বৃহস্পতিবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২২ কার্তিক ১৪৩১

সংবিধান সংশোধন পুনর্লিখন, নাকি নতুন প্রণয়ন?

বিগত আওয়ামী সরকার তাদের শাসন পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধনের নামে ৭(ক) এবং (খ) নামে দুটি অনুচ্ছেদ প্রণয়ন করেন। এই অনুচ্ছেদেগুলোতে বলা হয় যে, সংবিধানের কিছু অংশ এবং বিধান কেউ কখনো পরিবর্তন করতে পারবে না, করিলে বা করার চেষ্টা করিলে তাদের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি অর্থাৎ মৃতু্যদন্ড বরাদ্দ। একটি সংসদ তার পরবর্তী সংসদ কি করতে পারবে আর কি করতে পারবে না তার সীমানা নির্ধারণ করে দিতে পারে না- যা এই অনুচ্ছেদদ্বয়ের মাধ্যমে আওয়ামী সরকার নির্ধারণ করে দিয়েছে।
এ এস এম সায়েম
  ০১ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
সংবিধান সংশোধন পুনর্লিখন, নাকি নতুন প্রণয়ন?

একটি রাষ্ট্রের সংবিধান বলে দেয় সে রাষ্ট্রটি কেমন এবং তার প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে পরিচালিত হয়। তবে এই সংবিধান পরিবর্তনশীল। রাষ্ট্রের নাগরিকদের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষ্যে সংবিধান পরিবর্তন, পরিমার্জন বা সংশোধন করতে হয়। আবার শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্যও সংবিধান পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন বা স্থগিত করা হয়। এই পরিবর্তন আনা হয় কখনো বিপস্নবের মাধ্যমে আবার কখনো শাসকগোষ্ঠীর সম্মতির মাধ্যমে।

ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেস থেকে প্রকাশিত 'ঞযব ঊহফঁৎধহপব ড়ভ ঘধঃরড়হধষ ঈড়হংঃরঃঁঃরড়হং' নামক গবেষণা গ্রন্থে বলা হয়েছে একটি লিখিত সংবিধানের গড় আয়ুষ্কাল ১৯ বছর। তবে বেশিরভাগ সংবিধান ১০ বছরের বেশি টেকে না, এর মধ্যেই অনেক পরিবর্তন, পরিমার্জন হয়।

বাংলাদেশের সংবিধানের ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই। বাংলাদেশে এই পর্যন্ত তিনটি সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। ১০ এপ্রিল, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র (চৎড়পষধসধঃরড়হ ড়ভ ওহফবঢ়বহফবহপব) জারি করা হয়- যা বাংলাদেশের প্রথম অন্তবর্তীকালীন সংবিধান। ১১ জানুয়ারি, ১৯৭২ সালে 'বাংলাদেশের অস্থায়ী সংবিধান আদেশ' (চৎড়ারংরড়হধষ ঈড়হংঃরঃঁঃরড়হ ঙৎফবৎ ড়ভ ইধহমষধফবংয) জারি হয়। এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান। তারপর, ৪ নভেম্বর, ১৯৭২ সালে বাংলদেশের তৃতীয় সংবিধান অর্থাৎ বর্তমান সংবিধান গৃহীত হয়।

এই সংবিধান কার্যকর হওয়ার পর থেকে শাসকগোষ্ঠী বিশেষ করে আওয়ামী লীগ বিভিন্ন সময়ে তাদের শাসন পাকাপোক্ত করার জন্য এই সংবিধানকে সংশোধনের নামে ক্ষতবিক্ষত করেছে। সংবিধানের ১৭টি সংশোধনের মধ্যে আওয়ামী লীগ একাই করেছে ৭টি সংশোধন, আর নিজেদের নিয়ে গেছে দানব সরকারের কাতারে, ফলাফল, হাজারো ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে জুলাই বিপস্নবের মাধ্যমে আওয়ামী স্বৈরশাসক হাসিনার পতন।

এই পতনের পর থেকে স্বভাবতই বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে সংবিধান সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়েছে- যাতে করে আর কোনো শাসক সংবিধানের দোহাই দিয়ে ফ্যাসিস্ট সরকারের আকৃতি ধারণ করতে না পারে। বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে সংবিধান সংস্কারের লক্ষ্যে একটি কমিশন গঠন করেছে। ওই কমিশন গঠনের পর সংবিধান সংশোধন নাকি পুনর্লিখন হবে তা নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। এই বিতর্কে যাওয়ার আগে আমরা বর্তমান সংবিধানের কিছু ত্রম্নটি-বিচু্যতি নিয়ে আলোচনা করি।

প্রথমত, বিগত আওয়ামী সরকার তাদের শাসন পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধনের নামে ৭(ক) এবং (খ) নামে দুটি অনুচ্ছেদ প্রণয়ন করেন। এই অনুচ্ছেদেগুলোতে বলা হয় যে, সংবিধানের কিছু অংশ এবং বিধান কেউ কখনো পরিবর্তন করতে পারবে না, করিলে বা করার চেষ্টা করিলে তাদের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি অর্থাৎ মৃতু্যদন্ড বরাদ্দ। একটি সংসদ তার পরবর্তী সংসদ কি করতে পারবে আর কি করতে পারবে না তার সীমানা নির্ধারণ করে দিতে পারে না- যা এই অনুচ্ছেদদ্বয়ের মাধ্যমে আওয়ামী সরকার নির্ধারণ করে দিয়েছে।

দ্বিতীয়ত, একটি দেশের জনগণ শুধু তখনই গণতন্ত্রের সুফল ভোগ করবে যখন সে দেশের বিচার বিভাগ প্রকৃত অর্থেই স্বাধীন হবে। আমাদের সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের আলাদাকরণের কথা বলা থাকলেও অধস্তন আদালতের বিচারকদের স্বাধীনতা আইন মন্ত্রণালয়ের কবজায় রেখে দেওয়া হয়েছে ১১৬নং অনুচ্ছেদের দাপটে। এছাড়াও, গত স্বৈরশাসক সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে সোপর্দ করেছিল- যার ফলে, বিচারকদের বিচারালয়ে থাকা না থাকা সংসদ সদস্যদের মন-মর্জির ওপর নির্ভর করত। যদিও ওই সংশোধন চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে রিট করলে তা অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে।

তৃতীয়ত, এই সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে চিন্তা-বিবেক এবং বাকস্বাধীনতার কথা থাকলেও ৭০ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে একজন সংসদ সদস্যের বিবেক এবং বাকস্বাধীনতাকে উষ্ঠা মেরে ফেলে দেওয়া হয়েছে। এই অনুচ্ছেদ মতে, একজন সংসদ সদস্য তার দলের বিপক্ষে ভোট দিলে বা ভোট দানে বিরত থাকলে তার আসন শূন্য হবে। এর অর্থ হলো, একজন সংসদ সদস্য চাইলেও তার দলের অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবে না, টিকে থাকার জন্য শুধু জ্বি হুজুর, জ্বি হুজুর করতে হবে।

চতুর্থত, এই সংবিধানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে দানবের মতো ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে- যার ফলস্বরূপ বিগত ফ্যাসিবাদ সরকারের জন্ম হয়েছে; অন্যদিকে, রাষ্ট্রপতিকে পুতুল বানিয়ে রাখা হয়েছে। এখানে প্রধানমন্ত্রী বা সংসদ সদস্য হওয়ার সর্বনিম্ন বয়সসীমা বেঁধে দেওয়া থাকলেও সর্বোচ্চ বয়সসীমা দেওয়া নেই। আধুনিক বিজ্ঞান বলে, মানুষের বয়স ৭০ বছর হওয়ার পর থেকে স্মৃতি বিভ্রাট শুরু হয়, ব্রেনের কার্যক্ষমতা কমে যায়, তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়। আমাদের সংবিধানে সর্বোচ্চ বয়সসীমা না থাকার কারণে বেশিরভাগ সংসদ সদস্যদের বয়স ৬৫-৭০ বছরের ঊর্ধ্বে। যার ফলে, কারো একবার সংসদ সদস্য হওয়ার খায়েশ জাগলে, মৃতু্য না হওয়া পর্যন্ত যায় না। এছাড়াও, একজন প্রধানমন্ত্রী বা সংসদ সদস্য সর্বোচ্চ কয়বার প্রধানমন্ত্রী বা সংসদ সদস্য হতে পারবে তার কোনো বিধান সংবিধানে নেই।

এখন আসি সংবিধান সংশোধন নাকি পুনর্লিখন নাকি নতুন করে প্রণয়ন হবে? আমাদের দেশে শুধু একবারই সংবিধান সংশোধনের জন্য গণভোট হয়েছিল। স্বৈরশাসক এরশাদ পতনের পর ১৯৯১ সালে সাংবিধানিক সংকট দেখা দিলে এই গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। এই গণভোটের মাধ্যমে ১২তম সংশোধনী আনা হয় এবং রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন হয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ১৬টি অনুচ্ছেদ একসঙ্গে সংশোধন করা হয়।

১৯৯১ সালে বাংলাদেশের জনগণ যে সাংবিধানিক সংকট প্রত্যক্ষ করেছিল; ২০২৪ সালে বাংলাদেশের জনগণ জুলাই বিপস্নবের পর সে একই সাংবিধানিক সংকট প্রত্যক্ষ করছে। এরশাদ পতনের পর বাংলাদেশের জনগণ নতুন সংবিধান প্রণয়ন বা সংবিধান পুনর্লিখনের পথে না হেঁটে সংবিধান সংশোধনের পথে হেঁটেছিল। এখন বাংলাদেশের সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছে বর্তমান সংবিধান এতবার সংশোধন হয়েছে যে, তা আর সংশোধন করার থেকে পুনর্লিখন শ্রেয়। যদিও আমাদের পাশের দেশগুলোতে সংবিধান পুনর্লিখনের কোনো ধারণা পাওয়া যায় না বরং সংশোধনের ইতিহাসই বেশি, যেমন- ভারত তার সংবিধান ১০৬ বার সংশোধন করেছে, পাকিস্তান করেছে ২২ বার, শ্রীলঙ্কা করেছে ২১ বার।

সংবিধান পুনর্লিখনের ধারণাটি আমাদের কাছে বেশ নতুন। কোনো দেশে সাংবিধানিক সংকট দেখা দিলে সে দেশের জনগণের ইচ্ছানুযায়ী সংবিধান সংশোধন করা হয় না হয় নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা, পুনর্লিখনের প্রচলন তেমন একটা নেই। তবে ২০২৩ সালে উজবেকিস্তান সরকার তাদের সংবিধান পুনর্লিখনের জন্য গণভোটের আয়োজন করে এবং সে দেশের জনগণ পুনর্লিখনে সম্মতি দেয়। সংবিধান পুনর্লিখন অর্থ হলো সংবিধানে নতুন বিধান সংযুক্ত করা এবং বিদ্যমান বিধান যতদূর সম্ভব বাদ দেওয়া আর যেসব বিধান থাকবে তার নতুন করে ব্যাখ্যা দেওয়া।

যখন একটি সংবিধান জনগণের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয় এবং সংশোধনের মাধ্যমেও তা পূরণ করা যায় না তখন সংবিধান পুনর্লিখনের প্রশ্ন আসে। আমাদের সংবিধান পুনর্লিখন হলে তা কীভাবে করা হবে তার কোনো স্পষ্ট ধারণা এখনো সংবিধান সংস্কার কমিশন থেকে পাওয়া যায়নি।

তবে আমরা আশা করি, সংবিধান পুনর্লিখিত হওয়ার পূর্বে সেখানে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ প্রতিফলিত হবে কিনা, জাতি, ধর্ম এসব নিয়ে বিভেদ থাকবে কিনা তা কমিশন স্পষ্ট করবে। আর পুনর্লিখিত সংবিধান গণভোটের মাধ্যমে গ্রহণ করতে হবে অন্যথায় এর উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে।

এ এস এম সায়েম, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।

ইমেইল : ধফযড়পপড়হংড়ৎঃরঁস@মসরধরষ.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে