মেয়েটির নাম তার বাবা ভালোবেসে রেখেছে রঞ্জনা। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট্ট নদীর মতো। গ্রামের মানুষের ভালোবাসা জুড়ে এই নদী নদী পার হয়ে এলাকাবাসী শহরে যেত গ্রামের যাতায়াতে নদীর ভূমিকা ব্যাপক। হাটের দিন নদীর পাড়ে মানুষের ঢল নামত। কলকল ধ্বনিতে নদী বয়ে যেত। কখনো শান্ত কখনো তার উত্তাল রূপ মানুষকে অভিভূত করত। বিয়ের অনেক বছর পরও যখন মোহন ও সালমা দম্পতির কোনো ছেলেমেয়ে হয়নি একটি সন্তানের জন্য বুক জুড়ে ছিল হাহাকার। সোনার সংসার যেন অপূর্ণ একটি সন্তানের জন্য। সালমার বুকের ভেতরে হাহাকার করত এত কিছু থাকার পরও যখন কোনো সন্তানের মুখ দেখেনি। কারো সন্তান দেখলে নিজের ভেতরে মাতৃত্ববোধটি আরও তৃষ্ণা নিয়ে জেগে উঠত। মোহনের তাই। সন্তানের মুখ থেকে বাবা ডাক শোনার অতৃিপ্ত তাকে কুরেকুরে খেত। পুরুষ মানুষের মন ভেতরে যতই আঘাতে জর্জরিত হতো বাইরে তা কখনো প্রকাশ করত না। পুরুষের চোখের জল বুঝি হীরা মানিকের চেয়েও মূল্যবান, যা দেখা বা বোঝা যায় না। মোহন সালমাকে বুঝাতো। মাঝরাতে সালমার মুখটি বুকের ভেতরে নিয়ে আদরে আদরে ভরিয়ে দিত মোহন আর বুঝাতো সালমাকে ছেলেমেয়ে নাই বলে আমি তো তোমাকে কম ভালোবাসি না। জগতে সবাই সব কিছু পায় না। তুমিও মন খারাপ কর না। আমারও কষ্ট আছে কাউকে বলতে পারি না। বলে কি লাভ, ভাগ্যে থাকলে তুমি মা হবে সালমা। সালমা স্বামীর রুমস বুকে নিজেকে সমর্পণ করে কাঁদে। এ কান্না তার কত জনমের বিধাতা জানে।
সালমার চুলে বিলি কেটে কেটে বলে চলে কাল আমরা পাগলা বাবার দরবারে যাই, দেখি আলস্নায় মুখ তুলে চায় নাকি?
খুব ভোরে নিজেকে ফ্রেস করে ফুরফুরে মেজাজে স্বামী-স্ত্রী মিলে পাগলা বাবার দরবারে যেয়ে মানত করে আসে। আরও কতো জায়গায় যায় দু'জনে মিলে। যদি তাদের ঘর আলো করে একটি সন্তান আসে। বছর কেটে যায় কোনো কিছুই হয় না। আশাহত সালমা ভুলে যায়, তার মাতৃত্ব পাবার সাধ। একদিন দু'জনে মিলে সন্ধ্যার পর নদীটার কাছে এসে বসে। কত সুখ-দুখের কথার সাক্ষী হয় নদীটা। সালমা বলে আমার একটা মেয়ে হলে আমি নাম রাখব রঞ্জনা। মোহন তার হাত ছুঁয়ে দেয়।
একদিন সকালে সালমা ঘুম থেকে ওঠে মাথা ঘুরে পড়ে যায়, গা কেমন করে বমি বমি ভাব। পরপর কয়েকদিন এমন হবার কারণে শাশুড়ির চোখে আটকে যায় বিষয়টি। তিনি মোহনকে ডেকে বলেন, সালমাকে ডাক্তার দেখাতে। বিকালে নদী পার হয়ে তারা ডাক্তারের কাছে যায়, ডাক্তার সাহেবের মুখ থেকে শোনে অপ্রত্যাশিত আশার কথা, সালমা মা হতে যাচ্ছে আর মোহন বাবা। সেদিনের তাদের সেই আনন্দ আর সুখের সাক্ষী ছিল আকাশের চাঁদ। কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে আকাশে। জোছনায় পস্নাবিত চারপাশ। আহা এত সুখও তাদের কপালে লেখা ছিল। মোহন মায়ের কাছে এসে গল্প করে, মা তুমি দাদু হবে, এইবার তোমার দাদু হওয়া আর কে আটকায়? শাশুড়ির কাছে বউয়ের কদর বেড়ে যায় হাজার গুণ। পরদিন পুরো গ্রাম ভেসে যায় সালমার মা হবার আনন্দ গল্পে।
মোহন ও সালমা একই কলেজে লেখাপড়া করেছে। তারপর মোহন উচ্চ শিক্ষা নিতে ঢাকায় আসে। সালমার পড়া উচ্চ মাধ্যমিকের পর আর এগোয় না। মোহন ও সালমা দু'জন দু'জনকে ভালোবাসত। মোহন লেখাপড়া শেষ করে গ্রামের কলেজে সহকারী অধ্যাপকের পোস্টে চাকরি পায়। অবশেষে দুই পরিবারের সম্মতিতে তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের দশ বছরের মধ্যেও যখন ছেলেমেয়ে হচ্ছিল না তখন সালমা মোহনকে বলেছিল আরেকটি বিয়ে করতে। সেই ঘরে সন্তান হলে সে মা ডাক শুনবে। পুরুষ মানুষ আবেগে চলে না। মোহন জানে আবার বিয়ে করলে তাদের ঘরে অশান্তি বাড়বে ছাড়া কমবে না। আর বাস্তবতা খুবই কঠিন। আরেকটি মেয়ে এসে পুরোটাই তাকে দখলে নেবে। সন্তান না হোক সে সালমাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করা দূরে থাক ছুঁয়েও দেখতে চায় না। সালমা গ্রামের সাধারণ আর দশটি মেয়ের মতো। মোহন তো তা নয় সে শহরের আবহে চলেছে। এই শহরে কতো দেশের কতো মানুষের সঙ্গে দেখা কথা পরিচয় তবু কারো সঙ্গেই কারো চরিত্রের মিল নেই। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার পর মিথিলা নামে এক মেয়ের সঙ্গে মোহনের পরিচয় হয়। কয়েকদিনের কথা পরিচয়ে মিথিলা ভালোবেসে ফেলে মোহনকে। মোহন যখনই বিষয়টি টের পেয়ে গেছে তখন সে মিথিলাকে সালমার বিষয়টি বলেছে। তবু মিথিলা অবুঝ সে সালমাকে ভুলে যেতে বলে। মোহন তার কথায় অনঢ়। সে সালমাকেই ভালোবাসে তার জীবনে অন্য কোনো নারীর স্থান নেই। মিথিলা মোহনকে প্রচন্ড ভালোবাসে। মোহনকে নিয়ে সে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যেত। মিথিলার পরিবারের সঙ্গেও মোহনকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। মিথিলার মাও তাকে খুব ভালেবাসত। মোহন প্রথমে ভেবেছিল হয়তো বন্ধুত্ব। সেভাবেই মিথিলার সঙ্গে সে মিশেছে পরে যখন বুঝল মিথিলার ভালোলাগাটা আসলে অন্য কিছু। তখনই নিজের ভেতরে একটা ধাক্কা খায় মোহন। মিথিলা কোনো শর্তেই মোহনের জীবন থেকে সরতে চায় না। ভালোবাসার লতাপাতায় তাকে বাঁধতে চায়। কিন্তু মোহন নিরুপায়। তার যে কিছুই করার নেই। মানুষের মন বড় জটিল জায়গা। কোনো যুক্তিতর্ক সেখানে খাটে না। মোহন নিজেও কখন মিথিলার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে নিজের অজান্তে। যখনই মোহন নিজের ভেতরের সত্তার সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে যায় তখনি স্থির করে তাকে এখান থেকে সরতে হবে। একদিকে সালমা অন্যদিকে মিথিলা কোথায় যাবে সে? হাজারো প্রশ্নের মুখোমুখি। সালমা ছোটবেলা থেকেই মোহনকে ভালোবাসে। সম্পর্কে তারা আত্মীয়। মোহন সালমাকে ত্যাগ করলে সালমা পৃথিবীতে আর কাউকে বিশ্বাস করবে না। তার ছোট্ট পৃথিবী আরও ছোট হয়ে যাবে? নানামুখী টানাপোড়েনে মোহন অস্থির।
এক সময় জানতে পারে মিথিলা ক্যান্সার নামক ভয়াবহ রোগের সঙ্গে নিরন্তর আপস করে চলছে। অবস্থা যখন খুব খারাপ তখন তাকে চেন্নাই নেয়া হয়। সেখানকার ডাক্তার তার আশা ছেড়ে দিয়ে তাকে রিলিজ দিয়ে দেয়। মিথিলা দেশে এসে খবর পাঠায় মোহনকে। মোহন দেখতে গিয়ে আঁতকে ওঠে কি চেহারা কি হয়ে গেছে। মৃতু্যপথ যাত্রী মিথিলা মোহনকে অনুরোধ করে, একবার তাকে শুধু মোহন বলুক, সে তাকে ভালোবাসে। মোহন মিথিলার মুখটি তার বুকের ভেতরে নিয়ে বলে বড় অবেলায় আমাদের দেখা হয়েছিল। এমন সময় তুমি এলে যখন আমি নিরুপায়। মিথিলার চোখের জলে মোহন ভিজে একাকার।
মিথিলা কান্না থামিয়ে তাকে অনুনয়ের সুরে বলে, আমি মরে যাচ্ছি তোমার আর সালমার মাঝখানে আর কখনো আসতে পারব না। আমার একটা অনুরোধ রাখবে। মোহন আবেগ আপস্নম্নত। কি বলবে বুঝতে পারে না। মিথিলা মোহনের বুক থেকে সরে হাত ধরে বিনয়ের সঙ্গে বলে আমি মরে যাব যাবার আগে একবার শুধু বলো তুমি আমায় ভালোবেসেছিলে। আমার আয়ু হয়তো আর কয়েকটি দিন আছে, তুমি এই কয়েকদিন আমাদের বাসায় থাকবে।
\হ: মোহন বলে এভাবে কি থাকা যায়। লোকে কি বলবে।
: লোকে যা বলার বলুক বাকি কটা দিন আমি তোমার কাছে থাকতে চাই, তোমার বুকেই আমার শেষনিঃশ্বাসের ছোঁয়াটুকু রেখে যেতে চাই।
মোহন কি করবে ভেবে পায় না। নিজের বিবেকের দংশনে দংশিত হচ্ছে বারবার।
তারপর মিথিলার মাকে ডেকে বলে খালাম্মা রাতে একজন কাজি ডাকেন, আমি মিথিলাকে বিয়ে করতে চাই। বাকি কটা দিন আমি ওর কাছে থাকতে চাই। পৃথিবী নিষ্ঠুর নয়, মানুষও নিষ্ঠুর নয়- এটা ও দেখে যাক। তবে আমার একটি শর্ত আছে, এই বিষয়টা আপনারা ছাড়া আর কেউ জানবে না।
মিথিলার মা মেয়ের কথা ভেবে রাজি হয়। রাতে মিথিলাকে সুন্দর করে সাজানো হয়। কাজি ডেকে বিয়ে দেওয়া হয়।
অন্তরজ্বালায় জ্বলছে মোহন সে কি সালমার প্রতি অবিচার করল? না না, একটা মেয়ের ক্ষণিকের জীবনকে কিছুটা সময় শুধু রাঙিয়ে তোলা। এটা তার দায়বদ্ধতা। এটা সমাজের প্রতি একটি মেয়ের প্রতি তার ভালোবাসার প্রকাশ। বিছানাটা ফুল দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হলো। মিথিলার কথা জড়িয়ে যায়। সে আর বেশিদূর এগুতে পারে না, ক্লান্তির সবটুুকু রেশ নিয়ে মোহনের বুকে ঘুমিয়ে যায়। ঘুমন্ত মিথিলার ঠোঁটেমুখে আদরের আঁচর কাটে মোহন, মিথিলার মাথার কাছে বসে রাত পার হয়। কতো ভাবনা আজ তাকে ক্ষত-বিক্ষত করছে। সে মিথিলাকে মরতে দেবে না। তাকে বাঁচিয়ে রাখতে যত চিকিৎসা আছে সব করবে। সালমা জানলে হয়তো তাকে ভুল বুঝবে, কিন্তু এখন কারো ভুল ভাঙানোর সময় নয়। যে মেয়েটি পৃথিবীর এই রূপ-রস-গন্ধে ফুল হয়ে ফুটতে চেয়েছিল তাকে আর সে ঝরতে দেবে না। যেভাবেই হোক তাকে বাঁচাতে হবে। জীবন এমন এক নদী কোথায় তার স্রোত এসে থামে কেউ জানে না।কখনো নদীর একটি পাড় ভেঙে আরেকটি পাড়ে চর জেগে ওঠে। সেই একটি চর উঠাবে মিথিলার জীবনে। এটাই তার একমাত্র পণ। সকাল হলে মোহন ফ্রেস হয়ে মিথিলার মাকে ডাকে মিথিলাকে তুলে খাবার ও ওষুধ খাওয়াতে হবে। মা এসে মিথিলার গায়ে হাত দেয়। কী পরম নির্ভরতায় মিথিলা ঘুমিয়ে আছে। আলতো করে মা ডাক দেয় মিথিলার ঘুম ভাঙে না। মোহন এসে তার শরীরে মুখে হাত বুলিয়ে ডাকে। কোনো শব্দ নেই। সে ঘুমিয়ে আছে। মিথিলার সারাশব্দ না পেয়ে ডাক্তার আংকেলকে খবর দেন। ডাক্তার এসে মিথিলাকে ভালোমতো দেখে তারপর ধীরকণ্ঠে বলে ংযব রং হড় সড়ৎব. একটা আর্তচিৎকার দিয়ে মোহন মিথিলাকে জড়িয়ে আদরে আদরে ভরিয়ে দেয়। মিথিলা তুমি আমাকে ছেড়ে এভাবে যেতে পার না। আমি তোমার জন্য সব ত্যাগ করলাম। এখন তুমি আমাকে ত্যাগ করে কোথায় চলে যাচ্ছ। কেন আমাকে এভাবে ফাঁকি দিলে। আমি তো তোমাকে ফাঁকি দেইনি। তুমি যা চেয়েছিলে তোমাকে দিয়েছি তবু এত অভিমান তোমার। এত অভিমান আমার জন্য তুমি লুকিয়ে রেখেছিলে প্রতিশোধ নেবে বলে?
বছর গড়িয়ে যায় উচ্ছল মোহন কেমন যেন ধীরস্থির হয়ে যায়। একটা বিষণ্ন্নতা তাকে তিল তিল করে শেষ করে দিচ্ছে।পরীক্ষা শেষ হবার পরই কলেজের চাকরি নিয়ে মোহন গ্রামে চলে আসে। শহরের প্রতিটি ইটের গায়ে দেখতে পায় মিথিলার ছবি। চাকরির পরপরই সালমার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তার আর সালমার মাঝখানে অদৃশ্য দেয়াল হয়ে ওঠে মিথিলা। এই পরম সত্য আজ দশটি বছর মোহন সবার থেকে লুকিয়ে রেখেছে। নিজেকে কখনো সে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করায় কখনো নিজেকে দেবতার রূপে আবিষ্কার করে।
সালমা ও মোহনের বুক জুড়ে একটি একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তান আসে। তাদের আনন্দ আর ধরে না পুরো বাড়িতে খুশিতে গম গম ছোট্ট এ শিশুটিকে নিয়ে। দীর্ঘ দশ বছরের সাধনা আজ পরিপূর্ণতা লাভ করে। মোহন মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে যায় অবিকল মিথিলার প্রতিচ্ছবি। বুকের ভেতরে শত আনন্দেও মিথিলার জন্য বুকে তার হাহাকার নেমে আসে। মুহূর্তে ফিরে যায় ফেলে আসা অতীতের চেপে যাওয়া ঘটনা। মেয়ে তাকে আবার মনে করিয়ে দেয় মিথিলাকে। একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সদ্য জন্ম নেয়া মেয়ের দিকে। আনমনে ভুলে যায় বর্তমানকে। সালমার ডাকে তার ঘোর ভাঙে। কিছু ভাবছ? কই কিছু না তো। সম্বিত ফিরে আসে মোহনের। মেয়ের নাম রাখে রঞ্জনা। রঞ্জনা সেই নদী যে নদীটা কৈশোর থেকে সালমা আর মোহনের জীবনের প্রতিটি সময়ের সাক্ষী হয়ে আছে।
নদী সাক্ষী হয়ে থাকে মানুষের জীবনের কতো জানা অজানা গল্পে।