জুলাইয়ে গণ-অভু্যত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু করার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনাল (আইসিটি)-তে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে হাইকোর্টের বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারকে। এছাড়া, ট্রাইবু্যনালে সদস্য হিসেবে থাকছেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
এইবার দ্রম্নত বিচার কাজ শুরু হওয়াটা জরুরি। আশা করছি, সহস্র শহীদের আত্মত্যাগের একটা প্রতিদান আসবে ন্যায়বিচারের মাধ্যমে।
জুলাই গণহত্যার বিচার নিয়ে আইনগত অনেক টেকনিক্যালিটি রয়েছে। তবে ইন জেনারেল যে প্রশ্নগুলো প্রায়সময়ই আমরা পাই, সেটা নিয়ে একটু সংক্ষেপে বলি, যদি এতে জিজ্ঞাসুদের মনে কিছুটা স্বচ্ছতা আসে।
প্রথম প্রশ্ন- এই ট্রাইবু্যনাল এবং আইনটি অত্যন্ত বিতর্কিত। এরকম জায়গায় কেন বিচার করতে হবে? দেখেন 'আদালত' বা ট্রাইবু্যনাল ইটসেলফ একটা বিমূর্ত জিনিস, ইট-পাথরের নিষ্প্রাণ স্থাপনা। এর তো আর ভালো-মন্দ হতে পারে না। এখানকার বিচারক-আইনজীবীদের কার্যক্রমই বলে দেবে এখানে ইনসাফ হয় কিনা। এই বিচারিক প্রক্রিয়া থেকে আপনি যদি সাক্ষী গুম করা, হুমকি-ধমকি দেয়া, এভিডেন্স তৈরি করা আর সাক্ষীকে মুখস্থ করানো, ডিফেন্সকে নূ্যনতম সুযোগ-সুবিধা না দেয়া, বিচারক এবং আইনজীবীর 'আমি খাড়াইয়া যামু আপনে বসাইয়া দেবেন' এ ধরনের কোলাবোরেশন এবং সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপ- এই বিষয়গুলো যদি বাদ দেন এবং ১৯৭৩ সালের আইনটিকে বর্তমান প্রেক্ষাপট ও মৌলিক ন্যায়বিচারের জায়গায় অল্প কিছু (খুব বেশি না) সংস্কার আনেন- তাহলে এই ট্রাইবু্যনালেই ইনসাফ করা সম্ভব, অবশ্যই সম্ভব। এর দায়টা বর্তায় বিচারক, প্রসিকিউশন, ডিফেন্স এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ওপর।
জুলাই গণঅভু্যত্থানের স্পিরিট ধারণ করে সবাই যার যার জায়গা থেকে কাজগুলো করবেন বলে বিশ্বাস রাখি।
দ্বিতীয় প্রশ্ন- একেবারে নতুন একটা ট্রাইবু্যনালে বিচার হলে ক্ষতি কি?
- এইখানে বেশ কিছু লিগ্যাল টেকনিক্যালিটি আছে, লজিস্টিকাল প্রশ্ন আছে। আমি তবুও সহজে বোঝার জন্য একটা বিষয় বলি। ১৯৭৩ সালের আইনে যখন যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হলো, তখন তার একটা বড় সমালোচনা ছিল যে, ১৯৭৩ সালের তৈরি করা আইন দিয়ে ১৯৭১ সালের অপরাধের বিচার কীভাবে হবে? এটাকে বলে রেট্রোস্পেকটিভ ইফেক্ট- ঘটনা ঘটার সময়ে যে বিষয়টা অপরাধ বলে কোনো আইনে লিপিবদ্ধ ছিল না, আপনি পরবর্তী সময়ে আইন করে সেই বিষয়ের বিচার করতে পারেন না। এইটা মৌলিক ন্যায়বিচারের পরিপন্থি। এমনকি আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৫-এরও পরিপন্থি। তাহলে কীভাবে হবে?
এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের সংবিধানে প্রথম সংশোধনী আনা হয়েছিল- যার মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধসহ এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে সংবিধানের ৩৫ সহ আরও কিছু অনুচ্ছেদের প্রয়োগ একেবারে 'বন্ধ' করে দেয়া হয়।
এখন, কথার কথা, জুলাইয়ে সংঘটিত অপরাধগুলোর জন্য আপনি অক্টোবরে নতুন আইন তৈরি করে (দুই-তিন মাসে এই ধরনের অত্যন্ত টেকনিক্যাল একটা আইন লেখা যায় কিনা সেই প্রশ্ন বাদই দিলাম) রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে অর্ডিন্যান্স আকারে জারি করে তা দিয়ে নতুন ট্রাইবু্যনাল বানিয়ে সামগ্রিক বিচার কাজ শুরু করে দেবেন? কি মনে হয়, সম্ভব?
৩য় (সর্বশেষ) প্রশ্ন- এত ভেজালে না গিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার করা যায় না?
- আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) শুধু তখনই কোনো রাষ্ট্রে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করতে পারে, যখন- (১) ওই রাষ্ট্র নিজে বিচারে অক্ষম বিধায় আইসিসি'কে অনুরোধ জানায়; (২) ওই রাষ্ট্রের বিরাজমান পরিস্থিতিতে এই ধরনের বিচারকাজ আয়োজন করা সম্ভব না; অথবা (৩) বিশেষ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কোনো রেজু্যলেশন যদি নেয়া হয়।
বুঝতেই পারছেন, উপরের কোনো ক্রাইটেরিয়াতেই আমরা পড়ছি না। সহস্র শহীদ অকাতরে নিজের রক্ত দিয়ে ফ্যাসিবাদের করাল গ্রাস থেকে আমাদের উদ্ধার করেছে। আর সেই বিচার করার সামর্থ্য আমাদের নেই? আমাদের আইসিসি'তে যেতে হবে?
আশা করি, কিছুটা হলেও ক্ল্যারিফিকেশন এসেছে।
\হ
ব্যারিস্টার শাইখ মাহদী
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট