রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইসু্যতে সংবিধান আইনি নৈরাজ্য ও অতীত ইতিহাস

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার ঘটনার পর নিজেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। ওই হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত সেনা কর্মকর্তাদের সমর্থন নিয়ে ১৯৭৫ সালের ২০ আগস্ট খন্দকার মোশতাক সামরিক আইন জারি করে নিজেই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নেন। এরপর তিনি নিজেই নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেছিলেন। তবে বাংলাদেশের রাজনীতির সেই ভয়ংকর অস্থির সময়ে সামরিক অভু্যত্থান পাল্টা অভু্যত্থানের জের ধরে পঁচাত্তরের ৬ নভেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি

প্রকাশ | ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
ক্ষমতাচু্যত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র নিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের মিথ্যাচার ফুঁসে উঠেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংগঠন। এরই মধ্যে ভুল বুঝতে পেরে রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হয়েছে, 'মীমাংসিত বিষয়ে নতুন করে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি না করার জন্য সবার প্রতি আহ্বান।' দেশ-বিদেশ থেকে আমার অনেক পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইসু্যতে জানতে চেয়েছেন যে, আইন ও সংবিধান অনুযায়ী তাকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার সুযোগ আছে কিনা? ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যে কোনো দেশে গণঅভু্যত্থানের পর 'আইন ও সংবিধানের' বিষয়টিই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। সেখানে 'জনআকাঙ্ক্ষার' বিষয়টি বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। সে আলোকে উড়পঃৎরহব ড়ভ হবপবংংরঃু (সময়ের চাহিদা নীতি) প্রয়োগ করে রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে অন্য কাউকে সে পদে বসাতে চাইলেও কোনো ব্যত্যয় ঘটবে না। আমাদের দেশের কয়েকটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি সাধারণ পাঠকদের মাঝে পরিষ্কার হয়ে উঠবে। বাংলাদেশে অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া কিংবা বিদায় নেওয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার করে রাষ্ট্রপতি থেকে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। আবার ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পুনঃপ্রবর্তন করে রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার ঘটনার পর নিজেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। ওই হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত সেনা কর্মকর্তাদের সমর্থন নিয়ে ১৯৭৫ সালের ২০ আগস্ট খন্দকার মোশতাক সামরিক আইন জারি করে নিজেই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নেন। এরপর তিনি নিজেই নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেছিলেন। তবে বাংলাদেশের রাজনীতির সেই ভয়ংকর অস্থির সময়ে সামরিক অভু্যত্থান পাল্টা অভু্যত্থানের জের ধরে পঁচাত্তরের ৬ নভেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। ৩ নভেম্বর এক সামরিক অভু্যত্থান খন্দকার মোশতাকের পতন ডেকে আনে। সেদিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক একজন সাবেক উপ-রাষ্ট্রপতি ও দু'জন সাবেক প্রধানমন্ত্রীসহ চারজন শীর্ষস্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকে গুলি করে হত্যা করে সেনা বাহিনীর কয়েকজন অফিসার। ৩ নভেম্বরের অভু্যত্থানে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান পদচু্যত হন। অভু্যত্থানের নেতা ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ নিজেকে সেনা প্রধান ঘোষণা করেন এবং ছয়ই নভেম্বর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত করেন। পরের দিন বদলে যায় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। সিপাহী বিদ্রোহতে নিহত হন ৩ নভেম্বরের অভু্যত্থানের নায়ক খালেদ মোশাররফ। আবার সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ চলে যায় জেনারেল জিয়াউর রহমানের হাতে। তবে বিচারপতি সায়েম ১৯৭৭ সালের একুশে এপ্রিল পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি পদে বহাল ছিলেন, যদিও ক্ষমতার চাবি-কাঠি ছিল জেনারেল জিয়াউর রহমানের হাতে। এক বছর পর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আয়োজন করেন জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং ১৯৭৮ সালের ৩ জুন তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। জেনারেল জিয়াউর রহমান হত্যার পর প্রথমে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও পরে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বিচারপতি আব্দুস সাত্তার। উনিশশ' বিরাশি সালের ২৪ মার্চ তৎকালীন সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক অভু্যত্থানে ক্ষমতা হারান তিনি ও রাষ্ট্রপতি হন বিচারপতি আবুল ফজল মোহাম্মদ আহ্‌সান উদ্দীন চৌধুরী। কিন্তু ২৭ মার্চ ১৯৮২ সালে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব শুরু করে ১৯৮৩ সালের এগারই ডিসেম্বর ক্ষমতা থেকে সরে যান তিনি। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে সরিয়ে নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ঘোষণা করে বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো সামরিক শাসন জারি করেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। রেডিও টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে সেদিন তিনি বলেছিলেন, 'জনগণের ডাকে সাড়া দিতে হইয়াছে, ইহা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিলো না'। অন্যদিকে, প্রবল গণ-আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন সাবেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ওইদিন প্রথমে পদত্যাগ করেছিলেন তখনকার ভাইস প্রেসিডেন্ট ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ। এরপর জেনারেল এরশাদ বিচারপতি সাহাবুদ্দিনকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ করেন এবং নিজে পদত্যাগ করেন। এরপর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হন বিচারপতি সাহাবুদ্দিন। উপরের আলোচনাসমূহ কতটুকু সংবিধান সম্মত ছিল তা সংবিধান বিশেষজ্ঞরা ভালো বলতে পারবেন। তবে বর্তমান বিদ্যমান আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ সংবিধান অনুযায়ী সংসদ রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করতে পারে। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর সংসদ বাতিল করে দেওয়ায় সেই সুযোগ আর নেই। আবার রাষ্ট্রপতি চাইলে স্পিকারের কাছে পদত্যাগ করতে পারেন। কিন্তু স্পিকার পদত্যাগ করেছেন এবং ডেপুটি স্পিকার কারাগারে থাকায় সেটিও সম্ভব হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ইসু্যতে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বা অপসারণের দাবি উঠলেও সেটি সংবিধান অনুযায়ী হওয়া সম্ভব নয়। অতীত শিক্ষা দেয় যে, পরিবেশ পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে সংবিধান পুরোপুরি অনুসরণ করা হয়নি। সে আলোকে উড়পঃৎরহব ড়ভ হবপবংংরঃু (সময়ের চাহিদা নীতি) প্রয়োগ করে রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে অন্য কাউকে সে পদে বসাতে চাইলে ক্ষতি কার, ক্ষতি কীসের। অপ্রতিরোধ্য নির্লিপ্ততায় ছেয়ে যাওয়া ফ্যাসিস্টের ছায়া সরাতে এখন সময়ে দাবি মাত্র। লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগবেষক ও আইনগ্রন্থ প্রণেতা। ইমেইল: ংবৎধল.ঢ়ৎধসধহরশ@মসধরষ.পড়স