রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১
স্মৃতিতে অ্যাডভোকেট সৈয়দ আহমেদ স্যার

'ডায়েরিতে মামলা থাকুক আর নাই থাকুক, কোর্ট মিস দিবে না'

ক্লায়েন্টের চেম্বারে আসার সময় ছিল সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৯:৩০ পর্যন্ত। রাত ১০টায় চেম্বারের সব লাইট ফ্যান অফ। তবে ব্যতিক্রম ছিল দুই তিন বার। সেটাও রাত ১০:১৫ পর্যন্ত সর্বোচ্চ। খুব ডিসিপিস্ননড জীবনযাপন করতেন স্যার। কোর্টে যাওয়ার সময়, কোর্ট থেকে ফেরার সময়, ইভেনিং চেম্বার টাইম সব একটি টাইম টেবল অনুযায়ী করতেন। আর স্যার বলতেন, 'শোনো! ঈধংব ড়ৎ হড় পধংব মড় পড়ঁৎঃ ফধরষু.' মামলা না থাকলেও আমরা স্যারের সঙ্গে জজকোর্ট যেতাম
অ্যাডভোকেট আজিজ উলস্নাহ ইমন
  ২৮ মে ২০২৪, ০০:০০
'ডায়েরিতে মামলা থাকুক আর নাই থাকুক, কোর্ট মিস দিবে না'

'জুনিয়র যখন একবার হইসো, সিনিয়র তো একদিন হইবা।' স্মিত হেসে বললেন আমাদের বিজ্ঞ সিনিয়র অ্যাডভোকেট সৈয়দ আহমেদ স্যার। প্রতিদিন কোর্ট আওয়ার শেষ করে পুরানা পল্টন লাইনের পল্টন বিলাসে (ছোট আপার বাসা) গিয়ে বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যায় কলাবাগান এলাকার ডলফিন গলির কাছে সিনিয়রের চেম্বার ঝ অযসবফ ্‌ অংংড়পরধঃবং-এ যেতাম। রোদ-বৃষ্টি-ঝড় যাই হোক, চেম্বারে যেতেই হবে। কারণ, পরদিনের মোকদ্দমার হাজিরা, দরখাস্ত বা আরজি বা লিখিত জবাব/আপত্তি স্যারের ডিকটেশন শুনে প্রথমে রাফ এবং পরবর্তী সময়ে বস্নু পেইজে লিখতে হবে অথবা কম্পিউটারে টাইপ করতে হবে।

ঢাকায় ম্যাক্সিমাম চেম্বারে কম্পিউটার জানা জুনিয়রকেই প্রেফারেন্স দেয়।

আমাকে এই স্বনামধন্য সিভিল চেম্বারে নিয়ে আসেন আমাদের চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটির ল' ফ্যাকাল্টির ২য় ব্যাচের বড় ভাই অ্যাডভোকেট শাকির ভাই। আমাদের ফার্স্ট ব্যাচের বড় ভাই অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলাম সোহেল ভাইয়ের অনুরোধের প্রেক্ষিতে শাকির ভাই আমাকে তাদের চেম্বারে নিয়ে যান। সেখানে বিশাল এক রুমে ৪টা বড় টেবিল আর দুইটা কম্পিউটার ডেস্ক (মূলত দুইজন জুনিয়রের জন্য)।

আমাকে অ্যাডভোকেট শাকির ভাই ড. নাইম আহমেদ ভাইয়ের কাছে নিয়ে গেলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন যে, আইনজীবী হতে চাই কিনা? আরও কিছু কথা বললেন। তারপর চেম্বারের সিনিয়র শ্রদ্ধেয় অ্যাডভোকেট সৈয়দ আহমেদ স্যারের কাছে নিয়ে গেলেন এবং বললেন, 'আব্বু! ও অ্যাডভোকেট ইমন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলএম করেছে। আগামীকাল থেকে আমাদের চেম্বারে জজকোর্ট এ কাজ করবে।'

সিনিয়র স্যার আমার দিকে তাকালেন। তার সামনে ছিল অ্যাডভোকেট নয়ন (বর্তমানে অতিরিক্ত জেলা জজ লুৎফুল মজিদ)। স্যার বললেন, অ্যাডভোকেট নয়নের সঙ্গে কোর্টে যেতে। রাতে অ্যাডভোকেট নয়নের সঙ্গেই একসঙ্গে চেম্বার থেকে বের হয়ে শুক্রাবাদ বাসস্ট্যান্ডে যেতে যেতে কথা হলো। নয়ন রাজশাহী ইউনিভার্সিটি থেকে এলএলএম করে সিনিয়রের সঙ্গে কাজ করছে অনেকদিন। আমাকে বলল, 'খুব ভালো চেম্বার। শুধু সিভিল মোকদ্দমাই করেন সিনিয়র। কালকে জজকোর্টের হল রুম নং-৩ এ চলে আসবেন। দেখা হবে ইনশাআলস্নাহ।'

সন্ধ্যা ঠিক ৭টায় চেম্বার টাইম। সিনিয়রের বাসায় ড্রয়িং রুমের পাশেই বিশাল এক হল রুমে চেম্বার। পাশেই গেস্ট রুম আর একটা ছোট রুম ছিল।

দ্বিতীয় দিন গিয়েই দেখি ব্যারিস্টার সাইফ ভাই (ব্যারিস্টার সাইফুর রশিদ) যিনি বার কাউন্সিলে বার ভোকেশনাল কোর্সে আমাদের ক্লাস নিয়েছিলেন। আর পাশেই অ্যাডভোকেট শাকির ভাইয়ের টেবিল। পরে জানতে পেরেছিলাম যে এই চেম্বারে আমাদের ৫ম ব্যাচের জুলফিকার হায়াত ভাই (বর্তমানে জেলা জজ) ও মো. জগলুল হক ভাই (বর্তমানে জজ) আমাদের শ্রদ্ধেয় সিনিয়র সৈয়দ আহমেদ স্যারের সঙ্গে জজকোর্টে জুনিয়রশিপ করেছেন।

আমি জয়েন করার প্রায় ৩ মাস পর ৫ম ব্যাচের অ্যাডভোকেট মাসুম সাইফুর রহমান ভাইও আমাদের চেম্বারে জয়েন করেন। মাসুম ভাই আর আমি ছিলাম স্যারের জুনিয়র। সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০টা ছিল চেম্বার টাইম।

মাঝেমধ্যে রাত ৯:৩০ মিনিটের মধ্যে পরদিনের স্টেপ নেওয়া হয়ে গেলে সিনিয়র স্যার শুরু করতেন ১৯৬১/৬২ সালের কোর্ট কাছারির স্মরণীয় কিছু হিয়ারিংয়ের গল্প। স্যার ১৯৬১ সালে ঢাকা জজকোর্টে প্র্যাক্টিস শুরু করেন। এর আগে ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজিতে মাস্টার্স করে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন ঢাকার বিখ্যাত নবকুমার ইনস্টিটিউটে।

স্যারের ছাত্র ছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা, বর্তমান মন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম প্রমুখ।

কোয়ালিটি টাইম দিলে দুই আড়াই ঘণ্টায়ও যে একটা আরজি বা লিখিত জবাব বা আপত্তি ড্রাফট করা যায় তা ঝ অযসবফ ্‌ অংংড়পরধঃবং-এ গিয়ে শিখেছি। ২০০৮ সালে স্যারের ওকালতির বয়স ছিল প্রায় ৪৭ বছর।

আমি দুই বছর স্যারের সঙ্গে ছিলাম। কখনো জুনিয়রকে রেগে কোনো কথা বলতে শুনিনি স্যারের কাছ থেকে। যদি কখনো রাগ হতেন স্যার চুপ করে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকতেন। তবুও কিছু বলতেন না।

একবার ৫ম যুগ্ম জেলা জজ আদালতে একটা মামলা ডি.ডি. হয়ে গেল। প্রয়াত শফি ভাই (আমাদের চেম্বার ক্লার্ক) আর আমি ভয়ে ভয়ে হল রুম-৩ এ ঢুকলে স্যার জিজ্ঞেস করলেন, 'শফি! মামলার খবর কি?'

শফি ভাই বললেন, 'স্যার! মামলা তো ডি.ডি. কইরা দিছে জজ সাহেব!'

স্যার বললেন, 'অসুবিধা নেই। ....টাকা দিয়ে মামলা রেস্টোর কইরা ফেলো!'

আমি অবাক হলাম।

কন্ডিশনাল অর্ডার ছিল আগে এবং সময়ের দরখাস্ত ছিল।

রাতে মাঝেমধ্যে সিনিয়র স্যার বললেন, 'বলতো, পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখী মানুষ কে?'

আমরা চুপ করে থাকলে স্যার বললেন, 'ঐব যিড় যধং ষবংং, ধিহঃং ষবংং রং :যব যধঢ়ঢ়রবংঃ ঢ়বৎংড়হ ড়ভ :যব ড়িৎষফ.'

২.

২০০৮ সালে চেম্বারে আমি আর মাসুম ভাই দুই জুনিয়র ঢাকা জজকোর্টে নিয়মিত যাই সিনিয়র স্যারের সঙ্গে। সিনিয়রের বয়সও অনেক হয়েছে। স্যারের ড্রাফটিং ছিল খুব ভালো। ক্লায়েন্ট ম্যাক্সিমাম ছিল ধানমন্ডি আর গুলশানের। স্যার ক্লায়েন্টের কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। তারপর কাগজ পত্র দেখতেন এবং প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতেন।

ক্লায়েন্টের চেম্বারে আসার সময় ছিল সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৯:৩০ পর্যন্ত। রাত ১০টায় চেম্বারের সব লাইট ফ্যান অফ। তবে ব্যতিক্রম ছিল দুই তিন বার। সেটাও রাত ১০:১৫ পর্যন্ত সর্বোচ্চ। খুব ডিসিপিস্ননড জীবনযাপন করতেন স্যার। কোর্টে যাওয়ার সময়, কোর্ট থেকে ফেরার সময়, ইভেনিং চেম্বার টাইম সব একটি টাইম টেবল অনুযায়ী করতেন। আর স্যার বলতেন, 'শোনো! ঈধংব ড়ৎ হড় পধংব মড় পড়ঁৎঃ ফধরষু.' মামলা না থাকলেও আমরা স্যারের সঙ্গে জজকোর্ট যেতাম। দুপুরে লাঞ্চ করতাম আমি আর মাসুম ভাই এক সঙ্গে।

বছরখানেক পর এরশাদ জয়েন করল। এরশাদ তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে সদ্য এলএলএম করছে বা পরীক্ষা দিয়েছে। এরশাদের জয়েন করার কিছুদিন পর তাপস বন্ধু দাশ জয়েন করে। তাপস তখনো স্টুডেন্ট। তাপসের সঙ্গে আমার অবশ্য অনেক আগেই পরিচয় ছিল আইন ও সালিস কেন্দ্র (আসক) এ কর্মরত থাকাবস্থায়। শিক্ষানবিশ তাপস ও এরশাদ নাইম ভাইয়ের কিছু রিসার্চের কাজে সাহায্য করত। মাসুম ভাই আর আমি সিনিয়র স্যারের সঙ্গে জজকোর্টে যেতাম।

একদিন সন্ধ্যায় দেখি একজন বয়স্ক ভদ্রলোক এলেন। স্যার গিয়াস ভাই বলে সম্বোধন করছিলেন। মতলব পাইলট হাইস্কুলে স্যারের সিনিয়র ভাই ছিলেন গিয়াসউদ্দিন আংকেল। আমাকে খুব স্নেহ করতেন। আরেক দিন সন্ধ্যায় এসে আমাকে বলেন, 'ব্যারিস্টার সাহেব! শুনেন! সব সময় চেম্বারে ফরমাল ড্রেসে থাকবেন।' আমি কিঞ্চিৎ হেসে বললাম, 'আংকেল সারাদিন তো কালো কোট গাউন আর সাদা শার্ট আর টাই পরে থাকি। সন্ধ্যায় চেম্বারে টি-শার্ট পরলাম।' তিনি বললেন, 'না। অলওয়েজ ইন ফরমাল ড্রেস। আপনি একজন ব্যারিস্টার সাহেব।'

বললাম, 'আংকেল, আমি তো ব্যারিস্টার না।'

তিনি বললেন, 'একদিন তো হবেন।'

তিনি একজন স্বনামধন্য শিল্পপতি ছিলেন।

পিপলস জুট মিলস, পিপলস ইনসু্যরেন্স আর পূবালী ব্যাংকের ডিরেক্টর ছিলেন। খুব ভালো মানুষ ছিলেন।

রাত ১০টা:৫ এ আমরা শুক্রাবাদ মডেল কলেজের সামনে বাসের জন্য অপেক্ষা করতাম। সেখানে দেখা হতো অ্যাডভোকেট ইমরানের সঙ্গে। ইমরান তখন ইশতিয়াক আহমেদ অ্যান্ড এসোসিয়েট নামক ল' চেম্বারে জুনিয়র এসোসিয়েট হিসেবে কাজ করত।

জুনিয়রশিপ করা কালীন আপার বাসা টু জজকোর্ট, জজকোর্ট টু আপার বাসা, সন্ধ্যায় আপার বাসা টু চেম্বার এই ছিল আমার চেনা পথ।

আড্ডা দিতাম কোর্টের বন্ধুদের সঙ্গে আমি, বন্ধু তারিক শামমি, শিপন, খালেদ জজকোর্টের বটতলার কাছের টি স্টলে! শামমি হেসে বলতো, 'দোস্ত! বটতলার নিচে দাঁড়াইস না! তাহলে লোকে বটতলার উকিল (চবঃঃু ভড়মমবৎ) বলবে।'

সবার চেম্বারের মামলা মোকদ্দমার শুনানি শেষে সেই গল্প চলতো বটতলায় বা বারের ক্যান্টিনে!

আজিজ উলস্নাহ ইমন, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে