(১) হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের পর্যালোচনা
সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত বা আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন করপোরেশনে চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) বিদ্যমান কোটা বাতিলসংক্রান্ত ২০১৮ সালের সরকারি পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে কিছুদিন আগে রায় প্রদান করেন হাইকোর্ট বিভাগ।
তবে, সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগ হাইকোর্ট বিভাগের সেই রায়ের ওপর চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা বজায়ের আদেশ দিয়েছেন। আদালতের এই আদেশের অর্থ হচ্ছে, চার সপ্তাহের জন্য হাইকোর্ট বিভাগের রায় কার্যকর থাকবে না। পরবর্তী সময়ে শুনানি শেষে আপিল বিভাগ হাইকোর্ট বিভাগের রায় পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রদান করবেন।
সম্প্রতি হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের অপারেটিভ অংশ প্রকাশিত হয়েছে। সেই রায়ের সারমর্ম নিম্নরূপ:
- সম্পূর্ণ কোটা বাতিল করা ২০১৮ সালের সরকারি পরিপত্রটি বেআইনি;
- মুক্তিযোদ্ধার সন্তান/নাতি-নাতনিদের জন্য কোটা পুনর্বহাল করতে হবে;
- এছাড়া নিম্নোক্ত শ্রেণি, যথা-
(ক) জেলা,
(খ) নারী,
(গ) শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি,
(ঘ) উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী এবং
(ঙ) অন্যান্যের (যদি থাকে) জন্য কোটা বজায় রাখতে হবে;
- প্রয়োজনে উলিস্নখিত শ্রেণির ক্ষেত্রে কোটা পরিবর্তন ও কোটার হার কমানো বা বাড়ানোর বিষয়ে এই রায় বিবাদীদের জন্য কোনো বাধা তৈরি করবে না;
- যে কোনো পাবলিক পরীক্ষায় কোটা পূরণ না হলে সাধারণ মেধাতালিকা থেকে শূন্য পদ পূরণ করায় বিবাদীদের স্বাধীনতা থাকবে।
হাইকোর্ট বিভাগের রায়ে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়:
এক, এটি স্পষ্ট যে, আদালত উলিস্নখিত 'শ্রেণী'র প্রার্থীদের জন্য কোটা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু মোট কোটা কত রাখা হবে বা কোন শ্রেণীর জন্য কোটার হার কত রাখা হবে- সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত আরোপ করেননি বরং 'প্রয়োজনভেদ' এ কোটার পরিবর্তন, কোটা কমানো বা বাড়ানোর এখতিয়ার সরকারের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতার (উরংপৎবঃরড়হধৎু চড়বিৎং) ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। সম্ভবত আদালত এটিকে নির্বাহী বিভাগের পাবলিক পলিসির বিষয় বিবেচনায় বিচারিক হস্তক্ষেপের বাইরে রেখেছেন। এর মাধ্যমে রায়ে ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতির প্রতিফলন ঘটেছে।
দুই, কোটা পূরণ না হলে সাধারণ মেধাতালিকা থেকে শূন্য পদ পূরণ করার সুযোগ রাখার নির্দেশ আদালতের ন্যায়পরায়ণতার নীতি প্রতিফলন করে।
তিন, রায়ে কোটার শ্রেণিবিভাগে 'অন্যান্যের (যদি থাকে)' শ্রেণি হিসেবে অন্তর্ভুক্তি তাৎপর্যপূর্ণ। এর মাধ্যমে কোটা সুবিধা শুধু নির্দিষ্টভাবে উলেস্নখিত শ্রেণীসমূহের মধ্যে নিঃশেষিত হবে না; বরং আরো কোনো শ্রেণীকে ভবিষ্যতে কোটার সুবিধায় অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ সরকারের থাকবে। 'অন্যান্য' টার্মটি এখানে অনিঃশেষ তালিকা (ঘড়হ-বীযধঁংঃরাব খরংঃ) বুঝাবে।
চার, এই সংক্ষিপ্ত রায়ের কোথাও কোটা সংরক্ষণের মূলভিত্তি- সংবিধানের ২৯(৩)(ক) অনুচ্ছেদে বিবৃত 'অনগ্রসর অংশ' শব্দের প্রয়োগ নেই। অর্থাৎ, আদালত কোটার সুবিধাভোগী শ্রেণির তালিকা দিলেও তাদের স্পষ্টভাবে 'অনগ্রসর অংশ' ঘোষণা করেননি। হয়তো মূল রায়ে 'অনগ্রসর অংশ' বিষয়ে আলোকপাত থাকতে পারে। সেটি হলে, আমাদের জুরিসপ্রম্নডেন্স সমৃদ্ধ হবে। কারণ, বাংলাদেশের সংবিধান বা আইনি কাঠামোতে 'অনগ্রসর অংশ'-এর কোন সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা এখনো অনুপস্থিত।
পাঁচ, এই রায়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির শ্রেণি বুঝাতে ইংরেজি 'চযুংরপধষষু ঈযধষষবহমবফ চবৎংড়হ' টার্ম ব্যবহৃত হয়েছে। এই টার্ম ব্যবহার সমস্যাজনক মনে হয়। কারণ, এর মাধ্যমে শুধু শারীরিক প্রতিবন্ধীরা অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক ও দেশীয় আইন অনুযায়ী প্রতিবন্ধিতা (উরংধনরষরঃু) শুধু শারীরিক প্রতিবন্ধিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি মানসিক, বুদ্ধিগত, বিকাশগত বা ইন্দ্রিয়গত প্রতিবন্ধিতাও হতে পারে। ২০১৩ সালের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন-২০১৩ এর ধারা-৩ এ ১১ ধরনের প্রতিবন্ধিতার উলেস্নখ আছে। ফলে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বুঝাতে এই টার্ম ব্যবহার করা হলে অন্যান্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বঞ্চিত হতে পারে।
(২) কোটা সংরক্ষণ কি একটি সাংবিধানিক অধিকার বা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব?
পুরো সংবিধানজুড়ে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বারংবার উলেস্নখ করা হয়েছে- সমতা, সাম্য ও বৈষম্যহীনতার কথা। সরকারি নিয়োগ লাভে সুযোগের সমতা (ঊয়ঁধষরঃু ড়ভ ঙঢ়ঢ়ড়ৎঃঁহরঃু) সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদে আইনগতভাবে বলবৎযোগ্য মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। এই ২৯ অনুচ্ছেদ পর্যালোচনা করা যাক:
অনুচ্ছেদ ২৯-এর (১) ও (২) উপ-অনুচ্ছেদ সরকারি চাকরিতে সুযোগের সমতা ও বৈষম্যহীনতার অধিকার ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নিশ্চিত করে। সমগ্র ২৯ অনুচ্ছেদের মধ্যে এই দুটি উপ-অনুচ্ছেদ কে বলা যায় ঊহধনষরহম ঈষধঁংব বা মূল বাধ্যকরী বিধান।
অন্যদিকে, অনুচ্ছেদ ২৯(৩)(ক)তে বলা হয়েছে: 'নাগরিকদের যে কোনো অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করিতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে তাহাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান প্রণয়ন করা হইতে রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।'
এখানে দুটো উপাদান গুরুত্বপূর্ণ- 'অনগ্রসর অংশ (ইধপশধিৎফ ঝবপঃরড়হ)' এবং 'উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব (ধফবয়ঁধঃব জবঢ়ৎবংবহঃধঃরড়হ)'। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সরকারি চাকরিতে নাগরিকদের মধ্যে যে অংশ অনগ্রসর তাদের পর্যাপ্ত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বিশেষ ব্যবস্থা নিতে কোনো বাধা নেই। এই বিশেষ ব্যবস্থা সুযোগের সমতা ও বৈষম্যহীনতার মূল বাধ্যকরী বিধানের লঙ্ঘন বিবেচিত হবে না।
অনগ্রসর অংশের জন্য কোটা সংরক্ষণ এমনই একটি বিশেষ ব্যবস্থা। রাষ্ট্রের পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীকে বিশেষ ব্যবস্থায় এগিয়ে না আনলে সত্যিকার সমতা ও বৈষম্যহীনতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তাই সরকারি চাকরিতে বিশেষ ব্যবস্থা হিসেবে কোটা সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
উলেস্নখ্য, এই বিশেষ ব্যবস্থা সাংবিধানিকভাবে শুধু কোটা সংরক্ষণে সীমাবদ্ধ নয়। এক্ষেত্রে সরকারের অবাধ স্বাধীনতা রয়েছে। সরকার চাইলে অনগ্রসর নাগরিকদের জন্য আরো বিভিন্ন প্রকার বিশেষ ব্যবস্থা নিতে পারে, উদাহরণস্বরূপ- পৃথক নিয়োগ পরীক্ষা আয়োজন, যোগ্যতা শিথিলকরণ, অন্ধ পরীক্ষার্থীর জন্য শ্রম্নতিলেখক প্রদান, প্রতিবন্ধী প্রার্থীর জন্য পরীক্ষায় অতিরিক্ত সময় প্রদান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি কোটা, স্কলারশিপ প্রদান, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রতিবন্ধিতার ধরন অনুযায়ী কর্মপরিবেশ প্রদান, প্রভৃতি।
অর্থাৎ, বিশেষ পদক্ষেপের মাধ্যমে রাষ্ট্রের মূল জনস্রোতে অনগ্রসর নাগরিকদের জবধংড়হধনষব অপপড়সসড়ফধঃরড়হ নিশ্চিত করতে পারে। এই বিশেষ ব্যবস্থাকে আইনে চড়ংঃরাব উরংপৎরসরহধঃরড়হ বা অভভরৎসধঃরাব অপঃরড়হ বা ঝঢ়বপরধষ গবধংঁৎবং নামে অভিহিত করা হয়।
এটি স্পষ্টত একটি সাময়িক ব্যবস্থা- অনগ্রসর অংশের উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা সাপেক্ষে এই ব্যবস্থা পরিবর্তনশীল।
বুঝা যাচ্ছে, সংবিধানের ২৯(৩) অনুচ্ছেদ একটি ঘড়হ-ড়নংঃধহঃব ঈষধঁংব যা ঊহধনষরহম ঈষধঁংব- অনুচ্ছেদ ২৯(১) ও ২৯(২) এর একটি ব্যতিক্রম। অর্থাৎ, এই বিশেষ ব্যবস্থাগ্রহণ রাষ্ট্রের ইচ্ছাধীন। এটি নাগরিকদের জন্য বলবৎযোগ্য কোনো সাংবিধানিক অধিকার কিংবা রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যকরী সাংবিধানিক কর্তব্য সৃষ্টি করে না। কিন্তু রাষ্ট্র যদি বিশেষ ব্যবস্থা হিসেবে কোটা এমনভাবে সংরক্ষণ করে- যার ফলে, ২৯ অনুচ্ছেদের ঊহধনষরহম ঈষধঁংবং ক্ষতিগ্রস্ত হয় অর্থাৎ, সুযোগের সমতা ও বৈষম্যহীনতার মূল বিধান লঙ্ঘন হয়- সেটি সংবিধানসম্মত হবে না। ব্যতিক্রম মূল বিধানকে অতিক্রম করতে পারে না। সরকারি চাকরিতে স্থায়ীভাবে ৫৬ শতাংশ কোটা সংরক্ষণের বিধান- তাই অন্যায্য এবং সংবিধান পরিপন্থি বলে প্রতীয়মান হয়।
(৩) 'অনগ্রসর অংশ' কারা?
প্রশ্ন হচ্ছে, ২৯(৩)(ক) অনুচ্ছেদ প্রয়োগে বর্তমানে সরকার যাদের অনগ্রসর অংশ বিবেচনায় কোটা সুবিধা প্রদান করছে- সেটি কীভাবে নির্ধারিত হয়েছে? এই অনগ্রসরতা নির্ধারণে সাংবিধানিক ও আইনি মানদন্ড কী?
বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮(৪) ও ২৯(৩)(ক) অনুচ্ছেদে নাগরিকদের 'অনগ্রসর অংশ' এর জন্য বিশেষ ব্যবস্থার কথা উলেস্নখ করলেও কারা 'অনগ্রসর অংশ'- সেটি সংবিধানে উলেস্নখ নেই।
দ্বিতীয়ত, অনগ্রসর শ্রেণি হিসেবে বিবেচনা করার ক্ষেত্রে কী কী সাংবিধানিক ও আইনগত মানদন্ড অনুসরণ করতে হবে- সেই নির্দেশনা অনুপস্থিত।
তৃতীয়ত, অনগ্রসর শ্রেণি সরকারি চাকরিতে নিযুক্ত হয়ে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে কি না বা বর্তমানে তালিকাভুক্ত অনগ্রসর শ্রেণির সামাজিক, শিক্ষাগত বা অর্থনৈতিক অবস্থান কীরূপ আছে, কোনো অংশকে বাদ দেওয়া দরকার কিনা, বা নতুন কোনো অনগ্রসর অংশকে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন কিনা- সেটি যাচাইয়ের জন্য বাংলাদেশে কোন আইন, বিশেষায়িত কমিশন বা কর্তৃপক্ষ নেই।
এক্ষেত্রে ভারতীয় জুরিসপ্রম্নডেন্স আমাদের পথ নির্দেশক হতে পারে। ভারতের সংবিধান অনুযায়ী অনগ্রসর শ্রেণির সংজ্ঞা ও তালিকা সুনির্দিষ্ট করা আছে। ভারতে তফসিলভুক্ত বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণি (পধংঃবং) ও তফসিলভুক্ত উপজাতি (ঃৎরনবং)-এর সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক, শিক্ষাগত ও আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে 'অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি (ঙঃযবৎ ইধপশধিৎফ ঈষধংং- ঙইঈ)' হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এবং তাদের জন্য কোটা সংরক্ষণ ও অন্যান্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে (ভারতীয় সংবিধান: অনুচ্ছেদ ৩৩০-৩৪২)। এই বিধান দ্ব্যর্থহীন এবং রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যকরী।
ভারতের সংবিধানে অনগ্রসর শ্রেণির অধিকারের সুরক্ষার জন্য জাতীয় কমিশন গঠনের বাধ্যবাধকতাও রয়েছে (অনুচ্ছেদ ৩৩৮খ)। ৩৪০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ভারতের অনগ্রসর শে্িরণর অনগ্রসরতার পরিস্থিতি তদন্ত ও মূল্যায়নের জন্য আলাদা কমিশন গঠনের সাংবিধানিক নির্দেশনা আছে।
(৪) অনগ্রসরতা নির্ধারণে 'ঈৎবধসু খধুবৎ' নীতি
'ক্রিমি লেয়ার' শব্দটি ভারতীয় বিচারপতি কৃষ্ণ আইয়ার ১৯৭৫ সালে ঝঃধঃব ড়ভ কবৎধষধ াং ঘ. গ. ঞযড়সধং [১৯৭৬ অওজ ৪৯০] মামলায় প্রথম উলেস্নখ করেন। অনগ্রসর শ্রেণির ক্রিমি স্তরটি অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল, সামাজিক এবং শিক্ষাগতভাবে উন্নত। জাস্টিস কৃষ্ণ আয়ার পর্যবেক্ষণ করেন: 'কোটা সংরক্ষণের বিপদও আছে। কোটার সুবিধা 'অনগ্রসর' বর্ণ বা শ্রেণির শীর্ষ ক্রিমি স্তর দ্বারা অনেক সময় কেড়ে নেওয়া হয়, ফলে দুর্বলদের মধ্যে দুর্বলরা সবসময় দুর্বল থেকে যায় এবং ভাগ্যবান স্তরগুলি পুরো কেকটি ভোগ করে।'
১৯৯২ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ওহফৎধ ঝধযিহবু া. টহরড়হ ড়ভ ওহফরধ [অওজ ১৯৯৩ ঝঈ ৪৭৭] মামলায় 'ক্রিমি লেয়ার' নীতিকে নিশ্চিত করেন, 'সামাজিক অনগ্রসরতা' কে সংজ্ঞায়িত করেন এবং অনগ্রসরতা নির্ধারণের জন্য ১১টি সূচক নির্ধারণ করেন।
ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন যে, কোটা সংরক্ষণের সুবিধা সাংবিধানিক পদধারী- যেমন রাষ্ট্রপতি, সুপ্রিম কোর্ট এবং হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি, কেন্দ্র এবং রাজ্য প্রশাসনের নির্দিষ্ট স্তরের উপরে কর্মচারী, পাবলিক সেক্টর কর্মচারী এবং কর্নেল পদমর্যাদার উপরে সশস্ত্র বাহিনী এবং আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যদের সন্তানদের দেওয়া উচিত নয়।
এছাড়া, উচ্চশ্রেণির পেশাজীবী যেমন, ডাক্তার, আইনজীবী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, আয়কর পরামর্শক, আর্থিক বা ব্যবস্থাপনা পরামর্শক, ডেন্টাল সার্জন, প্রকৌশলী, কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ, চলচ্চিত্র শিল্পী, পেশাদার, লেখক, নাট্যকার, খেলোয়াড়, ক্রীড়া পেশাদার, গণমাধ্যম পেশাদার বা অনুরূপ মর্যাদার অন্য যে কোনো পেশায় নিযুক্ত ব্যক্তিদের সন্তানদের বাৎসরিক আয় তিনটি ধারাবাহিক বছরে ৮ লাখ রুপির বেশি হলে তাদেরও ক্রিমি লেয়ার বিবেচনায় কোটা সংরক্ষণের সুবিধা থেকে বাদ দেওয়া হয়।
অন্যদিকে, বাংলাদেশে অনগ্রসর অংশের জন্য কোটা সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে 'ইষধহশবঃ' নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। অর্থাৎ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা, জেলা কোটা, নারী কোটা, উপজাতি ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী এবং প্রতিবন্ধী কোটা প্রয়োগের সময় এই গোষ্ঠীদের অন্তর্ভুক্ত সব সদস্য- সামাজিক, শিক্ষাগত বা আর্থিক অবস্থান নির্বিশেষে- কোটা লাভের অধিকারী হয়। তারমানে, একই গ্রম্নপের সব সদস্য ঈড়সসড়হ ঞৎবধঃসবহঃ লাভ করে, একই গ্রম্নপের সদস্যদের মধ্যে জবধংড়হধনষব ঈষধংংরভরপধঃরড়হ করা হয় না।
এটি অন্যায্য, বৈষম্যমূলক এবং সাংবিধানিক বিশেষ ব্যবস্থার উদ্দেশ্য ও চেতনার বরখেলাপ। কারণ: রাষ্ট্রের নাগরিকদের আপাত 'অগ্রসর' অংশের মধ্যেও 'অনগ্রসর' মানুষ থাকতে পারে। একইভাবে, 'অনগ্রসর' অংশের জনগোষ্ঠীর মধ্যেও একটি 'সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণী (ঈৎবধসু খধুবৎ)' রয়েছে যাদেরকে ইষধহশবঃ নীতিতে একই সুবিধা দেওয়া অন্যায্য।
উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের সব উপজাতি ও ক্ষুদ্রজাতিগোষ্ঠী একই সামাজিক, শিক্ষাগত ও অর্থনৈতিক শ্রেণিতে অবস্থান করে না, আন্তঃজাতিগোষ্ঠী অসমতা রয়েছে। আবার একই জাতিগোষ্ঠীর সব সদস্য সমান অবস্থানে নেই। একটি নির্দিষ্ট উপজাতি বা ক্ষুদ্রজাতিগোষ্ঠীর প্রার্থী মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, বিচারপতি বা সচিবের সন্তান হতে পারে। তিনি স্পষ্টত সেই জাতিগোষ্ঠীর ক্রিমি লেয়ারের অংশ। অন্যদিকে, একই জাতিগোষ্ঠী বা ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর আরেকজন প্রার্থী সেই তুলনায় সামাজিক, শিক্ষাগত ও অর্থনৈতিক অবস্থানে অধিক প্রান্তিক বা অধিক ভালনারেবল হতে পারেন।
বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থায় অনগ্রসরদের এই ক্রিমি অংশ 'অধিক অনগ্রসর' এর কোটা সুবিধা হরণ করে চলেছে।
একইভাবে প্রশ্ন করা যেতে পারে, সব মুক্তিযোদ্ধার সব সন্তান বা সব নাতি/নাতনি, সব জেলার সব বাসিন্দা, কিংবা রাষ্ট্রের সব নারী কি সত্যিকারভাবে একই রকম অনগ্রসর নাকি তাদের অনেকে অগ্রসর অংশ অথবা অনগ্রসর অংশের মধ্যে তুলনামূলক অগ্রসর বা ক্রিমি লেয়ার?
উপরিউক্ত পর্যালোচনায় এটি প্রতীয়মান যে, সরকারি চাকরিতে অনগ্রসর নাগরিকদের জন্য বাংলাদেশে ৫৬ শতাংশ কোটা বরাদ্দ থাকলেও এই বিদ্যমান কোটা সংরক্ষণ ব্যবস্থার সাংবিধানিক ভিত্তি দুর্বল, অবলবৎযোগ্য ও আইনি কাঠামোহীন। এমনকি অনগ্রসর অংশের মধ্যেই কোটা বণ্টনের নীতি আইনানুগ নয়, সুসামঞ্জস্য নয় এবং আন্তঃগোষ্ঠী বৈষম্যমূলক। অন্যদিকে, সাধারণ প্রার্থীদের সঙ্গে কোটা প্রার্থীদের সুযোগের সমতার বিরাট ব্যবধানের কথা বলাই বাহুল্য। তাই পুরো কোটাব্যবস্থার সংস্কার জরুরি।
হাইকোর্ট বিভাগের রায় এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পথ প্রদর্শক যদিও তা যথেষ্ট নয়। আশা করি, আপিল বিভাগ সাংবিধানিক অভিভাবক হিসেবে এক্ষেত্রে আলোকবর্তিকা হয়ে পর্যবেক্ষণ প্রদান করবেন। মূল দায়িত্ব নির্বাহী বিভাগ ও আইন বিভাগের। রাষ্ট্রের অনগ্রসর অংশের সুরক্ষায় বিশেষ বিধান নিশ্চিতকল্পে সংবিধান সংশোধন, বিশেষ আইন প্রণয়ন ও স্পেশালাইজড কমিশন গঠন অপরিহার্য।
আইনের শাসনের এই আপ্তবাক্য ভুলে গেলে চলবে না- 'ঞযব বয়ঁধষ :ৎবধঃসবহঃ ড়ভ :যব ঁহবয়ঁধষ রং :যব মৎবধঃবংঃ রহবয়ঁধষরঃু'
কিন্তু অসমতা দূর করতে গিয়ে অধিক বৈষম্য সৃষ্টির কোনো সুযোগ সংবিধানে কিংবা আইনে কি আছে বা থাকা কি উচিত?
সাঈদ আহসান খালিদ, সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়