বই আলোচনা
স্বপ্নহীন চোখ বসন্ত খোঁজে না
প্রকাশ | ১২ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
নীলা চৌধুরী শানু
সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনে ক্রমাগত পরিচিত হয়ে উঠছেন কবি রুদ্র সাহাদাৎ। উদীয়মান তরুণ লেখকদের মধ্যে অন্যতম। ধৈর্য এবং অনলস শ্রম তাকে কবিতা গভীরে প্রবেশে অনুপ্রাণিত করছে। প্রচুর লেখাপড়া নিয়মিত, জাতীয় পত্রিকাসহ বিভিন্ন প্রিন্ট, লিটল ম্যাগাজিন, অনলাইন পত্রিকাতেও লিখছেন ভালো। ইতোমধ্যেই তার একটি অনুরাগী পাঠকগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। তিনি কবিতা, বুকরিভিউ, প্রবন্ধ, লিখেছেন দু'হাতেই- যা মাঝেমধ্যেই দৃষ্টিতে পড়ে। পাঠকপ্রিয় এই কবি নিরীক্ষাধর্মী লেখায় আগ্রহের কারণে বিভিন্ন পরিসরের কবিতা রচনা করছেন। অনুসন্ধিৎসু সুমানসে তিনি আঙ্গিক ও উপস্থাপন, প্রকরণ ও বিন্যাস, ভাষা ও শব্দচয়নে গড্ডালিকায় গা না ভাসিয়ে নিজস্ব রীতি ও বিন্যাসে নির্মাণের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রেই তার প্রায়োগিক সাফল্য কবিতাগুলোকে আলোকিত করেছে, পাঠকের পাঠ স্পৃহাকে উজ্জীবিত করেছে। কোনো দুর্বোধ্য শব্দ, ভাষা তিনি উচ্চারণ করেননি তার কবিতায়। সহজ সরল ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ চোখে পড়ে। যা দৃষ্টি নন্দন বটে।
আজকাল ঘুমের ভেতর নিজের মৃতু্য দেখি /ক্রুশবিদ্ধ যন্ত্রণার মৃতু্য / একদল লোক হাসে হা হা হা শব্দে / আরেকদল নৈঃশব্দে চোখের জলে /কিছু লোক প্রাণভয়ে আড়ালে তসবিহ জপে।
চোখে দেখা বাস্তবতা যেন কবির লেখার বিষয়বস্তু, উপকরণ।
স্বল্প পরিসরে বৃহত্তর বক্তব্য প্রকাশের একটি প্রবণতা তার কবিতায় সমুপস্থিত। এটাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখতে চাই। বাহুল্য বর্জিত নিরাভরণতায়, সহজ শৈলিতে গভীর ও ব্যাপক জীবনানুভব প্রকাশ সহজসাধ্য নয়। সেই দুরূহ কাজটিই কবি সাগ্রহে সম্পাদনের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। তরুণ কবি'র সম্মুখযাত্রায় দীর্ঘ পথ। সাহসী এবং সম্পন্ন পথযাত্রায় ঋদ্ধিমান অব্যাহত পথযাত্রা তাকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাবে, সঙ্গত ও যৌক্তিক এ প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি।
বাউন্ডুলে অন্ত্যমিলহীন যৌবন -
হৃৎপিন্ডজুড়ে কেবল পাঁজর ভাঙার গান।
\হঅথবা
বেঁচে থাকার ইচ্ছেরাই মরে গেছে অনেক আগে
মাটির দেহ মাটির জন্য রাত্রিদিন কাঁদে, ঘুমেই জাগে।
অনুভূতির প্রগাঢ় গভীরতা একটি সন্নত শুদ্ধ চেতনায় তাকে শানিত করে। দীপ্র বোধের সমুজ্জ্বলতায় তিনি জীবনের অন্তঃস্থ ও বহিরঙ্গের সব সুষমা ও শ্রী অবলোকনে ব্রতী হন। সত্য সুন্দরের বোধ তাকে আকৃষ্ট করে, পুষ্ট করে, সংরাগে বিভূষিত করে। প্রকৃতিগতভাবে সুন্দর পৃথিবীর বর্ণময়তার সব সম্ভার যেমন কবি মানসকে শুদ্ধতায় নিবিষ্ট করে, তেমনই যাবতীয় প্রতিকূল, বিনাশী, অসুন্দর, অনন্দের সঙ্গে তার সাংঘর্ষিকতা অবিদিত থাকে না। জীবনের মৌল সুরাঞ্জলি আহরণ প্রয়াসী কবি সব অশুভের দানব প্রাকার গুঁড়িয়ে সত্য সুন্দরের উদ্বোধন ও আবাহনে নিবেদিত থাকুন। যা কিছু বৈরী- যা কিছু অপ্রভ- যা কিছু আনন্দ, তার প্রতিই কবি'র প্রবল অনীহা ও বৈরিতা।
মুখোশ দেখতে দেখতে ক্লান্ত মুখ
প্রগাঢ় আঁধারের মাঝে লুকায় চোখ।
অথবা
বৃষ্টি দেখে এখন কাঁদি না আর / গাই না কোনো বিরহী গান।
আমি জাইলস্ন্র্যার পুত জলেই আজন্ম বসবাস/স্বপ্নহীন ডানাভাঙা পাখির মতন
জেগে থাকি নৈঃশব্দে গভীর আন্ধার /জেগে থাকি রৌদ্রোজ্জ্বল ভোরের প্রতীক্ষায়।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থসমূহ- শঙ্কায় আয়না দেখি না ২০১৮, নৈঃশব্দ্যে সমুদ্র পাঠ ২০১৯. সমুদ্র নিকটবর্তী পান পাতার সংসার ২০২০, স্বপ্নহীন চোখ বসন্ত খোঁজে না ২০২১, কবিমন হাঁটে দরিয়া নগর ২০২১, জীবনের জলছবি আঁকছে জেলেমন ২০২২, চেতনায় একাত্তর হৃদয়ে বাংলাদেশ ২০২৩, ফ্ল্যাপ অংশে লিখেছেন শ্রদ্ধেয় কবি ও প্রাবন্ধিক হাফিজ রশিদ খান।
রুদ্র সাহাদাৎ কবিতাপাড়ার পরিচিতস্বর, পরিচিত মুখ। নিরলস সাধনায় তার সহজ কবিমন সর্বক্ষণ যেন তাকিয়ে আছে পৃথিবীর প্রতিটি মুহর্ূতের দিকে। বর্ণনা করা যায় না, এমন কিছু অপার্থিব সুন্দর তাকে চঞ্চল করে রাখে জীবনের পথে পথে। বেদনা ও কষ্টের মানবিকতা তার সত্তাকে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করে পরিশুদ্ধির উত্তাপে। প্রেমপূর্ণ ও প্রকৃতিমগ্ন এই কবি অন্ধকার ও অন্ধতার সব দুয়ার ভেঙে আলোয় ভুবন রাঙাতে বদ্ধপরিকর। তার কবিতার শব্দচয়ন ও চলনের গতি সংবেদী পাঠককে সেই বার্তা দিচ্ছে বারবার। শ্রেণিবিন্যস্ত সমাজের সীমাবদ্ধতা ও কলুষতা তাকে পীড়িত ও ন্যুব্জ করে। কবিতার ব্রক্ষ্ণাস্ত্রে তিনি তাই প্রতিবাদী। হতাশা ও পরিব্যাপ্ত অপাপ্তির ক্ষোভ তাকে প্রকৃত সংবেদনের কাছে নতজানু করেছে- যা কখনো বা নিয়তি বা ললাটলিখনের নামান্তর। পৃথিবীর বহু যুগন্ধর কবি শিল্পীই এই নিয়তির তটে তাদের চেতনার রুধিরাক্ত অর্ঘ্য অর্পণ করে গেছেন সজল নয়নে। একালের মানুষও কি তা থেকে মুক্তি পেয়েছে খুব বেশি? কবির একটি উচ্চারণ সেদিক ইঙ্গিত করছে যেন বড় মর্মান্তিকভাবে-
বারবার কেন যে জিততে জিততে হেরে যাই
প্রভু সব জানে, সব দেখে-
চার ছক্কার চক্করে মইহীন পা......
রুদ্র সাহাদাৎ সাচ্চা প্রেমিক ও ভৈরব। কবি ও কবিতা এই কুঞ্জ ও রুদ্রের অভিঘাতেই বেঁচে থাকে নিরন্তর। কবি রুদ্র সাহাদাৎ কাব্যচর্চার নিরন্তর নিবিষ্টতার যে চাষবাস করে চলেছেন, তার আরেকটি উদযাপন হচ্ছে এই গ্রন্থ। গ্রন্থটি বেশ কিছু কবিতা সমবায়ে সজ্জিত। স্বপ্নহীন চোখ বসন্ত খোঁজে না- বইটি পাঠে সহজ সরল মনের ভাষায় সহজভাবে প্রকাশ করেছেন। এত ছন্দ মেনে জীবন যেমন চলে না তেমনি কবিতাও যায় না লেখা। তারই উদাহরণ এই কিতাবখানা। তেমন কোনো দীর্ঘ কবিতা নেই- তবে অল্প কথায় তিনি যেন ব্যাপক বলেছেন- যা একটা খতম দিলেই বোঝা যায়। বইটি প্রকৃতিপ্রেম ও সমসাময়িক বাস্তবতার অনেক লিখা চোখে পড়ে। দারুণ একটা প্রচ্ছদ এঁকেছে প্রিয় চিত্রশিল্পী নির্ঝর নৈঃশব্দ্য। তবে বুক বাইন্ডিং প্রকাশক মহোদয় চাইলে আরও ভালো করতে পারতেন। কেননা, অনুপ্রাণন প্রকাশনের কাজ ভালো হয়। যা অন্যান্য বইপাঠে জেনেছি। কবিতা ও কবিতার বিষয় নির্বাচন চমৎকার। কবির পরবর্তী কাব্য পাঠের জন্য ব্যাকুল পাঠক মন। জয় হোক কবি ও কবিতার।
বই- স্বপ্নহীন চোখ বসন্ত খোঁজে না। লেখক-রুদ্র সাহাদাৎ ধরণ-কাব্যগ্রন্থ, প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান- অনুপ্রাণন প্রকাশন, মূল্য-১৬০ টাকা, প্রকাশকাল- ফ্রেরুয়ারি-২০২০, প্রচ্ছদ- নির্ঝর নৈঃশব্দ্য