থানায় মামলা নিতে না চাইলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির করণীয়
থানা পুলিশ মামলা নিতে না চাইলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি, একজন অভিজ্ঞ আইনজীবীর পরামর্শক্রমে বা সহায়তায়, সংশ্লিষ্ট থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত বিজ্ঞ আমলী জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করতে পারেন। আদালতে দায়ের করা মামলার অভিযোগকে নালিশি দরখাস্ত বা আরজি বলা হয়। যিনি আরজি দায়ের করেন তাকে ফরিয়াদি/বাদী বলা হয়। আরজিতে আদালতের নাম, যে আইনে মামলা দায়ের হবে সেই আইনের সংশ্লিষ্ট অপরাধের ধারা, বাদী ও আসামির নাম-ঠিকানা, সাক্ষীদের নাম-ঠিকানা এবং ঘটনার বিবরণ উলেস্নখ করতে হয়
প্রকাশ | ১২ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
মো. রায়হানুল ওয়াজেদ চৌধুরী
দেশের চলমান প্রেক্ষাপটে থানায় এজহার দায়ের বিষয়টি নিয়ে জনসাধারণের জানার অগ্রহ বেড়েছে। থানায় এজহার দায়ের করার মানে হচ্ছে কোনো অপরাধের আইনি পদক্ষেপ শুরু করা। যিনি থানায় এজাহার দায়ের করেন তাকে এজাহারকারী বা সংবাদদাতা বলা হয়। কোনো ফৌজদারি অপরাধ সংঘটনের পর সংক্ষুব্ধ বিচারপ্রার্থীর/সংবাদদাতার প্রথম কাজ হলো সংশ্লিষ্ট থানায় এজাহার দায়ের করা।
ফৌজদারি মামলা বা ক্রিমিনাল কেস হলো: নির্যাতন, অপহরণ, হুমকি, অগ্নিসংযোগ, চুরি, ডাকাতি, দস্যুতা, ধর্ষণ, খুন, প্রতারণা, বে-আইনি সমাবেশ, ইভটিজিং, মিথ্যা সাক্ষ্যদান, জালিয়াতি, মাদক কারবারি ইত্যাদি অপরাধমূলক কর্মকান্ড থেকে উদ্ভূত মামলা।
থানায় মামলা হলে থানা কর্তৃপক্ষ সেটি বিজ্ঞ আদালতে স্থানান্তরিত করে। আদালতে এই ধরনের মামলাকে থানার মামলা/জি.আর (জেনারেল রেজিস্ট্রার) মামলা হিসেবে ধরা হয়। ফৌজদারি কার্যবিধি, পুলিশ রুলস অব বেঙ্গল (পিআরবি) এবং উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী ধর্তব্য (আমলযোগ্য) অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশ থানায় মামলা নিতে বাধ্য। ধর্তব্য অপরাধ সম্পর্কে ফৌজদারি কার্যবিধির দ্বিতীয় তফসিলে উলেস্নখ করা আছে। সহজভাবে বলতে গেলে বড় ধরনের যে কোনো অপরাধ, যেমন চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই, হত্যা, ধর্ষণ- এসবই ধর্তব্য অপরাধ।
যদি কোনো অযৌক্তিক কারণে থানায় মামলা নিতে অস্বীকার করে তাৎক্ষণিক সেটা সংশ্লিষ্ট থানার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানাতে পারেন। তাহলে তারা আইন অনুযায়ী দ্রম্নত ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিতে পারেন। বিভিন্ন কারণ বা সমস্যা দেখিয়ে থানার পুলিশ মামলা নিতে গড়িমসি/ অপারগতা প্রকাশ করে অনেক সময়। এই পরিস্থিতে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির কী করণীয়? পুলিশ থানায় কখনো মামলা নিতে না চাইলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আরো যেসব আইনি উপায় আছে;
১. ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা
থানা পুলিশ মামলা নিতে না চাইলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি, একজন অভিজ্ঞ আইনজীবীর পরামর্শক্রমে বা সহায়তায়, সংশ্লিষ্ট থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত বিজ্ঞ আমলী জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করতে পারেন। আদালতে দায়ের করা মামলার অভিযোগকে নালিশি দরখাস্ত বা আরজি বলা হয়। যিনি আরজি দায়ের করেন তাকে ফরিয়াদি/বাদী বলা হয়। আরজিতে আদালতের নাম, যে আইনে মামলা দায়ের হবে সেই আইনের সংশ্লিষ্ট অপরাধের ধারা, বাদী ও আসামির নাম-ঠিকানা, সাক্ষীদের নাম-ঠিকানা এবং ঘটনার বিবরণ উলেস্নখ করতে হয়। যখন কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা বাদী সরাসরি আদালতে গিয়ে বিজ্ঞ অ্যাডভোকেটের মাধ্যমে মামলা দাখিল করলে সেটিকে পিটিশন রেজিস্টার এবং সি.আর. (কমপেস্নইন্ট রেজিস্টার) বলে। আদালতে আরজি দাখিল করার পর ম্যাজিস্ট্রেট ফরিয়াদি/বাদীর জবানবন্দি গ্রহণপূর্বক সারাংশ ম্যাজিস্ট্রেট লিপিবদ্ধ করবেন এবং উহাতে বাদী বা সাক্ষীর সই নেবেন। বিজ্ঞ আদালত ফরিয়াদির জবানবন্দি গ্রহণপূর্বক সন্তুষ্ট হলে, সরাসরি মামলাটি আমলে নিতে পারেন এবং অপরাধের গুরুত্ব বিবচেনায়; অভিযুক্তকে সমন/ ওয়ারেন্ট ইস্যুর আদেশ দিতে পারেন বা সংশ্লিষ্ট থানাকে এফআইআর হিসেবে রুজু করার নির্দেশ দিতে পারেন অথবা উপযুক্ত যে কোনো ব্যক্তি ও সংস্থাকে (পুলিশ,র্ যাব, সিআইডি, ডিবি) অভিযোগটি তদন্তপূর্বক রিপোর্ট প্রদানের নির্দেশ দিতে পারেন (রিপোর্ট এর ভিত্তিতে মামলা আমলে নেন)।
অথবা বিজ্ঞ আদালত জবানবন্দি গ্রহণপূর্বক সেই আবেদন খারিজও করে দিতে পারেন। নালিশি পিটিশনটি খারিজ হলে অভিযোগকারী খারিজাদেশের বিরুদ্ধে প্রতিকার চেয়ে দায়রা জজ আদালতে বা হাইকোর্ট বিভাগে উক্তাদেশ ঘোষণার ৬০ দিনের মধ্যে রিভিশনের আবেদন করতে পারেন।
এইখানে উলেস্নখ্য যে, বিশেষ আইনের প্রতিকার এর ক্ষেত্রে যদি বিশেষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে মামলা করার কথা বলা থাকে তখন সে অনুযায়ী পিটিশন/মামলা দায়ের করতে হয়। যেমন-নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলা সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা সংশ্লিষ্টবিভাগীয় সাইবার ট্রাইব্যুনালে, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা ট্রাইব্যুনালে দায়ের করতে হবে।
২. হাইকোর্ট বিভাগে মামলা
থানা পুলিশ মামলা নিতে না চাইলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি, অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় মহামান্য হাইকোর্টে রিট দায়ের করে প্রতিকার চাইতে পারেন। রিট আবেদনে থানায় মামলা দায়েরের অনুমতি প্রদান ও আসামিদের গ্রেপ্তারের আদেশ প্রার্থনা করতে পারেন। হাইকোর্ট বিভাগ রায় প্রদান করলে পুলিশ রায় মানতে বাধ্য। অ্যাডমিরালটি (সমুদ্র-সংক্রান্ত বিষয়) এবং কোম্পানি সংক্রান্ত বিষয়ে সরাসরি উচ্চ আদালতে বিচার প্রার্থনা করা যায় এবং জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়ে সরকার বা সংশ্লিষ্ট পক্ষের বিরুদ্ধে মহামান্য হাইকোর্টে রিট দায়ের করা যায়।
৩. মানবাধিকার কমিশনে অভিযোগ
থানা পুলিশ মামলা নিতে না চাইলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনেও প্রতিকার চাওয়া যায়। এছাড়াও, বেশ কিছু বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থার কাছেও এ ধরনের অভিযোগ দেওয়া যায় (বস্নাস্ট, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্ট, মহিলা আইনজীবী সমিতি)। বিশেষ করে নারী নির্যাতন ও মানবিক বিষয়গুলো মানবাধিকার কমিশনের কাছে আবেদন করলে তারা এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে পারেন।
অজ্ঞতা, দীনতা ও নানাবিধ প্রতিবন্ধকতায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমাদের দেশের বাস্তবতায় অসহায় ও দরিদ্র বিচারপ্রার্থী নাগরিক থানায় আইনের আশ্রয় না পেলে পুলিশকে এড়িয়ে ম্যাজিস্ট্র্রেট আদালত বা অন্যান্য ফোরাম পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেন না। এসব দরিদ্র জনগোষ্ঠেীর ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সরকারের 'জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা'র অফিসে যোগাযোগ করা যেতে পারে। আইনজীবী নিয়োগ থেকে শুরু করে মামলা পরিচালনার সম্পূর্ণ খরচ বিনামূল্যে আইনি সেবা দিয়ে থাকে রাষ্ট্রীয় এই সংস্থাটি। এছাড়া, বেসরকারি কিছু সংস্থা, যেমন বস্নাস্ট, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস, মহিলা আইনজীবী সমিতির মতো বেশ কিছু বেসরকারি সংস্থা দুঃস্থ ও মামলা চালাতে অক্ষম ব্যক্তিদের আইনি সহায়তা দিয়ে থাকে।
বলে রাখা ভালো, যে কোনো ঘটনায় আইনি প্রতিকারে প্রথম যোগাযোগের ঠিকানা হচ্ছে স্থানীয় পুলিশ। এজন্য স্থানীয় থানার ওসি, ডিউটি অফিসার, থানার নম্বর ফোনে সেভ করে রাখলে ভালো। এছাড়া যে কোনো সময় জাতীয় জরুরি সেবার ৯৯৯ নম্বরটিতে কল করা যায়।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর, মহানগর দায়রা জজ আদালত, চট্টগ্রাম।