আদানির সঙ্গে করা বিতর্কিত বিদু্যৎ চুক্তিটি আইনগতভাবে বাতিল করা সম্ভব?

চুক্তিতে এমন কিছু খাতে বাংলাদেশকে টাকা পরিশোধ করার কথা বলা হয়েছে, যে খাতগুলো বাস্তবে নেই। যেমন, চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ একটা রেফারেন্স ট্যারিফ পরিশোধ করবে, যার মধ্যে থাকবে আমদানিকৃত পণ্যের কাস্টমস ডিউটি, সার্ভিস ট্যাক্স, কৃষি কল্যাণ ট্যাক্স, কেন্দ্রীয় বিক্রয় কর, যন্ত্রপাতির উপর ভ্যাট, পূর্ত নির্মাণকাজের ওপর ট্যাক্স এবং আয়কর, ইত্যাদি।

প্রকাশ | ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

ব্যারিস্টার শাইখ মাহদী
পুরো চুক্তিটি খুব ভালোভাবে না যাচাই করে একেবারে সুনির্দিষ্ট আইনগত বিষয়গুলো নির্ধারণ করা মুশকিল। এই কাজ অভিজ্ঞ আইন বিশেষজ্ঞদের। তবে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে এই চুক্তির ব্যবচ্ছেদ করে তুলে আনা বেশ কিছু বিষয় কিন্তু অনলাইনেই পাওয়া যায়, বিশেষ করে ২০২২ সালে ওয়াশিংটন পোস্টে এবং ২০২৩ সালে 'আদানিওয়াচ' নামক একটি অনুসন্ধানী সংবাদ সংস্থার দু'টো রিপোর্ট এই বিষয়ে উলেস্নখযোগ্য। তাদের ভাষ্য যদি খুব জেনারেলাইজডভাবে তুলে ধরি, তাহলে দু'টো পয়েন্টে আইনি বৈধতার প্রশ্নে চুক্তিটি চ্যালেঞ্জ করা যেতে পারে। প্রথমত, ভারতের আইন অনুযায়ী নিজের দেশের চাহিদা মিটিয়ে সারপস্নাস থাকলেই কেবলমাত্র বিদেশে বিদু্যৎ রপ্তানি করা যেতে পারে। বলা হচ্ছে, সেই সময়ে ভারত বিদু্যতে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল না এবং আদানি যাতে বিদেশে বিদু্যৎ রপ্তানি করতে পারে, সে জন্য ঝাড়খন্ড রাজ্যের নিজস্ব বিদু্যৎ বিষয়ক নীতিমালাও পরিবর্তন করা হয় ২০১৬ সালে। বলাবাহুল্য, ২০১৬ সালে ঝাড়খন্ড রাজ্যের ক্ষমতায় ছিল বিজেপি। ভারতের পরিপ্রেক্ষিত থেকেই চুক্তিটি যে আইনসিদ্ধ নয় তা প্রমাণ করার জন্য এই বিষয়টি ব্যবহৃত হতে পারে। আদানিকে কেন অবৈধ সুবিধা দেয়া হচ্ছে এটা নিয়ে গত বছর পার্লামেন্টে প্রশ্ন তুলেছিলেন রাহুল গান্ধীও। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, চুক্তিতে এমন কিছু খাতে বাংলাদেশকে টাকা পরিশোধ করার কথা বলা হয়েছে, যে খাতগুলো বাস্তবে নেই। যেমন, চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ একটা রেফারেন্স ট্যারিফ পরিশোধ করবে, যার মধ্যে থাকবে আমদানিকৃত পণ্যের কাস্টমস ডিউটি, সার্ভিস ট্যাক্স, কৃষি কল্যাণ ট্যাক্স, কেন্দ্রীয় বিক্রয় কর, যন্ত্রপাতির উপর ভ্যাট, পূর্ত নির্মাণকাজের ওপর ট্যাক্স এবং আয়কর, ইত্যাদি। তবে, ২০১৭ সালে চুক্তিটি স্বাক্ষর হওয়ার মাসকয়েক আগেই ভারত সরকার এড়ড়ফং ্‌ ঝবৎারপব ঞধী (এঝঞ) নামে একটি সমন্বিত কর ব্যবস্থা চালু করে- যা রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় পর্যায়ে থাকা বেশিরভাগ কর প্রতিস্থাপন করে। তদুপরি, চুক্তি স্বাক্ষরের ১৫ মাস পরে, ২০১৯ সালে আদানির এই প্রকল্পটিকে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (ঝঊত) ঘোষণা করা হয়, যা কোম্পানির আরও বিভিন্ন কর মওকুফ করে দেয়। বলা হচ্ছে যে, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (ঝঊত) ঘোষণা হওয়ার পরই এই বিদু্যৎকেন্দ্রে বেশিরভাগ আমদানি হয়েছে, এবং সেসব আমদানিকৃত কয়লার ওপর আমদানি শুল্ক বা কোনো অন্যান্য কর পরিশোধ করার প্রয়োজন হয়নি। চুক্তি স্বাক্ষরের পরে যদি চুক্তির ওপরে প্রযোজ্য ভারতীয় আইনের কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটে, সেক্ষেত্রে অবশ্যই বিদু্যতের ক্রেতা বাংলাদেশকে তা নোটিশের মাধ্যমে জানাতে হবে, এই বিধান চুক্তিতেই আছে। চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরে এসব আইনগত পরিবর্তন বিষয়ে বাংলাদেশকে অবহিত করা হয়েছে কিনা সে বিষয়ে আদানিওয়াচ জানতে চাইলে অবশ্য 'কবি নীরব ছিলেন'। এসব টেকনিক্যাল খুঁটিনাটির বাহিরেও, কোনো চুক্তি যদি সাধারণভাবে পাবলিক পলিসির বিরুদ্ধে যায়, কিংবা সরাসরি প্রতারণা বা দুর্নীতির অভিযোগ বা প্রমাণ পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রেও আইনগতভাবে চুক্তি বাতিল করা বা সংশোধনের জন্য আলোচনার টেবিলে টেনে আনার বিষয়টা বিবেচনা করা যায়। এইখানে প্রাসঙ্গিক দু'টো দেশের ঘটনা বলেই শেষ করি। কেনিয়ার বৃহত্তম বিমানবন্দর জোমো কেনিয়াত্তা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট আদানি গ্রম্নপের হাতে তুলে দেয়ার একটা আলোচনায় বসেছিলেন সে দেশের সরকার, গোপন চুক্তিও হয়ে গেছে এই মর্মেও খবর রটে যায়। এই গেল জুলাই-অগাস্টেই নাইরোবিতে তীব্র আন্দোলনের মুখে সেই উদ্যোগে ভাটা পড়ে। আইনজীবীরা আদালতে গেলে এই চুক্তির নেগোসিয়েশন ও পরবর্তী কার্যক্রমের ওপরে স্থগিতাদেশ দেন কেনিয়ার হাইকোর্ট। গত মাসের শেষ দিকে আদানির পক্ষ থেকে আদালতে জানানো হয় যে, চুক্তিটা এখনো ডিউ-ডিলিজেন্স অর্থাৎ যাচাই-বাছাই পর্যায়ে আছে। আর এইদিকে শ্রীলঙ্কার জেভিপি নামক একটি রাজনৈতিক দল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা দেয়, তাদের যদি নির্বাচিত করা হয় তাহলে তারা আদানির সঙ্গে করা ৪৮৪ মেগাওয়াট সক্ষমতার বায়ুবিদু্যৎ প্রকল্প বাতিল করে দেবে। গত ২৩ সেপ্টেম্বর জেভিপির প্রধান অনুরা কুমার দিশনায়েকে শ্রীলঙ্কার নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্বগ্রহণ করেন। আদানিকে কীভাবে ডিল করবেন তারা এখন, দেখার বিষয়। যা হোক, এই মাপের একটা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক চুক্তি বাতিল কিংবা সংশোধনের চেষ্টা করা যে কোনো পক্ষের জন্যই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। আরবিট্রেশন বা আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ বিষয়ক আদালতে বাংলাদেশের পক্ষে-বিপক্ষে এ যাবতকালের যে ১০-১১টা মামলা হয়েছে, তাতে দেশ হিসেবে আমাদের অভিজ্ঞতা খুব একটা প্রীতিকর নয়। ক্যাপাসিটি চার্জসহ বিভিন্ন যে দায়দেনার দাবি তুলে আদানি কোম্পানি বাংলাদেশ সরকারের ওপরে চাপ দিচ্ছে মর্মে যে খবরগুলো দেখছি, সেটা উদ্বেগজনক নিঃসন্দেহে। আদানির বিদু্যৎ সরবরাহ হুট করে বন্ধ হয়ে গেলে দেশের বিদু্যৎ খাতে কোনো জটিলতা তৈরি হয় কিনা সেগুলোও বিবেচ্য বিষয়। স্বাধীন বাংলাদেশের স্পিরিট ধারণ করে দূরদৃষ্টি, দেশপ্রেম এবং বাস্তবসম্মত সাহসের সঙ্গে এই বিষয়গুলো ডিল করা জরুরি। ব্যারিস্টার শাইখ মাহদী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী