শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১

সমালোচনা সাহিত্যের সেকাল-একাল

জসীম উদ্দীন মুহম্মদ
  ১৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
সমালোচনা সাহিত্যের সেকাল-একাল

সমালোচনা সাহিত্যের একটি বিশেষ শৈল্পিক শাখা। বলা হয়ে থাকে- এলিট শাখা। এজন্য অনেকেই সাহিত্য সমালোচনা না বলে সমালোচনা সাহিত্য বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে থাকেন। তাতে করে 'সমালোচনা এবং সাহিত্য' শব্দ দুটিকে অধিক বিশেয়ায়িত করা হয়েছে বলে মনে করা হয়। আমিও তাদের সঙ্গে সহমত। আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, 'সমালোচনা' একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শব্দ বিশেষ। তা কেবল সাহিত্যের ক্ষেত্রেই নয়; বরং ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবন, এমনকি বৈশ্বিক জীবন পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে সমালোচনা একান্ত জরুরি। কেননা, সমালোচনা না থাকলে আলোচ্য ব্যক্তি সিংহভাগ ক্ষেত্রেই ভুল পথে থেকেও স্বেচ্ছাচারী এমনকি স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারেন। এজন্যই সমালোচনা শব্দটির সঙ্গে প্রাসঙ্গিক আরও কিছু শব্দ স্বর্ণলতার মতোন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে। এই যেমন: ভুল (তা চেতনে হউক, অবচেতনে হউক কিংবা অজ্ঞতাবশত হউক), অতিরিক্ত আবেগ, তথ্য এবং তত্ত্বের ঘাটতি, ভাষাগত সমস্যা ইত্যাদি... ইত্যাদি। উলিস্নখিত কারণগুলো ছাড়া সমালোচনা সাহিত্যের খোরাক বা অনুষঙ্গ হিসেবে আরও অনেক কারণ আছে। থাকতেই পারে। আর তাই সমালোচনা সাহিত্যের বিকল্প অন্য আর কোনো কিছু নেই। মূলত সমালোচনা হলো সাহিত্যে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয় ধরনের আলোচনার মাধ্যমে একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার।

মূল আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে সংক্ষিপ্ত পরিসরে সমালোচনার সংজ্ঞা সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে চাই। সমালোচনা সাহিত্য হচ্ছে সাহিত্যের গবেষণা, আলোচনা, মূল্যায়ন এবং ব্যাখ্যা। যদিও আধুনিক কালে সাহিত্য সমালোচনায় সাহিত্য তত্ত্ব প্রয়োগ করা হয়। সাহিত্য তত্ত্বের ভিত্তিতে সাহিত্য সমালোচনার পদ্ধতি ও লক্ষ্যের দর্শন নিয়ে আলোচনা করা হয়। এই সমালোচনা সাহিত্যের আদি গুরু মহামতি এরিস্টটল। তিনি তার ঢ়ড়বঃরপং বইয়ের সূচনায়ই উলেস্নখ করেছেন, 'কাব্যের নানা প্রকারভেদ এবং তাদের বৈশিষ্ট্য, সার্থক কাব্যের কাহিনী গঠনের শ্রেণি বিভাগের বিভিন্ন অংশের সংখ্যা ও ধরন এবং সেই সঙ্গে কাব্য পাঠের সম্পৃক্ত প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাই' (পোয়েটিকস্‌ পৃ: ৫৯)।

সমালোচনা সাহিত্যের বিভিন্ন রীতি বা পদ্ধতি রয়েছে। এই যেমন: উদারনৈতিক মানবতাবাদী রীতি। ম্যাথিউ আরনল্ডের মতে, 'সমালোচনার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে মূল রচনায় বিষয়টি যেমন আছে ঠিক তেমন করেই দেখা।' সাহিত্যে শুভ-অশুভ বিচার করে ইতিবাচক দিক তুলে ধরাই উদারনৈতিক মানবতাবাদী রীতির মূল উদ্দেশ্য। মার্কসবাদী রীতি: সাহিত্যকে যখন ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ভিত্তিতে বিচার করা হয় তখন তা হয়ে ওঠে মার্কসীয় সমালোচনা রীতি। এখানে বস্তুবাদ বিশেষভাবে প্রাধান্য পায়, এটি বেশ উলেস্নখযোগ্য সাহিত্য সমালোচনা পদ্ধতি। ঐতিহাসিক সমালোচনা পদ্ধতি: যে সমালোচনা যুগচিত্ত, পরিবেশ-পরিপার্শ্ব ইত্যাদির নিরিখে সাহিত্যের বিচার করে থাকে, তাকে চিহ্নিত করা হয় ঐতিহাসিক সমালোচনা পদ্ধতি বলে। পাশ্চাত্যের সাহিত্যিক টেইনের হাত ধরে এই ধারার সূত্রপাত। বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত সাহিত্যিক বিনয় ঘোষ এই ধারার বেশ সমৃদ্ধি ঘটিয়েছেন। তুলনামূলক সমালোচনা পদ্ধতি: যে পদ্ধতিতে ভাব, বিষয়, শব্দ সম্পদের তুলনামূলক বিচারের দ্বারা পারস্পরিক উৎকর্ষ ও অপকর্ষ নিরূপিত হয় তাকে তুলনামূলক সমালোচনা পদ্ধতি বলে। যেমন: আমরা মধুসূদনের 'বীরাঙ্গনা কাব্যে'র সঙ্গে তুলনা করি ওভিদের হিরোইক এপিসলসের, বাল্মীকি-ব্যাসদেবের সঙ্গে তুলনা হয় হোমার-ভার্জিলের। অ্যারিস্টটলের পোয়েটিক্সের সঙ্গে আমরা এখন তুলনীয় মনে করি সংস্কৃত আলংকারিকদের বিভিন্ন প্রস্থান। বিশ্লেষণমূলক পদ্ধতি: একদল সমালোচক শব্দ, চিত্রকল্প, অলংকার ইত্যাদির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে তার স্বরূপ নির্ণয় করতে চান। এ ধরনের পদ্ধতিকে বলা হয় বিশ্লেষণাত্মক পদ্ধতি।

সমালোচনা সাহিত্যের উপরোক্ত পদ্ধতিগুলো ছাড়া আরও কিছু পদ্ধতি রয়েছে। সেদিকে আলোচনা লম্বা না করে আমরা এখন মূল আলোচনায় আসতে চাই। অর্থাৎ সমালোচনা সাহিত্যের সেকাল ও একাল নিয়ে কিছু আলোচনা করতে চাই। সাহিত্যের অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের লেখক সমাজের মধ্যে রয়েছে মারাত্মক মিশ্র-প্রতিক্রিয়া। খুব কমসংখ্যক কবি-সাহিত্যিক এমন আছেন, যারা সমালোচনাকে সানন্দ চিত্তে গ্রহণ করে থাকেন। কেউ তার লেখায় ভুল ধরলে অন্তরের অন্তস্থল থেকে খুশি হন। আনন্দিত হন। কারণ তিনি জানেন এবং মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, এই সমালোচনার হাত ধরেই তিনি একদিন প্রকৃত লেখক-কবি হয়ে উঠবেন। কেননা, অধিকাংশ সময়ই নিজের ভুলত্রম্নটি নিজের চোখে ধরা পড়ে না। এই যেমন: আমাদের অধিকাংশ মানুষের কাছেই নিজের সন্তানের ভুল তেমন একটা চোখে না পড়লেও অন্যের সন্তানের ভুলত্রম্নটি চোখে পড়ে। এটা যারা বুঝেন, তারা সত্যিকার অর্থেই চান, তাদের লেখায় অন্যরা ভুল ধরুন। কারণ তারা ভুল থেকে শিক্ষা লাভ করতে চান। নিজের ভুলত্রম্নটির সংশোধন করার মাধ্যমে সমাজে ফুল ফোটাতে চান। এই প্রসঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি বিখ্যাত কবিতার উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। কবিতাটির নাম- নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো।। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো/যুগ জনমের বন্ধু আমার আঁধার ঘরের আঁলো।/সবাই মোরে ছাড়তে পারে, বন্ধু যারা আছে,/ নিন্দুক সে ছায়ার মতো থাকবে পাছে পাছে।/ বিশ্বজনে নিঃস্ব করে পবিত্রতা আনে,/ সাধক জনে নিস্তারিতে তার মতো কে জানে?/বিনামূল্যে ময়লা ধুয়ে করে পরিষ্কার,/বিশ্বমাঝে এমন দয়াল মিলবে কোথা আর?/নিন্দুকে সে বেঁচে থাকুক বিশ্ব হিতের তরে;/ আমার আশা পূর্ণ হবে তাহার কৃপা ভরে।

কবিতাটিতেও যদিও নিন্দুকের কথা বলা হয়েছে; তবুও আমি মনে করি, নিন্দুক এবং সমালোচক শব্দ দুটি খুব কাছাকাছি বৈকি। যদিও শব্দ দুটির কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। এই যেমন: একজন নিন্দুক যার নিন্দা করছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার ক্ষতি চান। কিন্তু একজন সমালোচক যার লেখার সমালোচনা করেন... অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার ভালো চান, লেখার উৎকর্ষ চান, উন্নতি চান। কারণ সমালোচনা শব্দটি আপাতত দৃষ্টিতে একটি নেতিবাচক শব্দ মনে হলেও প্রকৃত অর্থে তা নয়। তাছাড়া একপেশেভাবে কেবল ভুল ধরে যাওয়াকেও আর যা কিছুই বলুক না কেন সমালোচনা বলে না। সমালোচনা সাহিত্যে ইতিবাচক, নেতিবাচক উভয় দিকেরই যথার্থ এবং গঠনমূলক আলোচনা করা হয়ে থাকে। করা উচিত। আর এজন্যই সমালোচনাকে সাহিত্য হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। কেবল ভুলত্রম্নটি ধরিয়ে দেওয়া হলে সমালোচনাকে সাহিত্যের মর্যাদা দেওয়া হতো না। এসব কারণেই অনেক বিখ্যাত বিখ্যাত কবি-লেখককে দেখেছি তারা নিজেদের লেখার সমালোচনার জন্য মুখিয়ে থাকতেন। এখনো কেউ কেউ মুখিয়ে থাকেন। যদিও এই মুখিয়ে থাকা কবি এবং কথাসাহিত্যিকের সংখ্যা একেবারেই হাতে গোনা। অনেকে আবার স্বেচ্ছায় স্বপ্রনোদিতভাবে তাদের লেখার সমালোচনা করাতেন। এই হলো আমাদের সমালোচনা সাহিত্যের সেকালের কথা। যা থেকে আমাদের সবার শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।

এবার সমালোচনা সাহিত্যের একাল সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করা যাক। বলা বাহুল্য, সমালোচনা সাহিত্যের একালটা বড় বেশি রসহীন। বর্তমান কালের অধিকাংশ কবি-লেখক সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না। নিজের লেখা কাউকে সমালোচনা করতে দেখলেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেন। যিনি সমালোচনা করেছেন, তিনি বা তার লেখার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করেন। প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠেন। অর্থাৎ তাদের সমালোচনা হজম করার মতোন মানসিকতা নেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে এমন অনেক কবি-সাহিত্যিককে জানি, যারা তাদের লেখার সমালোচনা করার জন্য সমালোচনাকারীর গায়ে হাত তোলার হুমকির মতো ধৃষ্টতাও দেখাতে ছাড়েননি! কী সেলুকাস! এই যদি হয় আমাদের বর্তমান প্রজন্মের সমালোচনা ভাবনা... তাহলে আমার আর কিছুই বলার নেই। বলার থাকতে পারে না। তবে তাদের উদ্দেশ্যে একটি প্রশ্ন রাখতে চাই। সমালোচনা সাহিত্য ব্যতীত আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের উৎকর্ষ কীভাবে সম্ভব?

আলোচনাটি আর লম্বা করতে চাইছি না। এখানেও হামবড়া, অহংকারী কবি-লেখকের শ্যেন দৃষ্টি পড়তে কতক্ষণ! আসল কথা হলো, এই হজম না করাটা আমাদের এক প্রকার মানসিক ব্যাধি। এই মানসিক ব্যাধির চিকিৎসা হওয়া জরুরি। অন্যথায় আমাদের নিজেদেরই পস্তাতে হবে। আর এর সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা পদ্ধতি হল, আত্ম-জিজ্ঞাসা। সমালোচনা সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা খোলামনে অনুধাবন করা। মোটকথা আমাদের মানসিক দীনতা পরিহার করতে হবে। গঠনমূলক সমালোচনা সহ্য করার মতো মানসিক উদারতা থাকতে হবে। আমাদের মানসিকভাবে আরও ধনী ও সমৃদ্ধশালী হতে হবে।।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে