১৯৭৫ সালের সাবালকত্ব আইন অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সি যে কোনো ব্যক্তি নাবালক। ১৮৮২ সালের সম্পত্তি হস্তান্তর আইন এবং ১৮৭২ সালের চুক্তি আইনের বিধান অনুযায়ী তিনি নিজে কোনো সম্পত্তি বিক্রি বা কোনো চুক্তি করতে পারেন না। এ ছাড়া রেজিস্ট্রেশন আইন ১৯০৮-এর ৩৫ ধারা অনুসারে কোনো নাবালক দলিল সম্পাদন করতে পারে না। নাবালকের পক্ষে তার পিতা বা মাতা কিংবা অন্য কোনো অভিভাবক সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারেন।
পিতা স্বাভাবিক অভিভাবক, তাই পিতাকে নাবালকের অভিভাবক নিযুক্ত হতে হয় না। নাবালকের পক্ষে কোনো কাজ সম্পন্ন করতে হলে পিতাকে আদালতের হুকুমের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। পিতা ছাড়া অন্যরা নাবালকের সম্পত্তি বিক্রয় করতে চাইলে প্রথমে আদালত থেকে অভিভাবক নিযুক্ত হতে হয়।
মেজরিটি অ্যাক্ট ১৮৭৫-এ জেলা জজকে এ ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। ১৮৯০ সালের গার্ডিয়ান অ্যান্ড ওয়ার্ডস অ্যাক্টের ৮নং ধারা মতে, নাবালকের অভিভাবক নিয়োগের জন্য আদালতে দরখাস্ত করতে হবে। আদালত সেই দরখাস্ত পরীক্ষা করে দেখবেন এবং প্রয়োজন মনে করলে নাবালকের কল্যাণের জন্য অভিভাবক নিযুক্ত করবেন। আদালত যাকে অভিভাবক নিয়োগ করবেন তিনি আদালতের অনুমতি ছাড়া নাবালকের সম্পত্তি বিক্রি বা বন্ধক দিতে পারবেন না। এবং ১০নং ধারা অনুযায়ী অনুমোদিত ফরমে তা করতে হবে।
আদালত কর্তৃক নাবালকের অভিভাবক নিয়োগ না করা হলে সে ক্ষেত্রে নাবালকের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হলেই সে সাবালক গণ্য হবে। কাজেই নাবালকের পক্ষে ওই সম্পত্তি বিক্রয়ের অনুমতি নিতে হয়।
কোনো মানসিক প্রতিবন্ধী বা পাগলের সম্পত্তি বিক্রয়ের জন্যও একই ভাবে আদালতের অনুমতি নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে নির্বোধ, উন্মাদ বা অপ্রকৃতিস্থ বলতে যে কোনো বয়সের ব্যক্তিকেই বোঝাবে।
তবে নাবালকের অনুকূলে বা বরাবরে সম্পত্তি হস্তান্তর করতে আইনে কোনো বিধি-নিষেধ নেই। অর্থাৎ অভিভাবক কোনো সম্পত্তি নাবালকের পক্ষে ক্রয় করলে তা বৈধ বলে বিবেচিত হবে। কোনো ব্যক্তি নাবালকের কাছে কোনো সম্পত্তি বিক্রয় করার পর নাবালকত্বের অজুহাতে তা অস্বীকার করতে পারবে না। সুতরাং একজন নাবালক হস্তান্তর গ্রহীতা হতে পারে। কিন্তু দাতা হতে পারে না। দাতা হতে হলে যথাযথ আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে তার পক্ষে তার অভিভাবক সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারেন।
কে হবেন নাবালকের অভিভাবক
নাবালক শিশুর অভিভাবক হিসেবে যে সব ব্যক্তির আইনগত স্বীকৃত রয়েছে তারা হলেন বাবা, বাবা কর্তৃক উইল দ্বারা নিয়োগকৃত ব্যক্তি, দাদা ও দাদা কর্তৃক উইল দ্বারা নিয়োগকৃত ব্যক্তি। আপন ভাই, রক্ত সম্পর্কের ভাই, আপন ভাইয়ের ছেলে, রক্ত সম্পর্কীয় ভাইয়ের ছেলে, বাবার আপন ভাইয়ের ছেলে, বাবার রক্ত সম্পর্কীয় ভাইয়ের ছেলে। যে ক্ষেত্রে এ রকম কোনো আত্মীয়ও নেই, সে ক্ষেত্রে আদালত তার স্ববিবেচনামূলক ক্ষমতাবলে যে কাউকে নাবালক, নির্বোধ, উন্মাদ বা অপ্রকৃতিস্থ ব্যক্তির অভিভাবক নিয়োগ করতে পারে।
মুসলিম আইনে বাবা হলেন সন্তানের স্বাভাবিক আইনগত অভিভাবক। মুসলিম আইনে মা সন্তানের অভিভাবক হতে পারেন না। তবে মা ৭ বছর বয়স পর্যন্ত পুত্রসন্তানকে ও বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত কন্যাসন্তানকে কাছে রাখতে পারেন। এ অধিকারকে বলে 'হিজানা' বা জিম্মাদারিত্ব। কিন্তু মা কখনই সন্তানের স্বাভাবিক অভিভাবক হতে পারেন না। কিন্তু বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি অভিভাবকত্বের আবেদন করতে পারেন, যেমন মা যদি দেখেন সন্তানের প্রকৃত অভিভাবক যিনি, তিনি ঠিকমতো দেখাশোনা করছেন না বা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছেন তবে মা নিজ সন্তানের প্রকৃত কল্যাণের জন্য তার কাছে সন্তান থাকা উচিত মর্মে অভিভাবকত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য আবেদন করতে পারেন।
আদালত কখন অভিভাবক নিয়োগ করেন
যদি কোনো নাবালকের স্বাভাবিক অভিভাবক থেকে থাকে, তবে আদালতের মাধ্যমে অভিভাবক নিয়োগের কোনো প্রয়োজন নেই। তবে স্বাভাবিক অভিভাবক তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে বা স্বাভাবিক অভিভাবকের মৃতু্য হলে বা অভিভাবকত্বের অধিকার নিয়ে মা-বাবা বা দাদা বা নানি-বাবার মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হলে ও সন্তানের অভিভাবকত্ব দাবি করে একাধিক আবেদনপত্র জমা হলে আদালত সমগ্র পরিস্থিতির পর্যবেক্ষণ শেষে নাবালকের কল্যাণের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত ব্যক্তিকে অভিভাবক নিয়োগ করতে পারেন।
সন্তানের সম্পত্তির অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে প্রচলিত মুসলিম আইন ৩ ধরনের অভিভাবকত্ব স্বীকার করে।
১। আইনগত অভিভাবক কখন নাবালকের সম্পত্তি বিক্রি করতে পারেন- নাবালকের খাদ্য, বস্ত্র বা লালন-পালনের মতো অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজনে নাবালকের জিনিসপত্র ও অস্থাবর সম্পত্তি আইনগত অভিভাবক বিক্রয় বা বন্ধক দিতে পারেন। এ ছাড়া একজন আইনগত অভিভাবক শুধু নিম্নলিখিত এক বা একাধিক কারণে নাবালকের স্থাবর সম্পত্তি বিক্রয় করতে পারেন যখন ১. ক্রেতা দ্বিগুণ মূল্য দিতে প্রস্তুত, ২. সম্পত্তিটি ধ্বংসের পথে, ৩. যদি সম্পত্তির ব্যয় তার আয়কে ছাড়িয়ে যায়। তবে এজাতীয় বিক্রয় কেবল নাবালকের ভরণপোষণ বা উইলের দাবি পরিশোধ, ঋণ বা ভূমি কর পরিশোধের জন্যই করা যেতে পারে, ৪. সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে।
২. আদালত কর্তৃক নিয়োগকৃত অভিভাবক: উপরোক্ত আইনগত অভিভাবকদের অনুপস্থিতিতে সন্তানের সম্পত্তির অভিভাবকদের জন্য আদালত কর্তৃক কোনো যোগ্য ব্যক্তিকে নাবালকের সম্পত্তির তত্ত্বাবধানের জন্য নিযুক্ত অভিভাবক আদালতের অনুমতি ছাড়া নাবালকের স্থাবর সম্পত্তি কোনো অংশ বন্ধক দিতে বা বিক্রয়, দান, বিনিময় বা অন্য কোনো প্রকারে হস্তান্তর করতে পারেন না।
৩. কার্যত অভিভাবক : কোনো ব্যক্তি আইনগত অভিভাবক কিংবা আদালত কর্তৃক নিয়োগকৃত অভিভাবক না হলেও স্বেচ্ছায় নাবালকের শরীর ও সম্পত্তির দায়িত্ব নিতে পারেন। এ ধরনের অভিভাবকত্বকে কার্যত অভিভাবক বলা হয়। একজন কার্যত অভিভাবক নাবালকের শরীর ও সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ক মাত্র। তিনি নাবালকের স্থাবর সম্পত্তির কোনো স্বত্ব, স্বার্থ বা অধিকার হস্তান্তর করতে পারেন না এবং তিনি তা করলে সে হস্তান্তর বাতিল হবে। মা, চাচা, ভাই, শ্বশুর প্রমুখ হলেন কার্যত অভিভাবক। সন্তানের ক্ষেত্রে বাবার বংশের লোকদের ওপর প্রথমে দায়িত্ব ন্যস্ত হবে। তারা ব্যর্থ হলে মায়ের বংশের আত্মীয়রা নাবালকের বিবাহ চুক্তি সম্পাদনের দায়িত্ব পাবেন।
গার্ডিয়ান্স অ্যান্ড ওয়ার্ডস অ্যাক্ট, ১৮৯০-এর ধারা ১৭ (ক)-এর অধীনে নাবালকের অভিভাবক হিসেবে নিযুক্তির জন্য শুধু নিকটাত্মীয় বা প্রিয়জনই নয়, নাবালকের যে কোনো আত্মীয় বা বন্ধুও পারিবারিক আদালতের কাছে আবেদন করতে পারেন। আদালত এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে অভিভাবকত্ব নির্ধারণ করতে পারে ক. নাবালকের কল্যাণ, খ. নাবালকের বয়স, লিঙ্গ ও ধর্ম, গ. আবেদনকারী অভিভাবকের চরিত্র ও আর্থিক সক্ষমতা, নাবালকের সঙ্গে তার গোত্র-সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা, ঘ. বাবা-মা কারও মৃতু্য হয়ে থাকলে মৃতের অন্তিম ইচ্ছা (কার কাছে সন্তান মানুষ হবে সে বিষয়ে), ঙ. নাবালক বা তার সম্পত্তির সঙ্গে আবেদনকারী অভিভাবকের অতীত বা বর্তমান কোনো সম্পর্ক থেকে থাকলে, চ. নাবালকের নিজস্ব ইচ্ছা, তার অভিভাবক নির্বাচনের মতো যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তা থেকে থাকলে।
পিতা কখন সন্তানের ভরণপোষণ দিতে বাধ্য আর কখন বাধ্য নয় :
মুসলিম আইনে একজন বাবা তার নাবালক পুত্র-কন্যার ভরণপোষণ দিতে বাধ্য। শুধু যখন পুত্রসন্তান বয়ঃসন্ধিতে পদার্পণ করে সে সময় থেকে পিতা তার পুত্রের ভরণপোষণ দিতে আর বাধ্য নন। কণ্যাসন্তানের ক্ষেত্রে এ সময়সীমা যতদিন না তার বিয়ে হচ্ছে, সে সময় পর্যন্ত বহাল থাকে। বিধবা বা তালাকপ্রাপ্ত মেয়েকেও বাবা ভরণপোষণ দিতে বাধ্য। তবে বিধবা পুত্রবধূর ভরণপোষণে তিনি বাধ্য নন। যদি কোনো বাবার যুবক সন্তান পঙ্গু বা অসমর্থ হয়ে থাকে, তবে বাবা তাকে ভরণপোষণ প্রদান করবেন। নাবালক পুত্র ও অবিবাহিত কন্যা যৌক্তিক কারণ ছাড়াই বাবার কাছ থেকে পৃথক বসবাস শুরু করলে, বাবা সে ক্ষেত্রে তাদের ভরণপোষণে বাধ্য নন। যে শিশুসন্তানের নিজস্ব সম্পত্তি রয়েছে, বাবা তার ভরণপোষণ দিতে বাধ্য নন।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা,