শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১
সময়োপযোগী পরিবর্তনের লক্ষ্যে যেসব সংশোধনী আনা জরুরি

'আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবু্যনাল) আইন-১৯৭৩'-এর সংশোধন

সংশোধনীতে রাজনৈতিক দল বা সংগঠনকে নিষিদ্ধের কথা বলা হয়েছে কিন্তু এই নিষিদ্ধ কী শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ অ্যাক্টিভিটিসকে নিষিদ্ধ করবেন, নাকি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নিষিদ্ধ করা হবে তা স্পষ্ট করা জরুরি। ডিজিটাল পস্নাটফর্মের এই যুগে দেশের গন্ডির মধ্য নিষিদ্ধ হলেও বাহিরে বসে প্রচার প্রপাগান্ডা চালানো যে কত সহজ তা আমরা ৩৬ জুলাইয়ের (৫ আগস্ট) বিপস্নবের পরের বিগত কয়েক দিনেই বুঝে গেছি। সারা পৃথিবীতেই রাজনৈতিক দলগুলোর কমিটি রয়েছে। নিষিদ্ধ হলে দলের কমিটির পদধারীরা চট করে ঢুকতে না পারলেও তাদের ডিজিটাল প্রচার প্রপাগান্ডা চালানো অনেক সহজ হবে। আবার দেশের বাহিরে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করলে সে ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ কিভাবে হবে তা স্পষ্ট করা দরকার। আবার রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হলে তার নিবন্ধনও বাতিল হবে কিনা সে ব্যাপারে সংশোধনীতে কিছু বলা নেই
ব্যারিস্টার এস এম মইনুল করিম
  ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
-

বাংলাদেশে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় কথিত অন্য অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের আটক, বিচার এবং শাস্তি প্রদানের জন্য প্রণীত হয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবু্যনাল) আইন, ১৯৭৩। এ আইনে আন্তর্জাতিক শব্দটি থাকলেও আন্তর্জাতিকতার লেশমাত্র ছিল না বিগত দিনে। বিগত ২০২৪ সনের জুলাই-আগস্ট মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা ব্যানারে কোটা সংস্কারের আন্দোলন এবং তাতে হতাহতের বিচার দাবি ফ্যাসিবাদ পতনের এক দফার মধ্য দিয়ে রূপ নেয় কাঙ্ক্ষিত গণ-অভু্যত্থান বা দ্বিতীয় স্বাধীনতায়। এই গণ-অভু্যত্থান বা দ্বিতীয় স্বাধীনতার সংগ্রামের সময় সংঘটিত হত্যাকান্ডের বিচারের জন্য নতুন করে 'আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবু্যনাল) আইন, ১৯৭৩' সময়োপযোগী করতে সরকারের পক্ষ থেকে খসড়া সংশোধনী উপস্থাপন করা হয়েছে। যদিও এর আগে আরও দুবার এ আইনের সংশোধনী আনা হয়েছিল। প্রথম সংশোধনী আনা হয়েছিল ২০০৯ সালে এবং দ্বিতীয় সংশোধনী আনা হয়েছিল ২০১৩ সালে। নতুন প্রস্তাবনা- প্রস্তাবিত সংশোধনীতে ৩টি নতুন ধারা ও ২টি উপধারা যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়। প্রস্তাবিত ধারাগুলো হলো- ৪এ, ১৩এ ও ২০এ এবং উপধারাগুলো হলো- ৩(৩) ও ১২(২)। এ ছাড়া সংশোধনের প্রস্তাব করা হয় ৩(২)(এ), ৪(২) ও ১৯ ধারায়। কি আছে এই নতুন ধারাসমূহে? প্রস্তাবিত সংশোধনীর ৩(২)(এ) বলা হয়েছে, হত্যা, নির্মূল, দাসত্ব, নির্বাসন, কারাবাস, অপহরণ, বন্দিত্ব, জোরপূর্বক গুম, নির্যাতন, ধর্ষণ, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, যৌনদাসত্ব, জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তি, জোরপূর্বক গর্ভধারণ, জোরপূর্বক বন্ধ্যাকরণ বা অন্য অমানবিক কাজ। কোনো বেসামরিক জনসংখ্যার বিরুদ্ধে ব্যাপক বা পদ্ধতিগত আক্রমণের অংশ হিসেবে প্রতিশ্রম্নতিবদ্ধ বা রাজনৈতিক, জাতিগত, লিঙ্গ, সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় ভিত্তিতে নিপীড়নের অংশ হিসেবে দেশের অভ্যন্তরীণ আইন লঙ্ঘন হোক বা না হোক তা মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবে। সংশোধনী ৪(২) ধারায় বলা হয়েছে, এ আইনের অধীন অপরাধ হতে পারে এটি জানা সত্ত্বেও যদি কোনো সংস্থা, সংগঠন, দল, সংঘবদ্ধ চক্র বা সত্ত্বার নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তি যথাযথ পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয় তাকেও বিচারের আওতায় আনা হবে। প্রস্তাবিত সংশোধনীর ১৯(১) ধারায় বলা হয়েছে চৌম্বকীয়, ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক, অপটিক্যাল বা কম্পিউটার মেমরিতে উৎপন্ন, প্রস্তুত, পাঠানো, প্রাপ্ত বা সংরক্ষিত ডেটা বা তথ্য; অডিও এবং ভিডিও রেকর্ডিং; ডিজিটাল ভার্সেটাইল ডিস্ক (ডিভিডি), ডিজিটাল ভিডিও ডিস্ক (ডিভিডি); মোবাইল ফোন থেকে রেকর্ড; হার্ডওয়্যার, সফ্‌টওয়্যার, বা অন্য কোনো ডিজিটাল ডিভাইস যার সম্ভাব্য মান আছে বলে মনে করা হয়। সংশোধনীর ৩(৩) ধারায় বলা হয়েছে, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ইত্যাদি অপরাধের দায় নির্ধারণ করতে ট্রাইবু্যনাল রোম স্ট্যাটিউটের অনুচ্ছেদ-৯ অনুযায়ী গৃহীত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) অপরাধের উপাদানগুলো বিবেচনা করতে পারবে। সংশোধনীর ১২(২) ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ লিগ্যাল প্র্যাকটিশনারস অ্যান্ড বার কাউন্সিল অর্ডার, ১৯৭২-এ যা কিছুই থাকুক না কেন, ট্রাইবু্যনাল সন্তুষ্টি সাপেক্ষে বিদেশি কাউন্সিলকে তার সামনে উপস্থিত হওয়ার অনুমতি দিতে পারবে, যদি ওই কৌঁসুলির আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আইনের অনুশীলনে কমপক্ষে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকে। সংশোধনীর ৪(এ) ধারায় বলা হয়েছে, ট্রাইবু্যনাল একটি পূর্ণ অথবা আংশিক শুনানির অডিও-ভিজু্যয়াল রেকর্ডিং করার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। ট্রাইবু্যনাল অংশগ্রহণকারীদের নিরাপত্তা, গোপনীয়তা এবং মর্যাদা রক্ষা করার জন্য আদালতের দ্বারা নির্ধারিত যে কোনো শর্ত অনুসারে ইন্টারনেট বা অন্য উপায়ে শুনানির একটি অডিও বা ভিডিও সম্প্রচার বা তার অংশ উপলব্ধ করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সংশোধনীর ১৩(এ) ধারায় বলা হয়েছে, বিদেশি সরকার, বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা ট্রাইবু্যনালের পূর্বানুমতি এবং স্বীকৃতিসাপেক্ষে জনশুনানি, বিচার এবং অন্য কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারে। সংশোধনীর ২০(এ) ধারায় বলা হয়েছে, আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, যদি কোনো রাজনৈতিক সংগঠন এ আইনের ধারা ৩-এর অধীন কোনো অপরাধ সংঘটিত, মদদ প্রদান, প্ররোচনা বা সহায়তা করে বলে পাওয়া যায় তাহলে এ ধরনের সংগঠন সর্বনিম্ন ১০ বছর সময়কালের জন্য নিষিদ্ধ হবে। ট্রাইবু্যনাল তার বিবেচনার ভিত্তিতে, সংগঠনের দ্বারা দায়ের করা আবেদনের ভিত্তিতে নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ কমাতে পারে। আরও বলা হয়, এ ধারার অধীন আরোপিত নিষেধাজ্ঞার মধ্যে সংগঠনের সমস্ত কর্মকান্ড অন্তর্ভুক্ত থাকবে, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত কিন্তু সীমাবদ্ধ নয়: (ক) নির্বাচনে অংশগ্রহণ; (খ) সভা-সমাবেশ, সমাবেশ বা যে কোনো ধরনের জনসমাবেশের আয়োজন করা; (গ) প্রচার বা যোগাযোগের জন্য মিডিয়া এবং ডিজিটাল পস্ন্যাটফর্মের ব্যবহার; এবং (ঘ) তহবিল সংগ্রহ এবং কোনো আর্থিক লেনদেন পরিচালনা। এই ধারার অধীন আরোপিত নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনকারী যে কোনো ব্যক্তি ট্রাইবু্যনাল কর্তৃক নির্ধারিত দন্ডের জন্য দায়ী থাকবেন। সংশোধনের সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা- সংশোধনী প্রস্তাবটি একটি ভালো উদ্যোগ হলেও যথার্থ নয় বলে অনেকে মনে করেন। অনেকের মতে আগের তুলনায় সংশোধনীতে আসামিদের স্বার্থ ও অধিকার সংরক্ষণের দিকে বেশি ফোকাস করা হয়েছে। সংশোধনীতে প্রয়োজনে বিদেশি আইনজীবী নিয়োগের প্রস্তাবনা এসেছে। যা আসামি এবং প্রসিকিউশন উভয় পক্ষের জন্য প্রযোজ্য হওয়া উচিত। যেহেতু শুধু ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে সংগঠিত আপরাধের বিচারই বর্তমান এ ট্রাইবুনালের মূল উদ্দেশ্য। সেহেতু আওয়ামী লীগ তথা ১৪ দলীয় জোটের নেতা এবং পুলিশের হোমরা-চোমরারাই হবেন প্রধান আসামি। কিন্তু এদের সবারই রয়েছে বিগত ১৫ বছরের লুটপাটের অঢেল সম্পদ। তারা চাইলেই বিদেশি এবং অভিজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগ করতে পারবেন। অপরদিকে সরকারের বিদেশি এবং অভিজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগের পর্যপ্ত বাজেট না থাকলে কিংবা ট্রাইবুনালের প্রসিকিউটরদের পর্যাপ্ত ট্রেনিং না থাকলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার সম্ভাবনা কমে যায়। আবার প্রসিকিউশনের পাশাপাশি ভিকটিমের পরিবার চাইলে আইনজীবী নিয়োগে সুযোগ আইনে রাখা হয়নি। এতে ভিকটিমের পরিবারের পক্ষ থেকে ন্যায়বিচার প্রাপ্তির সংশয় প্রকাশের সুযোগ থেকে যায়। বিচারে স্বচ্ছতা আনতে এই অপশন থাকা দরকার বলে আইনজ্ঞরা মনে করেন। যেহেতু বাংলাদেশে তথা আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে গ্রহণযোগ্য বিচার নিশ্চিত করতেই এই সংশোধন আনা হচ্ছে সেহেতু আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার জন্য আন্তর্জাতিকমানের বিচারক নিয়োগ করা জরুরি। একই সঙ্গে প্রসিকিউটরদের নিরাপত্তা, যোগ্যতা, নিয়োগের প্রক্রিয়ার বিষয়গুলোর স্পষ্ট বিধান থাকা জরুরি বলেও আলোচনা উঠেছে। অতীতে যেহেতু স্কাইপি কেলেঙ্কারির মতো গুরুতর অভিযোগ বয়েছে এই ট্রাইবুনালের বিচারক ও প্রসিকিউটরের বিরুদ্ধে; কিন্তু এ ধরনের অপরাধ রোধে কোনো ব্যবস্থা অথবা শাস্তির বিধান এই সংশোধনীতে রাখা হয় নাই। বাংলাদেশের প্রচলিত অন্য আইনে ডিজিটাল অ্যাভিডেন্স গ্রহণ করার সুযোগ তেমন না থাকলেও এ আইনের সেটি থাকাকে বিশ্লেষকরা ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তবে ডিজিটাল অ্যাভিডেন্স গ্রহণের পদ্ধতি কী হবে সেটা স্পষ্ট না থাকায় বিতর্কের অবকাশ থেকেই যাচ্ছে। ডিজিটাল তথ্য-উপাত্ত নেওয়ার পদ্ধতি স্পষ্ট না থাকলে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের যুগে তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করা কঠিন হবে। সংশোধনীতে রাজনৈতিক দল বা সংগঠনকে নিষিদ্ধের কথা বলা হয়েছে কিন্তু এই নিষিদ্ধ কী শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ অ্যাক্টিভিটিসকে নিষিদ্ধ করবেন, নাকি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নিষিদ্ধ করা হবে তা স্পষ্ট করা জরুরি। ডিজিটাল পস্নাটফর্মের এই যুগে দেশের গন্ডির মধ্য নিষিদ্ধ হলেও বাহিরে বসে প্রচার প্রপাগান্ডা চালানো যে কত সহজ তা আমরা ৩৬ জুলাইয়ের (৫ আগস্ট) বিপস্নবের পরের বিগত কয়েক দিনেই বুঝে গেছি। সারা পৃথিবীতেই রাজনৈতিক দলগুলোর কমিটি রয়েছে। নিষিদ্ধ হলে দলের কমিটির পদধারীরা চট করে ঢুকতে না পারলেও তাদের ডিজিটাল প্রচার প্রপাগান্ডা চালানো অনেক সহজ হবে। আবার দেশের বাহিরে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করলে সে ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ কিভাবে হবে তা স্পষ্ট করা দরকার। আবার রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হলে তার নিবন্ধনও বাতিল হবে কিনা সে ব্যাপারে সংশোধনীতে কিছু বলা নেই। আমরা জানি শুধু ন্যায়বিচার করলেই হবে না, দেখাতেও হবে ন্যায়বিচার করা হয়েছে, তেমনি আইনের গায়ে আন্তর্জাতিক থাকলেই হবে না আন্তর্জাতিকমান নিশ্চিতও করতে হবে। আবার আইনের সংশোধনী আনলেই হবে না বরং গুণগত ইতিবাচব পরিবর্তনও আনতে হবে। যেন এটা নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন তুলতে না পারে। এবং এ আইনের মাধ্যমে যেন দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্য এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। অন্যথায় বিগত দিনের ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলের ক্যাঙ্গারু ট্রাইবুনাল আর গণ-বিপস্নবের মাধ্যমে গঠিত ট্রাইবুনালের মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন হবে। ব্যারিস্টার এস এম মইনুল করিম আইনজীবী- বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। হেড অব চেম্বার, এম এন্ড এন অ্যাসোসিয়েটস।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে