কবি জাহিদুল হকের ধ্রম্নপদ সাধনা

প্রকাশ | ১৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

শিমুল সালাহ্‌উদ্দিন

স্পষ্টভাষী মিতবাক কবি জাহিদুল হক, জাহিদ ভাইয়ের সঙ্গে প্রথম কবে দেখা হয়েছে ভুলেই গেছি প্রায়। বইমেলায়, টেলিভিশনে, নানা কবিতার আড্ডায় জাহিদ ভাইকে দেখেছি। স্মৃতি হাঁতড়ে যেটি মনে পড়ছে সেটির সময়কাল ২০১৩ এর নভেম্বর (৩০), অধুনালুপ্ত নতুনধারার আয়োজন কবিতা পড়তে গিয়েছিলাম পাবলিক লাইব্রেরির সেমিনার হল দুইয়ে। সে আয়োজনের আমন্ত্রণপত্র ঘেঁটে দেখতে পাচ্ছি নতুনধারা সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান ও অতিথি সম্পাদক ফরিদ কবির কর্তৃক প্রেরিত সে আমন্ত্রণপত্র অনুসারে সেখানে কবিতা পাঠের জন্য আমার পাশাপাশি আমন্ত্রিত ছিলেন কবি জাহিদুল হক। আরো ছিলেন আনোয়ারা সৈয়দ হক, শামসুল ফয়েজ, মুজতবা আহমেদ মুরশেদ, কামরুল হাসান, আহমেদ স্বপন মাহমুদ, নভেরা হোসেন, সোহেল হাসান গালিব এবং আলতাফ শাহনেওয়াজ। প্রায় এক দশক আগের ঘটনা, তবে আমার আবছা মনে আছে আমার প্রকাশিতব্য বই কথাচুপকথা থেকে দুই কি তিনটি কবিতা আমি পড়েছিলাম। কবিতা পাঠের শেষে আড্ডায় আমাকে আলাদা করে ডেকে কথা বললেন জাহিদ ভাই, মুগ্ধচোখে- স্নেহাতুর কণ্ঠে। ছন্দ ও শব্দপ্রয়োগের প্রসংশা করেছিলেন, বইটা কারা বের করবে শুনে নিয়েছিলেন। বলেছিলেন রেডিওতে যেতে, শাহবাগেই অফিস! একটি ২৪ ঘণ্টার সংবাদমাধ্যমের কর্মীর যা হয়, কথা রাখতে পারিনি, যাওয়াও হয়নি জাহিদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে। দেখা হলেই মনে হতো আহা জাহিদ ভাই বলেছিলেন, আমি তো গেলাম না। আদতে জীবনের এত টানাপড়েন, সোনায় সোহাগার মতো মিলন আর আমাদের হলো কই! এরপরের মোলাকাতটি অবশ্য কবিতাবাংলার আয়োজনে, ৯ আগস্ট ২০১৪, কাঁটাবনে। কবিতাবাংলা আয়োজিত চেতনকবিতার দ্বাদশ আয়োজনে। আমাকে আয়োজকরা জানিয়েছিলেন আমার কবিতার বই 'কথাচুপকথা' নিয়ে আলাপ করবেন একজন অগ্রজ কবি। তার নামটি আমাকে বলেননি। তড়িঘড়ি করে অফিসের কাজ শেষ করে ও অন্যদের ঘাড়ে কিছু কাজ চাপিয়ে দিয়ে যখন গিয়ে পৌঁছলাম তার অনেকক্ষণ আগে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। ব্যানারে দেখি আমার কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ, আরেকটা কথাসাহিত্যের বইয়ের পাশে। তা নিয়েই নাকি আলোচনা করবেন অধ্যাপক মোহাম্মদ মুনিরুজ্জামান. কবি সানাউল হক খান, মুহম্মদ নূরুল হুদা, জাহিদুল হক, মতিন বৈরাগী ও ফরিদ আহমদ দুলালের মতন অগ্রজজনরা। বেশ একটু অবাক হলাম। তো এক্সটেম্পোর আলাপ করলেন আমার বইটি নিয়ে দুজন। সানাউল হক খান এবং জাহিদুল হক। জাহিদ ভাইয়ের কবিতার পঠনপাঠন থেকেই আমার তিনি খুব প্রিয় কবি হয়ে উঠেছিলেন, তো তিনি সেবার যে প্রশংসাপূর্ণ আলোচনা করলেন তা থেকে নিশ্চিত হলাম বাকিদের কেউ পড়ুন কী না পড়ুন জাহিদুল হক এবং সানাউল হক খান বইটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছেন। কি প্রশংসা করেছেন তা আর না বলি, সে এখানে প্রাসঙ্গিকও নয়। প্রাসঙ্গিক হলো, কবি জাহিদুল হকের নজর ও চয়েস। নতুনধারার আয়োজনে কবিতা শুনে একজন অতি তরুণ্যের নাম মনে রাখা, বইটি নিজের আগ্রহে জোগাড় করা এবং স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও সুযোগ পাওয়ামাত্র সেই তরুণের বুক কাব্যের আত্মবিশ্বাসে ফুলিয়ে দেয়ার মতো একটি 'কান্ড' ঘটিয়ে ফেলা। এরপর বহুবার জাহিদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে, দেখা হলেই দুষ্টুমি করতেন, কী মিঞা, ললাটভাসা রোদে কি ছায়া পড়েছে নাকি, সঙ্গে কেউ নেই কেন? তারপর ধীরে ধীরে খোঁজখবর নিতেন, কাজের কি খবর কি করছো কি পড়ছো। আমি খোঁচাতাম আচ্ছা জাহিদ ভাই মুজতবা আলীর ইন্টারভিউ করেছিলেন ওই গল্পটা বলেন না! কিংবা সুচিত্রাকে কি সেদিন আসলেই চুমু খেয়েছিলেন জাহিদ ভাই! আমাদের জাহিদ ভাই, কবি জাহিদুল হক লজ্জায় লাল হয়ে যেতেন। বলতেন, কী সব তিলকে যে তোমরা মুখে মুখে তাল বানাও। আমি কবিগিরি ব্যবহার করে শুধু দেখা করতে গিয়েছিলাম। আমরা বলতাম, না জাহিদ ভাই আপনি বলছেন না, এড়িয়ে যাচ্ছেন। নইলে তারপর বারবার আপনি কোলকাতা কেন যেতেন! জাহিদ ভাই হাসতেন, তার সেই প্রাণখোলা হাসি। মাঝে মাঝে ক্ষেপে গিয়ে বলতেন আমাকে আবুল হাসান ভেবো না, আমি কিন্তু অকৃতদার; ডুব দেই কিন্তু ভিজি না! আমরা হেসে উঠতাম। (জাহিদ ভাই পরে ২০১৭ সালে বিয়ে করেছিলেন, মাত্র বছর দুয়েক পর তার স্ত্রী মারা যায়, সে আরেক ট্র্যাজেডি) পূর্ব-পশ্চিমের যশোর সাহিত্য উৎসব কিংবা বাংলামোটরের জহুরা টাওয়ারে কবিতার আয়োজনে দেখা হয়ে গেল জাহিদ ভাইয়ের সঙ্গে। সব কবিরা যেখানে কবিতা পড়লেন দেখে দেখে জাহিদ ভাই মূর্তিমান ব্যতিক্রম। টানা মুখস্ত কবিতা শুনিয়ে গেলেন। তার মধ্যে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবার আসা সৈয়দ মুজতবা আলীর ইন্টারভিউর গল্প। তখন তিনি রেডিও বাংলাদেশ-এর প্রযোজক। সেদিন সে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা কয়েকজন কবিও। এর মধ্যে সৈয়দ হাসমত জালাল যাবেন উত্তরায়, আমারও গন্তব্য সেদিকে। আয়োজকদের কাঁধে ভার জাহিদ ভাইকেও বাসায় পৌঁছে দেওয়ার। পূর্ব- পশ্চিমের নির্বাহী সম্পাদক চঞ্চল কবীর বললেন, শিমুল ভাই আপনি একটু দায়িত্ব নেন, আমি গাড়ি দিচ্ছি, জাহিদ ভাইকে বনশ্রী নামিয়ে আপনারা উত্তরা যান, হাসমত জালাল ভাইকে ড্রপ করে আমার ড্রাইভার আপনাকে উত্তরায় নামিয়ে আসবে। একে জ্যামের শহর, দুইয়ে বৃহস্পতিবার, কিন্তু দুই কবির সান্নিধ্য পাওয়ার লোভে ঘুরপথ এ যাত্রায় রাজি হয়ে গেলাম। গাড়িতে উঠেই শুরু হলো কবিতার গল্প, হাসমত জালাল এবং জাহিদুল হক দুজনেরই কণ্ঠস্থ নিজেদের অনেক কবিতা, আমার সে তুলনায় কম। কিন্তু কবিতা পাঠ আর গল্পে কখন সময় গেল আর কখন বনশ্রী চলে এলো টেরই পেলাম না। নিজের নায়িকার কথা ভেবে আরব সাগর তীরে দাঁড়ানো এক বিমানসৈনিক সৈয়দ হাসমত জালালের দুর্দান্ত এক কবিতা শোনার পর কবিতার নায়িকার প্রশ্নেই এলো অমোঘ সেই প্রসঙ্গ। সুচিত্রা সেন। জাহিদ ভাইদের আমলের নায়িকা শুধু নন যিনি, যিনি জাহিদুল হকের স্বপ্নের নায়িকা। জাহিদ ভাই ঘোরগ্রস্তের মতো প্রেমিকা চেহারা নিয়ে বলছেন তখন- 'আমি তার আগে কলকাতায় খুব একটা যাইনি। মাত্র দুবার। দ্বিতীয়বারের গল্প এটা বুঝলে। একদিন কফি হাউসে বসে আড্ডা দিচ্ছি। সঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং অপর্ণা সেন। অপর্ণা আমাকে বলেন, আপনাকে তো আগে কখনো দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না। আমি বলি, আমি কলকাতায় আগে মাত্র একবার এসেছি। আসলে কলকাতার প্রতি আমার কোনো মোহ নেই। শুধু দুজন মানুষের টানে দুবার এসেছি। অপর্ণা তখন খুব উৎসুক এবং আহত হলেন। তিনি বললেন, কলকাতা ব্রিটিশ ভারতের ইন্টেলেকচুয়াল হাব, কত শত বিখ্যাত মানুষ এখানে জন্মেছে, থেকেছে, আর আপনি মাত্র দুজন মানুষের আকর্ষণে এখানে এসেছেন! কোন সে দুজন সৌভাগ্যবান বা সৌভাগ্যবতী, নাম জানতে পারি কি? আমি বললাম, অবশ্যই জানতে পারেন। তাদের একজন বুদ্ধদেব বসু, যার সঙ্গে দেখা হওয়ার আর কোনো সুযোগ নেই। অপর্ণা জিজ্ঞেস করলেন আরেকজন, আমি বললাম আরেকজনের সঙ্গেও দেখা হওয়ার সুযোগ নেই, যদিও তিনি বেঁচে আছেন। অপর্ণা জিজ্ঞেস করলেন কে! আমি বললাম, অন্যজন সুচিত্রা সেন। আমার খুব ইচ্ছে এবার তার সঙ্গে দেখা করে যাব। অপর্ণা এমন মুখভঙ্গি করলেন যেন আকাশের চাঁদ হাতে চাইছি। এরপর আমরা অনেকক্ষণ আড্ডা দিয়ে যখন উঠে যাচ্ছি তখন সৌমিত্র বলেন, জাহিদ, সুচিত্রা তো আজকাল কারো সঙ্গে দেখা করেন না, নীরবে নিভৃতে জীবন যাপন করছেন। আমি একজনের ফোন নাম্বার দিই, যোগাযোগ করে দেখতে পারেন। আমি পরদিন হোটেল থেকে ফোন করলাম, এক ভদ্রলোক ধরলেন। তিনি, সুচিত্রা সেনের যিনি দেখাশোনা করেন, একজন বৃদ্ধ লোক। অনিরুদ্ধ বা এমন কোনো নাম। তিনি আমাকে জানিয়ে দিলেন দিদি কারো সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করেন না, আর সাংবাদিক টাইপের কারো সঙ্গে তো নয়-ই। আমি এবার সুর পাল্টে বললাম, আপনি বলবেন আমি একজন কবি, বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুধু তার সঙ্গে দেখা করতে, আমি দিদিকে আমার বইটা দিয়েই চলে যাব, এক মিনিটও বসবো না। অনিরুদ্ধ বললেন, হবে না। তিনি কারো সঙ্গেই দেখা করবেন না। আমি বললাম, ঠিক আছে, আপনি অন্তত দিদিকে আমার কথাটা বলুন, 'না'টা তার মুখ থেকেই শুনি। পরদিন জাহিদ ভাইয়ের হোটেলে ফোন করে সেই ভদ্রলোক জানান, দিদিকে আপনার কথা বলেছি, তিনি আমার ওপর ক্ষেপে গেছেন। আমরা সমস্বরে বলে উঠলাম উফফফ। তারপর? জাহিদ ভাই বলছেন, তখন আমি খুব আহত এবং আশাহত হলাম। আমার প্রিয় নায়িকাকে এক নজর দেখতে পাব না? আমার টাকাও ফুরিয়ে আসছে। সেই হোটেল ছেড়ে দিয়ে একটি সস্তার হোটেলে উঠি। কলকাতার হোটেলগুলোর তখন একটা নিয়ম ছিল, কেউ অন্য হোটেলে ট্রান্সফার হলে নতুন হোটেলের ঠিকানা, রুম নাম্বার আগের হোটেলকে জানাতে হতো। আমি তাই করি। পরদিন আমার নতুন হোটেলে সেই ভদ্রলোক ছুটে আসেন। আমি তখন বাইরে ছিলাম, তিনি অনেকক্ষণ আমার জন্য অপেক্ষা করেন। তখন তো আর মোবাইল ফোনের যুগ ছিল না, চাইলেই কারো সঙ্গে যোগাযোগ করা যেত না। আমি ফিরে এলে তিনি আমার ওপর ভীষণ ক্ষেপে যান। আপনি যে হোটেল বদলেছেন, আমাকে জানাবেন না মশাই। তখনই তিনি বলেন, সকালে নাশতার টেবিলে বসে দিদি হঠাৎ বলছেন, হঁ্যা রে তোর বাংলাদেশের সেই কবিটাকে কাল বিকালে আসতে বলিস তো। আপনি খুব সৌভাগ্যবান মশাই, দিদির দেখা পেয়ে যাবেন। আমি তখন বলি, কখন যাব? ঠিক ৫টায়। দিদি কিন্তু সময়ের ব্যাপারে খুব সচেতন। এক মিনিটও যেন দেরি না হয়। আমি ঠিক ৫টায়ই চলে আসব। ঠিকানাটা বলুন, আমি লিখে নিচ্ছি। ঠিকানা লাগবে না মশাই। হোটেল থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি নেবেন, বলবেন সুচিত্রা সেনের বাড়িতে যাব। ৫টা বাজার পাঁচ মিনিট আগেই আমি পৌঁছে যাই। গিয়ে ৫ মিনিট গেটের বাইরে অপেক্ষা করি। ড্রয়িংরুমে আমি বসে আছি। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি আসেন। আমি নিজের নাম বলে তার হাতে আমার বইটা দিই। এরপর বলি, দিদি, অনুমতি দিলে আমার জীবনের একটা ঘটনা আপনাকে শোনাতে চাই, দুমিনিটের বেশি লাগবে না, এটা বলেই আমি চলে যাব। তিনি ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিলেন। আমি আপনার সব সিনেমাই দেখেছি। হারানো সুর দেখতে গিয়ে একটা বিপদে পড়েছিলাম। আমি তখন স্কুলে পড়ি। মা জানতেন আমি আপনার খুব ভক্ত। হারানো সুর তখন আমাদের সিনেমা হলে এসেছে। সন্ধ্যায় পড়ার টেবিল থেকে পালিয়ে সিনেমা দেখতে চলে যাই। রাতে ফিরে এসে যখন খেতে বসেছি, মা আমার ভাতের পেস্নট টেনে নিয়ে যান। বলেন, সুচিত্রা সেনকে গিয়ে বল তোকে ভাত দিতে। একথা শুনে তিনি হাসতে শুরু করেন। তার সেই বিখ্যাত হাসি। এরপর বলেন, সুচিত্রা সেন তোমাকে ভাত খাওয়াবে, তুমি খেয়ে যাবে। এরপর অনেকক্ষণ গল্প করি। বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে চেয়েছেন। মাঝে মাঝেই তিনি উঠে যাচ্ছিলেন, বুঝতে পারছিলাম রান্নাঘরের তদারকি করতেই উঠে যাচ্ছিলেন এবং প্রতিবার ফিরে এসেই জিজ্ঞেস করতেন, মা কি বললো, আবার বলো তো। বেশ কয়েকবার তিনি এই ঘটনাটি জানতে চাইলেন এবং প্রতিবার আমার কথা শুনে হাসতে শুরু করলেন'। এতক্ষণে ড্রাইভার আমাদের বলেছেন, আমরা বনশ্রীতে, তুমুল আড্ডার প্রতিশ্রম্নতি দিয়ে নেমে গেলেন জাহিদ ভাই, বাকি রাস্তাটা আমি আর হাসমত জলিলও সুচিত্রার সিনেমার গল্পে মত্ত হয়ে থাকলাম। ওহ মনে পড়েছে, জাহিদ ভাইয়ের একটা ছোট্ট ইন্টারভিউ করেছিলাম আমি ২০১৬/১৭ সালের দিকে, বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ বিষয়ে। সেই ইন্টারভিউর র'ফুটেজ থেকে উদ্ধৃত করি। জাহিদ ভাইকে সাতই মার্চের ভাষণের দিনের ঢাকা বেতারের ভেতরের দৃশ্য কেমন ছিল জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বলছিলেন, '১৯৭১-এর ১৮ জানুয়ারি আমি যোগ দেই ঢাকা কেন্দ্রে। এক শিক্ষককে অনুরোধ করে এই পোস্টিং নিয়েছিলাম যেন এই উত্তাল সময়ে আমি ঢাকার কেন্দ্রে থাকতে পারি। ঢাকা বেতারের সুবিধা হলো, প্রায় সবাই ছিলেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। ঐতিহাসিক ৭ মার্চে আমি শাহবাগ কেন্দ্রের অফিসার ইনচার্জ ছিলাম। এটা তখন বিশাল বিষয়। অনেক ক্ষমতাধর ছিলাম কিন্তু। আমরা পরিকল্পনা করলাম বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি সম্প্রচার করব। সব প্রস্তুত। কিন্তু শেষ মুহূর্তে করাচি থেকে বার্তা এলো ভাষণ প্রচার করা যাবে না। তাদের ভয় ছিল, বঙ্গবন্ধু যদি স্বাধীনতার ঘোষণা করে দেন! মাথায় আগুন উঠে গেল আমার। এমনিতেই বাম রাজনীতি করে আসা ছেলে, সবাই আমাকে মানতো। ভাষণ প্রচারে বাধা আসায় আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, ঢাকা কেন্দ্র বন্ধ করে দেব। আমি আর আশফাকুর রহমান খান, আমার সিনিয়র কলিগ। চমৎকার মানুষ ছিলেন। তাকে নিয়ে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিলাম, চলো রেডিও বন্ধ করে দেই। সবাই তখনই মাস্টার কন্ট্রোল রুমে (এমসিআর) গেলাম। সন্ধ্যা ৬টা-সাড়ে ৬টা হবে। সেখানে গিয়ে একে অপরের হাতে হাত রেখে স্টেশন সুইচ অফ করে দিলাম। বঙ্গবন্ধু নিজেই তো সেদিন বলেছিলেন, 'আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি...'। সেই মন্ত্রবলেই রেডিও বন্ধ করে বেরিয়ে পড়লাম। এই কাজের মাধ্যমে আমিই তো স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করেছিলাম। এর আগে তো যুদ্ধটা শুরু হয়নি। এই গৌরব আমি করতেই চাই। আমিসহ সেদিন আরও যারা সহকর্মী ছিলেন, সবাই মিলেই মুক্তির যুদ্ধটা শুরু করেছি বেতার থেকে। পরেরদিন অবশ্য, সচিব-মন্ত্রী-সামরিক বাহিনী পর্যন্ত গড়ালো বিষয়টা।

এরপর সিদ্ধান্ত হলো, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বেতারে স¤প্রচার করবে। আমাদের আশ্বস্ত করল। আমরা পরদিন আবারও কাজে ফিরলাম।‘
শুধু সাতই মার্চের ভাষণ বিষয়ে নয়, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর জাহিদুল হক লিখেছিলেন দৈনিক সংবাদের পাতায় প্রথম কবিতাটি। যে কবিতা পরে বহু-বহুবার নানা অনুষ্ঠানে আয়োজনে পড়েছেন তিনিÑ
হঠাৎ রঙিন গোলাপ দেখে
মুজিব দেখে ভুল করি
কোথায় পেলি অমন কুসুম
সোনার বাংলা আ মরি
কোথায় পেলি পদ্মা মেঘনা
কার নামে সে কুলুকুলু
মসজিদে তোর প্রাণের আজান
মন্দিরে তোর উলু
(গোলাপ/ জাহিদুল হক)
আজীবন ধ্রæপদি কবিতার সাধনা করেছেন জাহিদুল হক, কবিতার বইগুলোর শিরোনাম দেখলেই তা যে কোনো কবিতার পাঠক টের পাবেন। পকেট ভর্তি মেঘ, তোমার হোমার, নীল দূতাবাস, সেই নিঃশ্বাসগুচ্ছ, পারীগুচ্ছ ও অন্যান্য কবিতা, এই ট্রেনটির নাম গার্সিয়া লোরকা, এ উৎসবে আমি একা কী দারুণ রোমান্টিক সব নাম।
মাত্র শ’খানেক গান লিখেই জনপ্রিয় গীতিকবি হিসেবে খ্যাতি পেয়েছেন। ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর ত নয়, তবু কেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়’ সুবীর নন্দীর কণ্ঠে গীত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে মানুষের মুখে মুখে। কিন্তু নিজে জাহিদুল হক কখনো গীতিকবি হিসেবে পরিচিত হতে চাননি, নিজেই লিখেছেন, ‘গান লিখতে চাইনি একেবারেই। সামান্য যে ক’টি গান রচনা করেছি, সেগুলোর অন্যতম কৃতিত্ব সুরকার কমল দাশগুপ্ত, আব্দুল আহাদ এবং খন্দকার নূরুল আলমের। তারাই আমাকে কবিতা থেকে গানে আসতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তারা প্রায়ই বলতেন, ‘কী মিষ্টি তোমার কবিতা, তুমি আমাদের জন্য গান লেখো না কেন? আমাদের এক-দুটো গান লিখে দিলে কী হয়!’ আমি বলতাম, গানের বাণীর যে অবস্থা, গীতিকারদের যে অবস্থা এমন পরিবেশে গান লেখার আগ্রহ পেতাম না। একরকম নাক সিটকানো বিষয় আমার মধ্যে কাজ করত। তবুও তারা থামেননি। বিভিন্ন সময়ে আমাকে চাপ দিয়ে বলতেন, ‘ঠিক আছে, তুমি তোমার মতো করেই লিখো। সমস্যা তো নেই। কিন্তু লিখো।’
তখন ভাবলাম, আসলেই তো আমার মতো করে লিখতে পারি। আমার গানের লিরিক কবিতার দিকে ঝুঁকিয়ে দিতে পারি। এই ভেবে লেখার চেষ্টা করেছি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। অথচ একাধিক গণমাধ্যম তার মৃত্যুর খবরে হেডলাইন করেছে গীতিকবি জাহিদুল হক মারা গেছেন। এ যে কী তীব্র বেদনার জাহিদুল হকের শুভার্থীদের জন্য, হায় বার্তাকক্ষের পÐিতজন যদি জানতেন! গানের লিরিক কবিতার দিকে ঝুঁকিয়ে দেয়া মানুষটা আগে কবি, গীতিকবি নন, তার পরিচয় গীতিকবি হতে পারে না।
বেদনারই বরপুত্র ছিলেন জাহিদুল হক আদতে, কাকে কাকে যেন তাকে ডাকতেও শুনেছি বেদনাপুত্র। কিন্তু সমস্ত বেদনা ছাপিয়ে এক জীবনে উদযাপনও ছিল জাহিদুল হকের যাপনে। ফেনী সাহিত্যসভার উদ্বোধনী, কবির সংবর্ধনা আয়োজনে গিয়েছিলাম শাবিহ মাহমুদ কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়ে কদিন আগে। কী যে খুশি হলেন জাহিদ ভাই আমাকে দেখে! অনুষ্ঠান শেষে রাতে আড্ডা হলো, পরদিন ভোরে ঢাকাযাত্রা হবে বলে অনেক আড্ডার প্রতিশ্রæতি দিয়ে শেষ হওয়া সে আড্ডাই যে শেষ আড্ডা হবে কে জানতো!
এই ছবিটা দেখুন, এই যে ভাবটা দেখতেছেন না, আপাদমস্তক এক কবির ভাব। মুঞ্জিত পলকের ভেতর নাকি পাথর হয়ে গেছে তার দুটি চোখ।
জাহিদ ভাই, ধ্রæপদি বাংলা কবিতার ভুবনে আপনি অমর, আপনি থাকবেন। আমরা কেবল এ মরপৃথিবী থেকে আপনাকে সাময়িক বিদায় জানাতে পারি। আপনার সঙ্গে আড্ডা, কবিতা নিয়ে গভীর কথকতা খুব মিস করব। কীভাবে আর শুনব আপনার কণ্ঠস্থ কবিতাগুলো, কী দারুণ মগ্ন উচ্চারণেই না আপনি পড়তেন।
আমায় একটু আকাশ দেবে
তোমার মনের ওপাশ থেকে
যেই পাশেতে উদাস হাওয়া
উদাস মেঘের জটলা থাকে,
সেই পাশেতে রঙিন সুতায়
ছোট্ট একটা ঘুড়ি ওড়াব!
আমায় একটু চক্ষু দেবে
তোমার চোখের সাগর থেকে,
আধার চোখের সাগর পাড়ে
একবার আমি নাইতে যাব!
আমায় একটু বসতে দেবে
হৃদ উঠোনের দখিন পাশে,
এ পাশটাতে ছোট্ট একটা
হাসনাহেনার গাছ লাগাব!
আমায় একটু স্বপ্ন দেবে
স্বপ্ন মালার শেষের থেকে
রংধনুটার একটু এনে
স্বপ্ন তোমার রাঙিয়ে দেব!
আমায় একটু রাত্রি দেবে
মন ফাগুনের রাত্রি থেকে,
বটের তলে নীরব বসে
রাখালী বাঁশির গান শোনাব!
আমায় একটু বাতাস দেবে
হৃদপাথারের ওপাশ থেকে,
 চৈতী রাতের হিমেল হয়ে
গোপনে তোমার গায়ে জড়াব!
আমায় একটু জীবন দেবে
ওই জীবনের কিনার থেকে,
এই জীবনের রংতুলিতে
ওই জীবনটা রাঙিয়ে দেব!
(ইচ্ছেছবি/ জাহিদুল হক)
বাংলা কবিতার বেদনাপুত্র, প্রিয় জাহিদুল হক, নিজের প্রিয় সমস্ত কিছু নিয়ে ভালো থাকবেন আপনি, দেখা হবে স্বর্গের নিলাভ প্রান্তরে অনন্ত আড্ডায়।