শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
ল্যান্ড সার্ভে মামলার বিচার ও কার্যপদ্ধতি

প্রচলিত ভুল ধারণার অপনোদন জরুরি

কথায় আছে, বাংলাদেশের জরিপ অফিস, ভূমি অফিস ও সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের সরকারি মানুষ যদি কাজকর্মে সঠিক থাকতেন, তাহলে দেওয়ানি আদালতের হাতে তেমন কাজ থাকত না। ডিসি অফিস, এসিল্যান্ড অফিস, তহশিল অফিস প্রভৃতি জায়গা থেকে জমিসংক্রান্ত বিষয়ে সেবা বা প্রতিকার পেতে মানুষকে কী পরিমাণ হয়রানির শিকার হতে হয় তা কেবল ভুক্তভোগীরাই ভালো বলতে পারবেন। ল্যান্ড সার্ভে মামলার বিচার ও কার্যপদ্ধতি নিয়ে তিন পর্বের ধারাবাহিকের আজ প্রকাশিত হলো শেষ পর্ব। লিখেছেন কুমিলস্নার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সোহেল রানা, যিনি একসময় গোপালগঞ্জের ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবু্যনালের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
সোহেল রানা
  ১৭ মার্চ ২০২০, ০০:০০

ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবু্যনালে যদি বিচারক হিসেবে সহকারী জজদের পদায়ন করা হয়ই, তাহলে মামলার নিষ্পত্তি হয়তো একই ধারায় চলতে থাকবে, কিন্তু বিচারিক মানটা যে সেটেলমেন্টের চেয়ে শুদ্ধতর হবে না তা নিশ্চিতই বলা যায়। বলা বাহুল্য, অনেক সহকারী জজ বা সিনিয়র সহকারী জজরাও কিন্তু অনেক যুগ্ম জেলা জজ কিংবা তার চেয়েও ওপরের পদধারী বিচারকদের চেয়ে ভালো দক্ষতা রাখেন, কিন্তু এটা ব্যতিক্রম এবং ব্যতিক্রমকে উদাহরণ হিসেবে নেয়ার সুযোগ নেই। কর্মসম্পাদন ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অর্জিত ব্যবহারিক জ্ঞানের কোনো বিকল্প নেই।

আইনে প্রত্যেক বিচারিক কর্মকর্তার কমপক্ষে চার মাসের সেটেলমেন্ট প্রশিক্ষণ এবং তা সহকারী জজ পর্যায়েই নিশ্চিতের কথা বলা থাকলেও ভূমি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর কর্তৃক সরকারিভাবে প্রদত্ত 'সার্ভে অ্যান্ড সেটেলমেন্ট' প্রশিক্ষণের মেয়াদকাল কমতে কমতে বর্তমানে নেমে এসেছে পঁয়তালিস্নশ দিনে এবং তা-ও নানান ফাঁকিঝুঁকিতে ভরা। সরকারি কর্মকর্তাদের জরিপকার্য শেখানোর অন্যকোনো সরকারি ব্যবস্থা বাংলাদেশে চালু নেই, এবং সবেধন নীলমণি হিসেবে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর কর্তৃকচালিত প্রশিক্ষণ কোর্সগুলোতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বিচারিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে যে সংখ্যাগত-বৈষম্য দেখানো হচ্ছে, তাতে সহকারী জজ বা সিনিয়র সহকারী জজ থাকাবস্থায় তো দূরের কথা, বর্তমানকালে নিয়োগ পাওয়া অনেক বিচারক চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের আগে ওই প্রশিক্ষণে ডাক পাবেন কিনা সন্দেহ। দেখা যাচ্ছে, প্রতিটি ব্যাচে প্রশাসন, বিচার, পুলিশ ও রেলওয়ে ক্যাডার মিলে প্রশিক্ষণার্থী ডাকা হয় ১০০ জন, এর মধ্যে ৪০ জন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তার বিপরীতে বিচারক থাকেন মাত্র ১০ বা সর্বোচ্চ ১৫ জন। অথচ, সেটেলমেন্টবিষয়ক প্রশিক্ষণ অন্যদের চেয়ে বিচারকদেরই বেশি জরুরি ও প্রয়োজনীয়।

ল্যান্ড সার্ভে মামলার নিষ্পত্তি খুব সহজ, তাতে স্বত্বের বিষয়ে কোনো ফয়সালা বা সিদ্ধান্ত দেয়া যাবে না, ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবু্যনালে দেওয়ানি কার্যবিধির বিধান প্রয়োগ হবে না বা হলেও তা কেবল সুনির্দিষ্ট কয়েকটি ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকবে, ল্যান্ড সার্ভে মামলার বিচারপ্রক্রিয়া হবে সংক্ষিপ্ত পদ্ধতির; ইত্যাদি বেশ কয়েকটি ধারণা ও চর্চাও অনেকের মধ্যে প্রচলিত আছে যা নিঃসন্দেহে সঠিক নয়।

ল্যান্ড সার্ভে মামলার নিষ্পত্তি খুব সহজ নাকি কঠিন, সেটি একটি আপেক্ষিক বিষয়। তবে তাতে স্বত্বের বিষয় ফয়সালা করা বা রায়ে সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দেয়া যাবে না মর্মে ধারণাটি মারাত্মক ভুল। কোনো কোনো মামলার ফিচার অনুযায়ী স্বত্বের বিষয়টি হয়তো রায়ে ঘোষণা করা লাগে না, কিন্তু সব ক্ষেত্রে তা নয়। যেমন- খাস খতিয়ানে চলে যাওয়া বা 'দাগছুট' (বাস্তবে দাগের অস্তিত্মত্ব আছে, কিন্তু কোনো খতিয়ানে রেকর্ড হয়নি) জমির রেকর্ড নিজের নামে পাওয়ার দাবিতে আনীত মামলায় ডিক্রি হলে ওই জমিবাবদ ডিক্রিদারের নামে নতুন খতিয়ান খুলে দেয়ার কিংবা জমিটা তার নামীয় বিদ্যমান কোনো খতিয়ানেই অন্তর্ভুক্ত করে দেয়ার নির্দেশনা দিতে হয়। কিন্তু এরূপ নির্দেশনার ভিত্তিই হবে ডিক্রিদারকে ওই জমির স্বত্বদখলকার মর্মে ঘোষণা করা।

স্বত্বদখলকার হওয়া সত্ত্বেও খতিয়ানে নাম না-আসায় বাদী মামলা করল এবং দাবি প্রমাণিতও হলো, এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট খতিয়ানটিকে অশুদ্ধ বলা এবং শুদ্ধকরণ হিসেবে তাতে প্রাপ্য হিস্যানুযায়ী তার নাম অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশনার ভিত্তি হিসেবে স্বত্বের ঘোষণাটি দিয়ে নেয়াটা রায়কে কি মজবুত করবে না? কোনো জমির স্বত্বদখলের সরেজমিন বা প্রকৃত চিত্রের কাগজি-রূপই হচ্ছে রেকর্ড-অব-রাইটস (খতিয়ান+নকশা), রেকর্ডের কোনো তথ্য যদি সরেজমিনের সঙ্গে না মেলে, তাহলেই বলা হয় যে রেকর্ডটি ভুল। কোনো রেকর্ডের শুদ্ধতা যাচাই মানেই কিন্তু খতিয়ান-সম্পর্কিত ব্যক্তিদের স্বত্বদখলের বিষয়টি যাচাই করা। ফলে ল্যান্ড সার্ভে মামলায় স্বত্বের বিষয়টি দেখতে হয় না মর্মে ধারণাটি নিঃসন্দেহে হাস্যকর।

রেকর্ড ভুলের কারণে সাধারণ দেওয়ানি আদালতে দায়েরি মামলায় ডিক্রি হলেও কালেক্টরের কার্যালয়ে আবার আলাদা মিস- কেস করিয়েই তর্কিত রেকর্ড সংশোধন করাতে হয়। কিন্তু ল্যান্ড সার্ভে মামলায় ট্রাইবু্যনাল একাই ওই দুটি কাজ করে। খতিয়ানের ভুলভ্রান্তি যাচাই বা খতিয়ানভুক্ত মালিকদের প্রাপ্যতা নির্ধারণ করার জন্য অনেক সময় বাটোয়ারা মামলার চেয়েও বেশি পরিশ্রম করা লাগে। মোদ্দা কথায়, ল্যান্ড সার্ভে মামলার প্রকৃতি খাঁটি দেওয়ানি হলেও এটি কোনো একক মামলা নয়, বরং যৌগিক মামলা এবং নিষ্পত্তিও করতে হয় দেওয়ানি ও জরিপের আঙ্গিক মিলিয়ে। কারণ, ১৫-২০ বছর সময় নিয়ে এবং সরেজমিনে প্রস্তুত করা রেকর্ডের শুদ্ধতা যাচাইয়ের কাজটি করতে হয় ল্যান্ড সার্ভে মামলায়, দক্ষতা ও দায়িত্বশীলতার প্রয়োজন রয়েছে বলেই জজিয়তে তুলনামূলক অভিজ্ঞ ধরে সহকারী বা সিনিয়র সহকারী জজদের পরিবর্তে যুগ্ম জেলা জজদের দিয়ে এসব বিশেষায়িত আদালতগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ল্যান্ড সার্ভে মামলার নিষ্পত্তি খুবই সহজ মর্মে পাইকারি মন্তব্য করা দায়িত্বশীল মনোভাবের পরিচয় নয়।

ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবু্যনালে দেওয়ানি কার্যবিধির বিধান চলবে না বা চললেও তা কেবল সুনির্দিষ্ট কয়েকটি ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকবে মর্মে ধারণা যারা পোষণ করেন তারা এসএটি অ্যাক্টের ১৪৫ডি. ধারার বরাত দেন। ল্যান্ড সার্ভে মামলায় উপস্থিতির পরওয়ানা, দলিলাদি উদ্ঘাটন ও পরিদর্শন, হলফনামার মাধ্যমে সাক্ষ্য গ্রহণ, সরকারি দলিল বা রেজিস্টার তলব, সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য কমিশনার নিয়োগ এবং বিধিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে নির্ধারিত অন্যকোনো বিষয়ে প্রচলিত দেওয়ানি কার্যবিধির বাইরে গিয়ে বিশেষ বিধান প্রণয়ের সুযোগ সরকারকে দেয়া হয়েছে এবং তা করা হলেই কেবল সে ক্ষেত্রে দেওয়ানি কার্যবিধির বিধান প্রয়োগ করতে হবে প্রণীত বিশেষ বিধানকে প্রাধান্য দিয়ে।

ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবু্যনাল সংক্রান্ত ১৪৫ডি. ধারার মূল কথা বা উদ্দেশ্যগত ব্যাখ্যা কিন্তু এটিই। অথচ ধারাটিতে ব্যবহৃত বাক্যশৈলীর ভিন্নতার কারণে পুরো বিষয়টি আমরা সম্পূর্ণ উল্টিয়ে ব্যাখ্যা করছি এবং ল্যান্ড সার্ভে মামলায় দেওয়ানি কার্যবিধির প্রযোজ্যতা সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি। একটু চিন্তা করলেই কিন্তু বোঝা যায় যে, শুধু ১৪৫ডি. ধারায় বর্ণিত বিধানগুলো দিয়ে যদি ট্রাইবু্যনালকে চলতে বলা হয় তাহলে নিষ্পত্তি তো দূরের কথা, মামলা দায়ের বা গ্রহণই কিন্তু করার সুযোগ নেই!

দেওয়ানি মামলা বা কার্যধারায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যা যা করা লাগে তার সবকিছুই দেওয়ানি কার্যবিধিতে মোটামুটি বিধৃত আছে, তবে সময়ের আবর্তনে সেগুলোর প্রয়োগে হয়তো সময় লাগছে বেশি। লক্ষ্যের বিষয়, মামলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অনেককিছু করা লাগলেও এর মধ্যে কয়েকটি কাজ আছে যেগুলো দ্রম্নতবিচারে সহায়ক এবং ১৪৫ডি. ধারায় কিন্তু সেগুলোই বলে দেয়া হয়েছে।

দেওয়ানি কার্যবিধির প্রচলিত বিধানমতে এগোলে মামলার নিষ্পত্তি দ্রম্নত হবে না এবং এতে বিশেষায়িত ট্রাইবু্যনাল গঠনের উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে- এরূপ আশঙ্কা ও প্রত্যাশা থেকেই কিন্তু কতিপয় বিষয়ে বিশেষ বিধান প্রণয়নের সুযোগ রাখা হয়েছে। কিন্তু ওই সব বিষয়ের কোনোটি নিয়েই এখন পর্যন্ত বিশেষ বা অতিরিক্ত কোনো বিধান প্রণয়ন করা হয়নি। বিষয়টি এক হিসাবে স্বস্তিরও বটে, কারণ বর্তমানে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে যে অদক্ষতা ও অপেশাদারিত্বের প্রতিফলন দেখা যায়, তাতে তা করতে গেলে লেজেগোবরে হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাই বেশি থাকবে, দেওয়ানি কার্যবিধির বিদ্যমান বিধানের চেয়ে উত্তমতর আর হবে না।

প্রচলিত দেওয়ানি কার্যবিধির বিধানাবলি অপ্রযোজ্য রেখে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবু্যনালকে চলতে হলে ভিন্ন একটি সিপিসি তৈরি করিয়ে আইনে (এসএটি অ্যাক্টে কিংবা বিধিমালায়) ঢুকিয়ে নিতে হবে। কিন্তু এটি যেমন সম্ভব নয়, তেমনি প্রয়োজনও নেই। কারণ, প্রতিটি ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবু্যনাল একটি পরিপূর্ণ দেওয়ানি আদালত এবং প্রতিটি ল্যান্ড সার্ভে মামলা একটি আদি দেওয়ানি মামলা। এখন পর্যন্ত আইনের যে বিধান, তাতে মূল মামলায় তো বটেই, উদ্ভূত মিস বা আপিলেও দেওয়ানি কার্যবিধির সব সুবিধা-অসুবিধা সমানভাবে প্রযোজ্য হবে এবং এ ক্ষেত্রে আলাদা করে সংক্ষিপ্ত বিচারেরও কোনো সুযোগ নেই বলে আমি মনে করি। ল্যান্ড সার্ভে মামলার (মূল কিংবা মিস বা আপিলেও) প্রতিটি স্তরে আমাদের সুযোগ ও প্রয়োজন রয়েছে বিদ্যমান দেওয়ানি কার্যবিধির সকল বিধান চোখ বন্ধ করে প্রয়োগ করার।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<92872 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1