি বুঝতে ও জানতে পারলে তখনই মধুসূদনের স্বদেশ চেতনা ও বাঙালি জাতীয়তাবোধ বিষয়টি আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। এছাড়া, 'স্বদেশ চেতনা ও বাঙালি জাতীয়তাবোধ' বিষয়টি কি এবং কেন পাঠক মাত্রই উপলব্ধিতে মননে বিশ্বাসে চেতনায় মধুসূদনের সাহিত্য সৃষ্টির রহস্য উদ্ঘাটনে সক্ষম হবে। আর সময় এটাকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় এনে পাঠকের সামনে একান্তে সৃজন ও মননশীলতার আবরণে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। জানি যে, কবি মধুসূদন ব্যক্তি জীবনে হিন্দু না মুসলিম এবং মুসলিম না খ্রিষ্টান ছিলেন এটা বড়ো কথা না, কথা হলো তিনি ছিলেন একজন খাঁটি বাঙালি। বাংলা তার মাতৃভাষা, বাঙালি জাতীয়তাবোধ তার বিশ্বাসের জায়গা। পৃথিবীর সব দেশে সবকালে প্রকৃত ভালো লেখকরা তার সাহিত্যের মধ্যে স্বদেশ চেতনা ও জাতীয়তাবোধের চেতনাকে ধারণ করে থাকে। মধুসূদনও দক্ষতার সহিত এটাকে ধারণ করেই নিপুণ হাতে অনবদ্য সাহিত্য সম্ভার সৃষ্টি করেছেন। একজন বিদগ্ধ সচেতন নিরপেক্ষ পাঠক মাত্রই জানেন যে, আমাদের বাঙালি রেনেসার কালজয়ী প্রতিভাবান শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে মধুসূদনের সৃজনশীল বৈচিত্র্যময় সাহিত্যে স্বদেশ চেতনার চিন্তা ভাব ও ভাবনার ঐকান্তিক রূপ-রসের কত বেশি বিকাশ ঘটেছে। আর তাই সুদূর ভার্সাই নগরে থেকেও কবি তার স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা দেশের কথা শৈশব জীবনের হাজারো মধুময় স্মৃতি এতটুকু ভুলে যাননি বলেইতো তিনি তার অমর সৃষ্টি 'কপোতাক্ষ নদ' শীর্ষক কবিতায় স্বদেশের একটি নদের জলকে গর্ভধারিণী জননীর দুধের সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে প্রবল আবেগে আপস্নুত হয়ে এভাবেই মনের অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেছেন- 'সতত হে নদ, তুমি পড় মোর মনে,/সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে ; সতত (যেমতি লোক নিশার স্বপনে শোনে মায়া-মন্ত্রধ্বনি) তব কলকলে/জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে ! বহু দেশে দেখিয়াছি বহু নদ-দলে,/কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে? দুগ্ধ-স্রোতরূপী তুমি জন্ম-ভূমি-স্তনে..........!' আসলে একথা আজ সর্বজনবিদীত যে, মধুসূদন তার সাহিত্যে বাঙালি জাতীয়তাবোধকে অনেক বেশি জাগ্রত ও বিনির্মাণ করেছে। ফলে বাংলা কাব্যজগতে মধুসূদনের আবির্ভাবের কারণেই বাংলা সাহিত্যে বাঙালির মনে মননে ও বিশ্বাসে এক নতুন আশা-আকাঙ্ক্ষার দীপ্ত আলো আলোকিত হয়ে ধরা দিয়েছিল। তার 'কপোতাক্ষ নদ' কবিতাটি তারই জলন্ত উদাহরণ হয়ে কালের সাক্ষী হয়ে আছে। বাংলা সাহিত্যে অনেক বড়ো বড়ো কবি সাহিত্যিকের আবির্ভাব হয়েছে এবং তারা বাংলা ভাষায় কাব্য কথাসাহিত্য গদ্য ইত্যাদি নির্মল সাহিত্যের জন্ম দিয়েছেন। কিন্তু দেশের কোনো নদীকে কাব্যে তুলে ধরেছেন কয়জ'না তার হিসাব মেলে না। অথচ মধুসূদন তার কবিতায় তার শৈশব কৈশর ও যৌবনের স্মৃতির সাক্ষী প্রিয় কপোতাক্ষ নদকে এক দুর্লভ জীবন্ত রূপ দান করেছেন। এখানেই মধুসূদনের বিশেষ শক্তিময়তা ও সত্ত্বা লুকায়িত রয়েছে। মূলত মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যকে একেবারে স্বদেশ প্রেমের রঙে রাঙিয়ে উন্মুক্ত নীলাকাশের গায়ে রঙধনুর মতো অপরূপ সৌন্দর্যের নান্দনিক এক লীলাক্ষেত্র তৈরি করেছে। আর এখানেই স্বদেশ চেতনা ও বাঙালি জাতীয়তাবোধ সম্পূর্ণ আপন সত্ত্বা পরিপূর্ণ অখন্ড ভাব ও ভাষা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। এটাকে অস্বীকার করা যাবে না। কবি মধুসূদনের চিন্তাচেতনায় ভাবনায় বিশ্বাসে ও তার সাহিত্যে স্বদেশ চেতনা এবং জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটেছিল বলেই না তিনি আজ আধুনিক বাংলা কবিতার জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছেন। কেননা, একজন যুগসচেতন কবি হিসেবে মধুসূদনের অবদান বাংলা কাব্যকে অনেক বেশি সমৃদ্ধ ও বিকশিত করেছে। অবশ্য আমরা একথা নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, বিগত উনিশ শতকের বাংলা কবিতার নবজাগরণের অন্যতম ব্যক্তিত্ব এবং শক্তিমান প্রধান কবি মধুসূদনের ক্ষণকালের বর্ণাঢ্য যাপিত জীবনে একদিকে যেমন স্বদেশ চেতনার যারপরনাই উন্মেষ ঘটেছে তেমনি আবার তার গোটা বৈচিত্র্যময় সৃজনশীল সাহিত্য কর্মের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবোধের প্রসার অত্যাধিক লাভ করেছে। মোটকথা, স্বদেশ চেতনা ও বাঙালি জাতীয়তাবোধ নিরেট মৌলিকসত্তার মতো কবিকে জাগিয়ে তুলেছে। আর সবকিছু মিলেই কবি মধুসূদনকে এক অনন্য রূপে কালের সামনে দাঁড় করিয়েছে। তার চেতনায় স্বদেশ ভাবনা বিস্ময়করভাবে প্রকাশ হয়েছে। আর তাই তার সাহিত্যে স্বদেশ চেতনা প্রতিটা পাঠককে মুগ্ধ ও অবাক করেছে। আসলে স্বদেশ চেতনা ও জাতীয়তাবোধ মধুসূদনকে এতটাই আলোকিত করেছে যে, তিনি সমাজ ও ধর্মের প্রচলিত প্রথাকে ভাঙতে ও অস্বীকার করতেও এতটুকু পিছপা হননি। অনেক প্রথাকেই তিনি প্রশ্নের সম্মুখীন দাঁড় করিয়েছেন। যদিও এই জন্য তাকে সমাজের কাছ থেকে কটূূক্তি বদনাম শুনতে হয়েছে। তার প্রতি বাঁকা চোখে তাকানো হয়েছে। কিন্তু এতকিছুর পরেও মধুসূদন নো-কেয়ার করে তার সাহিত্য ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে আগামীর দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। আজ একথা দিবালোকের মতো সত্য যে, কালের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর প্রতিবাদী মুখ মহাবিদ্রোহী মহাকবি মধুসূদনের সমগ্র সাহিত্যে অর্থাৎ তার কি কবিতায়, কি নাটকে, কি প্রহসনে এবং কি তার মহাকাব্যে মূলত স্বদেশ চেতনা ও বাঙালি জাতীয়তাবোধেরই সফল জাগ্রত রূপই প্রকাশ পেয়েছে। আর এ কারণেই বাংলা সাহিত্য বলি কিংবা বাংলা কাব্য-মহাকাব্য যাই বলি না কেন, কবি মধুসূদনের কাছে ঢের বেশি ঋণী হয়ে আছে। মধুসূদনকে উপেক্ষা করলে বাংলা সাহিত্য বাংলা কাব্য বাংলা মহাকাব্য আপন শক্তিতে দাঁড়াবার ক্ষমতায় হারিয়ে ফেলবে। কাজেই যতদিন বাংলা সাহিত্য-কাব্য-নাটক ও মহাকাব্য থাকবে ততদিন মধুসূদন মহিরুহ হয়ে সৃজনশীলতার আলো ছড়াবে। এমন কে আছে ধর্মের জিকির তুলে মধুসূদনকে দূরে ঠেলে দেবে, কে আছে নিজ ভাষা-সাহিত্যকে অবজ্ঞা অবহেলার অজুহাত তুলে তাকে উপক্ষো করবে; এই দুঃসাহস জানি কেউই দেখাতে পারবে না। কেননা, মধুসূদন স্বদেশ চেতনা আর বাঙালি জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাহিত্য রচনা করেছিলেন বলেই তিনি আজ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের জনক হতে পেরেছে, বাংলা সাহিত্যে প্রথম মহাকাব্য রচনা করে বাংলা কাব্যকেই সম্পূর্ণ নতুন রূপে তুলে ধরেছেন এবং গোটা বিশ্বকে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে, আমরা বাঙালিরা দেশপ্রেমে চেতনায় জাতীয়তাবোধে অন্যদের চাইতে অনেক অনেক বেশি স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছি এবং তা পারিও বটে। অবশ্য এটা ঠিক যে, কবি মধুসূদন তিনি পাশ্চাত্য অনুসারে অনুকরণে (ইতালির কবি পেত্রার্ক সনেটের জনক) চতুর্র্দশপদী কাব্য রচনা করেছেন। তবে তিনি তার কবিতাকে নিজের বিশ্বাস ও আস্থা থেকেই রচনা করেছেন। তিনি নিজের ভাষার নিজের সংস্কৃতির নিজের ইতিহাস-ঐতিহ্যের নিজের স্বজাতির প্রতি দ্বায়বদ্ধতা থেকে সচেতনভাবেই সতত কাব্য রচনা করেছিলেন। এই জন্য আমরা তার গোটা কাব্যজগতে দেশপ্রেমের ছোঁয়া স্বজাতির প্রতি ভালোবাসা আপন ভাষার প্রতি বিশ্বাস ও নিজের সংস্কৃতির প্রতি অকাট্য শ্রদ্ধা এবং আন্তরিকতার প্রকাশ দেখতে পাই। এই জন্য দূর দেশে বাস করেও মাতৃভাষাকে তিনি এতটুকু ভুলে যাননি। মাতৃভাষার প্রতি তার ভালোবাসা কিছুতেই ম্স্নান হয়নি। আর তাইতো তিনি মাতৃভাষার বন্দনা করতে গিয়ে এক অনন্য সার্থক সুন্দর চমৎকার কবিতা রচনা করেছেন। তিনি নিজ ভাষা সংস্কৃতি ঐতিহ্যকে ভুলে অন্যের পরধনে লোভ করাটাকে চরম ঘৃণা করে ক্ষেপে গিয়ে তাই 'বঙ্গভাষা' কবিতায় মূল্যায়নটা করেছেন যথার্থই- 'হে বঙ্গ, ভান্ডারে তব বিবিধ রতন ;/তা সবে (অবোধ আমি!) অবহেলা করি, পরধন লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ/পর দেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি ; কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি।/অনিদ্রায়, নিরাহারে সঁপি কায়, মনঃ মজিনু বিফল তপে অবরণ্যে বরি;/কেলিনু শৈবালে; ভুলি কমল কানন..........!' মহাকবি মধুসূদন দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে এবং জাতীয়তাবোধে নিজেকে শামিল করে তার সব সাহিত্য কর্মকে এক অনন্যরূপে অসাধারণ আঙ্গিকে নতুনের স্পর্শে অভিনব নির্মাণ করে কালের হাওয়ায় আগামীর চেতনায় বাংলার সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্ব দরবারে ছড়িয়ে দিয়েছেন। যেহেতু পাশ্চাত্য ভাষা-শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার প্রতি কবি মধুসূদন অধিক পরিচিত ছিলেন, সেহেতু তিনি স্বদেশ চেতনা ও বাঙালি জাতীয়তাবোধে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলা ভাষা ও বাংলা কাব্যকে পরাধীনতার শিকল ছিঁড়ে বের করে এনেছিলেন। এখানেই তার কাব্য রচনার স্বার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায় এবং স্বদেশ চেতনা জাগ্রত হয়েছে। হ্যা এটা ঠিক যে, মধুসূদন তিনি তার নিজের ভাষা-সাহিত্য-স্বজাতির প্রতি অবজ্ঞা-অবহেলা করেছেন, মাতৃভাষাকে বাদ দিয়ে পরভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, আপন ধর্ম-সংস্কৃতিকে বদলিয়ে অন্যের ধর্ম সংস্কৃতিকে গ্রহণ করেছিলেন; এখন প্রশ্ন হলো তার কেন এই অবজ্ঞা কেন এই অবহেলা? এটা কি শুধুই পরধর্ম ভাষা সংস্কৃতি গ্রহণ করে বিশ্বের মাঝে বড়ো একজন কবি বা লেখক (এলিয়ট, কিটস, বায়রণ, শেক্সপিয়র) হওয়ার জন্যই করেছেন নাকি এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য অথবা চিন্তাচেতনা লক্ষ্য ছিল! আজ নতুন করে এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। অতএব, কবি মধুসূদনের গায়ে হরহামেশা যে অপবাদ বা ছিল আমরা এটে দিচ্ছি সেটা আমরা কতটুকু জেনে বুঝে ভেবে করছি তাও আমাদের ভাবতে হবে। আসলে আমরা একটু খেয়াল করলে দেখতে পাব যে, তিনি যখন জন্মেছেন তখন বাংলা কবিতার আকাল চলছিল এবং বাংলা সাহিত্য মৃতপ্রায় অবস্থার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছিল। এমতাবস্থায় মধুসূদন এসে বাংলা কবিতার হাল ধরলেন। বাংলা কাব্যকে নতুন করে জন্ম দিলেন। একটি কথা এখানে অপ্রিয় হলেও বলতে চাই যে, বিগতকালে কিংবা বর্তমানে অনেক সুন্দর মানসম্মত বাংলা কাব্য-কথাসাহিত্য বাংলাতে রচনা হলেও বা করলেও কি আন্তর্জাতিকভাবে নোবেল (!) পুরস্কার কিংবা ম্যান-বুকার প্রাইজ (!) বাঙালিদের অর্জন হবে কি? হয়তো বা হবে না। আর না হওয়ার পেছনের একটিই কারণ তা হলো সাহিত্যকর্মকে বাংলাতে লেখা। তবে কি আমরা বাঙালিরা পদক কিংবা পুরস্কার পাওয়ার জন্য বাংলাতে লেখা ছেড়ে দেব অবশ্যই না। আসলে উলিস্নখিত পুরস্কারদ্বয় অর্জন বাংলাতে ভালো কিছু লিখলে হবে না, এটা শুধু ইংরেজিতেই লিখতে হবে। অবশ্য এই নিয়ম আগামীতে পরিবর্তন হবে কিনা জানি না, তবে পরিবর্তন হলে অনেক ভাষা থেকে ভালো ভালো সাহিত্য বেরিয়ে আসবে। আর তাই মধুসূদনের নিজ ভাষা-স্বজাতিকে বাদ দিয়ে অন্য ভাষাতে লিখতে যাওয়াটা তেমন দোষের কিছু না। একথা আমাদের মানতেই হবে যে, দেখা দৃষ্টিতে তিনি তার ভাষা-ধর্ম-দেশ-জাতিকে ছাড়লেও মনেপ্রাণে তিনি তার আপন বলতে যা বোঝায় কোনো কিছুকেই অস্বীকার করেননি বা ভোলেননি। যদি ভুলতো তবে তিনি বিদেশে বসবাস করেও দেশের তরে ভাষার তরে জাতির তরে এভাবে নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারতেন না। অন্তরে গভীরে নিজ ভাষাকে চরম আপন করে ভেবেছিলেন তাই বাংলা কাব্যে আজ এত বৈচিত্র্যময় কাব্য সাহিত্যকর্ম রচনা করতে পেরেছেন। বাংলা কাব্যকে নতুনের মোড়কে উদ্ভাষিত করেছেন, প্রচন্ড প্রতিভার জোরে মহাকাব্য সৃষ্টি করে পৃথিবীকেই অবাক করে দিয়েছেন। এই সবকিছু মিলে আমাদের কাছে মধুসূদনের ব্যক্তিগত জীবন না তার অপার সাহিত্য জীবনই বারংবার মুখ্য হয়ে উঠেছে এবং উঠবে। কবি মধুসূদন তার বন্ধুবর রাজনারায়ণ বসুকে লেখা (বিলেতে যাওয়ার পূর্বে) এক চিঠিতে তিনি তার 'বঙ্গভূমির প্রতি' কবিতায় মাতৃভূমির প্রতি তার নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ও পরম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। কবি যে এই বঙ্গভূমি মাতৃভূমি মায়ের একজন দাস ও মা মাটি দেশ যেন তাকে না ভুলে মনে রাখে এবং কবি যেন বিস্মৃতির একেবারে আড়াল হয়ে না যান সে কথা তিনি একান্তে নিবেদন করেছেন- \হ'রেখো, মা, দাসেরে মনে, এ মিনতি করি পদে, সাধিতে মনের সাদ,/ ঘটে যদি পরমাদ, মধুহীন করোনা গো তব মনঃ কোকনদে। সেই ধন্য নরকুলে,/লোকে যারে নাহি ভুলে, মনের মন্দিরে সদা সেবে সর্ব্বজন........... ;
বাংলা কবিতায় যুগস্রষ্টা বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী আত্মচেতনার মূর্তপ্রতীক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের মান্যবর মহাকবি মধুসূদনের চিন্তায় ও বিশ্বাসে স্বদেশ চেতনা ও বাঙালি জাতীয়তাবোধ কতটা প্রভাব ফেলেছে এবং সেটা অতিব শক্ত অবস্থান করে আছে তারই বাস্তব পেক্ষাপট ও চরম সত্যতা মেলে ‘কপোতাক্ষ নদ’ ‘বঙ্গভাষা’ ‘বঙ্গভ‚মি’সহ আরও অনেক অনেক কবিতার পরতে পরতে। একজন লেখক দূরদেশে বসে নিজের দেশের একটি নদকে এতটাই ভালোবেসেছেন এবং মনে রেখেছেন যে, সে নদের স্বচ্ছ কাচের মতো জলকে গর্ভধারিণী জননীর বিশুদ্ধ পবিত্র দুধের সঙ্গে তুলনা করেছেন। একথা ঠিক যে, দেশের একটি নদ বা নদীকে ভালোবাসা প্রেমকরা পবিত্র আসনে বসানোর মধ্যেই মূলত গভীর দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে, ভাষাতো মায়ের মতো। কাজেই মা-কে যেমন অস্বীকার করা যায় না, তেমনি ভাষাকেও কোনো প্রকারেই অস্বীকার করা যায় না। আর ভাষার প্রতি অবহেলা অবজ্ঞা করাটা নিজের সঙ্গেই বিশ্বাসঘাতকতা করার শামিল। কবিতো এমন সত্য ইঙ্গিতই অকপটে বলেছেন।
কলকাতার লোয়ার সার্কুলার সড়কের পাশে মহাকবি মধুসূদনের সমাধিস্থল অবস্থিত। কবির এই সমাধি ফলকে লেখা (মধুসূদনের মৃত্যুর কিছুদিন আগে নিজ স্বহস্তে ) তার এপিটাফে দৃঢ় বিশ্বাস ও অধিকার নিয়ে মনের কথা বলেছেন-
‘দাঁড়াও, পথিক-বর, জন্ম যদি তব
বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধিস্থলে........।’
প্রিয় পাঠক একটু ভেবে দেখুন যে, এখানে এই কবিতায় কবি তিনি তার সমাধিক্ষেত্রে লিপিবদ্ধ এপিটাফে ‘দাঁড়াও’ এর পরিবর্তে দাঁড়ান কথাটি বলতে পারতেন কিন্তু তা বলেননি, বলেছেন দাঁড়াও অর্থাৎ নিজ বঙ্গদেশের কোনো বঙ্গ পথিকের কাছে আপন অধিকারের অভিব্যক্তি এভাবে সম্বোধন করেছেন। আসলে নিজ দেশের, দেশের মানুষের, ভাষার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ভালোবাসা প্রেম বিশ্বাস ছিল বলেই তিনি এমন দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করতে পেরেছেন। কবি মধুসূদন এখানেও সফল ও স্বার্থক।
আমরা যদি বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহাকাব্য হিসেবে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’টিকে রাজনৈতিক পারিবারিক সামাজিক ও সমাজতাত্বিকভাবে বিচার করে দেখি তাহলে দেখতে পাই যে, এই মহান সৌন্দর্য অনুপম মহাকাব্যের মাধ্যমে মধুসূদনের মধ্যে লুকায়িত স্বদেশ চেতনা এবং জাতীয়তাবোধেরই প্রতিফলন ঘটেছে এবং তা মেঘনাদবধ কাব্যের চরিত্রের মধ্যে প্রকাশ করেছেন। এখানে দেশপ্রেমের এক অতিসুন্দর অকাট্য ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি কবি মধুসূদন অমিত্র-ছন্দে তুলে ধরেছেন। আর প্রকাশ পেয়েছে অপার দেশপ্রেমের কাব্যিক পরিচয়। এছাড়া এই মহাকাব্যে রাবণপুত্র ইন্দ্রজিতের দেশপ্রেমের প্রতি উদ্বুদ্ধের ভাষণ, বিভীষণের মনেপ্রাণে ও বিশ্বাসে দেশপ্রেম এবং প্রিয় লঙ্কার স্বাধীনতা রক্ষার জন্য কঠিন লড়াই-সংগ্রামের কথা সাবলিলভাবে উঠে এসেছে স্বদেশ চেতনাকে সামনে রেখে। পাশাপাশি আদরের সন্তান হারাবার আকুলতা ক্রন্দন বিষাদ পিতা রাবণের মধ্যে দিয়েও প্রকাশ পেয়েছে। মেঘনাদবধ মহাকাব্যে স্বদেশ চেতনা জাতীয়তাবোধ মানবতা ও প্রেমের জয়গান ফুটে উঠেছে। প্রতিবাদের দীপ্ত ভাষায় বিদ্রোহের সুরে মানবিকতাবোধ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই কাব্যটির পাতায় পাতায় কবি মধুসূদনের স্বদেশপ্রেম, স্বদেশ চেতনা, স্বদেশবোধ ও স্বাজাত্যবোধেরই আত্মপ্রকাশ লাভ করেছে। মূলত সনেট কবিতা, অন্য কবিতা, নাটক, ট্র্যাজেডি, পত্রকাব্য, গদ্য, মহাকাব্য কিংবা প্রহসনের ন্যায় মেঘনাদবধ কাব্যে স্বাদেশিকতার পরিচয় জোড়ালোভাবে প্রকাশ হয়েছে। ইতিহাস-ঐতিহ্য, পুরাণকাহিনী, ধর্ম, বিশ্বসাহিত্য, সৃষ্টিশীল ক্ষমতা-জ্ঞান আর চিন্তাবোধের প্রতি মধুসূদনের জানা-দেখা-বোঝার নিরিখ ছিল বলেই আমরা এই মহাকাব্যের মধ্যে স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল, দেব-দানব-মানব, ক্রোধ-করুণা-বেদনার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এক কাব্যসৌন্দর্য রূপ অবলোকন করতে পারি। বাংলা সাহিত্যে এই মহাকাব্যটি স্বদেশ চেতনা ও জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়েই অনন্য অসাধারণ এক বিরল সৃষ্টির স্বাক্ষর বহন করে আছে।
এছাড়া শিল্পনিষ্ঠা মনের অধিকারী কবি মধুসূদনের অমিত্রাক্ষর ছন্দে পত্রাকারে রচনা ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যটিতে পৌরাণিক কাহিনীর নারীরা এখানে খুউব প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে। এখানে কবি মধুসূদন ভারতীয় পুরানন্ধিত নারী চরিত্রগুলোকে মাধ্যম করে এই বীরাঙ্গনা কাব্যটি সৃষ্টি করেছেন। আমরা জানি যে, ধর্মের ভয় ও কথা বলে আবহমানকাল ধরে ভারতীয় হিন্দু সমাজে ও জীবনে নারীদের নির্যাতন অত্যাচার অপমান করা হয়েছে। আর তাই এই সমাজের নির্যাতিত নিষ্পেষিত অবহেলিত লাঞ্চিত নারীরা পুরুষের সমাজব্যবস্থা ভেঙে, ধর্মের গোড়ামীর ছেকল ছিঁড়ে, শাসকের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে দৃঢ় প্রত্যয়কে ধারণ করে আপন অধিকারের স্বপ্নকে বুকে নিয়ে চরম বিদ্রোহ করেছে সব অন্যায় জুলুম অত্যাচার আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে। এসব নারীকে কবি মধুসূদন স্বদেশ চেতনার প্রতিক হিসেবে এই বীরাঙ্গনা কাব্যকে পাঠকের সামনে দাঁড় করিয়েছেন। কবি মধুসূদনের অন্তরে যে বোধ ভাব বিশ্বাস শক্তি সত্য ধারণা এবং মুক্তি ও চেতনা জাগ্রত তা তিনি এই কাব্যে নারীদের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন। নারীরা মাটির পুতুল নয় যে, এদের সোকেচে কিংবা ঘরের মধ্যে আটকিয়ে রাখতে হবে। নারীরাও মানুষ, তাই কবি মধুসূদন নারীদের ঘরের বাইরে বের করে এনেছেন। আর নিজেদের দাবি ও অধিকারের কথা দৃঢ় কণ্ঠে বলিয়েছেন এবং অসত্য অন্যায় বৈষম্য ও জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী করে তুলেছে। কবি মধুসূদন স্বাধীনতা মুক্তির কথা বিশ্বাস করতেন, তাই তিনি নারীদেরও ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ও মুক্তির প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন বীরাঙ্গনা কব্যে। এখানে স্বাতন্ত্র্য ব্যক্তিত্ব ও সমমর্যাদার অভিপ্রায় নিয়ে নারীরা জীবনসত্যর জয়গান গেয়ে নির্ভীকচিত্তে স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধের ঝান্ডাকে সমুন্নত করে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। মূলত এই পত্রাকাব্যে নারীরা অপার প্রেম ও ভালোবাসার মূলশক্তিতে বীরাঙ্গনা হয়ে ওঠার পাশাপাশি তাদের ব্যক্তিত্ব স্বাধীনতা ইচ্ছেশক্তি সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছেন।
পরবর্তীকালে অনেক পুরস্কারের সঙ্গে, সে সাহিত্য পুরস্কারই হোক বা অন্য কোনো বিষয়ই হোক, বিজ্ঞাপন পণ্যের নাম সংযুক্ত হতে দেখা যায়।
সুগন্ধি ব্যবসায়ের পাশাপাশি সাইকেল কারখানা, ছাপাখানা, মোটরগাড়ি ও ক্যামেরা বিক্রি প্রভৃতি নানা রকমের ব্যবসায়ের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন।
হেমেন্দ্র মোহনের পরবর্তী অর্জন গ্রামোফোন রেকর্ডস। ১৯০০ সালে তিন পাশ্চাত্য থেকে গ্রামোফোন তৈরির প্রযুক্তি আমদানি করে কলকাতায় একটি গ্রামোফোন রেকর্ডিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর মাধ্যমে গ্রামোফোন রেকর্ড প্রস্তুত ও বিতরণ শুরু করেন। এ ক্ষেত্রেও তিনি ভারতীয়দের মধ্যে প্রথম এবং এ ব্যবসায় তার সাফল্য পূর্ববর্তী সব অর্জনকে ছাড়িয়ে যায়। বাজারে তার রেকর্ড ‘এইচ বোস’স রেকর্ড’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
তার তৈরি রেকর্ডের মাধ্যমেই জগদীশ চন্দ্র বসু, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং দ্বিজেন্দ্র লাল রায়ের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিদের আবৃত্তি, বাণী ও সাক্ষাৎকার ধারণ করা সম্ভব হয়, বোস’স রেকর্ড বাংলা, হিন্দি ও উর্দূতে অনেক অনুষ্ঠান ধারণ করেন। রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে তারই রচিত গান ও কবিতার রেকর্ডও বের করেন।
১৯০৭ সাল থেকে এইচ বোস’স রেকর্ডের অসংখ্য ডিস্ক বাজারে মুক্তিপায় এবং এর চাহিদা ক্রমশ এতই বৃদ্ধি পায় যে, হেমেন্দ্র মোহন বসু অবিভক্ত ভারতের একজন খ্যাতিমান ও সম্মানিত ব্যক্তিতে পরিণত হন, কারণ তিনি ছিলেন একজন বাঙালি উদ্যোক্তা এবং স্বদেশী আন্দোলন ও জাতীয়তাবাদের ওপর অনেক রেকর্ড প্রকাশ করেছিলেন। ১৯১৬ সালের ২৮ আগস্ট তিনি মারা যান।
গ্রামোফোন তৈরি ও বাণিজ্যিকীকরণের ক্ষেত্রে প্রথম উদ্যোক্তা ছিলেন কলকাতার মানিক লাল শাহা (এম, এল, শ্ব)। এর আগে তিনি ছিলেন একজন সফল হারমোনিয়াম নির্মাতা।
মানিক লাল শাহা লন্ডনের নিকল ফেরেস লি.-এর নিকল রেকর্ডস ও নিকল ফোনের প্রথম ও প্রধান এজেন্ট ছিলেন। তিনি শেষ পর্যন্ত বিখ্যাত ইন্ডিয়ান রেকর্ডস ম্যানিউফ্যাকচারিং কোম্পানি লিঃ প্রতিষ্ঠা করেন। বিংশ শতকের বিশের দশক থেকে গ্রামোফোন ও গ্রামোফোন রেকর্ডস বাঙালি পরিবারে একটি মর্যাদাপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়। যখন স্টেরিও গ্রামোফোন স্থান দখল করেছিল তখন পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত এ প্রবণতা অব্যাহত ছিল।
টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারের জমিদার পরিবারের সন্তান বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ স্যার আব্দুল হালিম গজনবী হলেন প্রথম বাঙালি মুসলমান, যিনি গ্রামোফোন সামগ্রীর ব্যবসায় নেমে প্রভ‚ত সাফল্য অর্জন করেন।
এ ছাড়া মীনা পেশোয়ারি নামক এক অবাঙালি ধনী মুসলমান ১৯২৬ সালে ‘শাহন শাহ’ রেকর্ড কোম্পানি নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
চন্ডীচরণ সাহা, বিভ‚তিভ‚ষণ ও জিতেন্দ্র নাথ ঘোষ তিরিশের দশকের গোড়ার দিকে গড়ে তোলেন স্বদেশী রেকর্ড কোম্পানি ‘মেগাফোন’, ‘হিন্দুস্তান’ ও ‘সেনোলা’।
পরবর্তীতে এদের সাফল্য ও প্রেরণায় কয়েকটি দেশীয় রেকর্ড কোম্পানির জন্ম হয় যেমন- পাইওনিয়ার, ভারত, রিগ্যাল, মেল-ও-ডি এবং কোহিনূর। দেশভাগের আগ পর্যন্ত এই দেশি কোম্পানিগুলো সাফল্যের মুখ দেখেছিল।
গ্রামোফোন বা কলের গান ৮০ বছরের ইতিহাসে এক মহাগৌরব ও অসামান্য খ্যাতি অর্জন করেছিল। গ্রামোফোনকে কেন্দ্র করে বাংলায় যে সঙ্গীত শিল্পী সৃষ্টি হয়েছিল তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন- গওহর জান, লালচাঁদ বড়াল, কে মল্লিক (কাশেম মল্লিক), ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ, ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ, ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খাঁ, ভীস্মদেব চট্টোপাধ্যায়, বিমল দাশগুপ্ত, তুলসী লাহিড়ী, আব্বাস উদ্দীন আহমদ, কাজী নজরুল ইসলাম, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, কুন্দ লাল সায়গল, আঙ্গুর বালা, ইন্দু বালা, শচীন দেব বর্মণ, কাননবালা দেবী, জ্ঞানেন্দ্র প্রসাদ গোস্বামী, বেগম আখতার, সুধীর লাল চক্রবর্তী, কমলা ঝরিয়া, জগন্ময় মিত্র, যুথিকা রায়, পিয়ারু কাওয়াল, কাল্লু কাওয়াল এবং আরও অনেক শিল্পী।
কাজী নজরুল ইসলামকে গ্রামোফোনের (কলের গান) শ্রেষ্ঠ সম্পদ বলা যায়। ১৯২৬ সাল থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত (নজরুল অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত) কাজী নজরুলই ছিলেন গ্রামোফোনের প্রধান গীত রচয়িতা, সুর ¯্রষ্টা ও সঙ্গীতের প্রশিক্ষক।
নজরুল আনুষ্ঠানিকভাবে হিজ মাস্টার্স ভয়েস (এইচ.এম.ভি) গ্রামোফোন রেকর্ড কোম্পানিতে যোগ দেন ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে। নজরুলের নিজস্ব কণ্ঠে গাওয়া কয়েকটি গান গ্রামোফোন থেকে সেই সময় রেকর্ড বের হয়।
আনুষ্ঠানিকভাবে এইচ এম.ভিতে যোগদানের পর নজরুলের লেখা ও সুরে গান গেয়ে অনেক গায়ক-গায়িকা অর্থ ও খ্যাতির শিখরে পৌঁছেন। সেই সঙ্গে এই কোম্পানিও আয় করেছে প্রচুর অর্থ। তবে এইচ.এম.ভি’র মধ্যমণি ‘সুরের জাদুকর’ নজরুলের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন সে সময় হয়নি।
গ্রামোফোন রেকর্ডের সুর সংযোজন ও সঙ্গীত পরিচালনায় আর যাদের স্মরণ করতে হয় তারা হলেন- তুলসী লাহিড়ী, রাইচাঁদ বড়াল, কমল দাশগুপ্ত, হীরেন বসু, সুর সাগর হিমাংশু দত্ত, অনুপম ঘটক, দুর্গা সেন, তিমির বরণ, সুধীরলাল প্রমুখের নাম। নজরুলের লেখা ও সুর করা গানের রেকর্ড এইচ.এম.ভি, মেগাফোন, টুইন, কলম্বিয়া, সেনোলা-পাইওনিওর, হিন্দুস্তান, শাহান শাহ, ভিয়েলোফেন এসব কোম্পানি থেকে শুধু বের হয়নি সমাদরও পেয়েছে। এর পরবর্তী যারা গীতিকার হিসেবে গ্রামোফোন কোম্পানিতে নাম করেন তারা হলেন- প্রণব রায়, হীরেন বসু, শৈলেন রায়, অজয় ভট্টাচার্য, সুবোধ রায়, মোহিনী চৌধুরী, পবিত্র মিত্র এবং আরও অনেকে। এক সময় গ্রামোফোন ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। সৌখিন ব্যক্তিরা বিভিন্ন শিল্পীর গানের রেকর্ড সংগ্রহ করে রাখতেন। সে সময় বাংলার ঘরে ঘরে গ্রামোফোনে গান শোনাটাই ছিল বিনোদনের সেরা মাধ্যম।
জ্ঞানের অসামান্য অগ্রগতির ফলে নতুন প্রযুক্তির কাছে হার মেনে গ্রামোফোন বা কলের গান কয়েক দশক আগেই বাঙালির জীবন থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে।
এখন শুধু স্মৃতির বেদনা হয়ে পড়ে আছে কলের গান।
অত্যাধুনিক ডিজিটাল যন্ত্রপাতির যুগে গ্রামোফোন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। নবপ্রজন্ম আর প্রকৃত গ্রামোফোন বা কলের গান চিনবে না। বাংলার ঘরে ঘরে কলের গান আর কখনো বাজবে না।
এখন গ্রামোফোন বা কলের গানের চেহারা বদলিয়ে আধুনিক রেকর্ড প্লেয়ার, ডিস, স্টেরিও এবং সিডি করা হয়েছে। এগুলোর পূর্বের রূপই হলো গ্রামোফোন বা কলের গান।