চেকের মামলা থেকে অভিযুক্ত যেভাবে মুক্ত হতে পারেন

প্রকাশ | ০৭ মে ২০২৪, ০০:০০

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়িক লেনদেন এবং অর্থ পরিশোধের প্রতিশ্রম্নতি হিসেবে একে অপরকে ব্যাংক চেক প্রদান করে থাকি। যদি চেকের উপর বর্ণিত পরিমাণ টাকা চেক প্রদানকারীর অ্যাকাউন্টে না থাকে, তাহলে চেকটি ডিজঅনার হয়। পরবর্তী সময়ে অর্থ পরিশোধের ব্যর্থতায় চেক প্রদানকারীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করতে হয়। এতে মামলার রায় সাধারণত আসামির বিপক্ষে যায়। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে চেকের মামলা আসামির পক্ষেও যায়, যদি আসামি সে বিষয়গুলো আদালতের সামনে প্রমাণ করতে পারেন। একটি কেস স্টাডিতে জানা যায়, আসামি ব্যবসায়িক কারণে বাদীর কাছ থেকে নয় লাখ কুড়ি হাজার টাকা ধার গ্রহণ করেন। এরপর টাকা পরিশোধে চেক দেন। সেই চেকটি ব্যাংক থেকে ডিজঅনার হয়েছে। বাদী আদালতে মামলা করে দিলেন। সেই মামলায় আসামি পক্ষে ডিফেন্স নিতে গিয়ে দেখা যায় নালিশি আরজিতে দিন, ক্ষণ, তারিখ, সময়, টাকা লেনদেনের স্থান, সাক্ষীদের উপস্থিতি এসব কোনো কথায় বাদীর উলেস্নখ নেই। এমনকি বাদী জবানবন্দিতেও এ কথাগুলো বলেননি। এন আই অ্যাক্ট মামলা প্রমাণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার নোটিশ প্রাপ্তির বিষয়। আসামির ওপর নোটিশ জারি ১৩৮ ধারার মামলার পূর্বশর্ত, ব্যর্থতায় আসামি খালাস পাবে। এ মামলায়- ১। আসামি কর্তৃক লিগ্যাল নোটিশপ্রাপ্ত হওয়ার কোনো তারিখ উলেস্নখ করেননি; ২। নোটিশ প্রাপ্তির প্রমাণস্বরূপ প্রাপ্তি স্বীকার আদালতে সাবমিট করতে পারেননি; ৩। ফেরত খামও আদালতে উপস্থাপন কিংবা নালিশি আরজিতে উলেস্নখ করতে পারেননি; ৪। পোস্ট মাস্টারের কোনরুপ প্রত্যয়নপত্রও সাবমিট করতে পারেননি। এ বিষয়ে উচ্চতর আদালতের একটি সিদ্ধান্ত রয়েছে ৩৯ বিএলডি পেজ নং-২২২। সেখানে বলা হচ্ছে যে, আসামির ওপর নোটিশ জারির বিষয়ে কোনো সন্দেহ সৃষ্টি হলে এবং যদি লক্ষ্য করা যায় যে, আসামি ইচ্ছাকৃতভাবে নোটিশ উপেক্ষা করেনি, তাহলে ১৩৮ ধারার পূর্বশর্ত পরিপালনে ব্যর্থতার কারণে আসামি খালাস পাবে। কারণ ১৩৮ ধারার (১) উপধারার প্রোভাইশো (বি)তে বলা হয়েছে, আসামি কর্তৃক নোটিশ প্রাপ্তির তারিখ থেকে ৩০ দিন সময় দিতে হবে। যদি আসামি নোটিশপ্রাপ্ত না হয়, সেই প্রাপ্তির তারিখ জানার সুযোগ আছে কিনা? এই ৩০ দিনের সময় না দিয়ে যদি মামলা দায়ের করা হয় তাহলে বাংলাদেশের সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদের মৌলিক অধিকার পরিপন্থি। \হ এন আই অ্যাক্টের তামাদি বিষয় : তামাদির মেয়াদ এ আইনের ১৪১(বি) ধারায় ধার্য করা হয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ২২১ ধারার ৫ উপধারায় বলা হয়েছে যে, অভিযোগ গঠনের সময় অপরাধ সংগঠনের আইনানুগ সব উপাদান অভিযোগে থাকতে হবে। যদি নালিশি দরখাস্তে আসামি কর্তৃক নোটিশ প্রাপ্তির তারিখ উলেস্নখ না থাকে, সেই তারিখ থেকে ৩০ দিন সময় না দেওয়া হয়, সেই ৩০ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে মামলা করা না হয়, তাহলে ১৩৮ ধারার চেক ডিসঅনারের অপরাধ সংগঠনের ০৩টি উপাদানের অনুপস্থিত থাকবে বলে তা অপরাধ সংগঠনে ব্যর্থ হবে। অনেক সময় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে জেনারেল ক্লজেস অ্যাক্টের ২৭ ধারার বিধান তুলে ধরে কিছু লেইম এক্সকিউজ উপস্থাপন করা হয়। চেক ডিসঅনারের অপরাধের ক্ষেত্রে জেনারেল ক্লজেস অ্যাক্টের ২৭ ধারার বিধান প্রয়োজ্য হবে কিনা? দ্য জেনারেল ক্লজেস অ্যাক্ট প্রণীত হয়েছে ১৮৯৭ সালে আর দ্যা নেগোসিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্ট প্রণীত হয়েছে ১৮৮১ সালে। ১৬ বছর আগে জন্ম হয়েছে এন আই অ্যাক্টের। আর দ্য জেনারেল ক্লজেস অ্যাক্টের ২৭ ধারা বলছে যে, এই ধারার বিধানাবলি কার্যকরী হবে দ্য জেনারেল ক্লজেস অ্যাক্ট চালু হওয়ার পর থেকে। এ বিষয়ে ৬৪ ডিএলআর ২৫৫ পাতায় উচ্চ আদালতের একটি সিদ্ধান্ত রয়েছে। নোটিশ জারির বিষয় অনুমান: নোটিশ জারির বিষয় অনুমান প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে ডাক পিওনকে পরীক্ষা করার বিষয়ে বলা আছে। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ৭ এসসিসি ৫১০ পৃষ্ঠায় বলছেন, বাদী ডাকপিওনকে আদালতে পরীক্ষা করে নোটিশ জারির বিষয় ২৭ ধারার অধীন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু নোটিশ জারি হয়েছে প্রমাণের দায়িত্ব কার? নোটিশ যে জারি হয়েছে তা প্রমাণের দায়িত্ব একমাত্র বাদীর। এ বিষয়ে ৬০ ডিএলআর ৬৭৭ পৃষ্ঠায় উচ্চ আদালতের একটি সিদ্ধান্ত রয়েছে। বস্ন্যাঙ্ক চেকের ক্ষেত্রে : আবার চেকটি অনেক সময় বস্ন্যাঙ্ক চেক হয়ে থাকে। ঋণ প্রদানের আগেই কিছু বস্ন্যাঙ্ক চেক নেয়া হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে বোম্বে হাইকোর্ট ২০১০ সালের ডিসিআর ২নং ভলিউমের ৩১৭ পৃষ্ঠায় বলছেন, ঋণ প্রদানের আগে জামানত স্বরূপ হিসেবে বস্ন্যাঙ্ক চেক গ্রহণ করা হলে তা কোন দায়-দেনার অস্তিত্ব সৃষ্টি করে না বিধায় তার দ্বারা চেক ডিসঅনারের মামলা দায়ের করা যায় না। আবার জালিয়াতির মাধ্যমে অর্জিত চেক দিয়ে পক্ষদের মধ্যে কোনো দায়দেনার অধিকার সৃষ্টি করে না বলে উচ্চ আদালাতের সিদ্ধান্ত রয়েছে। (এআইআর ১৯৭৫ অল ১০৪)। তবে আমাদের উচ্চ আদালত সিকিউরিটি চেক দিয়ে মামলা করলে সে মামলা চলবে বলে সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন। চেকের উপর ওভাররাইটিং থাকলে: আবার চেকের উপর ওভাররাইটিং থাকলে কিংবা টেম্পারিং করে তর্কিত চেকের টাকার অংক পরিবর্তন করলেও আসামি খালাস পাবে। এক্ষেত্রে ভারতের পাঞ্জাব এবং হরিয়ানা হাইকোর্ট ২০১০ সালে ডিসিআর ১ নং ভলিউমের ১০৮ পৃষ্ঠায় একটি দারুণ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। ভিন্ন হাতের লেখা হলে: আবার আসামির স্বাক্ষর, টাকার অংক এবং পেয়ীর নাম ভিন্ন হাতের লেখা হলে এন আই অ্যাক্টের ৩ (ই) ধারার বিধান অনুসারে এটাকে ইসু্যয়েন্স অব চেক বলা যাবে না। সেই চেক আইনানুগভাবে বৈধ হবে না। এ বিষয়ে ৫৬ ডিএলআর ৬৩৬ পৃষ্ঠায় একটি দারুণ সিদ্ধান্ত আছে। সাধারণত উপরোক্ত বিষয়গুলো প্রমাণ করতে পারলেই চেক ডিসঅনারের মামলায় আসামির খালাস পাওয়া সম্ভব। লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইনের শিক্ষক। ঊসধরষ: ংবৎধল.ঢ়ৎধসধহরশ@মসধরষ.পড়স