রু দ্য শাঁতিয়ে'র ১২নং বাড়ি ও মধুসূদন
প্রকাশ | ১৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
তাপস মজুমদার
মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য লন্ডন গিয়েছিলেন। কলকাতা থেকে লন্ডনে যাওয়ার আগে তিনি তার পড়ার খরচ, লন্ডনে থাকার খরচ এবং কলকাতাতে প্রিয়তমা স্ত্রী হেনরিয়েটার সংসার খরচের জন্য পত্তনিদারদের কাছ থেকে টাকা পাওয়ার ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন। যথাসময় কথা অনুযায়ী টাকা না পাওয়াতে কবি লন্ডনে সে সময় বিপদে পড়লেন। হেনরিয়েটাও যাদের কাছ থেকে অর্থ পাওয়ার কথা ছিল তা না পেয়ে ১৯৬৩ সালের মার্চ মাসের শেষদিকে কলকাতা থেকে বেঙ্গল জাহাজে চেপে চলে যান কবির কাছে লন্ডনে। ফলে কবির বিপদ আরও বাড়ল। সারাজীবন বেহিসাবি কবি এবার বিপদে পড়ে সত্যি সত্যি হিসাব করে দেখলেন লন্ডনে থাকলে ব্যয় অনেক বেশি। সেখানকার জীবনযাত্রার মান, দ্রব্যমূল্য সবকিছু মিলিয়ে কবির পক্ষে লন্ডনে থাকা যে সম্ভব না তা তিনি উপলব্ধি করলেন। তাই তিনি ভাবতে থাকেন হাতে যে অবশিষ্ট টাকা আছে তা নিয়ে লন্ডন ছেড়ে এমন কোথাও যাবেন যেখানে থাকতে ব্যয় কম হবে এবং তাকে কেউ চিনবে না। ঠিক এমন চিন্তা থেকেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীকে। যতদূর জানা যায় তিনি লন্ডন থেকে ভার্সাইতে যাওয়ার সময় কয়েকদিন প্যারিসে ছিলেন।
প্যারিস থেকে প্রায় ১৫ মাইল দূরে ভার্সাই নগরী। মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই ভার্সাই নগরীতে ছিলেন আড়াই বছর। এই আড়াই বছর তাকে অনেক ভালোলাগা-মন্দলাগা ও নিদারুণ আর্থিক কষ্টের ভিতর দিয়ে অতিবাহিত করতে হয়েছে। তিনি ভার্সাই নগরীর 'রু দ্য শাঁতিয়ে' রোড়ের ১২ নং বাড়িতে থাকার জন্য ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন। এই বাড়িটি ছিলো তিন তলা বিশিষ্ট একটি ছোট বাড়ি। এই বাড়িতে সে সময় মোট ১৮টি পরিবার বসবাস করত। এই ১৮টি পরিবারের ১২ টি পরিবার সরকারি দাতব্য তহবিল থেকে সাহায্য নিয়ে চলত। এ থেকে বোঝা যায় জমিদার পুত্র বাংলার মহাকবি যে বাড়িটি থাকার জন্য ভাড়া নিয়েছিলেন সেটি নিতান্তই অতি সাধারণ এবং সেখানে যারা বসবাস করত তারাও অতি সাধারণ। তবে কবির সে সময় যে অবস্থা তাতে এই পরিবেশকে মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায়ও ছিল না। কবির এই আবাসন থেকে রাজ প্রাসাদের দূরত্ব ছিল মাত্র আধমাইলের মতো। তিনি এই ভার্সাই প্রাসাদের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি মাঝেমধ্যে এই প্রাসাদের কাছে গিয়ে বসতেন। বাগানের পাশের খিড়কির পুকুরে মাছ আর হাঁসদের খেতে দিতেন। ভার্সাই শহরে একদিকে যেমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ছড়াছড়ি অন্যদিকে কিছুটা হলেও মানসিক প্রশান্তিতে তার কবিত্ব শক্তি জেগে ওঠে। তখন তিনি আর একটি মহাকাব্য লেখার পরিকল্পনা করেন। বিষয়বস্তু হিসেবে নির্বাচন করেন মহাভারত থেকে দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর। পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি এই মহাকাব্য লিখতে শুরু করেন ১৯৬৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বরে তারিখে। এই কাব্যের ৩০ পঙ্ক্তির মতো লিখেছিলেন। তারপর তিনি নিজের রচনার প্রতি তৃপ্তিবোধ করেননি। কাব্যটি তিনি নতুন ছন্দে লিখতে চেয়েছিলেন কিন্তু লেখার শুরুতে মেঘনাদবধের মতো শুরু হওয়াতে আবার ভাবতে শুরু করেন। যে কারণে প্রথম লেখা অংশ বাদ দিয়ে আবার দ্বিতীয়বার লেখেন। এবার তিনি সত্যি এক নতুন ছন্দে লিখতে সক্ষম হলেন। পরে এই ছন্দ রবীন্দ্রনাথের হাতে সমিল প্রবহমান পয়ার ছন্দ বলে বিখ্যাত হয়। তবে মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই ছন্দে লিখেছেন মাত্র ত্রিশ পঙ্ক্তি। যদি তিনি এই ছন্দে তার কাব্য শেষ করতে পারতেন তাহলে তিনি হতেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সমিল প্রবহমান পয়ার ছন্দের প্রবক্তা। তার প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এ কাব্যটি শেষ করতে পারেনি আর্থিক সংকটের কারণে। তবে এই কাব্য লিখতে না পারার বড় কারণ হিসেবে তিনি নিজেই প্রিয় বন্ধু গৌরদাস বসাককে লিখেছেন-'সেই নেশাটা কেটে গেছে'। তবে এ কথা সত্য সে সময় কবির ভিতর নতুন ছন্দে নতুন কাহিনী রচনার যে বাসনা জেগে উঠেছিল তা থেকে তিনি বিরত থাকতে পারেননি। তাই তিনি এর পরপরই শুরু করেন 'সুভদ্রা হরণ' রচনার কাজ। এবার তিনি লিখলেন ৬১ পঙ্ক্তি। তিনি যে চিন্তা নিয়ে শুরু করেছিলেন সে কাহিনীর ভিতর ঢোকার আগেই উৎসাহ হারিয়ে যায় কবির। কারণ তখন তিনি ভীষণ আর্থিক সংকটে দিশেহারা। প্রতিদিনের সমস্যা নিয়ে কোনোভাবে দিন পার করছিলেন। ধীরে ধীরে কবির হাত খালি হতে থাকে। আর্থিক সংকট মেটানোর জন্য একের পর এক চিঠি লিখতে আরম্ভ করেন দিগম্বর মিত্র, বৈদ্যনাথ মিত্র, হরিমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়কে। বহু সমস্যা মাথায় নিয়ে ১৯৬৩ সালের অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে তিনি পরিবারকে ভার্সাইতে রেখে আবারও চলে যান লন্ডনে। নভেম্বর মাসে মিকেলমেস টার্মের সময়কাল ছিল ২ নভেম্বর থেকে ২৫ নভেম্বর। এই টার্ম শেষ করে তিনি আবারও দ্রম্নত ফিরে আসেন ভার্সাইতে। সে সময় কবির আর্থিক অবস্থা ভীষণ খারাপ। যে কারণে তিনি আবারও আবেদন করেন গ্রেজ ইনে তার জমা দেওয়া টাকা থেকে ২৫ পাউন্ড পাওয়ার জন্য। গ্রেজ ইনের পেনশন কমিটি কবির সংকট বিবেচনা করে ১৯৬৩ সালে ২২ ডিসেম্বর তার আবেদন অনুযায়ী ২৫ পাউন্ড ধার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কবি আবারও ফিরে এলেন পরিবারের কাছে ভার্সাইতে।
এ সময় 'রু দ্য শাতিয়ের' বিভিন্ন দোকানদারদের কাছ থেকে ধার করে আর পরিচিতদের দয়ায় তিনি এবং তার পরিবার কোনোমতে বেঁচেছিলেন ভার্সাইতে। তবে তিনি ভার্সাইতে যে বাড়িতে ছিলেন পূর্বেই উলেস্নখ করেছি তার ভিতর বেশিরভাগ পরিবার সরকারি দাতব্য তহবিল থেকে অর্থ সাহায়্য নিলেও কবি কখনো কোনো সাহায্য নিয়েছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। তিনি প্রচুর অভাবের মধ্যে ছিলেন সত্য কিন্তু দাতব্য তহবিল থেকে তিনি কোনো সাহায্য নেননি। তবে ১২নং রু দ্য শাঁতিয়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটু ডানে গেলেই রাস্তার বা দিকে একটি গলি। সেখানে ছিল একটি চার্চ। এই চার্চটি কবি যে বাড়িতে ছিলেন তা থেকে মাত্র তিন মিনিটের পথ। যখন কবি ভীষণ অভাবের ভিতর দিন কাটাচ্ছেন সে সময় তিনি এই চার্চের সাহায্য পেয়েছিলেন। তাছাড়াও সে সময় তিনি যে বাড়িতে ছিলেন সে বাড়ির অন্য বাসিন্দরা দরিদ্র হলেও কবিকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছে। কবির প্রতি অনেক সহানুভূতি দেখিয়েছিল। এমনকি তাদের কেউ কেউ মাঝেমধ্যে কবির ঘরের সামনে খাবার রেখে যেতেন। সে সময় কবির মাঝেমধ্যে অনাহারে কিংবা অর্ধাহারে দিন কাটত। যাদের কাছে থেকে কবি ঋণ করেছিলেন তারা কবিকে নানা ধরনের ভয় এমনকি আদালতের ভয়ও দেখিয়েছিলেন। নিরুপায় বাংলার মহাকবি কলকাতা ছেড়ে যাওয়ার দু'বছর পর ১৯৬৪ সালের ২ জুন প্রিয়বন্ধু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে চিঠি লেখেন ভার্সাই থেকে। এই চিঠিতে তিনি শেষ অংশে লিখেছিলেন-...'আমার দুঃখের কথা শুনে আপনার কোমল হৃদয় ভেঙে যাবে।'
সে সময় ফ্রান্স থেকে চিঠি ভারতে যেতে সময় লাগত প্রায় ৫ সপ্তাহ। পরবর্তী ৪ সপ্তাহে কবি বিদ্যাসাগরের কাছে আরও ৪টি চিঠি লিখেছিলেন। এ চিঠিগুলোর প্রতিটিতেই ছিল কবির নিদারুণ কষ্টের কথা।
তবে জুন মাসের শেষদিকে কবি দিগম্বর মিত্রের কাছে থেকে ৮০০ টাকা পেয়েছিলেন। যা ছিল তা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য। যে কারণে তিনি বিদ্যাসাগরের কাছে আবারও চিঠি লেখেন। সে সময় হেনরিয়েটারের সন্তান প্রসব করার মাত্র দু-চার দিন বাকি। সে চিঠিতে তিনি লেখেন-
'...আমি আপনার ওপর আরও একটা পত্রাঘাত করছি বলে আমাকে ক্ষমা করবেন।...আপনার উপর আমার গভীর বিশ্বাস আছে, আশা করি আপনি আমাকে হতাশ করবেন না। যদি করেন, তাহলে আমি যেভাবে পারি ভারতে ফিরে যাব। তারপর জেনে-শুনে পূর্বপরিকল্পিতভাবে একটি কি দুটি খুন করে ফাঁসিতে ঝুলব'।
এ চিঠি থেকে বোঝা যায় কবি সে সময় ভার্সাইতে কতটা কষ্টের ভিতর ছিলেন।
তারপর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কাছে থেকে চিঠি পেলেন সঙ্গে পেলেন ১৫০০ টাকা। সে সময় তার ঘরে ছিল মাত্র তিন ফ্রাঁ। এদিকে কবি যে বাড়িতে থাকেন তার পাশেই মেলা বসেছে। সেখানকার ছোট ছোট ছেলেমেয়ে মেলা দেখতে যাচ্ছে দেখে মাইকেলের ছেলে মিল্টন ও কন্যা শর্মিষ্ঠা বায়না ধরল তারাও মেলায় যাবে। কবির স্ত্রী হেনন রিয়েটা কবিকে এ কথা জানালে তিনি বললেন 'চিন্তা কর না আজকের ডাকেই বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কাছ থেকে টাকা পাওয়া যাবে'। সত্যিই তাই হলো। তিনি টাকা পেলেন। ছেলেমেয়ে মেলায় গেল।
বিদ্যাসগরের কাছ থেকে তিনি যে টাকা পেলেন তা থেকে কিছু ঋণ শোধ করেন এবং কিছু টাকা হাতে রাখলেন পরবর্তী খরচ চালানোর জন্যে।
তবে কবির তখনো সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। ফ্রান্সে দেনার দায়ে কবি যখন দিশেহারা সে সময় ২য় বারের মতো বিদ্যাসাগর থেকে পেলেন ১০০০ টাকা। কিন্তু তখন তার ঋণ নেওয়া ছিল ১৪০০ টাকা। কিন্তু তারপরও তিনি তার স্বভাব-সুলভ আচরণ থেকে বের হতে পারেনি। তখন তিনি তার প্রিয় বন্ধু গৌরদাসের কাছ থেকে একটি চিঠি পান। এ চিঠির জবাবে কবি তাকে লেখেন-
'আমি এখানে-ফ্রান্সে কেন, তুমি নিশ্চয় তা জানার জন্য উদ্বিগ্ন হয়েছো। আমি তোমাকে বলছি। এ দেশে বাস করাটা যেমন আরামের, লন্ডন তার অর্ধেকও নয়। লন্ডনের তীব্র আবহাওয়া মিসেস ডাটের সহ্যও হয় না। আমি অবশ্য এই পৃথিবীর যে কোনো দেশে বাস করার মতো শক্ত মানুষ। তাছাড়া সেখানকার তুলনায় এখানে ফরাসি এবং ইটালিয়ান ভাষা আয়ত্ত করার সূচে অনেক বেশি। আমি এখন এদুটি ভাষা অবলীলার সঙ্গে লিখতে এবং পড়তে পারি। এ দুটি ভাষা ছাড়া আমি জার্মান ভাষা শিখতে চাই। বস্তুত, ইতোমধ্যে আমি শিখতে আরম্ভ করেছি। সুতরাং তুমি যদি কোনো দিন আমাকে আবার দেখতে পাও, তাহলে শেষবার আমাদের যখন দেখা হয়েছিল, তার চেয়ে আমাকে একটু বেশি শিক্ষিত দেখতে পাবে। আমি আইন অধ্যয়নে অবহেলা করছিনে। তবে ঠিক গুরুত্বের সঙ্গে শুরু করিনি। আমি কয়েকটা টার্ম অবহেলা করেছি এবং ইউরোপে আমার একটু বেশি দিন থাকতে হবে-এই যা। কিন্তু তার জন্য আমার কোনো আপসোস নেই। আহা, আমি যদি আমার সারাজীবন এখানে থাকতে পারতাম আর বন্ধুদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতের জন্য মাঝেমধ্যে ভারত যেতে পারতাম। কিন্তু তেমন টাকা-পয়সা আমার নেই- যদিও তার জন্য যে খুব একটা ধনী হবার দরকার আছে, তা নয়"।
এত ঝামেলা সমস্যা মাথায় নিয়ে কবি ফ্রান্সে থাকলেও লেখালেখি থেকে তিনি নিজেকে আলাদা করেননি। ১৮৬৪ সালের ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে তৃতীয় কিস্তি টাকা পান। সে সময় তিনি বিগত মাসগুলোর তুলনায় কিছুটা হলেও স্বাচ্ছন্দ্যে ছিলেন। সে সময় কবির শৈশবের স্মৃতি হৃদয়ে নাড়া দিয়ে উঠেছিল। ছ'হাজার মাইল দূরে ফেলে আসা মাতৃভূমির জন্য তার সমস্ত হৃদয় যেন কেদে উঠেছিল। সে সময় পরিবেশও কিছুটা অনুকূলে থাকার কারণে তিনি একের পর এক সনেট লিখতে শুরু করেন। এ সমমই তিনি তার বিখ্যাত সনেট কপোতাক্ষ নদ লেখেন। দীর্ঘ আড়াই বছর ভার্সাই নগরীতে থাকার পর ১৮৬৫ সালের সেপ্টেম্বরের তিনি পরিবার নিয়ে লন্ডন যাত্রা করেন। ১৯৬৬ সালের ১৭ নভেম্বর শুক্রবার রাতে মধু কবির ডাক পড়ে গ্রেজ ইন সোসাইটির বারে। সেদিন বাংলার মহাকবিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যারিস্টার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ব্যারিস্টারি পাশের পর কবি লন্ডনে ছিলেন অল্প কয়েক দিন। ১৯৬৭ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি পরিবার লন্ডনে রেখে ফিরে আসেন কলকাতা।