রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

ওকালতি কচড়া সিনিয়ির আইনজীবীদের ক্যারিশমাটিক শুনানি

অ্যাডভোকেট আজিজ উলস্নাহ ইমন
  ১৪ মে ২০২৪, ০০:০০
ওকালতি কচড়া সিনিয়ির আইনজীবীদের ক্যারিশমাটিক শুনানি

বছর কয়েক আগের ঘটনা। একদিন কোর্টের রিসেসের সময় জোহরের নামাজ পড়ে হাইকোর্ট চেম্বারে বসে আছি মেইন বিল্ডিংয়ের রুম নম্বর-৩২৬ এ। উলেস্নখ্য যে, এই রুমে সিনিয়র অ্যাডভোকেট হাবিবুল ইসলাম ভূঁইয়া স্যার ও সিনিয়র অ্যাডভোকেট মোস্তফা নিয়াজ মোহাম্মদ স্যার বসেন। আমি তখন সিনিয়র হাবিবুল ইসলাম ভূঁইয়া স্যারের জুনিয়র হিসেবে কাজ করি। লাঞ্চের পর দুইজন সিনিয়র পুরনো দিনের তাদের সময়কার স্বনামধন্য সিনিয়রদের সাবমিশন ও তৎকালীন বিচারপতিদের কথোপকথন ঊদ্ধৃত করতেন। আর আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো চুপচাপ শুনতাম।

একবার সিনিয়র অ্যাডভোকেট এম এইচ খোন্দকার স্যার নাকি কোর্টে সবমিশন দিতে গিয়ে (কিঞ্চিৎ রেগে) বেশ কড়া সাবমিশন দিলে তৎকালীন বিচারপতি খুব নরম গলায় বললেন, 'মি. খোন্দকার! ডোন্ট বি সো আনকাইন্ড টু আস!'

একবার একটা সিনিয়র ব্রিফ স্যারকে দিয়ে করাতে আসলেন পরিচিত এক আইনজীবী। সিনিয়র স্যারকে বললেন, স্যার দুইটা ভালো গ্রাউন্ড আছে এই রিট পিটিশনে। ভ্যাকেশন এর আগের শেষ কর্মদিবসে বিচারপতি তারিকুল হাকিমের ডিভিশন বেঞ্চে (এনেক্স-১০) এ সিনিয়র স্যার মামলা শুনানি শুরু করলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা গ্রাউন্ড নিয়ে এবং বিচারপতিরাও তার সাবমিশনে সন্তুষ্ট হয়ে মামলায় ইন্টেরিম অর্ডার দিলেন।

ব্যক্তিগত জীবনে দুইজন বিজ্ঞ সিনিয়র অ্যাডভোকেট (সিনিয়র অ্যাডভোকেট আজমালুল হোসেন কিউ সি স্যার) এর সঙ্গে গত ৫ বছরের অধিক সময় কাজ করতে গিয়ে দেখেছি তাদের অভিজ্ঞতা আর প্রজ্ঞার আলোকে অনেক সাবমিশন। ক্যারিশমাটিক অনেক ব্যাপার আছে আমাদের বারের সিনিয়রদের সাবমিশনে। দীর্ঘদিনের কোর্ট প্র্যাক্টিস আর পড়াশোনার আলোকে তাদের এই অবস্থান।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এর একটা মামলায় দেখেছি কিউ সি স্যারকে তার প্রজ্ঞাময় সাবমিশন দিতে। রিট পিটিশনের রেসপন্ডের পক্ষে যখনই আমরা কন্টেস্ট করতাম! স্যার বলতেন, 'ডযবৎব রং :যব রষষবমধষরঃু?' এই প্রশ্নের জবাব যখন পিটিশনারের কাছে চাওয়া হবে বা যুক্তি খন্ডন করে দেখানো হবে যে, কোনো ওষষবমধষরঃু নেই! তাহলেই রুল ডিসচার্জ।

আরেকটি ঘটনা না উলেস্নখ করলেই নয়- আমার সৌভাগ্য হয়েছিল আমাদের প্রয়াত অ্যাটর্র্নি জেনারেল সিনিয়র অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম স্যারের সঙ্গে আমাদের চেম্বারে দুটো মামলায় তাকে এসিস্ট করার। একটা মামলা ছিল সার্ভিস ম্যাটার। মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথোরিটি ছিল আমাদের ক্লায়েন্ট। আমরা চেম্বার জজ আদালতে গেলাম সিভিল পিটিশন ফর লিভ টু আপিল নিয়ে। শুনানি সিনিয়র আজমালুল হোসেন কিউ সি স্যার করার কথা ছিল। কিন্তু, কোর্ট সেদিন একটু ধীর গতিতে চলায় স্যারের ফ্লাইট ধরার জন্য স্যার কোর্ট থেকে এয়ারপোর্টে যাওয়ার আগে আমাকে ডেকে বললেন, 'শোনো! মাহবুব ভাইকে দিয়ে পিটিশন মুভ করাও। আমার ফ্লাইটের সময় হয়ে যাচ্ছে। আমি মাহবুব ভাইকে বলে দিচ্ছি। তুমি তাকে ফ্যাক্ট আর ল' পয়েন্টটা একটু বুঝিয়ে দাও। পারবে না!'

আমি বললাম, 'জ্বি, স্যার পারব।'

যেহেতু সিভিল পিটিশনটা আমি নিজেই ড্রাফট করেছিলাম। তাই কনফিডেন্ট ছিল। সামনের বেঞ্চে গিয়ে মাহবুবে আলম স্যারকে সালাম দিয়ে মোটা পেপার বুকটা স্যারের হাতে দিয়ে জাস্ট এক মিনিট রেলিভ্যান্ট পেজগুলো দেখালাম! স্যার বলল, 'ঠিক আছে। ওদের সার্ভিস কোড আর রেগুলেশন কোথায়।'

আমি বের করে দিলাম।

এক নজর চোখ বুলিয়ে মাহবুবে আলম স্যার বললেন, 'ঠিক আছে। আমি দেখছি।' সবুজ মার্কার দিয়ে পেপারবুকে দাগালেন কয়েক লাইন। পেজ মার্কার দিলেন কয়েক পেজে।

তারপর আমাদের মামলার শুনানির সময় স্যারের সাবমিশন শুনে আমি বিস্মিত। এত অল্প সময়ে কীভাবে এরকম প্রিপারেশন নিয়ে নিলেন স্যার!

ইনফ্যাক্ট, সিনিয়র অ্যাডভোকেটদের অভিজ্ঞতা আর ক্যারিশমাটিক সাবমিশন খুবই উপভোগ্য। ইতালিয়ান মার্বেল (মুন সিনেমা হল) এর মামলার ক্ষতিপূরণের চেক হস্তান্তরের ব্যাপারে একটা অ্যাপিস্নকেশন দেখাতে অ্যাটর্র্নি জেনারেল স্যারের রুমে গিয়েছিলাম। আমরা চেম্বার থেকে দেখলাম, বেশ কয়েকজন অ্যাডভোকেট স্যারের অপেক্ষায় আছেন এবং গ্রামের এক ক্লায়েন্ট মাটির হাঁড়িতে করে খুব সম্ভবত মিষ্টি নিয়ে এসেছেন। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম স্যার কোর্ট শেষে রুমে আসলেন এবং সবার সঙ্গেই হাসিমুখে কথা বলছেন। এতটা ইম্প্রেসিভ আর ইজিলি এক্সেসিবল ছিলেন তিনি!

করোনা আক্রান্ত হয়ে স্যার ইন্তেকাল করেছেন বছর দুয়েক আগে। মহান আলস্নাহ তায়ালা তাকে যেন জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করেন।

আজিজ উলস্নাহ ইমন: আইনজীবী,

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে